বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তবে সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোতে নারী ও কন্যাশিশুরা এখনও বৈষম্য ও অবহেলার শিকার। সামাজিক কুসংস্কার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে জিইয়ে রেখেছে, যা নারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় বড় অন্তরায়। জন্মের পর থেকেই কন্যাশিশুদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তার অনেক ক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরী অনেকের ওপরে যৌন হয়রানির অঘটন ঘটে। রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি অনেক সময় পারিবারিক পরিবেশেও মেয়েরা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়।
সমাজে বাল্যবিয়ে ও যৌতুকের কালো ছায়া এখনও বিস্তৃত। বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে বাল্যবিয়ে ও যৌতুক প্রথা ভয়াবহ আকারে বিদ্যমান। দেশে ১৮ বছরের নিচের বয়সী মেয়েদের বিয়ে হলে তা বাল্যবিয়ে হিসেবে ধরা হয়। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়ে এবং ২১ বছরের নিচে কোনো ছেলের বিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে এ আইনের ১৯ ধারায় ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বা ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো মেয়ের ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বিবেচনায় আদালতের নির্দেশে বিয়ে হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না। গত বছরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশে অর্ধেকের বেশি সংখ্যক মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগে। বাল্যবিয়ের শিকার হওয়ার কারণে মেয়েরা অনেক সময় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকেও ঝরে যায়।
অনেক ক্ষেত্রে মাদকাসক্তি, অনৈতিক সম্পর্ক ও পারিবারিক কলহ নারীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। কর্মক্ষেত্রেও নারী নির্যাতন থেমে নেই। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হলেও বাস্তবে বিচারিক প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর। এ কারণে নারী নির্যাতন এমনকি ধর্ষণের বিচারও ঠিকভাবে হয় না।
নুসরাত, তনু কিংবা শিশু মুন্তাহার নির্মম হত্যাকাণ্ড চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও সেগুলোর বিচারের অগ্রগতি হতাশাজনক।
গত পাঁচ বছরে ধর্ষণের পরিসংখ্যান ভয়াবহ। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ৩,৫৮৭ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুসারে ধর্ষণসহ নানা অপরাধের কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের অভাবে এই আইন কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা এবং সামাজিক চাপ ধর্ষণকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে বড় বাধা।
অপরাধীদের জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ যেমন জরুরি, তেমনি সামাজিক আন্দোলনও এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। সামাজিকভাবে যুবসমাজকে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অপরাধী যেই হোক, তার বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ একত্রে কাজ করলে ইতিবাচক ফল পাওয়া সম্ভব। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সমতার ভিত্তিতে সুস্থ, সুন্দর সমাজ গড়তে নারী ও পুরুষ উভয়েরই সমান ভূমিকা প্রয়োজন।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি মানসিকতা পরিবর্তনও জরুরি। নারীদের মা-বোন বা দয়াময়ীর চেয়ে একজন স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে দেখার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা ও গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে কুসংস্কার দূর করা জরুরি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণেই নারীর প্রতি সব ধরনের নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।
নুসরাত নাঈম সাজিয়া: শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
চাঁদাবাজ রিয়াদের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ মিশনপাড়া
নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র মিশনপাড়ায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি, হুমকি ও হয়রানিমূলক মামলার ভয়ঙ্কর এক চক্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন সাধারণ মানুষ।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, রিয়াদ দীর্ঘদিন ধরেই এলাকার বাসিন্দাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে দোকান বসানো পর্যন্ত সবকিছুতেই চাঁদা দাবি করেন তিনি ও তাঁর অনুসারীরা।
চাঁদা না দিলে থেমে যায় কাজ, চলে হামলা, পরে দেওয়া হয় সাজানো মামলা। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন রয়েছে রহস্যজনকভাবে নীরব।
স্থানীয়রা বলছেন, রিয়াদ নিজে কোনো রাজনৈতিক আদর্শের লোক না হলেও, একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাঁদের ব্যবহার করেন নিজের স্বার্থে।
রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় রিয়াদ এতটাই দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করেন যে, থানায় একাধিক অভিযোগের পরও তাঁর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার অন্যতম আসামিও এই রিয়াদ। সেইসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় তাঁর নামে একাধিক চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মামলা রয়েছে।
এমনকি তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু তারপরও তিনি দিব্যি এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আদায় করে চলেছেন চাঁদা, দখল করে নিচ্ছেন জমি, দোকান।
মিশনপাড়ায় বর্তমানে যেসব ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে, তার মধ্যে প্রায় প্রতিটির কাজেই বাধা দেওয়া হয়েছে রিয়াদের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাড়ির মালিক বলেন, “আমরা পরিবার নিয়ে এখানে থাকি।
নিজের পৈতৃক জমিতে ভবন নির্মাণ করছি। হঠাৎ একদিন ৪-৫ জন যুবক এসে জানায়, বসের অনুমতি ছাড়া কাজ হবে না। পরে রিয়াদ নিজেই ফোন করে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। না দিলে মালামাল ফেলে দেওয়া, শ্রমিকদের মারধরের হুমকি দেয়।”
এই অভিজ্ঞতা শুধু একজনের নয়। অন্তত ৮-১০ জন ভবন মালিক এবং কয়েকজন ঠিকাদার একই ধরনের ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্য, রিয়াদের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়মিতভাবে ১ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবি করে। কেউ না মানলে থেমে যায় কাজ, চলে হামলা-মামলা আর হয়রানির স্বীকারে।
মিশনপাড়ার বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, রিয়াদ এলাকায় একটি ভয়ঙ্কর ‘মিনি মাফিয়া নেটওয়ার্ক’ গড়ে তুলেছেন। ভবন নির্মাণ, দোকান বসানো, এমনকি ফুটপাতে ব্যবসা করতেও তাঁকে চাঁদা দিতে হয়। অন্যথায় চলতে থাকে ভয় দেখানো, ভাঙচুর, এমনকি জীবননাশের হুমকি। অনেকেই বলেন, তাঁরা যেন জিম্মি হয়ে পড়েছেন রিয়াদ ও তাঁর চক্রের হাতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, “আমার পৈতৃক জমিতে ভবন করতে গিয়ে বিপদে পড়েছি। ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে। না দিলে শ্রমিকদের মারধর করবে বলে হুমকি দিয়েছে। থানায় গিয়ে অভিযোগ করলাম, কিন্তু কিছুই হয়নি। বরং রিয়াদ খবর পেয়ে হুমকি দিয়ে চাঁদার পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
একজন ঠিকাদার বলেন, “ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে আমাদের এখন বেশি খরচ হয় রিয়াদকে সামলাতে। কোনো আইন-শৃঙ্খলা নেই। যে যেখানে ইচ্ছা চাঁদা চাচ্ছে, না দিলে মামলা, মারধর। কোথাও নালিশ করতে পারি না, বরং নালিশ করলেই বিপদ আরও বাড়ে।”
আরেকজন ঠিকাদার বলেন, “রিয়াদ এখন এলাকাবাসীর গলার কাঁটা। কাজ শুরু করলেই তার লোকজন এসে বলে, বসের অনুমতি লাগবে। চাঁদা না দিলে মালামাল উধাও, শ্রমিক পালায়, পরে থানায় গিয়ে দেখি আমার নামে নাকি মারামারির মামলা!”
ভুক্তভোগীরা জানান, শুধু ভীতি ও চাঁদাবাজি নয়, রিয়াদ ও তাঁর সহযোগীরা একটি সংঘবদ্ধ আইনি হয়রানির চক্রও তৈরি করেছেন। কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে বা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে উল্টো তাঁদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। পরবর্তীতে সেই মামলা আপোষে নিষ্পত্তির জন্য আবারও দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, রিয়াদের এতোসব অপরাধ কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা না নেওয়ায় মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে, কেন এই নীরবতা? তাঁর নামে একাধিক মামলা ও ওয়ারেন্ট থাকার পরও কীভাবে তিনি খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়ান? পুলিশ কি ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে আড়াল করছে?
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমরা অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তাধীন। অপরাধী হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে এলাকাবাসীর দাবি ভিন্ন।
তাঁরা বলছেন, শুধু অভিযোগ নয়, ভিডিও প্রমাণ, অডিও ক্লিপস, এমনকি লিখিত অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাননি তাঁরা। বরং অভিযোগ জানানোর পর হুমকির মাত্রা বেড়ে যায়। অনেকে ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন বা কাজ বন্ধ রেখেছেন।
রিয়াদের বিরুদ্ধে এইসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন। এরপর আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
স্থানীয় কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছেও বহুবার গেছেন এলাকাবাসী। কিন্তু কেউই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসেননি। বরং অনেকে অভিযোগ করেন, রিয়াদ একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক গ্রুপের ‘অঘোষিত কার্যকর্তা’ হিসেবে কাজ করেন, এবং সেই পরিচয়ের কারণেই তাঁকে ঘিরে রয়েছে এক ধরনের অদৃশ্য নিরাপত্তা।
মিশনপাড়ার এই অবস্থা এখন পুরো নারায়ণগঞ্জ শহরের নিরাপত্তা ও সুশাসনের জন্য ভয়ঙ্কর এক সংকেত হয়ে উঠেছে। নাগরিক সমাজের প্রশ্ন , যদি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও একাধিক মামলার আসামিকে গ্রেপ্তার না করা হয়, তবে আইনের শাসন কোথায়?
সচেতন মহলের দাবি, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে রিয়াদ ও তাঁর চক্র আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তখন শুধু মিশনপাড়া নয়, নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রতিটি প্রান্তেই গড়ে উঠবে এমন চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট।
এখনই সময় রিয়াদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার, নয়তো ঘটতে পারে ভয়ংকর অপ্রীতিকর কোন ঘটনা। আক্রান্ত হতে পারে ভুক্তভোগীরা।