কবি আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ। বিশ-শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত কবি তিনি। তিরিশের দশক থেকে বোদলেয়রীয় আধুনিকতায় জারিত আমাদের প্রায় সকল কবির রচনায় যখন স্বকালের বন্ধ্যত্ব, নৈরাশ্যবাদিতা, পাশ্চাত্যের অনুসরণে মেকি নগর-যন্ত্রণা এবং এক সর্বগ্রাসী বিনষ্টি ও বিমানবিকীকরণের আগ্রাসন ঘটেছিল তখন প্রথমত আহসান হাবীব ও পরে  আল মাহমুদ তাঁর প্রবেশলগ্নের দেশজতা, মানবিকতা, সাম্যবাদ ও এতে লগ্ন থাকার আকুতি দিয়েই আকৃষ্ট করেছিলেন পাঠককে। কিন্তু এসবের পরিণতিপ্রাপ্তির আগেই আল মাহমুদ তাঁর ভাষায় “মানবিক নির্মাণের প্রতি আস্থা হারিয়ে” ফেলেছেন বলে ঘোষণা দিয়ে কিছু ইসলামী ভাবধারার কবিতা লেখার প্রয়াস পান; যা কাব্যরসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে দুই কারণে: (১) কবি ফররুখ আহমদ ইসলামী রেনেসাঁয় জারিত হয়ে ইতঃপূর্বেই যে বিরাট সাফল্য অর্জন করে ফেলেছেন তা ‘রূপান্তরিত’ আল মাহমুদের রচনায় তেমন শিল্পিতভাবে প্রকাশ পায়নি; (২) ফররুখ আহমদ ছন্দকে অটুট রেখে প্রধানত সনেটীয় আঙ্গিকে তাঁর ইসলামিক ভাবধারাকে প্রকাশ করেছেন মনোমুগ্ধকর ভাষায়, আর আল মাহমুদ মধ্যবয়সের পর প্রধানত লিখেছেন গদ্যরীতিতে যা প্রকৃত কবিতা-পাঠকের মনে ধরেনি। 
আল মাহমুদ তাঁর মধ্যবয়সেও বলেছেন: “যে-কবি ছন্দ জানে না সে কবিতার কিছুই জানে না.

..”: (ইনকিলাব সাহিত্য, ৩ অক্টোবর ১৯৯৭)। একই বিশ্বাস ধ্বনিত হয়েছে মধ্যবয়সী শামসুর রাহমানের কণ্ঠেও: “সনেটে প্রত্যাবর্তন ছন্দহীনতার বিরুদ্ধে আমার একধরনের প্রতিবাদ (জনকণ্ঠ সাময়িকী, ২৩ অক্টোবর ১৯৯৬)। অন্যত্র (বরেণ্য কবিদের নির্মাণকলা, আগামী প্রকাশনী, ২০১৫) আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে আমার বিশাল বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে যেখানে তাঁর সমগ্র কবিতায় ছন্দ-প্রকরণের বিশ্লেষণও বাদ যায়নি। সংক্ষিপ্তকরণের প্রয়োজনে এ-লেখায় কেবল তাঁর শ্রেষ্ঠতম কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’-এর কবিতাগুলোয় ছন্দ-প্রকরণের বিশিষ্টতা তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। এর আগে প্রকাশিত দুটি বই ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’-এর কবিতাগুলোয় যে ছন্দ-প্রকরণ মেনে চলেছেন কবি আল মাহমুদ তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছে ‘সোনালি কাবিন’-এ এসে।
‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থে কেবল ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ এবং ‘তরঙ্গিত প্রলোভন’, ‘নদী তুমি’ এই দুটি কবিতা ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্তে রচিত। এই কবির অন্য গ্রন্থের তুলনায় এ-গ্রন্থে সর্বাধিক মুক্তক অক্ষরবৃত্ত আঙ্গিকের কবিতা রয়েছে। এই গ্রন্থে ‘প্রকৃতি’, ‘বাতাসের ফেনা’, ‘কবিতা এমন’, ‘অবগাহনের শব্দ’, ‘পলাতক’, ‘আমিও রাস্তায়’, ‘পালক ভাঙার প্রতিবাদে’, ‘খড়ের গম্বুজ’, ‘আত্মীয়ের মুখ’, ‘তোমার আড়ালে’, ‘সাহসের সমাচার’, ‘আভূমি আনত হয়ে’, ‘ক্যামোফ্লেজ’, ‘কেবল আমার পদতলে’, ‘সত্যের দাপট’, ‘আমি আর আসবো না বলে’, ‘আঘ্রাণ’, ‘বোধের উৎস’, ‘কই কোনদিকে’ কবিতাগুলো মুক্তক অক্ষরবৃত্তের রচনা। ‘জাতিস্মর’, ‘আমার অনুপস্থিতি’ এবং ‘আমার প্রাতরাশে’ কবিতাগুলোও তা-ই কিন্তু এগুলোতে রয়েছে শিথিল অক্ষরবৃত্তের বৈশিষ্ট্য। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে উপরিউক্ত শৈথিল্যের আশ্রয় নিয়ে গদ্যময়তা বৃদ্ধির ঝোঁকই শুধু নয়, ‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থে গদ্যরীতিতে বেশকিছু কবিতা রচনার দৃষ্টান্তও দেখিয়েছেন কবি। ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’, স্বপ্নের সানুদেশে’, ‘অন্তরভেদী অবলোকন’, ‘চোখ’, ‘উল্টানো চোখ’, ‘চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়’, ‘আমার চোখের তলদেশে’, ‘স্তব্ধতার মধ্যে তার ঠোঁট নড়ে’ এই ক’টি কবিতা প্রকৃত গদ্যরীতিতে রচিত। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’-এ ‘রাস্তা’ কবিতাটি শুরু হয়েছে বৃত্তীয় ঢঙে কিন্তু শেষ হয়েছে অক্ষরবৃত্ত ও গদ্যরীতির মিশেলে: “যদি যান,/কাউতলী/রেলব্রিজ/পেরুলেই/দেখবে” অংশে ৪-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় দোলা; মধ্যবর্তী অংশে “মানুষের সাধ্যমতো/ঘরবাড়ি” অক্ষরবৃত্তীয়; আবার, শেষ হয়েছে গদ্যে: “দেখবেন ভাদুগড়ের শেষপ্রান্তে/এক নির্জন বাড়ির উঠোনে ফুটে আছে/আমার মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাসবতী একটি ম্লান দুঃখের করবী”। গদ্যরীতিতে রচিত কবিতার প্রথম পঙ্‌ক্তিতেই গদ্যময়তা স্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয় যা এটিতে নেই। প্রথম গ্রন্থে ‘নিজের দিকে’ কবিতায়ও রয়েছে এ ধরনের মিশ্রণ কারণ প্রথম তিনটি স্তবকে ৪-মাত্রার মাত্রাবৃত্তের দোলা, চতুর্থ স্তবকের শুরুতে “আত্মাকেই বাজাতে বাজাতে” এবং শেষাংশে একইভাবে ‘আত্মাকে বাজাও’, ‘উদ্যত রেখেছে’, ‘ঈশ্বরের বুকে’ বাক্যবন্ধগুলোর বিবেচনায় একে অক্ষরবৃত্তীয় রচনা ভাবতে পাঠক প্ররোচিত হবেন কিন্তু বাকি অংশ সবটাই ৪-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় পর্বে বিন্যস্ত। কষ্টের তি/তির, নিজের দি/কেই, তেমনি ই/তর, আঙুল তো/মার, রাজার মু/কুট– এসব মধ্যখণ্ডন অভিনব এবং ছন্দ-প্রয়োগে দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে। এর মানে দাঁড়াল ‘লোক লোকান্তর’-এ একটিও প্রকৃত গদ্যকবিতা নেই। দ্বিতীয় বই ‘কালের কলস’-এ একটিমাত্র কবিতা ‘আমার সমস্ত গন্তব্যে’ প্রকৃত গদ্যরীতিতে রচিত। সে-তুলনায় ‘সোনালি কাবিন’-এ গদ্যকবিতার সংখ্যা সামান্য বেশি। 
মাত্রাবৃত্তীয় রচনায় ‘সোনলি কাবিন’ গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোয় কোনো মোড় পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না; পূর্বতন রীতিরই প্রয়োগ ঘটেছে। তবে, আল মাহমুদের হাতে প্রথমবারের মতো ৭-মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ব্যবহারের দৃষ্টান্ত মেলে ‘শোণিতে সৌরভ’ কবিতাটিতে। এতে আনুপূর্ব ৭/৭-মাত্রার বিন্যাস অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে:

তোমার মুখ-আঁকা একটি দস্তায়
লুটিয়ে দিতে পারি পিতার তরবারি
বাগান জোত জমি সহজে, সস্তায়...
(শোণিতে সৌরভ, সোনালি কাবিন)

‘কালের কলস’-এর মতোই ‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থেও মাত্রাবৃত্তীয় অধিকাংশ কবিতায় লোকছড়ার দুলুনিবিশিষ্ট ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা রয়েছে বেশ কয়েকটা:

সামনে দেখি গর্ত এক রয়েছে বড়ো হা করে (৫/৫/৫/৩)
আমার দিকে, দেখি নিগূঢ় আঘাতে (৫/৫/৩)
জীবন যেন জালের মাছি টানছে কালো মাকড়ে (৫/৫/৫/৩)
কোনোকিছুই পাবে না তারে জাগাতে (৫/৫/৩)
(ভাগ্যরেখা, সোনালি কবিন)

কবিতাটির পরের স্তবকেই ৩-মাত্রার সঙ্গে ৪-মাত্রার অপূর্ণ পর্বও ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু এতেও কোনো ধ্বনি বিপর্যয় ঘটেনি, কারণ ৩ ও ৪-মাত্রার শব্দগুলোর উচ্চারণকালের ব্যাপ্তি সমান:

তাহলে আমি জেনেছি এই আমার প্রাণ ঝলকের (৫/৫/৫/৪)
যা কিছু ছোঁয় দেখেছি সবই ঝালিয়ে; (৫/৫/৩)
বয়স করে তাড়া ভীষণ জীবন নাকি পলকের (৫/৫/৫/৪)
শহর থেকে শহরে আসি পালিয়ে (৫/৫/৩)
 মারাবৃত্তে রচিত অন্যগুলোর মধ্যে ‘দায়ভাগ’ ৫/৫/২-মাত্রার, ‘তোমার হাতে’ ৫/৫/৩ এবং ৫/৫/২-এর মিশ্রণে, ‘নতুন অব্দে’ ৬/৬/৬, ‘এক নদী’ ৫/৫/২-মাত্রার পর্বে বিন্যস্ত। 
‘আসে না আর’ এবং ‘যার স্মরণে’ কবিতা দুটি মূলত ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় ধ্বনিবিশিষ্ট হলেও প্রথমটিতে ‘পাহাড়পুরের’ এবং দ্বিতীয়টির ‘ডাকলো হুতোম’, ‘বন্য বাতাস’, ‘রাত্রি যখন’, ‘হাওয়ার আঘাত’, ‘ভাঙলো যখন’ এবং ‘আমার সকল’-এর জন্য কবিতা দুটি চূড়ান্ত বিচারে স্বরবৃত্তীয় রচনা। 
‘সোনালি কাবিন’-এর পর ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ এবং ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’য় প্রচুর গদ্য কবিতা লিখেছেন আল মাহমুদ। পরবর্তীকালে, বলতে গেলে, গদ্যরীতিকেই বক্তব্য প্রকাশের প্রধানতম বাহন ক’রে নিয়েছেন। কিন্তু বড় কবির শিরোপা তিনি পেয়েছেন ছন্দবদ্ধ কবিতার জন্যই। রবীন্দ্রনাথ-ও শেষবয়সে প্রচুর গদ্যকবিতা লিখেছেন কিন্তু তিনি নন্দিত হয়ে আছেন ছন্দবন্ধ কবিতাগুলোর জন্যই। কবি আল মাহমুদ-ও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর ছন্দবদ্ধ কবিতাগুলোর কারণেই। v

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গল প প রক ত গ রন থ প রক শ প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

আল মাহমুদের কবিতায় ছন্দ-প্রকরণ

কবি আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ। বিশ-শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত কবি তিনি। তিরিশের দশক থেকে বোদলেয়রীয় আধুনিকতায় জারিত আমাদের প্রায় সকল কবির রচনায় যখন স্বকালের বন্ধ্যত্ব, নৈরাশ্যবাদিতা, পাশ্চাত্যের অনুসরণে মেকি নগর-যন্ত্রণা এবং এক সর্বগ্রাসী বিনষ্টি ও বিমানবিকীকরণের আগ্রাসন ঘটেছিল তখন প্রথমত আহসান হাবীব ও পরে  আল মাহমুদ তাঁর প্রবেশলগ্নের দেশজতা, মানবিকতা, সাম্যবাদ ও এতে লগ্ন থাকার আকুতি দিয়েই আকৃষ্ট করেছিলেন পাঠককে। কিন্তু এসবের পরিণতিপ্রাপ্তির আগেই আল মাহমুদ তাঁর ভাষায় “মানবিক নির্মাণের প্রতি আস্থা হারিয়ে” ফেলেছেন বলে ঘোষণা দিয়ে কিছু ইসলামী ভাবধারার কবিতা লেখার প্রয়াস পান; যা কাব্যরসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে দুই কারণে: (১) কবি ফররুখ আহমদ ইসলামী রেনেসাঁয় জারিত হয়ে ইতঃপূর্বেই যে বিরাট সাফল্য অর্জন করে ফেলেছেন তা ‘রূপান্তরিত’ আল মাহমুদের রচনায় তেমন শিল্পিতভাবে প্রকাশ পায়নি; (২) ফররুখ আহমদ ছন্দকে অটুট রেখে প্রধানত সনেটীয় আঙ্গিকে তাঁর ইসলামিক ভাবধারাকে প্রকাশ করেছেন মনোমুগ্ধকর ভাষায়, আর আল মাহমুদ মধ্যবয়সের পর প্রধানত লিখেছেন গদ্যরীতিতে যা প্রকৃত কবিতা-পাঠকের মনে ধরেনি। 
আল মাহমুদ তাঁর মধ্যবয়সেও বলেছেন: “যে-কবি ছন্দ জানে না সে কবিতার কিছুই জানে না...”: (ইনকিলাব সাহিত্য, ৩ অক্টোবর ১৯৯৭)। একই বিশ্বাস ধ্বনিত হয়েছে মধ্যবয়সী শামসুর রাহমানের কণ্ঠেও: “সনেটে প্রত্যাবর্তন ছন্দহীনতার বিরুদ্ধে আমার একধরনের প্রতিবাদ (জনকণ্ঠ সাময়িকী, ২৩ অক্টোবর ১৯৯৬)। অন্যত্র (বরেণ্য কবিদের নির্মাণকলা, আগামী প্রকাশনী, ২০১৫) আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে আমার বিশাল বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে যেখানে তাঁর সমগ্র কবিতায় ছন্দ-প্রকরণের বিশ্লেষণও বাদ যায়নি। সংক্ষিপ্তকরণের প্রয়োজনে এ-লেখায় কেবল তাঁর শ্রেষ্ঠতম কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’-এর কবিতাগুলোয় ছন্দ-প্রকরণের বিশিষ্টতা তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। এর আগে প্রকাশিত দুটি বই ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’-এর কবিতাগুলোয় যে ছন্দ-প্রকরণ মেনে চলেছেন কবি আল মাহমুদ তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছে ‘সোনালি কাবিন’-এ এসে।
‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থে কেবল ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ এবং ‘তরঙ্গিত প্রলোভন’, ‘নদী তুমি’ এই দুটি কবিতা ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্তে রচিত। এই কবির অন্য গ্রন্থের তুলনায় এ-গ্রন্থে সর্বাধিক মুক্তক অক্ষরবৃত্ত আঙ্গিকের কবিতা রয়েছে। এই গ্রন্থে ‘প্রকৃতি’, ‘বাতাসের ফেনা’, ‘কবিতা এমন’, ‘অবগাহনের শব্দ’, ‘পলাতক’, ‘আমিও রাস্তায়’, ‘পালক ভাঙার প্রতিবাদে’, ‘খড়ের গম্বুজ’, ‘আত্মীয়ের মুখ’, ‘তোমার আড়ালে’, ‘সাহসের সমাচার’, ‘আভূমি আনত হয়ে’, ‘ক্যামোফ্লেজ’, ‘কেবল আমার পদতলে’, ‘সত্যের দাপট’, ‘আমি আর আসবো না বলে’, ‘আঘ্রাণ’, ‘বোধের উৎস’, ‘কই কোনদিকে’ কবিতাগুলো মুক্তক অক্ষরবৃত্তের রচনা। ‘জাতিস্মর’, ‘আমার অনুপস্থিতি’ এবং ‘আমার প্রাতরাশে’ কবিতাগুলোও তা-ই কিন্তু এগুলোতে রয়েছে শিথিল অক্ষরবৃত্তের বৈশিষ্ট্য। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে উপরিউক্ত শৈথিল্যের আশ্রয় নিয়ে গদ্যময়তা বৃদ্ধির ঝোঁকই শুধু নয়, ‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থে গদ্যরীতিতে বেশকিছু কবিতা রচনার দৃষ্টান্তও দেখিয়েছেন কবি। ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’, স্বপ্নের সানুদেশে’, ‘অন্তরভেদী অবলোকন’, ‘চোখ’, ‘উল্টানো চোখ’, ‘চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়’, ‘আমার চোখের তলদেশে’, ‘স্তব্ধতার মধ্যে তার ঠোঁট নড়ে’ এই ক’টি কবিতা প্রকৃত গদ্যরীতিতে রচিত। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’-এ ‘রাস্তা’ কবিতাটি শুরু হয়েছে বৃত্তীয় ঢঙে কিন্তু শেষ হয়েছে অক্ষরবৃত্ত ও গদ্যরীতির মিশেলে: “যদি যান,/কাউতলী/রেলব্রিজ/পেরুলেই/দেখবে” অংশে ৪-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় দোলা; মধ্যবর্তী অংশে “মানুষের সাধ্যমতো/ঘরবাড়ি” অক্ষরবৃত্তীয়; আবার, শেষ হয়েছে গদ্যে: “দেখবেন ভাদুগড়ের শেষপ্রান্তে/এক নির্জন বাড়ির উঠোনে ফুটে আছে/আমার মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাসবতী একটি ম্লান দুঃখের করবী”। গদ্যরীতিতে রচিত কবিতার প্রথম পঙ্‌ক্তিতেই গদ্যময়তা স্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয় যা এটিতে নেই। প্রথম গ্রন্থে ‘নিজের দিকে’ কবিতায়ও রয়েছে এ ধরনের মিশ্রণ কারণ প্রথম তিনটি স্তবকে ৪-মাত্রার মাত্রাবৃত্তের দোলা, চতুর্থ স্তবকের শুরুতে “আত্মাকেই বাজাতে বাজাতে” এবং শেষাংশে একইভাবে ‘আত্মাকে বাজাও’, ‘উদ্যত রেখেছে’, ‘ঈশ্বরের বুকে’ বাক্যবন্ধগুলোর বিবেচনায় একে অক্ষরবৃত্তীয় রচনা ভাবতে পাঠক প্ররোচিত হবেন কিন্তু বাকি অংশ সবটাই ৪-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় পর্বে বিন্যস্ত। কষ্টের তি/তির, নিজের দি/কেই, তেমনি ই/তর, আঙুল তো/মার, রাজার মু/কুট– এসব মধ্যখণ্ডন অভিনব এবং ছন্দ-প্রয়োগে দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে। এর মানে দাঁড়াল ‘লোক লোকান্তর’-এ একটিও প্রকৃত গদ্যকবিতা নেই। দ্বিতীয় বই ‘কালের কলস’-এ একটিমাত্র কবিতা ‘আমার সমস্ত গন্তব্যে’ প্রকৃত গদ্যরীতিতে রচিত। সে-তুলনায় ‘সোনালি কাবিন’-এ গদ্যকবিতার সংখ্যা সামান্য বেশি। 
মাত্রাবৃত্তীয় রচনায় ‘সোনলি কাবিন’ গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোয় কোনো মোড় পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না; পূর্বতন রীতিরই প্রয়োগ ঘটেছে। তবে, আল মাহমুদের হাতে প্রথমবারের মতো ৭-মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ব্যবহারের দৃষ্টান্ত মেলে ‘শোণিতে সৌরভ’ কবিতাটিতে। এতে আনুপূর্ব ৭/৭-মাত্রার বিন্যাস অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে:

তোমার মুখ-আঁকা একটি দস্তায়
লুটিয়ে দিতে পারি পিতার তরবারি
বাগান জোত জমি সহজে, সস্তায়...
(শোণিতে সৌরভ, সোনালি কাবিন)

‘কালের কলস’-এর মতোই ‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থেও মাত্রাবৃত্তীয় অধিকাংশ কবিতায় লোকছড়ার দুলুনিবিশিষ্ট ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা রয়েছে বেশ কয়েকটা:

সামনে দেখি গর্ত এক রয়েছে বড়ো হা করে (৫/৫/৫/৩)
আমার দিকে, দেখি নিগূঢ় আঘাতে (৫/৫/৩)
জীবন যেন জালের মাছি টানছে কালো মাকড়ে (৫/৫/৫/৩)
কোনোকিছুই পাবে না তারে জাগাতে (৫/৫/৩)
(ভাগ্যরেখা, সোনালি কবিন)

কবিতাটির পরের স্তবকেই ৩-মাত্রার সঙ্গে ৪-মাত্রার অপূর্ণ পর্বও ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু এতেও কোনো ধ্বনি বিপর্যয় ঘটেনি, কারণ ৩ ও ৪-মাত্রার শব্দগুলোর উচ্চারণকালের ব্যাপ্তি সমান:

তাহলে আমি জেনেছি এই আমার প্রাণ ঝলকের (৫/৫/৫/৪)
যা কিছু ছোঁয় দেখেছি সবই ঝালিয়ে; (৫/৫/৩)
বয়স করে তাড়া ভীষণ জীবন নাকি পলকের (৫/৫/৫/৪)
শহর থেকে শহরে আসি পালিয়ে (৫/৫/৩)
 মারাবৃত্তে রচিত অন্যগুলোর মধ্যে ‘দায়ভাগ’ ৫/৫/২-মাত্রার, ‘তোমার হাতে’ ৫/৫/৩ এবং ৫/৫/২-এর মিশ্রণে, ‘নতুন অব্দে’ ৬/৬/৬, ‘এক নদী’ ৫/৫/২-মাত্রার পর্বে বিন্যস্ত। 
‘আসে না আর’ এবং ‘যার স্মরণে’ কবিতা দুটি মূলত ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় ধ্বনিবিশিষ্ট হলেও প্রথমটিতে ‘পাহাড়পুরের’ এবং দ্বিতীয়টির ‘ডাকলো হুতোম’, ‘বন্য বাতাস’, ‘রাত্রি যখন’, ‘হাওয়ার আঘাত’, ‘ভাঙলো যখন’ এবং ‘আমার সকল’-এর জন্য কবিতা দুটি চূড়ান্ত বিচারে স্বরবৃত্তীয় রচনা। 
‘সোনালি কাবিন’-এর পর ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ এবং ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’য় প্রচুর গদ্য কবিতা লিখেছেন আল মাহমুদ। পরবর্তীকালে, বলতে গেলে, গদ্যরীতিকেই বক্তব্য প্রকাশের প্রধানতম বাহন ক’রে নিয়েছেন। কিন্তু বড় কবির শিরোপা তিনি পেয়েছেন ছন্দবদ্ধ কবিতার জন্যই। রবীন্দ্রনাথ-ও শেষবয়সে প্রচুর গদ্যকবিতা লিখেছেন কিন্তু তিনি নন্দিত হয়ে আছেন ছন্দবন্ধ কবিতাগুলোর জন্যই। কবি আল মাহমুদ-ও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর ছন্দবদ্ধ কবিতাগুলোর কারণেই। v

সম্পর্কিত নিবন্ধ