পাল্টা শুল্ক কার্যকর, ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ
Published: 7th, August 2025 GMT
বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আজ বৃহস্পতিবার কার্যকর হচ্ছে। পাল্টা শুল্কারোপের আগে বেশির ভাগ দেশের পণ্যে মোটামুটি একই হারে শুল্ক আদায় করত দেশটি। এখন দেশভেদে আলাদা হারে শুল্ক দিতে হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতার হিসাবও বদলে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কারোপের পর কোন দেশের পণ্যে শুল্ক কত দাঁড়াতে পারে, তা জানতে একটি সাধারণ সুতির টি-শার্টের শুল্কের তুলনা করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস এত দিন একটি সুতির টি-শার্ট থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ হারে স্বাভাবিক শুল্ক আদায় করেছে। এই শুল্কের সঙ্গে এখন থেকে বাংলাদেশের জন্য যুক্ত হবে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক।
যুক্তরাষ্ট্রের সময় আজ বৃহস্পতিবার প্রথম প্রহরে (বাংলাদেশ সময় আজ সকাল ১০টা ১ মিনিট) পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা। এ সময়ের পর চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে থাকা জাহাজে যুক্তরাষ্ট্রগামী যেসব পণ্য তোলা হবে, সেগুলোতে বসবে পাল্টা শুল্ক। চট্টগ্রাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে কনটেইনারবাহী পণ্য পৌঁছাতে ৩০ থেকে ৪৫ দিন সময় লাগে।
যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস এত দিন একটি সুতির টি-শার্ট থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ হারে স্বাভাবিক শুল্ক আদায় করেছে। এই শুল্কের সঙ্গে এখন থেকে বাংলাদেশের জন্য যুক্ত হবে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক।একটি টি–শার্টে কত শুল্কপাল্টা শুল্কের হিসাব তুলনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশন এবং ট্যারিফ শিডিউলের তথ্য–উপাত্ত পর্যালোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সুতির একটি টি-শার্টের উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক।
গত বছর বাংলাদেশ প্রতিটি টি-শার্ট যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ১ ডলার ৬২ সেন্টে (১৯৯ টাকা প্রায়)। এই টি-শার্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আদায় করেছে ২৭ সেন্ট (৩৩ টাকা)। এখন ২০ শতাংশ হারে পাল্টা শুল্ক হিসাবে দিতে হবে আরও বাড়তি ৩২ সেন্ট (৩৯ টাকা)। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে একটি টি-শার্ট নিতে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের গড়ে ৫৯ সেন্ট (৭২ টাকা) শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে সুতির টি-শার্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী ভারত। যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের টি-শার্টের গড় রপ্তানি মূল্য বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। দেশটির পণ্যের ওপর প্রথম দফায় ২৫ শতাংশের পর গতকাল বুধবার আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে সব মিলিয়ে ভারত থেকে একটি টি-শার্ট নিতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের মোট শুল্ক দিতে হবে ১ ডলার ২৫ সেন্ট।
বাংলাদেশের আরেক প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামকে যুক্তরাষ্ট্রে সুতির টি-শার্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি শুল্ক দিতে হবে। ভিয়েতনামের প্রতিটি টি-শার্টে গড়ে শুল্ক (পাল্টা শুল্কসহ) দিতে হবে ৯৮ সেন্ট।
চীন অবশ্য বাংলাদেশের চেয়ে কম দামে যুক্তরাষ্ট্রে টি-শার্ট রপ্তানি করে। এমনিতেই বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে ২০২০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে সাড়ে ৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক দিয়ে আসছিল চীন। শিগগিরই দেশটির ওপর চূড়ান্ত পাল্টা শুল্কহার ঘোষণা করার কথা যুক্তরাষ্ট্রের। তবে বর্তমানে পাল্টা শুল্ক ৩০ শতাংশ ধরে নিলে চীনের প্রতিটি টি-শার্ট যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে শুল্ক দিতে হবে ৮২ সেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে ভারত, ভিয়েতনাম ও চীন ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ আছে আরও তিনটি—ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়া। ইন্দোনেশিয়ার প্রতিটি টি-শার্টে গড়ে শুল্ক ৯০ সেন্ট, কম্বোডিয়ার ৮৯ সেন্ট এবং পাকিস্তানের টি-শার্টে ৫২ সেন্ট শুল্ক দিতে হবে।
গত বছর বাংলাদেশ প্রতিটি টি-শার্ট যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ১ ডলার ৬২ সেন্টে (১৯৯ টাকা প্রায়)। এই টি-শার্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আদায় করেছে ২৭ সেন্ট (৩৩ টাকা)। এখন ২০ শতাংশ হারে পাল্টা শুল্ক হিসাবে দিতে হবে আরও বাড়তি ৩২ সেন্ট (৩৯ টাকা)। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে একটি টি-শার্ট নিতে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের গড়ে ৫৯ সেন্ট (৭২ টাকা) শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।ছিটকে গেছে দুই ভবিষ্যৎ ‘হুমকি’একসময় মিয়ানমারকে বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য ভবিষ্যৎ হুমকি হিসেবে দেখা হতো। তবে দেশটির পণ্যে ৪০ শতাংশ পাল্টা শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিটি টি-শার্ট রপ্তানিতে তাদের দিতে হবে ১ ডলার ৮৮ সেন্ট, যা বাংলাদেশের রপ্তানিমূল্যের চেয়েও বেশি। এর ফলে রপ্তানিযুদ্ধে তারা কার্যত বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে।
আবার আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়াকেও একসময় হুমকি মনে করত রপ্তানিকারকেরা। কারণ, আফ্রিকান গ্রোথ অ্যান্ড অপরচুনিটি অ্যাক্টের আওতায় শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধা ছিল তাদের। তবে বাণিজ্যসুবিধার শর্ত ভাঙায় ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি এই চুক্তি থেকে ইথিওপিয়াকে বের করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি এখন প্রতিযোগিতার মহাসাগরে পড়েছে।
প্রতিযোগী দেশ আছে আরও তিনটি—ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়া। ইন্দোনেশিয়ার প্রতিটি টি-শার্টে গড়ে শুল্ক ৯০ সেন্ট, কম্বোডিয়ার ৮৯ সেন্ট এবং পাকিস্তানের টি-শার্টে ৫২ সেন্ট শুল্ক দিতে হবে।ভালো নেই দুই শীর্ষ প্রতিযোগীযুক্তরাষ্ট্রে সুতির টি-শার্টে গত বছর শীর্ষ দুই রপ্তানিকারক হলো যথাক্রমে নিকারাগুয়া ও হন্ডুরাস। দেশ দুটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি কাফটার আওতায় শর্ত সাপেক্ষে শূন্য শুল্কের সুবিধা পেয়ে আসছে। পাল্টা শুল্কে দিন বদলে গেছে তাদেরও। এখন নিকারাগুয়া ১৮ শতাংশ পাল্টা শুল্কের আওতায় পড়েছে। গেল মে মাসে হন্ডুরাসের টি-শার্টে গড়ে ১০ শতাংশ শুল্ক আদায় করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
সব মিলিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কে প্রতিটি টি-শার্টে গড়ে বাংলাদেশকে শুধু পাকিস্তানের চেয়ে বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। তা–ও টি-শার্টপ্রতি ৭ সেন্ট। অন্য সব প্রতিযোগী দেশগুলোকে বাংলাদেশের চেয়ে টি-শার্টপ্রতি বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। শুল্কহার সমান হলেও গড়মূল্য বেশি হওয়ায় টি-শার্টপ্রতি শুল্কের পরিমাণও বেশি হয়।
নিকারাগুয়া ও হন্ডুরাস আমাদের প্রতিযোগী নয়। আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের তুলনায় আমরা আগের মতোই আছি। ভারত ও চীনের চেয়ে এগিয়ে আছি। পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়ার চেয়ে ১ শতাংশ শুল্ক বেশি হলেও পিছিয়ে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যচুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ইথিওপিয়াও এখন আর হুমকি নয়। এক কথায় বলা যায়, ৩৫ শতাংশ নিয়ে আমরা যে শঙ্কায় ছিলাম, তা কেটে গেছে।এশিয়ান-ডাফ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সালাম বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়বাংলাদেশের রপ্তানির একক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, দেশটিতে গত অর্থবছরে ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৭৬০ কোটি ডলার। এত দিন বাংলাদেশের পণ্যে কার্যকর গড় শুল্কহার ছিল ১৫ শতাংশ। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে গড় কার্যকর শুল্কহার ছিল ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ। নতুন করে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক যুক্ত হয়ে গড় কার্যকর শুল্কহার আরও বাড়বে। তবে শুল্কহার বাড়লেও বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের সমানই রয়েছে। আবার চীন ও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের শুল্কহার কম। সব মিলিয়ে নতুন পাল্টা শুল্কে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতায় থাকা কিংবা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার কথা বলছেন রপ্তানিকারকেরা।
এমন বিশ্লেষণের কথা তুলে ধরে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের শীর্ষ পর্যায়ের রপ্তানিকারক এশিয়ান-ডাফ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিকারাগুয়া ও হন্ডুরাস আমাদের প্রতিযোগী নয়। আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের তুলনায় আমরা আগের মতোই আছি। ভারত ও চীনের চেয়ে এগিয়ে আছি। পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়ার চেয়ে ১ শতাংশ শুল্ক বেশি হলেও পিছিয়ে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যচুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ইথিওপিয়াও এখন আর হুমকি নয়। এক কথায় বলা যায়, ৩৫ শতাংশ নিয়ে আমরা যে শঙ্কায় ছিলাম, তা কেটে গেছে।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ব ট য ক তর ষ ট র কম ব ড য় র ইন দ ন শ য় হন ড র স সব ম ল য় ক র যকর র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
রয়টার্সের বিশ্লেষণ: অতি আত্মবিশ্বাস ডুবিয়েছে ভারতকে
পাঁচ দফা বাণিজ্য আলোচনার পর ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি অনুকূল চুক্তি করা নিয়ে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তারা গণমাধ্যমকেও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন শুল্ক সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখা হতে পারে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১ আগস্টের সময়সীমার কয়েক সপ্তাহ আগে নিজেই এই চুক্তির ঘোষণা দেবেন। কিন্তু সেই ঘোষণা আর আসেনি। আর এখন যা এল, তা ভারতের ভাবনাতেও ছিল না।
এখন নয়াদিল্লি একপ্রকার বিস্মিত অবস্থায় পড়েছে, কারণ শুক্রবার থেকে ভারতের পণ্যের ওপর হঠাৎ করেই ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, পাশাপাশি রাশিয়া থেকে তেল আমদানির জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
আরো পড়ুন:
পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন ট্রাম্প
রাশিয়ায় পৌঁছেছেন ট্রাম্পের বিশেষ দূত
এরই মধ্যে ট্রাম্প জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বড় বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে। এমনকি ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকেও তুলনামূলকভাবে ভালো সুযোগ দিয়েছেন ট্রাম্প।
চারজন ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা এবং দুজন মার্কিন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ভারতের সঙ্গে প্রস্তাবিত চুক্তি এবং কীভাবে বেশিরভাগ বিষয়ে কারিগরি সমঝোতা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে আলোচনা ভেঙে পড়ল, সেসব বিষয়ে অপ্রকাশিত তথ্য বের করে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
উভয় পক্ষের কর্মকর্তারা বলেছেন, রাজনৈতিক ভুল হিসাব, ভুল বার্তা এবং পারস্পরিক তিক্ততার মিশ্রণে বিশ্বের বৃহত্তম (যুক্তরাষ্ট্র) এবং পঞ্চম বৃহত্তম (ভারত) অর্থনীতির মধ্যে এই চুক্তি ভেস্তে যায়, যাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১৯০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
এই বিষয়ে জানতে রয়টার্স মন্তব্য চেয়ে ইমেইল করে হোয়াইট হাউস, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি অফিস, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। তবে তারা জবাব দেয়নি।
ভারত মনে করেছিল, দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের ওয়াশিংটন সফর এবং মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভ্যান্সের দিল্লি সফরের পর একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে তারা চুক্তি চূড়ান্ত করার পথে অগ্রসর হয়েছে।
দুজন ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, ভারতে রপ্তানি করা যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পজাত পণ্যের ওপর প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি শুল্ক সম্পূর্ণ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল নয়াদিল্লি।
কর্মকর্তারা বলেন, ঘরোয়া চাপ থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কোটার ভিত্তিতে ভারত ধীরে ধীরে মার্কিন গাড়ি ও অ্যালকোহলের ওপর শুল্ক কমাতে রাজি হয়েছিল। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের মূল দাবি অনুযায়ী, জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা খাতে আমদানি বাড়াতেও সম্মত হয়েছিল নয়াদিল্লি।
কর্মকর্তাদের একজন রয়টার্সকে বলেন, “ওয়াশিংটনে পঞ্চম দফা আলোচনার পর প্রায় সব মতবিরোধই মেটানো গিয়েছিল, যা আমাদের মধ্যে বড় ধরনের অগ্রগতির আশা জাগিয়েছিল।”
“আলোচকরা বিশ্বাস করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মার্কিন কৃষিপণ্য ও দুগ্ধজাত পণ্যের শুল্কমুক্ত আমদানিতে অনীহা মেনে নেবে। এটি ছিল একটি ভুল হিসাব। ট্রাম্প বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখেছিলেন এবং আরো বেশি ছাড় চেয়েছিলেন,” যোগ করেন ওই কর্মকর্তা।
“ভারতের সঙ্গে আলোচনায় অনেক অগ্রগতি হয়েছিল কিন্তু কখনোই এমন কোনো সমঝোতা হয়নি, যেটি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম,” বলেন হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা।
“আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছাইনি, যেটিকে আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি বলতে পারি; একটি সেই ধরনের চুক্তি, যেটার জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম,” যোগ করেন তিনি।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং ভুল হিসাব
ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটন সফর করা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২৫ সালের শরতের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণে সম্মত হন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দেন।
৪৭ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি কেনার এবং প্রতিরক্ষা খাতে আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।
তবে এখন কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, ট্রাম্প যখন ‘বড়’ একটি আসন্ন চুক্তির কথা বলেছিলেন, তখন ভারত অত্যধিক আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল এবং এটিকে একটি অনুকূল চুক্তির সংকেত হিসেবে ধরে নিয়েছিল। এরপর নয়াদিল্লি তাদের অবস্থান কঠোর করে তোলে, বিশেষ করে কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের ক্ষেত্রে, যা ভারতের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল দুটি খাত।
মধ্য জুলাইয়ে আলোচনায় যুক্ত এক ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, “আমরা বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর একটি। আর যুক্তরাষ্ট্র ১৪০ কোটি মানুষের বাজারকে উপেক্ষা করতে পারে না।”
আলোচনাকারীরা এমনকি এপ্রিল মাসে ঘোষিত গড় ১০ শতাংশ মার্কিন শুল্ক থেকে মুক্তি এবং স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম ও গাড়ির শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য দাবি তুলেছিলেন।
অবশ্য জাপান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো প্রধান অংশীদারদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তি সই করার পর ভারত তাদের প্রত্যাশার মাত্র কমিয়ে আনে। তারপরও তাদের আশা ছিল, কম ছাড় দিয়ে হলেও ১৫ শতাংশের শুল্কের সমপরিমাণ চুক্তি হতে পারে। কিন্তু হোয়াইট হাউসের কাছে তা গ্রহণযোগ্য ছিল না।
ওয়াশিংটনে আলোচনায় যুক্ত এক সূত্র বলেছে, “ট্রাম্প এমন একটি ঘোষণা চেয়েছিলেন, যা ব্যাপকভিত্তিক বাজার প্রবেশযোগ্যতা, বিনিয়োগ এবং বড় ক্রয়ের প্রতিশ্রুতি নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।”
একজন ভারতীয় কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, নয়াদিল্লি অন্যদের দেওয়া শর্ত মেলাতে প্রস্তুত ছিল না।
উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ কোরিয়া ট্রাম্পের ১ আগস্টের সময়সীমার ঠিক আগে একটি চুক্তি করে ফেলে; যেখানে ২৫ শতাংশ শুল্কের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ শুল্ক নিশ্চিত করে। এ জন্য দক্ষিণ কোরিয়া ৩৫০ বিলিয়ন বিনিয়োগ, বেশি জ্বালানি আমদানি এবং চাল ও গরুর মাংসের ওপর ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে।
যোগাযোগের বিঘ্ন
বর্তমানে একটি লবি গ্রুপে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বাণিজ্য প্রতিনিধি এবং দুই দেশের আলোচনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত মার্ক লিনস্কটের কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চায় রয়টার্স। তিনি বলেন, “এক পর্যায়ে উভয় পক্ষই চুক্তি সইয়ের খুব কাছাকাছি ছিল।”
“অপসৃয়মান উপাদান ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রধানমন্ত্রী মোদির মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের লাইন,” যোগ করেন লিনস্কট।
হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তাও এ কথা জোরালোভাবে অস্বীকার করেছেন। তার মতে, অন্যান্য চুক্তি এমন সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমাধান হয়েছে।
আলোচনায় জড়িত এক ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা বলেন, “মোদি কল করতে পারতেন না; কারণ তিনি ভয় পেতেন ট্রাম্পের সঙ্গে একপক্ষীয় কথোপকথনের, যা তাকে কঠিন অবস্থায় ফেলতে পারে।”
তবে অন্য তিনজন ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, “ট্রাম্পের বারবার ভারত-পাকিস্তান বিরোধে মধ্যস্থতার মন্তব্য আলোচনাকে আরো জটিল করে তোলে এবং এর ফলে মোদি চূড়ান্ত আলাপটা করতে পারেননি।”
ওই তিন কর্মকর্তার একজন বলেন “ট্রাম্পের পাকিস্তান সম্পর্কে মন্তব্য ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়নি। অবশ্য ভারতের উচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা স্বীকার করা, তবে স্পষ্ট করা যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমাদেরই।”
সম্পর্কের ভাঙনের জন্য ভুল হিসাব-নিকাশকে দূষছেন একজন জ্যেষ্ঠ ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা। তার মতে, শীর্ষ ভারতীয় উপদেষ্টারা প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেননি।
“যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, জাপান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভালো চুক্তি করায় আমরা কূটনৈতিক সহায়তার অভাব অনুভব করেছিলাম,” বলেন ওই কর্মকর্তা।
“এখন আমরা এমন এক সংকটে রয়েছি, যা এড়ানো যেত।”
ট্রাম্প মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) বলেন, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ভারতের আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বাড়ানো হবে। তিনি অভিযোগ করেন, রাশিয়ার কাছ থেকে নয়াদিল্লির তেল কেনা ইউক্রেন যুদ্ধকে উদ্দীপিত করছে।
আগামীর পথ
আলোচনা চলমান রয়েছে, এই মাসের শেষে একটি মার্কিন প্রতিনিধি দলের দিল্লি সফর করার কথা রয়েছে। ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তারা এখনো বিশ্বাস করেন, এখান থেকেও চুক্তি করা যেতে পারে।
হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, “এখনো (চুক্তি) সম্ভব।”
চতুর্থ কর্মকর্তা জানান, ভারত সরকার কৃষি ও দুগ্ধ খাতের মধ্যে এমন কিছু ক্ষেত্র পুনঃমূল্যায়ন করছে, যেখানে ছাড় দেওয়া যেতে পারে। রাশিয়ান তেলের ক্ষেত্রে, যদি মূল্য ঠিক থাকে তাহলে ভারত কিছু আমদানি কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনার পরিমাণ বাড়াতে পারে।
লিনস্কট বলেন, “সম্ভবত এর জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের প্রয়োজন হবে।”
“ফোন তুলে নিন। এখন আমরা এমন এক অবস্থায় আছি যেখানে কেউই লাভবান হচ্ছে না। কিন্তু পরস্পর লাভজনক একটি বাণিজ্য চুক্তির প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে,” যোগ করেন তিনি।
ঢাকা/রাসেল