প্রথাগত অর্থে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন না। আমাকে পড়াননি। শ্রেণিকক্ষে তাঁর বক্তৃতা শুনতে বসিনি। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি, সেই বিভাগেরই ছাত্র ছিলাম না আমি। তবু তিনি আমায় শিখিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে ধার করে নানান শব্দ শিখেছি; সাধারণ বাক্য ভেঙেচুরে নতুন করে বাক্য গঠন শিখেছি। লেখার কায়দাও অনেকটা রপ্ত করেছি তাঁর কাছ থেকে। বক্তৃতার শব্দচয়ন, স্বর-প্রক্ষেপণ, উপস্থাপন– সেটাও অনেকটা শেখা তাঁর কাছে। তাই সরাসরি না পড়ালেও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমার শিক্ষক, যিনি সিক (এসআইসি) নামে পরিচিত আমাদের প্রজন্ম এবং পরবর্তী বহু প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে। আজ ২৩ জুন, তাঁর ৯০তম জন্মতিথি। জন্মদিনের অন্তর্ময় শুভেচ্ছা।
সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালীন তাঁকে খুব কাছে থেকে চেনা-জানার একাধিক সুযোগ তেমন হয়নি আমার। হ্যাঁ, বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভায় গিয়েছি বটে আমি কখনও-সখনও, তাঁর লেখাও পড়েছি এখানে-সেখানে। কিন্তু তাঁর মতো একজন ব্যক্তিত্বকে চেনা-জানার জন্য যে নৈকট্য প্রয়োজন, তা সত্তরের দশকে আমার ছিল না।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে আমার চেনা-জানার বলয় দৃঢ় হয় আশির দশকে, আমি উচ্চশিক্ষা সমাপন করে দেশে ফিরে এলে। একাধিক অঙ্গনে তখন আমাদের যৌথ পদচারণা– সভা-সমিতি, লেখালেখির জগৎ, রেডিও-টিভির বলয়, বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায়। দেখা হতো, কথা হতো, আলাপ-আলোচনা হতো কখনও দু’জনে, কখনও অনেকের সঙ্গে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকার সম্পাদক। প্রায়ই গবেষণামূলক নানা প্রবন্ধ নিয়ে তাঁর কাছে যেতাম। বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপ করতেন আমার সঙ্গে। ছেপেছেন আমার একাধিক প্রবন্ধ; প্রশংসা করেছেন লেখার; পরামর্শও দিয়েছেন নানান সময়ে নানান বিষয়ে। পত্রপত্রিকায় লেখা বেরোলে উল্লেখ করেছেন সে লেখার দেখা হলেই।
রেডিও-টেলিভিশনের নানান অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলাম দু’জনে। বাংলাদেশ বেতারে প্রভাতি অনুষ্ঠান ‘আজকের ঢাকায়’ এক সপ্তাহে তাঁর ধারাবাহিক কথিকা ‘কথার কথা’ যেত; অন্য সপ্তাহে আমার নিয়মিত কথিকা ‘যা না বললেই নয়’। বাংলাদেশ বেতারের স্বর্ণকণ্ঠ বালক কৌশিক আহমেদের উপস্থাপনায় আর প্রয়াত কবি আবু তাহেরের প্রযোজনায় হতো জননন্দিত সে অনুষ্ঠান। তাঁর কথিকা ধারণের জন্য অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নির্ধারিত সময়ে নিয়ম করে উপস্থিত হতেন। আমার কথিকা ধারণের জন্য অনুষ্ঠান সংগঠক মনোয়ারা আপাকে বাতি নিয়ে আমাকে খুঁজতে বেরোতে হতো। অনেক সময় এমনও হয়েছে, অনুষ্ঠানের সময়েই স্টুডিওতে কৌশিকের পাশে বসে আমি পড়ে দিয়েছি আমার কথিকা। প্রযুক্তির কুশীলব এবং উপস্থাপকের উদ্বেগে স্টুডিওর বাতাস তখন ঘন হয়ে আসত।
টেলিভিশনে আমার উপস্থাপিত অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেশ ক’বার এসেছেন। মনে আছে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফলতম ছাত্রদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করার সময়ে আমি জোর দিয়েছিলাম যারা ব্যর্থ হয়েছে, তাদের ওপরে। সে অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমার বক্তব্যের জোর সমর্থন করেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে বড় গভীর বিশ্লেষণ করেছিলেন সে সমস্যার। জননন্দিত সে অনুষ্ঠান শেষে নানান গুণীজনের কাছ থেকে অভিনন্দনমূলক বার্তা পেয়েছিলাম দূরালাপনীতে।
মধ্য আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে একটি ঘটনার কথা মনে আছে। প্রতি মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার কলাভবনের ২০২৮-এ আমার ক্লাস থাকত; মঙ্গলবার আমার পরেই ওখানে ক্লাস নিতেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বৃহস্পতিবার প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুকের পোশাকি নাম)।
মঙ্গলবার আমি সতর্ক থাকি। ঘণ্টা বাজলেই ক্লাস ছেড়ে দিই, স্যারকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। অনেক সময় স্যার এসে গেছেন জানলে শিক্ষার্থীরাও আমাকে চোখ দিয়ে জানান দেয়। আমি মুখের বাক্য অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসি। একদিন স্যার আমাকে বললেন, ‘এত তাড়াহুড়ো কর কেন? পড়ানোটা শেষ করেই বার হও।’ ‘আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন!’ আমি নম্রস্বরে বলি। ‘তাতে কী? আমি তোমার বক্তৃতা শুনি। কত কিছু শিখি অর্থনীতির’– হাসতে হাসতে বলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। নির্ভুলভাবে ‘কেইনসের মূল্যতত্ত্ব’ আউড়ে যান, তিন দিন আগে যা বলেছি শিক্ষার্থীদের। আমি হতবাক।
আর দশজনের মতো অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখার আমিও পরম ভক্ত। দেদার লেখা পড়েছি তাঁর। কিন্তু তাঁর অজস্র লেখার মধ্যে তিনটি আমার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। প্রথমটি ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ’– তাঁর প্রয়াত স্ত্রী নাজমা জেসমিন চৌধুরীর স্মরণে লেখা; দ্বিতীয়টি ‘আমার পিতার মুখ’– তাঁর পিতাকে নিয়ে লেখা এবং তৃতীয়টি ‘আমার বান্ধবেরা’– তাঁর সমসাময়িক ছাত্রবন্ধুদের নিয়ে লেখা। অসামান্য সে লেখাগুলোর বহু অংশ আমি এখনও গড় গড়িয়ে বলে যেতে পারব।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাহিত্যবিষয়ক আলোচনায় অবধারিতভাবেই চলে আসে সমাজ ও রাজনীতি; প্রাসঙ্গিকভাবে অবশ্যই। সেসব আলোচনায় পুঁজিবাদের বিপক্ষে সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর পক্ষপাতও সর্বজনবিদিত। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, বিশেষত নারী চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিও পাঠক সবার চেনা।
শেষের কথা বলি। ঘটনাটি বেনুর মুখে শোনা। কোথাও বেনুর সঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দেখা। নানান কথার মধ্যে বেনু আমার উল্লেখ করে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাঁকে বলেছিল, ‘ও তো আপনার পরম ভক্ত।’ সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্মিতহাস্যে বলেছিলেন, ‘আমিও তো ওর বিরাট ভক্ত।’ তাঁর জবাবে বেনু উদ্বেলিত হয়েছিল এবং বাড়ি ফিরে খুব গর্বিতভাবে আমাকে এ গল্প বলেছিল। নানাজনের কাছ থেকে বহু প্রশংসা আমি জীবনে পেয়েছি; কিন্তু অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এ প্রশস্তিটুকু আমি চিরকাল মাথায় তুলে রাখব। শুভ জন্মতিথি জানাই তাঁকে।
ড.
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন উপস থ প র দশক
এছাড়াও পড়ুন:
পরিদের জন্য একটি দিন
ছোটবেলায় আমরা প্রায় সবাই কোনো না কোনো এক পরির গল্প শুনে ঘুমিয়েছি। দাদি-নানির মুখে শোনা কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়েছি, অথবা মায়ের কণ্ঠে ঝিমিয়ে পড়েছি একজোড়া ডানাবিশিষ্ট এক অলৌকিক সত্তার গল্প শুনতে শুনতে। সেই পরিরা হেসে উঠত গোলাপি ঠোঁটে, ঝলমলে পোশাক পরে ঘুরে বেড়াত প্রজাপতির মতো ডানায়, হাতে থাকত ইচ্ছাপূরণের জাদুর কাঠি। তারা কখনও বাঁচাত রাজকন্যাকে, কখনও পথ দেখাত হারিয়ে যাওয়া পথিককে আর আমরা শিশুরা ছোট ছোট কষ্ট ভুলে হারিয়ে যেতাম সেই রূপকথার মধ্যে।
২৪ জুন, আন্তর্জাতিক পরি দিবস। এমন এক দিন, যখন আমরা ফিরে তাকাই সেই ছোটবেলার দিকে, আবারও একটু পরি হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখি।
পরি চরিত্রের শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের নানা সংস্কৃতিতে। ইতালীয় লোককথা হোক কিংবা মধ্যযুগীয় ফরাসি সাহিত্যে চার্লস পেরোঁর ‘ফেয়ারি টেলস’–সব জায়গাতেই পরির উপস্থিতি চোখে পড়ে। পিটার প্যানের পাশে থাকা টিংকারবেল, সিন্ডারেলার পাশে থাকা গডমাদার বা শিশুর দাঁত নিয়ে যাওয়া টুথ ফেয়ারি–সব চরিত্রই পরিকে নতুন নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছে। তারা কেবল সুন্দর নয়, তারা সাহায্য করে, পথ দেখায়, রক্ষা করে।
বাঙালির কল্পনায় পরি এসেছে নানা রূপে। শাড়ি পরে, টিকলি আর টিপ পরে; যে মুখটিপে হাসে। সবচেয়ে সুন্দর রূপ– সেই পরি দেখতে মায়ের মতো।
পরির গল্প শুনে একটি শিশু মনে করে– সেও পরি। সে উড়তে পারে, শুধু ডানাগুলো এখন অদৃশ্য। মায়ের কোলে লাফিয়ে এসে পড়া এক উড়ন্ত পরি; সে কখনও ধবধবে সাদা ডানাওয়ালা, আবার কখনও নিজের মতো সাদামাটা, শ্যামলা ও ঢ্যাঙা। যাদের ডানা আছে, কিন্তু কেউ দেখে না।
আবার ছোটবেলায় গল্পখেকো মেয়েটি যে বইয়ের মলাটে প্রথম পরি দেখেছিল, সে এখন বড় হয়ে নিজেকেই পরি ভাবে। সে জানে, পরি মানে শুধু সৌন্দর্য নয়, তার থাকে ইচ্ছা পূরণ করার ক্ষমতা। পরি মানে স্বাধীনতা। নিজে উড়তে পারা। কাউকে ঠেস না দিয়ে নিজেই হাল ধরতে পারা।
আমরা অনেক সময় বলি, ‘ডানাকাটা পরি’। এই কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক নির্মম বাস্তবতা। আমাদের সমাজে বহু মেয়েকে আমরা সেই ডানাকাটা পরিতে পরিণত করি; যাদের স্বপ্নগুলো আমরা নিঃশব্দে ছেঁটে দিই। তারা পড়তে চায়, সাজতে চায়, উড়তে চায়– কিন্তু বলা হয়, এত স্বাধীনতা তোমাদের জন্য নয়। যেন পরি হতে গেলে তাকে শুধু সুন্দর হতে হবে; ওড়ার সাহস কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার নেই। আসলে ডানাটা ওড়ার প্রতীক। সেই ওড়াকে পশ্চাৎপদ সমাজ ভয় পায়। যে নারী নিজে পথ বেছে নেন, নিজের মতো করে বাঁচেন, তাঁকে আমরা পরি না বলে ‘বিদ্রোহী’ বলি। অথচ তিনিই তো প্রকৃত পরি, যে কারও দয়ার পাত্র নন, নিজের শক্তিতে উড়তে জানেন।
আজকের দিনেও আমাদের চারপাশে অনেক পরি আছেন। যারা হয়তো পরির মতো দেখতে নন; যাদের ডানাগুলো তাদের মন আর মস্তিষ্কে লুকানো। তারা কেউ মা, কেউ শিক্ষক, কেউ চিকিৎসক, কেউবা একা ঘর সামলে চাকরি করেন। তারা হয়তো রূপকথার পরির মতো ঝলমলে নন; কিন্তু তারা নিজেরাই নিজের ইচ্ছাপূরণ করেন। অন্যদের ইচ্ছেও পূরণ করতে জানেন। তাদের ডানাগুলো হয়তো ধবধবে সাদা নয়; কিন্তু সেই ডানাতেই উড়ে সাহস, সহমর্মিতা, মমতা আর শক্তি।
আন্তর্জাতিক পরি দিবসে আমরা চাই পরিকে শুধু রূপকথায় নয়, জীবনের বাস্তবতায় স্বীকৃতি দিতে। আমাদের কন্যাদের শেখাতে পারি– তারা পরি হতে পারে শুধু রূপে নয়, সাহসে। আমাদের বোন, মা, প্রেমিকা বা বন্ধুরা– তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো গল্পের পরি। তারা যেন নিজস্ব স্বপ্ন নিয়ে উড়তে পারে, সেই স্বাধীনতা যেন আমরা দিতে শিখি।
আজ একটি ছোট উৎসব করা যেতে পারে– পরির থিমে সাজানো একটি পার্টি, ছোটদের অঙ্কন প্রতিযোগিতা বা শুধু একটি বই পড়া, যেখানে একটি পরি একা লড়ে জিতেছে। এমন গল্প পড়া, যেখানে পরি শুধু সুন্দর নয়, সাহসীও।
এই বিশেষ দিবসে আমরা যেন ভুলে না যাই পরির ডানার যত্ন নিতে হয়। যাদের আমরা ভালোবাসি, যাদের আমরা সম্মান করি, যারা আমাদের পাশে থাকে তাদের ডানাগুলো আমরা যেন না ছেঁটে ফেলি। বরং তাদের ওড়ার সাহস দিই। তাদের বলি– ‘তুমি পারবে। তুমি পরি।’ এটুকুই চাওয়া প্রত্যেক নারী যেন তাঁর ভেতরের পরিকে চিনতে পারেন আর তাঁর ডানাগুলো ছড়িয়ে দিতে পারেন আকাশজুড়ে। v