ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যে সেনা অভিযানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এবার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে পাকিস্তান। গতকাল শনিবার ‘আবদালি’ নামের স্বল্পপাল্লার এ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশটির সশস্ত্র বাহিনীকে অভিযানের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দেওয়ার সিদ্ধান্তের চার দিন পর এ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাল পাকিস্তান। যা পেহেলগাম হামলাকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুই দেশের উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। গতকালের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকে ভারতের প্রতি পাকিস্তানের বার্তা হিসেবে দেখছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। পেহেলগাম হামলার পাঁচ দিন পর গত ২৭ এপ্রিল ভারতও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছিল।

এদিকে পাকিস্তান থেকে সব ধরনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ভারত। পাশাপাশি ডাক ও পার্সেল সেবা বন্ধের ঘোষণাও দিয়েছে দেশটি।

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিল বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাঁদের বেশির ভাগই পর্যটক। এ হামলার পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছে নয়াদিল্লি। তবে এ অভিযোগ নাকচ করে আসছে পাকিস্তান। ওই হামলার পর থেকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রতিবেশীর মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী গতকাল জানায়, স্বল্পপাল্লার আবদালি ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে তারা। ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য এ ক্ষেপণাস্ত্র সর্বোচ্চ ৪৫০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। এক বিবৃতিতে সামরিক বাহিনী বলেছে, সেনাদের আভিযানিক প্রস্তুতি নিশ্চিত করা এবং গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি দিকগুলো যাচাই ছিল আবদালি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার উদ্দেশ্য।

সামরিক বাহিনীর বরাত দিয়ে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলমান ‘এক্স সিন্ধু’ সামরিক মহড়ার অংশ হিসেবে এ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এ সময় আর্মি স্ট্র্যাটেজিক ফোর্সেস কমান্ডের (এএফএসসি) কমান্ডার, স্ট্র্যাটেজিক প্লানস ডিভিশন ও এএফএসসির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এবং দেশটির সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা উপস্থিত ছিলেন।

ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকে ‘সতর্ক বার্তা’ হিসেবে দেখছেন পাকিস্তানের বিশ্লেষকেরা। সামরিক বিশ্লেষক হাসান আসকারি রিজভী বলেন, ‘এটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে ভারতকে মোকাবিলার সক্ষমতা আমাদের আছে। এটি শুধু ভারতের জন্যই নয়; বরং বাকি বিশ্বের জন্যও বার্তা যে আমরা ভালোভাবেই প্রস্তুত আছি।’

পেহেলগামে হামলার এক সপ্তাহের মাথায় ২৯ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন। বৈঠকে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতার ওপর পূর্ণ আস্থা জানান মোদি। তিনি বলেন, ভারতের পক্ষ থেকে জবাব দেওয়ার সময়, লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ এবং কোন প্রক্রিয়ায় জবাব দেওয়া হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।

মোদির ওই বক্তব্যের পর পাকিস্তানে যেকোনো সময় ভারতের হামলার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ উত্তেজনা প্রশমনে দুই দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। তবে দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে গোলাগুলি, নাগরিকদের ভিসা বাতিল, চুক্তি স্থগিত, কূটনীতিক বহিষ্কারসহ পাল্টাপাল্টি নানা পদক্ষেপ চলছেই।

আমদানি নিষিদ্ধের ঘোষণা ভারতের

পেহেলগামের হামলার পর থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অব্যাহত রেখেছে ভারত। এরই অংশ হিসেবে এবার পাকিস্তান থেকে সব ধরনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আমদানি নিষিদ্ধ করেছে নয়াদিল্লি। তাৎক্ষণিক এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু এ কথা জানিয়েছে।

ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় গত শুক্রবার গণবিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, পাকিস্তান থেকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে আসা সব ধরনের পণ্যের আমদানি ও পরিবহন এখন থেকে নিষিদ্ধ। এ নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে।

এ ছাড়া পাকিস্তান থেকে আকাশ ও স্থলপথে সব ধরনের ডাক ও পার্সেল নিষিদ্ধ করেছে ভারত। গতকাল এক গণবিজ্ঞপ্তিতে দেশটির যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এ কথা জানায়।

এসব পদক্ষেপের মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি গতকাল বলেছেন, মানবতার জন্য ‘সবচেয়ে বড় হুমকি’ সন্ত্রাসবাদ। সন্ত্রাসী ও তাদের মদদদাতাদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ও চূড়ান্ত’ পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে ভারত অঙ্গীকারবদ্ধ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম পিটিআই জানায়, দিল্লি সফররত অ্যাঙ্গোলার প্রেসিডেন্ট জোয়াও লরেনচোর সঙ্গে বৈঠকের পর মোদি এ কথা বলেন।

এদিকে পেহেলগামে হামলার পর গতকাল প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করেছেন জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে প্রায় আধা ঘণ্টা তাঁদের মধ্যে কথা হয়। জম্মু-কাশ্মীর পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুজন আলোচনা করেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

‘সংযত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে পাকিস্তান’

ভারতের উসকানিমূলক পদক্ষেপ সত্ত্বেও ইসলামাবাদ দায়িত্বশীল ও সংযত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন জানায়, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজের সঙ্গে গতকাল সাক্ষাৎ করেন ইসলামাবাদে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ইরফান নাজিরোগলু। পরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে দেওয়া এক বিবৃতি দেওয়া হয়।

বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেন, পাকিস্তান সব ধরনের সন্ত্রাসের নিন্দা জানায়। পেহেলগামের ঘটনায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততা নিয়ে ভারত কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেনি এবং ভিত্তিহীনভাবে এর সঙ্গে পাকিস্তানকে জড়ানোর চেষ্টা করছে। পেহেলগামের ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটনে বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত নিয়ে পাকিস্তানের প্রস্তাবের বিষয়ে ভারত এখনো কোনো জবাব দেয়নি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত রিজওয়ান সাঈদ শেখ কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পেহেলগাম হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ভেঙে যাওয়ার ‘মূল বিষয়’ হিসেবে কাশ্মীর সমস্যার কথা উল্লেখ করেন তিনি। গতকাল ফক্স নিউজ ডিজিটালে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে রিজওয়ান সাঈদ এ কথা বলেন।

‘আমরা যুদ্ধ চাই না’

বিবিসি উর্দুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত ও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণরেখার দুই পাশের কাশ্মীরি মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলে তাঁরাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এ জন্য আগেভাগেই দুই পাশের আতঙ্কে থাকা মানুষ বাংকার সংস্কার করছেন।

পেহেলগাম হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে বেসামরিক নানা বিধিনিষেধ ঘোষণার পরও কাশ্মীরের মানুষ ভেবেছিলেন, পরিস্থিতি হয়তো এর চেয়ে খারাপ হবে না। কিন্তু কয়েক দিন ধরে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) বরাবর গোলাগুলির কারণে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন সীমান্তের দুই পাশে বসবাসরত মানুষ।

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার মধ্যে কাশ্মীরের দুই অংশেই পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে। পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে আসা পর্যটকদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করেন ইসলামাবাদ থেকে পরিবার নিয়ে কাশ্মীরে আসা সালিম উদ্দিন সিদ্দিক।

পরিস্থিতি ‘খুবই ভয়াবহ’ হতে পারে বলে মন্তব্য করেন পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বেসরকারি পর্যটন সমিতির সভাপতি রাজা ইফতিখার খান। তিনি বলেন, পর্যটক আসার এ বিধিনিষেধ পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য বিধ্বংসী হবে। রাজা ইফতিখার বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না। কোনো বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কখনো এটা চাইতে পারে না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সব ধরন র পর স থ ত পদক ষ প র জন য প রস ত আবদ ল গতক ল আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজব্যবস্থা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য: সালাহউদ্দিন আহমদ

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত ইলেক্টোরাল কলেজব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘জনগণের ভোটাধিকার হরণে এ ব্যবস্থাকে আরেকটি ছলচাতুরী হিসেবে দেখা হচ্ছে।’

বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের তৃতীয় বৈঠকের আলোচনা শেষে বিকেলে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন সালহাউদ্দিন আহমদ।

বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভোটেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য। তিনি বলেন, ৭০ হাজার স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিকে ভোটার করে নির্বাচন করার প্রস্তাব তাদের কাছে এখনই গ্রহণযোগ্য নয়। ভবিষ্যতে যদি সংসদীয় আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সমঝোতা হয়, তখন তা বিবেচনার বিষয় হতে পারে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়টি উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকলে অতীতের অনেক নির্বাচনের অনিয়ম রোধ করা যেত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন থাকলেই নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা সম্ভব।

নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বর্তমানে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যে আইন রয়েছে, সেটি দুর্বল এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে অনুপযুক্ত। সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন এখন কার্যকর হলেও ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী আইন প্রণয়ন দরকার।

নির্বাচন কমিশনের জবাবদিহি আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেন সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিশনারদের অপসারণের বিধান থাকলেও আরও কিছু খুঁটিনাটি আইন তৈরি করতে হবে, যেন মিসকন্ডাক্ট বা অপব্যবহারের শাস্তি নিশ্চিত করা যায়।

এ ছাড়া মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্যও শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও কার্যকর আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন সালাহউদ্দিন আহমদ।

আরও পড়ুনকিছু ভিন্নমতসহ এনসিসির পক্ষে জামায়াত-এনসিপি, বিপক্ষে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল৫ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ