আশির দশকের বাংলা সিনেমা ও সিনেমাকেন্দ্রিক সমাজ
Published: 8th, August 2025 GMT
আশির দশকে সিনেমা ছিলো সাদাকালো কিন্তু কিছু কিছু গান ছিলো রঙিন। তখনকার ভাষায় বলা হতো, ‘আংশিক রঙিন ছবি’। ওই দশকের শেষের দিকে পূর্ণদৈর্ঘ্য রঙিন সিনেমা চলে আসলো। তখন প্রায় প্রতিটি জেলায় তো বটেই, থানা পর্যায়েও একটা, দুইটা সিনেমাহল ছিলো। কোনো কোনো জেলায় পাঁচটি বা তারও অধিক সিনেমা হল ছিলো। মোট কথা তিনটার কম সিনেমা হল কোনো জেলাতেই ছিলো না। এই সিনেমা হলগুলোতে সবগুলো শো একেবারে হাউসফুল থাকতো। সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলতো সেসব সিনেমা। এমনও হতো যে, কিছু কিছু সিনেমা মাসের পর মাসও চলতো।
ঈদে নতুন সিনেমা মুক্তি পেতো। ঈদ বিনোদনের একটা মাধ্যম ছিল সিনেমা। আর দর্শকদের কাছে সিনেমা দেখা একটা উৎসবে পরিণত হতো। সিনেমা হলগুলোতে টিকেটের জন্য মারামারি লেগে যেত।
জনজীবন ও ফ্যশনে সিনেমাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিলো। সিনেমায় নায়ক কী ধরণের পোশাক পরেছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে তরুণেরা স্টাইল করতো। যেমন—রংবাজসহ আরও অনেক সিনেমার কথা বলতে পারি। সিনেমার নায়ক বেল-বটম প্যান্ট পরেছিলো। যেটা দেখতে অনেকটা পালাজ্জোর মতো। তখনকার যুব সমাজ সিনেমা দেখেই স্টাইল সেট করতো। নায়ক বড় কলারওলা শার্ট পরতো। ফ্যাশন সচেতন তরুণেরাও তাই করতো। তারাও নায়কদের মতো বড় কলারওয়ালা বডি ফিটিং শার্ট বেছে নিতো।
আরো পড়ুন:
সন্তানের মৃত্যু ইরফান সাজ্জাদকে যা শিখিয়ে গেছে
‘অবুঝ মন’ থেকে ‘উৎসব’
চলচ্চিত্র কেন্দ্রীক নানা বাণিজ্য ছিলো। এই চলচ্চিত্র যে শুধুমাত্র নায়ক-নায়িকাদের কাজের সুযোগ তৈরি করতো তা নয়। প্রযোজক-পরিচালক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী পর্যন্ত বহু লোকের কর্মসংস্থান হতো। মেকআপ ম্যান, এক্সট্রা আর্টিস্ট, অথবা যে খাবার-দাবার পরিবেশন করতো এই ধরণের হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হতো চলচ্চিত্র কেন্দ্রীক। এ ছাড়া পোস্টার তৈরি, পোস্টার প্রিন্টিং, স্টিল ফটোগ্রাফিতেও- অনেকে যুক্ত থাকতো। তাদেরও একটা আয়ের সুযোগ ছিলো।
তখন ফোক ফ্যান্টাসি ধরণের অনেক সিনেমা হতো। স্ট্যান্টম্যানরা থাকতো যারা নায়কের পরিবর্তে তার ঝুঁকিপূর্ণ শটগুলো করতো। আবার সিনেমার প্রয়োজনে অনেকে সাপ সরবরাহ করতো, ঘোড়া সরবরাহ করতো। মানে বিভিন্ন ধরণের পোষা প্রাণ— বানর, বাঘ, হরিণ এই ধরণের প্রাণীর যোগনদাতারাও সিনেমা কেন্দ্রীক আয়ের সুযোগ পেতো।
তারপরে এটা যখন প্রদর্শন পর্যায়ে যেত অর্থাৎ হলে যেতো সেখানেও কিছুসংখ্যক লোকের কাজের সুযোগ হতো। এলাকায়-এলাকায় মাইকিং করা হতো। সেই মাইকম্যানেরও একটা রুটি-রুজির ব্যবস্থা হতো। এ ছাড়া টিকেরবিক্রিতা, গেইটম্যানও পেশার সুযোগ ছিল। যিনি টিকেট দেখে দেখে লোকজনকে সিনেমা হলে ঢোকাতো। তার একটা পেশা ছিল। সিনেমা হলের ভেতরে সুপারভাইজার ছিলো, যে দেখতো সবাই ঠিকমতো বসছে কিনা-তার একটা আয় রোজগারের ব্যবস্থা ছিল। হল মালিকদের আয়ের সুযোগ তো ছিলোই।
সর্বপরি তখন বাড়তি চাহিদার কারণে কালোবাজারে টিকেট বিক্রি করা হতো। এবং এটাও একটা পেশা, যদিও পেশাটা নেগেটিভ। তখন এমন কোনো সিনেমা হল ছিলো না, যেখানে ডিসি, ডিসি, বলে ডাকা না হতো। মানে সিনেমা হলের ভেতরে যে সিটগুলো ছিল—বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা ছিল। ডিসি মানে ড্রেস সার্কেল। তারপরে রেয়ার স্টল, মানে আরেকটু সামনে। আর সবার সামনে ছিলো ফ্রন্ট স্টল। আর কিছু কিছু থাকতো ভিআইপি বক্স। এভাবে প্রত্যেকটা সিনেমাহলে সিট বিন্যাস করা হতো। সেই অনুযায়ী টিকিটের দামটাও নির্ধারণ করা হতো। কালোবাজারীরা আগেই টিকেট নিয়ে নিতো। এরপর কিছুটা বাড়তি মূল্যে বিক্রি করতো। এবং তারা হাক-ডাক দিতো ডিসি ডিসি বলে। তবে চাইলে সে সব ধরণের টিকেটই ম্যানেজ করে দিতে পারতো। ঢাকা শহরের বড় বড় সিনেমাহলগুলোতে কালোবাজারিদের রমরমা একটা ব্যাবসা ছিলো।
রেডিওকেন্দ্রীক সিনেমার বিজ্ঞাপন হতো। প্রতিদিন বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বিজ্ঞাপন তরঙ্গ অনুষ্ঠান— দশ পনেরো মিনিটের একটা অনুষ্ঠান হতো। যে সিনেমা পেতে যাচ্ছি অথবা পেয়ে গেছি। সেই সব সিনেমার বিজ্ঞাপনগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কণ্ঠ দিতেন মাজহারুল ইসলাম এবং নাজমুল হুসাইন।
‘হ্যাঁ, ভাই আসিতেছে’ বলে শুরু হতো এই অনুষ্ঠান। গ্রাম বাংলায় এই অনুষ্ঠান এতোটাই জনপ্রিয় ছিল যে বলে বোঝানো কঠিন। এই অনুষ্ঠানে সিনেমার সংলাপ শোনানো হতো। তারপর গানের দুই, চার কলি শোনানো হতো। মাঝে এই উপস্থাপকরা ব্যাখ্যা করতো—সিনেমাটা কেমন, কেন দেখতে যাবেন; ইত্যাদি। এইটা ছিলো সিনেমার একটা রেডিও বিজ্ঞাপনের ধরণ। এছাড়াও নানান ভাবে সিনেমার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো।
সিনেমার যে নায়ক-নায়িকাদের জুটি ছিল। রাজ্জাক- কবরী, রাজ্জাক-শাবানা, শাবানা-আলমগীর, বুলবুল আহমেদ-কবরী, জাফর ইকবাল-ববিতা, সোহেল রানা-সুচরিতা। এই জুটি প্রথার কারণেও সিনেমা জনপ্রিয় হতো। মানুষ অনেক সময় জুটির কারণে সিনেমা দেখতে যেত।
তখন এফডিসিতে মানুষের ভীড় লেগেই থাকতো। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা একই পরিস্থিতি ছিল। রাতের বেলায়ও শুটিং হতো। তার কারণ, অনেক ব্যস্ত নায়ক হয়তো দিনে সিডিউল দিতে পারতো না। দেখা যেত যে— নায়ক এসেছে রাত বারোটার সময়। তখনই শুটিং হতো। আবার চিত্রনাট্যে হয়তো এমন দৃশ্য থাকতো যার শুটিং ভোর বেলায় করতে হবে। তার প্রিপারেশনের জন্য রাতে অনেক কাজ করা হতো। সিনেমার মহড়া চলতো। মানে এফডিসিও ছিলো সাধারণ মানুষের কাছে একটি উৎসবমুখর গন্তব্য।
সে সময়ের সিনেমার গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ঘুরতো। সে সময় অসাধারণ কিছু কণ্ঠশিল্পী, প্রথিতযশা সুরকার-গীতিকার ছিল যাদের কারণে আশির দশকের সিনেমার গান এখনও মানুষের হৃদয়ে দোলা দেয়। যাদের গান এখনও রেডিওতে বাজে। এখনও অবচেতনে মন গেয়ে ওঠে ‘আছেন আমার মুক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার।’ অথবা ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই’।
ঢাকা/লিপি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ন ম হল কবর চলচ চ ত র অন ষ ঠ ন ও একট র একট ধরণ র
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাস্থ্যখাতে সংস্কারের দাবিতে বরিশালের সড়কে জুমার নামাজ আদায়
‘এই মুহূর্তে দরকার সারা দেশের স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার, এই মুহূর্তে দরকার বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংস্কার’ এই স্লোগানে দ্বাদশ দিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে বরিশালে সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। তারা জুমার নামাজ সড়কে আদায় করেছেন।
শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকাল ১১টার দিকে বরিশাল নগরীর কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল নথুল্লাবাদের গোল চত্বরে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ফলে মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন যাতায়াতকারীরা।
আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সংগঠক মহিউদ্দিন রনি বলেন, “বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসলে প্রতিটি ক্ষেত্রে হয়রানীর স্বীকার হতে হয়। প্রথমে রোগী নিয়ে আসার পর ট্রলি আনতে গেলে দিতে হয় ১০০ টাকা, নার্সদের দিতে হয় ১০০ টাকা, সিস্টারদের দিতে হয় ১০০ টাকা, আয়াকেও দিতে হয় ১০০ টাকা। রাত ১০টার পরে হাসপাতালে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না।”
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে টিটিসি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, অধ্যক্ষ অবরুদ্ধ
৭১ এর গণহত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে চবিতে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের বিক্ষোভ
“জরুরি বিভাগেরও একই অবস্থা। মাঝে মধ্যে জরুরি বিভাগে ডাক্তার পাওয়া গেলেও তাদের অবহেলায় রোগী ও তাদের স্বজনদের সিমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মূলত ইর্ন্টান চিকিৎসকদের ওপর ভরসা করে চলছে দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সেবা”, যোগ করেন তিনি।
মহিউদ্দিন রনি বলেন, “চিকিৎসকদের অবহেলায় প্রায় প্রতিনিয়ত রোগীদের প্রাণহানী ঘটছে। তেমনি হাসপাতালের স্টাফদের অর্থ বাণিজ্যের কারণে রোগীর স্বজনদের পকেট খালি হচ্ছে। এ অবস্থা দেশের প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের। এ কারণে স্বাস্থ্যখাতে অব্যবস্থাপনা, রোগীদের ভোগান্তি ও হয়রানির প্রতিবাদে স্বাস্থ্যখাতে সংস্কার আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করা হয়েছে।”
আন্দোলকারীদের দাবি, স্বাস্থ্যখাতে বৈষম্য চলবে না, সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে, শেবাচিমে জনদুর্ভোগ বন্ধ করতে হবে। এসব সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
ঢাকা/শিপন/মাসুদ