সময়ের বদলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেন কিছুতেই ছাড় দেবে না। নিজেকে যন্ত্রের কাছে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে হবে– আমরা মানুষ, এআই নই। বলতে গেলে অদৃশ্য যুদ্ধে নেমেছে সব এআই। আর কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি মানবসভ্যতা। ব্যক্তি থেকে দপ্তর, উৎপাদন, উন্নয়ন– সবখানে যন্ত্রের কাছে নির্ভরতা এখন দৃশ্যমান। লিখেছেন সাব্বিন হাসান
বিশেষ কিছু তথ্য জানতে চাইলে প্রধান মাধ্যম এখন সার্চ ইঞ্জিন। আগ্রহী অনেকের খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারণে গবেষণাকেন্দ্রিক বিশেষ কিছু সাইটে ঢুঁ না দিলে যেন সঠিক তথ্যের খোঁজ মেলে না। অনেক সাইটে গিয়ে প্রথমেই থমকে যেতে হয় প্রবেশাধিকারে। দৃশ্যমান ছোট চেকবক্সে ভাসমান হয়, আপনি যে রোবট নন, তা প্রমাণ করতে বক্সে ক্লিক করুন। অনেক সময় সাইট ভাইরাস আক্রান্ত হলে নিরাপত্তা নিশ্চিতে এমন অপশন জুড়ে দেয় সাইট কর্তৃপক্ষ। তখনও যন্ত্রের কাছে মানুষকে প্রমাণ দিতে হয় যে সত্যিকার অর্থেই মানব বুদ্ধির অংশ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নয়।
যান্ত্রিক নির্দেশনা মেনে বা আরও স্পষ্ট কথায় যন্ত্রের কাছে নিজের মনুষ্যত্বের প্রমাণ দেওয়ার পরই ওই ধরনের সাইটে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়। কিছুদিন আগে এমন পরীক্ষার কাজ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাঁধে দায়িত্ব দিয়ে নির্ভার ছিল বহু ওয়েবসাইট নির্মাতারা। ভবিষ্যতে এমন দায়িত্বের পরিধি আরও বহুমাত্রিক হতে চলেছে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলেছেন গবেষকরা। চাকরি বা নিয়োগের পরিসরে হাজারো পদে আবেদনকারীর মধ্যে কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট পদের জন্য বিশেষ যোগ্য, অফিস পরিচালনার জন্য কোন পদ্ধতি মেনে চলা উচিত, কর্মীদের নিজেদের কাজে কেমন প্রশিক্ষণ দিলে তা অফিসের সহায়ক হয়– এমন সবকিছুই যেন এবার নিয়ন্ত্রণ করবে যন্ত্র। সাধারণত এগুলো হিউম্যান রিসোর্স (এইচআর) বিভাগের কাজের মধ্যে পড়ে। ইতোমধ্যে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু সংস্থা এমন কাজে এআই প্রযুক্তির পূর্ণ সহায়তা নিতে শুরু করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে ক্রমান্বয়ে মানুষের কাজের নিয়ন্ত্রক হবে– এমন ভাবনা থেকে গল্প লিখেছেন অনেকে। এর আগে হলিউডের বেশ কিছু সায়েন্স ফিকশন ছবিতে সেসব কর্মযজ্ঞের দৃশ্যায়ন অনেকে দেখেছেন। গল্পই যে এত দ্রুত বাস্তবে জায়গা করে নেবে, তা হয়তো ভাবনায় আসেনি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষকরা বলছেন, এআই অ্যান্ড জেনারেল লার্নিং, জেনারেটিভ এআই, রোবটিক প্রসেস অটোমেশন (আরপিআই), অ্যাডভান্সড অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ডেটা সায়েন্স– এমন ঘরানার প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোনো সংস্থা তার কর্মী নিয়োগে নেওয়া সাক্ষাৎকারের প্রশ্ন ও সদুত্তরের ভিত্তিতে কর্মীর মানসিকতা বিশ্লেষণের কাজ সহজে করতে পারবে। অন্যদিকে, কর্মীর পেরোল হিসাব, অফিসের দাপ্তরিক পরিচালন পদ্ধতি ও অন্যসব নৈমিত্তিক কাজ নির্বিঘ্নে এবং দ্রুত করে দেবে এআই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসছে, তবে কি এবার ফুরিয়ে যাবে হিউম্যান রিসোর্স বিভাগের প্রয়োজন। অনেকে আগে থেকেই প্রযুক্তি ঘরানার দাপ্তরিক কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সহায়ক শক্তি হিসেবে বেছে নিয়েছে। অ্যাপল, মাইক্রোসফট, স্পেসএক্স, মেটা, গুগল ও ফেসবুক এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। জনসম্পদ বিভাগের প্রধানরা বলছেন, ইতোমধ্যে আমরা দাপ্তরিক কাজে কৃত্রিম প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। যার মাধ্যমে কর্মীদের নিয়োগ ও কর্মপদ্ধতি ঠিকঠাক যাচাই-বাছাই করা আগের তুলনায় সহজ হয়েছে। মানবসম্পদ বিভাগের অনেকের মতে, পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে মানুষ সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু যন্ত্র এমন দোষে দুষ্ট নয়, যদি না তাকে ভুল কমান্ড দেওয়া হয়। সে অর্থে এআই প্রযুক্তির নিরপেক্ষ ব্যবহারে নিয়োগের সাক্ষাৎকার নিলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। আমরা এখন অনেকাংশে যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। তাতে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে এআই শুধু প্রযুক্তি নয়, বরং মানদণ্ড প্রকাশে নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ মাধ্যম। অদূর ভবিষ্যতে মানবসম্পদ (এইচআর) বিভাগের কাজ হবে শুধু কৌশলগত দিকনির্দেশনা দেওয়া। বাকি কাজ সব যন্ত্রই সম্পাদনা করবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ত র ম ব দ ধ মত ত
এছাড়াও পড়ুন:
জুমার দিনের করণীয় ও বর্জনীয়
জুমার দিন—মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ বরকতময় দিন।
এটি শুধু সাপ্তাহিক নামাজের দিন নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, সামাজিক সংহতি ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের মহান সুযোগ।
নবীজি (সা.) বলেছেন—“জুমার দিনই দিনসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনেই আদম (আ.) সৃষ্টি হয়েছেন, এ দিনেই জান্নাতে প্রবেশ করেছেন, এবং এ দিনেই পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৫৪)
অতএব, জুমা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়—এটি ইসলামি সভ্যতার একটি কেন্দ্রবিন্দু।
এই দিনে কিছু কাজকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে, আবার কিছু কাজ থেকে কঠোরভাবে বারণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুনইসলামোফোবিয়া মোকাবিলায় মুসলিম নারীর করণীয়২৬ আগস্ট ২০২৫জুমার দিনের করণীয়১. গোসল করা
নবীজি (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুমার দিনে গোসল করে, উত্তমভাবে পবিত্রতা অর্জন করে, তারপর মসজিদে আসে, নীরবে খুতবা শোনে ও নামাজ পড়ে, তার এক জুমা থেকে পরের জুমা পর্যন্ত গুনাহ মাফ করা হয়।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৮৩)
জুমার দিনের এই গোসল বিশেষ ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।
২. পরিচ্ছন্ন পোশাক ও সুগন্ধি ব্যবহার
জুমার নামাজে যাওয়ার আগে মুসলমানকে সুন্দর পোশাক পরা ও সুগন্ধি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
নবীজি (সা.) বলেছেন, “জুমার দিনে তোমাদের জন্য সুন্দর পোশাক পরা এবং সুগন্ধি ব্যবহার করা উত্তম।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৫২৪৮)
এটি সামাজিক মর্যাদা ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতার প্রতীক।
৩. তাড়াতাড়ি মসজিদে যাওয়া
জুমার নামাজে আগে পৌঁছানোর জন্য বড় ফজিলত রয়েছে।
নবীজি (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রথম ঘণ্টায় জুমার জন্য যায়, সে যেন উট কোরবানি করল; দ্বিতীয় ঘণ্টায় গেলে গরু কোরবানি করল; তৃতীয় ঘণ্টায় গেলে ভেড়া কোরবানি করল; চতুর্থ ঘণ্টায় গেলে মুরগি কোরবানি করল; আর পঞ্চম ঘণ্টায় গেলে ডিম দান করল।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৮১)
অর্থাৎ, যত আগে যাবে, তত বেশি সওয়াব।
৪. খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনা
নবীজি (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি খুতবা চলাকালীন তার সঙ্গীকে বলে ‘চুপ করো’, সে-ও অনর্থক কথা বলল।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৩৪)
খুতবা চলাকালীন কথা বলা, ফোন ব্যবহার করা বা অমনোযোগ হওয়া নিষিদ্ধ।
৫. সুরা কাহফ তেলাওয়াত করা
জুমার দিনে সূরা কাহফ পড়ার বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
নবীজি (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহফ তেলাওয়াত করবে, তার জন্য দুই জুমার মধ্যবর্তী সময় আলোকিত হয়ে যাবে।” (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস: ৩৩৯২)
৬. দোয়া করা ও দরুদ পাঠ করা
জুমার দিনে এমন একটি সময় আছে, যখন দোয়া কবুল হয়।
নবীজি (সা.) বলেন, “জুমার দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যেখানে কোনো মুসলমান নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ তা অবশ্যই কবুল করেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৩৫)
অনেক আলেমের মতে, এই সময়টি আসরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
এছাড়া, জুমার দিনে বেশি বেশি দরুদ পাঠ করার নির্দেশও এসেছে, “তোমরা জুমার দিনে আমার প্রতি বেশি দরুদ পাঠ করো, কারণ তোমাদের দরুদ আমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১৫৩১)
আরও পড়ুনপ্রাকৃতিক দুর্যোগে করণীয় আমল২২ আগস্ট ২০২৪জুমার দিনের বর্জনীয়১. জুমার নামাজ ত্যাগ করা
নবীজি (সা.) কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন, “যে ব্যক্তি অলসতা বা উদাসীনতার কারণে তিনটি জুমা ত্যাগ করে, আল্লাহ তার হৃদয় সিল করে দেন।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১০৫২)
অর্থাৎ, ইচ্ছাকৃতভাবে জুমা বাদ দেওয়া ইমানের জন্য ভয়ংকর বিপদ।
২. জুমা বাদ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত থাকা
কোরআনে আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! যখন জুমার আহ্বান দেওয়া হয়, তখন আল্লাহর স্মরণে ছুটে যাও এবং ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করো।” (সুরা আল-জুমা, আয়াত: ৯)
জুমার সময় ব্যবসা-বাণিজ্য, অনলাইন কেনাকাটা বা অন্য ব্যস্ততা বড় গোনাহ।
৩. উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা
মসজিদে অন্যদের বিরক্ত করা, ফোনে কথা বলা, এমনকি নামাজের আগে অপ্রয়োজনে গল্প করা জুমার আদববিরোধী কাজ।
৪. খুতবার সময় চলাফেরা করা
খুতবা চলাকালে যেকোনো অযথা নড়াচড়া বা সামনে যাওয়া, নবীজি (সা.) বলেছেন, এতে “সওয়াব নষ্ট হয়।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৫৭)
৫. নামাজ শেষে গাফেল থাকা
জুমার পরপরই নামাজ বা দোয়া না করে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাওয়া উচিত নয়। আল্লাহ বলেন, “যখন নামাজ শেষ হবে, তখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ করো, কিন্তু আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো।” (সুরা জুমা, আয়াত: ১০)
অর্থাৎ, কাজ করবে ঠিকই, কিন্তু মনে যেন আল্লাহর স্মরণ থাকে।
জুমার দিনের তাৎপর্য
জুমা মুসলমানদের জন্য সামাজিক ঐক্যের প্রতীক। এদিনে মসজিদগুলোতে ধনী-গরিব, নেতা-জনতা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই এক কাতারে দাঁড়ায়।
নবীজি (সা.) বলেছেন, “জুমার দিনে একবার নামাজ আদায় করা সাত দিনের গোনাহ মাফের সমান।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৫৬)
জুমার দিন আমাদের আত্মার পরিশুদ্ধি, সমাজের ঐক্য এবং আল্লাহর রহমত লাভের সোনালি সুযোগ।
এই দিনে গোসল, পরিষ্কার পোশাক, সময়মতো নামাজে যাওয়া, খুতবা শোনা, সূরা কাহফ পাঠ ও দোয়া করা—সবই মুসলিম জীবনের সৌন্দর্য বাড়ায়।
অন্যদিকে অলসতা, ব্যবসা, ও অমনোযোগিতা আমাদের ইমানকে দুর্বল করে।
অতএব, প্রতিটি মুসলমানের উচিত জুমাকে কেবল ছুটির দিন নয়, বরং “আত্মার নবজাগরণের দিন” হিসেবে পালন করা।
আরও পড়ুনসাহাবিদের প্রতি মহানবী (সা.)-এর শেষ উপদেশ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫