মা হওয়ার সত্যিকারের অর্থ তখনই উপলব্ধি করা যায়, যখন একজন নারী নিজে মাতৃত্বের পথে পা রাখেন। মাতৃত্ব কেবল একটি শিশুর জন্ম দেওয়া নয়, এটি শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক রূপান্তরের এক অসাধারণ যাত্রা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা মায়েদের জন্য শক্তি ও প্রেরণার অফুরন্ত উৎস। তাঁর বাণী ও জীবনাদর্শ মায়েদের কষ্টকে পবিত্র ইবাদতে রূপান্তরিত করে।
মাতৃত্বের কষ্টমাতৃত্ব একটি শিশুকে বড় করার পাশাপাশি মায়ের নিজের রূপান্তরের গল্প। এটি শারীরিক ক্লান্তি, প্রসবোত্তর মানসিক চাপ, রাত জেগে শিশুর দেখাশোনা এবং সন্তানের জন্য সর্বোত্তম চাওয়ার অবিরাম প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। এই যাত্রায় মায়েরা প্রায়ই নিঃসঙ্গতা ও দুশ্চিন্তায় ভোগেন। এমন সময়ে ইসলামের শিক্ষা মায়েদের জন্য এক অমূল্য আশ্রয়।
মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করেছে… সুতরাং আমার এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।সুরা লুকমান, আয়াত: ১৪পবিত্র কোরআন মায়েদের ত্যাগ ও কষ্টকে বারবার সম্মানিত করেছে। সুরা আল-আহকাফে বলা হয়েছে, ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের সঙ্গে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্টের সঙ্গে প্রসব করেছে।’ (সুরা আল-আহকাফ, আয়াত: ১৫)
এই আয়াত মায়ের শারীরিক ও মানসিক কষ্টের প্রতি আল্লাহর দৃষ্টি এবং তাঁর কাছে এর মূল্য তুলে ধরে। সুরা লুকমানে বলা হয়েছে, ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করেছে… সুতরাং আমার এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (সুরা লুকমান, আয়াত: ১৪)
আরও পড়ুনইসলামের আলোকে নিরাপদ মাতৃত্ব ও নবজাতকের পরিচর্যা২৮ মে ২০২১মায়ের মর্যাদানবীজি (সা.
নবীজি (সা.)-এর একটি বিখ্যাত হাদিসে বলা হয়েছে, ‘জান্নাত মায়ের পায়ের নিচে।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৩,১০৪)
আরেকটি হাদিসে বর্ণিত, মুআবিয়া ইবনে জাহিমা (রা.) নবীজির কাছে জিহাদে যাওয়ার পরামর্শ চাইলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার মা কি জীবিত?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ নবীজি বললেন, ‘তবে তার সঙ্গে থাকো, কারণ জান্নাত তার পায়ের নিচে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২,৭৮১)
আরও অবাক করা হলো, নবীজি (সা.) বলেছেন, যদি কোনো গর্ভবতী নারী প্রসবকালে মারা যান, তিনি শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর পথে নিহত হওয়া শাহাদাত, মহামারিতে মৃত্যু শাহাদাত, প্রসবকালে মৃত্যু শাহাদাত।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং: ২৩,৮৬৫)
আরও পড়ুনবিয়ের আগে মেয়েকে মা১৭ এপ্রিল ২০২৫নবীজি (সা.) বলেছেন, যদি কোনো গর্ভবতী নারী প্রসবকালে মারা যান, তিনি শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেন।সপ্তম শতাব্দীর বিপ্লবী শিক্ষাসপ্তম শতাব্দীর আরব সমাজে, যেখানে নারীদের প্রতি অবমাননা ছিল সাধারণ, নবীজি (সা.)-এর এই শিক্ষাগুলো ছিল বিপ্লবী। তিনি মায়েদের মর্যাদাকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যা আজও আমাদের জন্য পথপ্রদর্শক। আজকের ব্যস্ত জীবনে অনেকে পিতা-মাতার সঙ্গে সময় কাটাতে ভুলে যান। বয়স্ক মায়েরা বিশেষ করে একাকিত্বে ভোগেন, যা সমাজে একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা।
নবীজির শিক্ষা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে মায়েদের প্রতি যত্নশীল হতে উৎসাহিত করে। যাঁরা দূরে থাকেন, তাঁরা প্রতিবেশী বা সম্প্রদায়ের মায়ের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গ দিয়ে এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
নবীজি (সা.)-এর শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মাতৃত্ব কেবল একটি দায়িত্ব নয়, এটি আল্লাহর কাছে পবিত্র ইবাদত। মায়ের কষ্ট, ত্যাগ এবং ভালোবাসা আল্লাহর দৃষ্টিতে অতুলনীয়।
সমাজ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব মায়েদের শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল হওয়া। কোরআনের বাণী আমাদের পথ দেখায়: ‘তোমরা আমার এবং তোমাদের পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (সুরা লুকমান, আয়াত: ১৪)।
সূত্র: মুসলিম ম্যাটার্স
আরও পড়ুনসন্তান জন্মের আগে মৃত্যু কামনা করেন নবীর মা৩১ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র র জন য ল কম ন বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধারে ঢাকার আদালতের আদেশ
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে (আরসিবিসি) থাকা ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেয়াপ্ত করে ফেরত আনার আদেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার ঢাকার মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত এ আদেশ দেন।
গতকাল রোববার রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. ছিবগাত উল্লাহ বলেন, প্রায় ৯ বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সাইবার জালিয়াতির মাধ্যমে চুরি হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলার (৮ কোটি ১০ হাজার ডলার) বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. সাব্বির ফয়েজ। ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংক পাচারে জড়িত ছিল বলে সিআইডির আবেদনের ভিত্তিতে আদালত এ নির্দেশ দেন।
ছিবগাত উল্লাহ বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনার মধ্যে শ্রীলঙ্কা থেকে দুই কোটি ডলার ফেরত আসে। আর আরসিবিসির মাধ্যমে ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৬৮ হাজার ডলার ফেরত পায় বাংলাদেশ। প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার অন্য উদ্যোগে ফেরত আসে। এখন আরসিবিসির কাছে পুরো ৮১ মিলিয়ন ডলারই ফেরত চাওয়া হচ্ছে, যেটা আদালত বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিয়েছেন।
আরসিবিসির বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্কের আদালতে করা মামলার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান বলেন, এর সঙ্গে সিআইডির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সিআইডির কাছে যে মামলা আছে, সে ব্যাপারে কাজ চলছে। সমাপ্তির পথে, খুব দ্রুতই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
আদালতের আদেশে বলা হয়, তদন্তে সংগৃহীত তথ্যপ্রমাণ এবং ফিলিপাইন সরকারের পাঠানো মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পর্যালোচনা করে প্রমাণিত হয়েছে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে হ্যাকাররা অবৈধভাবে ৮১ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর করেছিল।
সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটর এহসানুল হক সমাজী বলেন, আদালতের আদেশ কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদেশের কপি (অনুলিপি) পাঠানো হয়েছে। প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শেষে টাকা দেশে ফেরত আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (ফেড) থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির তথ্য ১ দিন পর জানতে পারলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তা ২৪ দিন গোপন রাখে। ৩৩তম দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়।
সিআইডির ভাষ্য, জাতিসংঘের কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইম (ইউএনটিওসি), ফিলিপাইনের আইন এবং ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) নির্দেশনার আলোকে এবং সর্বশেষ আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার এখন ফিলিপাইনের সরকারের কাছ থেকে এই অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করবে।
সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা (মেসেজ) পাঠিয়ে ফেডে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে একটি মেসেজের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় একটি ‘ভুয়া’ এনজিওর নামে ২০ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেওয়া হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। বাকি চারটি মেসেজের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সরিয়ে নেওয়া হয় ফিলিপাইনের মাকাতি শহরে রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ‘ভুয়া তথ্য’ দিয়ে খোলা চারটি অ্যাকাউন্টে।
অল্প সময়ের মধ্যে ওই অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়, ফিলরেম মানি রেমিট্যান্স কোম্পানির মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রা পেসোর আকারে সেই অর্থ চলে যায় তিনটি ক্যাসিনোর কাছে। এর মধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া হলেও বাকি অর্থ উদ্ধারে তেমন কোনো অগ্রগতি হচ্ছিল না। জুয়ার টেবিলে হাতবদল হয়ে ওই টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গেছে, তারও কোনো হদিস মিলছিল না।
২০২০ সালের ২৭ মে ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করা ওই মামলায় অর্থ রূপান্তর, চুরি, আত্মসাতের অভিযোগে রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় আরসিবিসির বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্কের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওই মামলা চালিয়ে নেওয়ার অনুমতি দেন নিউইয়র্কের আদালত। তবে ব্যক্তিগত এখতিয়ার না থাকায় চারজন বিবাদীকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এদিকে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা পাচার ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় ১ কোটি ৯১ লাখ ডলার জরিমানা করে আরসিবিসিকে। ওই সময় করা এক মামলায় ফিলিপাইনের আদালত ২০১৯ সালে আরসিবিসির শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগিতোকে মুদ্রা পাচারের আট দফা অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা মামলায়ও তাঁকে আসামি করা হয়।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশেও একটি মামলা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় মামলাটি করেন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা ওই মামলায় সরাসরি কাউকে আসামি করা হয়নি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা পর্যালোচনায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিটির সময় গত ৮ জুলাই আরও তিন মাস বাড়ানো হয়েছে। সে অনুযায়ী চলতি সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ দেওয়ার কথা।
এর আগে গত ১১ মার্চ আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে প্রধান করে ছয় সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি করে সরকার। এ কমিটিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনার তদন্তকাজের অগ্রগতি, এ-সংক্রান্ত সরকারি অন্যান্য পদক্ষেপের পর্যালোচনা, এ ঘটনার দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং এর পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এ জন্য ওই কমিটিকে তিন মাস সময় দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় পরে আরও তিন মাস সময় বাড়ানো হয়।
পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা হলেন জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইনসের পরিচালক আলী আশফাক ও রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল হুদা।