‘মনে হলো এক টন ইট এসে পড়েছে’, বললেন লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানলে বাবাকে হারানো মেয়ে
Published: 11th, January 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে দাবানলে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে অন্তত ১১ জন হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রাণহানি আরও বাড়তে পারে।
লস অ্যাঞ্জেলেসে আগুনের সূত্রপাত হয় গত মঙ্গলবার। স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত বেশ কয়েকটি জায়গায় দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। শত চেষ্টার পরও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না আগুন। পুড়ে ছারখার হচ্ছে এলাকার পর এলাকা। দাবানলে এখন পর্যন্ত দেড় শ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে লুটপাট চালাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। লুটপাট ঠেকাতে একটি এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে।
স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, মৃতদের পরিচয় চূড়ান্তভাবে শনাক্ত করতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে। আঙুলের ছাপ কিংবা মুখমণ্ডল শনাক্তের মতো প্রচলিত উপায়ে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে প্রাণ হারানো কয়েকজনের পরিচয় জানিয়েছে মার্কিন কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। বাবা হারানো মেয়ে বলেছেন, শেষ কথা কী হয়েছিল। ছোট বোন বলেছেন, বাড়ি ছেড়ে কিছুতেই যেতে চাননি বড় ভাই। তাই তাঁকে ফেলেই নিরাপদে সরে যান তিনি। কেউ খুঁজছেন ৮৩ বছরের স্বজনকে। কেউ আবার হারিয়েছেন প্রিয় বন্ধুটিকে। জেনে নেওয়া যাক স্বজন হারানোদের গল্পগুলো।
অ্যান্থনি মিশেল ও জাস্টিনতাঁরা দুজন বাবা-ছেলে। অ্যান্থনি মিশেলের বয়স ৬৭ বছর। জাস্টিনের ২০ পেরিয়েছে। লস অ্যাঞ্জেলেসের আলটিডিনা এলাকায় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে থাকতেন জাস্টিন।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যান্থনি মিশেল একসময় বিক্রয়কর্মীর কাজ করতেন। অঙ্গহানি ঘটেছিল তাঁর। অবসরজীবন কাটাচ্ছিলেন। আর ছেলে জাস্টিন স্নায়বিক রোগে সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত ছিলেন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, দাবানল থেকে বাঁচতে নিরাপদে সরে যাওয়ার চেষ্টার সময় বাড়িতেই মারা যান বাবা-ছেলে। অ্যান্থনি মিশেলের মেয়ে হাজিমা হোয়াইট ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, তাঁর বাবা তাঁকে ফোন দিয়েছিলেন। ফোনে বলেছিলেন, ‘আগুন একেবারে উঠানে পৌঁছে গেছে।’
লস অ্যাঞ্জেলেসের আলটিডিনার বাড়িতে ফিরে এই দুজন দেখেন, দাবানলে সব পুড়ে গেছে। লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ৯ জানুয়ারি.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
গণভোটের প্রশ্নের ভাষা কতটা বোধগম্য হলো
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই একই দিনে সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গণভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জনগণকে মতপ্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্নটি যেহেতু সংবিধান সংস্কারবিষয়ক এবং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের যেহেতু সংস্কারের সব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি, সেহেতু এ গণভোটের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। কিন্তু এ জন্য যে দীর্ঘ প্রশ্ন নির্ধারণ করা হয়েছে, তার ভাষা সব মানুষের কাছে যথেষ্ট বোধগম্য হচ্ছে কি না, সেটিও ভাবা দরকার।
আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত শতকরা ২২ ভাগ মানুষ নিরক্ষর, অর্থাৎ তাঁরা পড়তেও পারেন না। সাক্ষরতার হার হিসাব করা হয় সাত বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর ওপর। তার মানে নিরক্ষর মানুষের বেশির ভাগই প্রাপ্তবয়স্ক ভোটার, যাঁরা গণভোটের প্রশ্নগুলো পড়তেই পারবেন না। আবার যাঁরা পড়তে পারেন, তাঁদের সবাই উত্থাপিত প্রশ্নগুলো যে বুঝতে পারবেন, এমন নয়। কেবল ভাষাগত কারণেই সংস্কারমূলক প্রস্তাবটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে অস্পষ্ট রয়ে যাবে, এমনকি এ জন্য ভোট প্রদানে অনাগ্রহও তৈরি হতে পারে।
আমাদের দেশের হতদরিদ্র মানুষের কাছে সংবিধান বাস্তবে ‘কাগুজে দলিল’ ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, তাঁরা রাষ্ট্রকে দেখতে চান নির্বিঘ্ন ও সচ্ছল জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করে। সরকার যখন মানুষের খেয়েপরে নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও দিতে পারে না, তখন মানুষের কাছে সংবিধানের ধারাগুলো গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
গণভোটের প্রশ্নে নতুন যেসব প্রস্তাব করা হচ্ছে, তাতে শাসনপ্রক্রিয়ায় নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসবে। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ও অধিকারের প্রশ্নে কতটুকু বদল আনবে, সেটি বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না গেলে বোঝা সম্ভব নয়।
গণভোটের প্রশ্নে ‘দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ’, ‘উচ্চকক্ষ’ ইত্যাদি এমন কিছু সরকার ও রাজনীতিবিষয়ক পরিভাষা আছে, যেগুলো আমাদের দেশে একেবারেই নতুন। তবে শুধু পরিভাষাগত কারণে গণভোটের প্রশ্নটি জটিল হয়েছে, তা নয়। প্রশ্নের কোনো কোনো জায়গা পূর্ণ ধারণাও প্রকাশ করতে পারছে না। যেমন গণভোটের প্রশ্নের একটি বিষয় এমন: ‘আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।’ বিদ্যমান কাঠামোর ৩০০ সংসদ সদস্যের বাইরে উচ্চকক্ষের এ অতিরিক্ত ১০০ সদস্যের কাজ ও ভূমিকা কী হবে, তা মোটেও এখানে স্পষ্ট নয়।
এবার জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট হওয়ার কারণে ভোটারের উপস্থিতি অনেক বেশি হবে বলেই ধারণা করা যায়। কিন্তু ভাষাগত ও ধারণাগত অস্পষ্টতার কারণে জনগণকে হয়তো ভোটদানে বিরত থাকতে হবে কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।তা ছাড়া বর্তমান পদ্ধতিতে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করা সহজ নয়; তাতে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের প্রয়োজন হয়। নতুন প্রস্তাবে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে, তার মানে অর্ধেকের বেশি সদস্যের সমর্থনেই সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলা সম্ভব হবে।
গণভোটের প্রশ্ন দেখে মনে হচ্ছে, নতুন প্রস্তাবে সংবিধান সংশোধনের কাজটি আগের চেয়ে সহজ হয়ে গেল। কারণ, সরকার গঠনকারী দল তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে উচ্চকক্ষেও সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে। উচ্চকক্ষের সদস্যরা দলীয় মতের বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন কি না, সেটিও বোঝা যাচ্ছে না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে উচ্চকক্ষ ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এর অন্যান্য ধারা, যেমন বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ ইত্যাদি বিষয় বদলে ফেলতে পারবে কি না, সেটি নিয়েও দ্বিধা থেকে যাচ্ছে।
সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সর্বশেষ ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে গণভোট হয়েছিল। তখন গণভোটের প্রশ্ন ছিল: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেওয়া উচিত কি না?’ সেই গণভোটে মোট ভোটারের শতকরা মাত্র ৩৫ ভাগ অংশ নেন। অথচ তার কয়েক মাস আগে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ৫৫ ভাগের বেশি ভোটার ভোট দেন।
আরও পড়ুনযাঁরা গণভোট দেবেন তাঁরা গণভোট নিয়ে কতটা জানেন১০ অক্টোবর ২০২৫এবার জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট হওয়ার কারণে ভোটারের উপস্থিতি অনেক বেশি হবে বলেই ধারণা করা যায়। কিন্তু ভাষাগত ও ধারণাগত অস্পষ্টতার কারণে জনগণকে হয়তো ভোটদানে বিরত থাকতে হবে কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আগের গণভোটের প্রশ্নের ভাষাও জটিল ছিল, কিন্তু প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল অভিন্ন মত প্রকাশ করার কারণে সাধারণ মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পেতে হয়নি।
কেউ কেউ বলছেন, পদ্ধতিগতভাবেও এবারের গণভোটে সমস্যা আছে। চারটি বিষয়ের জন্য একটি প্রশ্নে হ্যাঁ বা না ভোট দেওয়ার ব্যাপারটি যথেষ্ট যৌক্তিক নয়। কারণ, প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ব্যক্তির আলাদা সিদ্ধান্ত থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রশ্নের ডানে আলাদা করে হ্যাঁ/না ভোট দেওয়ার জন্য চারটি বাক্স বা ঘর রাখা যেতে পারে, যাতে একজন ভোটার প্রশ্ন অনুযায়ী আলাদাভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। দ্রুত ফল গণনার জন্য এ প্রশ্নের কাগজটিও মেশিন রিডেবল বা যন্ত্রে পাঠযোগ্য করতে হবে। তবে বিপুলসংখ্যক ভোটার নিরক্ষর ও স্বল্পশিক্ষিত হওয়ার কারণে এই পদ্ধতিও ঠিকমতো কাজ করবে না।
সাধারণ মানুষের কাছে পুরো বিষয় স্পষ্ট ও বোধগম্য করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে গণভোটের প্রশ্নের এবং জুলাই জাতীয় সনদের ব্যাখ্যামূলক প্রচারণা চালানো উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নের বিষয় এবং জুলাই সনদের ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা। সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত হয়তো দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হবেন, কিন্তু তাঁরা অন্তত আশ্বস্ত হতে পারবেন, সংবিধান সংশোধনে তাঁদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক