২৮ জুলাই, ২০২৪, রাত ২.৩০। উকুলেলে হাতে পারশা মাহজাবীন গাইলেন, ‘চল ভুলে যাই’। ভুলে যেতে বললেন আবু সঈদ, মুগ্ধদের কথা। বললেন, মনে রাখতে কেবল মেট্রোরেলের ক্ষত। মায়োপিক চোখে পৃথিবী দেখার বুলি আমাদের শেখানো হয়েছে ১৫ বছর ধরে; হয়তো তার চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে, হয়তো ‘হাজার বছর ধরে’।

পুরুষের চোখে নারীকে পৃথিবী দেখানোর প্রয়াস বুঝি এর চেয়েও ঢের পুরোনো। নারীর জীবন নির্ধারিত হবে পুরুষের ইচ্ছা অনুসারে। ফরাসি বিপ্লবের পর নেপোলিয়ন বোনাপার্টের খুব বেশি সময় লাগেনি এই আইন ফ্রান্সের নারীদের ওপর চাপিয়ে দিতে। তিনি সেদিন খুব সহজেই ভুলে গিয়েছিলেন ১৭৮৯ সালের ৫ অক্টোবর, ভার্সাই প্রাসাদের ক্ষমতা টলিয়ে দেওয়ার লড়াইের সম্মুখসারিতে ছিলেন নারীরা।

আমাদের দেশে জুলাই অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমাও তার চেয়ে খুব ভিন্ন হয়নি। এই মরণপণ লড়াই একবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া অধ্যাপক সামিনা লুৎফাকে বিজয়ের দুই মাস না পেরোতেই বিভৎস আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে সাইবার দুনিয়ায়। তখন কর্তাব্যক্তিরা প্রাণপণে চোখ বুঁজে থেকেছেন। অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের অনেকেই সে সময় তাঁর পাশে দাঁড়াননি।

অধ্যাপক সামিনা অভ্যুত্থানের পর নানাভাবে নিগৃহের শিকার হওয়া নারীদের দীর্ঘ তালিকায় একটিমাত্র নাম। সে তালিকায় আন্দোলনের অন্যতম মুখ উমামা ফাতেমা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক প্রাপ্তি তাপসী যেমন আছেন, তেমনি আছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির তাসনিম জারা আর তাজনূভা জাবীনরাও। এই আক্রমণ যে কেবল বাইরে থেকে এসেছে তা–ই নয়, কথিথ সহযোদ্ধারাও কখনো কখনো নিপীড়ক হয়েছেন আর অনেক সময়ই হয়েছেন নীরব দর্শক।

এই অন্তর্বর্তী সরকার জুলাইয়ের ঐতিহাসিক সমরে অংশ নেওয়া সবার ত্যাগের ফসল। তাই দেশের অর্ধেক মানুষকে, তাঁদের রজনৈতিক স্বীকৃতির অধিকারকে পেছনে ফেলে নির্বাচনী ট্রেনে উঠে পড়া হবে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিদারুণ প্রতারণা।

কিন্তু অধ্যাপক সামিনা, প্রাপ্তি, উমামা, জারা কিংবা তাজনূভারা দমে যাননি। দমে যাবেন না। জুলাই এ দেশের নারীদের শিখিয়েছে তাঁদের আপন শক্তিতে এগিয়ে যাওয়া। এখনো দেয়ালে দেয়ালে নজরুলের ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি–শিখা’ গানটির উৎকলন খুঁজে পাওয়া যাবে:

‘ধূ ধূ জ্ব’লে ওঠ ধূমায়িত অগ্নি,

জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী!

পতিতোদ্ধারিণী স্বর্গ-স্খলিতা

জাহ্নবী সম বেগে জাগো পদ-দলিতা,

মেঘে আনো বালা বজ্রের জ্বালা

চির-বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা।’

চির-বিজয়িনীরা হারিয়ে যান না। তাঁরা ফিরে ফিরে আসেন, নিশ্চিত বিজয়ের দিকে এগিয়ে চলেন। প্রশ্ন হলো, এ দেশের পুরুষেরা তাঁদের সঙ্গী হতে পারবেন কি না, নাকি কেবল পেছনে টেনে রাখতে চাইবেন?

দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের বেশির ভাগ এখনো পুরুষ। মুখে তাঁদের প্রায়ই শোনা যায়, নারী নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসার কথা। কিন্তু যখন ঐকমত্য কমিশনে প্রশ্ন এল, নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের কিংবা অন্তত ৩৩ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়ার, তখন বাদ সাধলেন অনেকেই। বাধা আসায় আপাতত ৫ শতাংশ আর এরপর ১০ শতাংশ মনোনয়নের সিদ্ধান্ত নিয়ে বাহাসের ইতি টানল কমিশন।

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, তবে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপরিশ কি একেবারেই মূল্যহীন? দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী, মোট ভোটারের অর্ধেকও তাঁরা। নারীরা কী চান, সেটা জানার বা বোঝার চেষ্টা কোথায়?

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এই গ্রাফিতি.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলও কি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে

১৫ বছর ধরে অনেক ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল আর সংগঠন মিলে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসেন।

এর ফলে হাসিনা সরকারের পতন হয় ও তিনি এবং তাঁর দলের কর্মীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এ পরিবর্তন শুধু একটা সরকারের পরিবর্তন নয়, বরং দীর্ঘ সময়ের ভয় ও দমনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের সাহস, আশা ও গণতান্ত্রিক চেতনার একটি বড় জয় ছিল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, কিছু গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনের সফলতাকে শুধু নিজের নামে দাবি করতে শুরু করে। কেউ কেউ বলতে থাকে, তাদের কারণেই সরকার পতন ঘটেছে। তাই তারাই ভবিষ্যতে ক্ষমতার একমাত্র ভাগীদার।

আবার কিছু ধর্মীয় বা আদর্শিক গোষ্ঠী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যারা আগে প্রকাশ্যে তেমন সক্রিয় ছিল না। এ ছাড়া কিছু নতুন দল, যারা আগে রাজনীতিতে খুব একটা পরিচিত ছিল না, তারাও হঠাৎ করে সামনে চলে এসেছে। তারা নিজেদের ‘নতুন শক্তি’, ‘ভিন্নধারার দল’ হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু তাদের আচরণে কখনো কখনো পুরোনো রাজনীতির কৌশলই দেখা যায়।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪

এই আন্দোলনের সময় বিভিন্ন গোষ্ঠী একসঙ্গে থাকলেও আন্দোলনের পর তারা নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে গিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ আবার নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ করছে। এতে আন্দোলনের মূল চেতনা—জনগণের অধিকার, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন ধীরে ধীরে পেছনের দিকে চলে গেছে।

এ বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে, যাঁরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরাই কি আবার ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়ে নতুন একধরনের স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেবেন?

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ৫ আগস্ট, ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ