প্রায় এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ইসরায়েল ইরানের ওপর বোমা হামলা চালানোর পর অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি সংঘাতে জড়িয়েছে। তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আঘাত হেনেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে। এই প্রতিক্রিয়া খুব শিগগির আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। মার্কিন হামলার পর ইরানি টেলিভিশনের এক উপস্থাপক মন্তব্য করেছেন, ‘মি.
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইরান কীভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে? সবচেয়ে সম্ভাব্য যে জবাবটি আসতে পারে, তা হলো অসামরিক যুদ্ধ কৌশল। এর মধ্যে থাকতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ বা ইরানের মিত্রগোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোতে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও সন্ত্রাসী হামলা।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই হামলা চালিয়ে একটি ‘খুব বড় লাল সীমা’ অতিক্রম করেছে। এখন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি যদি কোনো প্রতিক্রিয়া না জানান, তাহলে তিনি কট্টরপন্থী মহলের সমর্থন হারাতে পারেন। তাই ইরান যে পাল্টা আঘাত হানবে, সেটি অনেকটাই নিশ্চিত। তবে তা কখন হবে, তা এখনো অস্পষ্ট।
সবচেয়ে সহজ ও প্রত্যাশিত লক্ষ্য হবে মধ্যপ্রাচ্যের যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি, যেখানে হাজার হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছেন। বাহরাইন, ইরাক, জর্ডান, কাতার, সিরিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে।
এ ছাড়া দূতাবাস, কূটনৈতিক ভবন ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য স্বার্থও হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব স্থাপনায় ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হতে পারে। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী বা ইরাকের শিয়া–মিলিশিয়ার মতো ইরানের মিত্রগোষ্ঠীগুলোও সেসব জায়গায় হামলা চালাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ইসরায়েলে ভ্রমণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের জন্য সতর্কতা জারি করেছে। ইরাক ও লেবাননের দূতাবাসগুলো বাড়তি মার্কিন কর্মীদের দেশ ছাড়তে বলেছে।
সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে ইরাকে ইরান–সমর্থিত কাতাইব হিজবুল্লাহ। এই শিয়া–মিলিশিয়া গোষ্ঠী এর আগে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। তারা আবারও তাই করতে পারে। কাতাইব হিজবুল্লাহর নেতা আবু হুসেইন আল-হামিদাওয়ি এক সপ্তাহ আগে বলেছিলেন, ‘আমেরিকা যদি এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে, আমরা তাদের স্বার্থ ও ঘাঁটিগুলোতে সরাসরি আঘাত হানব।’
পারস্য উপসাগরের অন্যান্য দেশগুলোও ইরানের নিশানায় থাকতে পারে। যেমন ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনার সময় হুতিরা সৌদি আরবের দুটি তেল স্থাপনায় ড্রোন হামলা চালিয়েছিল। এর কিছু আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপকূলে তেল ট্যাংকারে হামলা হয়েছিল। এবারও ইরান ও তার মিত্ররা উপসাগর ও হরমুজ প্রণালিতে হামলা করতে পারে। সমুদ্র মাইন বসানো, তেল ট্যাংকার বা বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা করে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারকে অস্থির করে তোলা হতে পারে তাদের কৌশল।
গত ২০ মাসে ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলায় ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত। তবে তাদের সামরিক ক্ষমতা পুরোপুরি শেষ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সংঘাতে জড়ানোয় এখন ইরান এই নেটওয়ার্ক সক্রিয় করতে পারে।
অতীতে হিজবুল্লাহ লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপে ইসরায়েলি ও ইহুদি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। নব্বইয়ের দশকে আর্জেন্টিনায় ইসরায়েলি ও ইহুদি কেন্দ্রগুলোতে হামলায় শতাধিক মানুষ মারা যান। ২০১২ সালে বুলগেরিয়ার বুরগাসে এক বাস বোমা হামলায় পাঁচজন ইসরায়েলি পর্যটক নিহত হন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিজবুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রেও হামলার পরিকল্পনা করেছে। ২০১৭ সালে নিউইয়র্কে দুটি সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা স্থাপনায় নজরদারির অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২৩ সালে নিউ জার্সির এক বাসিন্দা ১২ বছরের কারাদণ্ড পান।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রে বড় ধরনের কোনো হামলা ঘটেনি, তবু ইরান বেশ কয়েকটি গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে ছিল জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন, মাইক পম্পেও এবং এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা।
ফলে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। এফবিআইয়ের পরিচালক কাশ প্যাটেল সম্প্রতি হিজবুল্লাহর স্লিপিং সেলগুলোর ওপর নজরদারি বাড়িয়েছেন।
সামরিক দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ইরানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ইরানের ভেতরে ঢুকে ইরানি পরমাণুবিজ্ঞানী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে নিয়মিত টার্গেট কিলিং করছে, যা থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়।
তবে অসামরিক বা সন্ত্রাসী হামলাই ইরানের প্রকৃত শক্তি। ১৯৮৩ সালে লেবাননে ইউএস মেরিন ব্যারাকে বোমা হামলায় ২৪১ মার্কিন সেনা নিহত হন। ১৯৯৬ সালে খোবার টাওয়ার বোমা হামলায় ১৯ জন মার্কিন বিমানবাহিনীর সদস্য নিহত হন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগের মেয়াদে তিনি কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইরান তখন প্রতিশোধ হিসেবে কয়েক মাস ধরে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছিল। আমেরিকার বোমা হামলার পর ইরান এবারও তীব্র ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
কলিন পি ক্লার্ক নিউইয়র্ক সিটির গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দ্য সউফান গ্রুপের গবেষণা পরিচালক
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
না, লেনদেনে ট্রাম্প ভরসা করার মতো লোক নন
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য কমিশনার মারোশ শেফচোভিচ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর মধ্যে হওয়া একটি বাণিজ্যচুক্তির কথা বলেছেন। এই চুক্তি অনুযায়ী, ইউরোপীয় রপ্তানির ওপর যুক্তরাষ্ট্র ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক বসাবে। এর বদলে ইউরোপ আগামী তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি কিনবে এবং আরও ৬০০ বিলিয়ন ডলার সেখানে বিনিয়োগ করবে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যদিও তার পরিমাণ প্রকাশ করা হয়নি। শেফচোভিচ এ চুক্তিকে বলছেন, ‘এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো চুক্তি ছিল।’ কিন্তু আসলেই কি এটা সবচেয়ে ভালো চুক্তি ছিল? ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর শুধু বিদেশি বাণিজ্য অংশীদারেরাই নন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, আইন প্রতিষ্ঠান, এমনকি সংবাদমাধ্যমও ভাবছে, ট্রাম্পের সঙ্গে চুক্তি করা মানে কি কেবল শক্তির খেলায় নামা, নাকি এর ফলে আমরা আইনকে অবহেলা করা এক নতুন স্বাভাবিক বাস্তবতায় ঢুকে পড়ছি?’
আরও পড়ুনট্রাম্প যেভাবে মিয়ানমারকে চীনের হাতে তুলে দিচ্ছেন০১ আগস্ট ২০২৫এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আইনের শাসন না থাকলে কোনো চুক্তিকেই আমরা ‘সর্বোত্তম’ বলতে পারি না। বাজার যেটা চায়, সেটা হলো স্থিতিশীলতা ও পূর্বানুমানযোগ্যতা, যা আসে আইনের শাসন থেকে। আইন না থাকলে সবকিছু হয়ে দাঁড়ায় জোরজবরদস্তি আর লোকদেখানো নাটক। একটা ভালো চুক্তির জন্য দরকার দুটি বিষয়—একটি হলো সত্যিকারের সদিচ্ছা; আরেকটি হলো এমন নিয়মকানুন, যা নির্ভরযোগ্যভাবে কার্যকর করা যায় এবং একতরফাভাবে পরিবর্তন করা যায় না।
এবার ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প আগের চেয়ে বেশি বেপরোয়া ও ‘স্বাধীন’ হয়েছেন। তাঁর ওপর আইনের নিয়ন্ত্রণ কার্যত উঠে গেছে। এর একটি উদাহরণ হলো দেশের সবচেয়ে বড় আইনজীবী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তাঁর ‘চুক্তি’। এখন পর্যন্ত নয়টি বড় আইনপ্রতিষ্ঠান এমন চাপে পড়েছে যে তারা ট্রাম্পপন্থী কাজে ৯৪০ মিলিয়ন ডলারের বিনা পারিশ্রমিক আইনি সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল—তাদের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স বাতিল করা হবে, সরকারিভাবে চুক্তি থেকে বাদ দেওয়া হবে, এমনকি ফেডারেল কোর্টেও ঢুকতে দেওয়া হবে না। যদিও চারটি প্রতিষ্ঠান ট্রাম্পের এসব নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং আদালতে জয় পায়।
আরও পড়ুন‘ট্রাম্প ডকট্রিন’ নয় ইরানের ৩টি কৌশলই সফল তাহলে১৮ জুলাই ২০২৫তাহলে প্রশ্ন আসে, দেশের সেরা আইনজীবীরা কেন এমন চাপের কাছে নতিস্বীকার করলেন? এর কারণ হলো আইনজীবীরা বুঝেছেন, এখন আর কেবল আইনের পক্ষে থাকলেই নিরাপদ থাকা যায় না। ট্রাম্প প্রশাসন পুরো আইন প্রয়োগব্যবস্থাকে নিজের ইচ্ছার অধীন নিয়ে এসেছে। প্রেসিডেন্ট চাইলে যেকোনো সময় যেকোনোভাবে তাঁদের শাস্তি দিতে পারেন। আইনের কোনো সুরক্ষা আর নেই। এখানেই মূল সমস্যা। যারা একচ্ছত্র ক্ষমতা চায়, তারা কোনো নিয়ম মানে না।
দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেই ট্রাম্প ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার মাধ্যমে অতিরিক্ত ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি ব্যবহার করেন ১৭৯৮ সালের এলিয়েন এনিমিস অ্যাক্ট। এই আইন কেবল তখনই কার্যকর হয়, যখন যুদ্ধ বা বিদেশি আগ্রাসনের মতো পরিস্থিতি ঘটে। কিন্তু ট্রাম্প এই আইন ব্যবহার করে ভেনেজুয়েলার একটি মাদক চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেন। এই যুক্তি ব্যবহার করে যেকোনো দেশের নাগরিককে (যে দেশ যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন বা মাদক পাচারের উৎস) টার্গেট করা সম্ভব।
আরও পড়ুনট্রাম্প কি বিশ্বের সব ডানপন্থী নিয়ে জোট গড়তে চান১৭ জুলাই ২০২৫ট্রাম্পের আরেকটি নির্বাহী আদেশ যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার বাতিল করে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪তম সংশোধনী বলছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া এবং এখানকার আইনের আওতায় থাকা প্রত্যেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।’ এ পরিস্থিতিতে কেউ যদি ট্রাম্পের সঙ্গে চুক্তি করে, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ‘আপনি আসলে কোন ভিত্তিতে এই চুক্তিকে টেকসই বলে মনে করছেন?’
এই সংকটে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় বিশ্ববিদ্যালয়ও। ট্রাম্প প্রশাসন তাদের হুমকি দিয়েছে, বিলিয়ন ডলারের সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেবে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর-ছাড়ের সুবিধাও বাতিল করবে। এখন তারা ভাবছে, ট্রাম্পকে খুশি রাখতে কি চুক্তি করে ফেলবে, নাকি একজোট হয়ে বলবে, ‘আমরা এই অন্যায় শর্ত মেনে নেব না?’ যে চুক্তি যেকোনো সময় একতরফাভাবে বাতিল বা পরিবর্তন করা যায়, সেই চুক্তি আসলে ফাঁকা বুলি। এটি আত্মপ্রবঞ্চনা, স্বার্থের মুখোশ।
রিচার্ড কে শারউইন নিউইয়র্ক ল স্কুলের আইন বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ