বিশ শতকের শুরুতে অখণ্ড বাংলায় উপনিবেশবাদবিরোধী রাজনীতি প্রবল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তখনকার ব্রিটিশ-ভারতীয় ঔপনিবেশিক শাসকচক্র একে দমন করার কৌশল হিসেবে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। শাসক লর্ড কার্জন ছিলেন এর মুখ্য পরিকল্পনাকারী ও উদ্যোক্তা। তাদের নিশ্চিত উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের স্বার্থ রক্ষা। আঠারো শতকে এই বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ নির্বিঘ্ন করার স্বার্থে শাসক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেমন এ দেশের প্রধান দুই ধর্মীয় পরিচয়ধারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি গ্রহণ করেছিল, এবারেও তার ভিন্নতা হয়নি। পার্থক্য ঘটেছিল শুধু কোন সম্প্রদায়কে শাসককুল নিজ স্বার্থের পক্ষভুক্ত করবে তা নির্ধারণে। আঠারো শতকের কৌশলে তারা বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়কে নিজ পক্ষপুটে আশ্রয় দিয়ে নানাভাবে ফুলেফেঁপে ওঠার সুযোগ দিয়েছিল। শতাধিক বছরের ব্যবধানে এই সম্প্রদায়ের সুবিধাপ্রাপ্ত অংশ শিক্ষা, প্রশাসন, অর্থনীতি, বাণিজ্য সবদিক থেকে প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠলে শাসককুলের সঙ্গে স্বার্থের দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। কিন্তু শাসকশক্তি তা মানবে কেন? এবারে তারা বিভেদের নীতি ঠিক রেখে কৌশল বদলায়।
উপনিবেশবাদীদের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত এতদিনকার সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের স্বার্থে আঘাত করেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু একইসঙ্গে অখণ্ড বাংলার জনমানসে যে ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী দেশাত্মবোধ প্রবলভাবে জাগ্রত করেছিল সে-সত্যও অনস্বীকার্য। এই স্বাদেশিকতার জাগরণে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় ১৯০৫-এর ১৬ অক্টোবর। কিন্তু এর প্রস্তাব সরকারের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয় অনেক আগেই। শুরু থেকেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
এই প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে বিলাতি দ্রব্য বর্জন তথা বয়কট প্রস্তাব গৃহীত হলে দেশব্যাপী আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ এ ধরনের বয়কট বা বর্জন নীতির মতো নেতিবাচকতার সমর্থক না-হলেও তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে শুরুর দিকে ছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হওয়ার প্রায় আড়াই মাস পূর্বেই বয়কট আন্দোলনের শুরু। এই আড়াই মাসে রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গান রচনারও এক সমৃদ্ধ কাল। যেমন : ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’, ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে’, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি’, ‘আমি ভয় করব না’ প্রভৃতি গান ১৯০৫ সালের ভাদ্র-আশ্বিন মাসে রচিত।
তখনও বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। এ গানগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো বাংলার নিজস্ব সুরে বাঁধা। এতে রয়েছে বাউল, কীর্তন, রামপ্রসাদী, ভাটিয়ালি, সারিগান প্রভৃতির সুর। সাধারণ মানুষের কাছে এর বাণী যেমন সহজে পৌঁছায়, তেমনি এর সুরও সহজে তাদের মর্মে প্রবেশ করে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ সময় থেকেই দেশীয় সুরের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিলাতি দ্রব্য বর্জন তথা বয়কটের প্রতি সমর্থনের পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্ব দেন দেশবাসীর ঐক্যের প্রতি। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার দিনটিতে তাঁরই প্রস্তাবে ‘রাখিবন্ধন’ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়; তাতে রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় ছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার পর আন্দোলন যখন তীব্র হয়, তখনও রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন যাবৎ তাঁর সক্রিয়তা অব্যাহত রাখেন। এই কিছুদিন বলতে দু-মাসের মতো। অক্টোবরের প্রথমার্ধ থেকে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধ। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করে ক্রমশ তিনি এ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। অথচ আন্দোলন চলে ছ-বছরব্যাপী (১৯১১ পর্যন্ত)। তাঁর কাছে মনে হয়, এ আন্দোলনে উন্মাদনা ও উন্মত্ততাই প্রবল, গঠনমূলক উদ্যোগ তেমন নেই। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে ১৯০৫-এর ১০ ডিসেম্বরে এক পত্রে লেখেন, ‘উন্মাদনায় যোগ দিলে কিয়ৎপরিমাণে লক্ষ্যভ্রষ্ট হইতেই হয় এবং তাহার পরিণামে অবসাদ ভোগ করিতেই হয়। আমি তাই ঠিক করিয়াছি যে, অগ্নিকাণ্ডের আয়োজনে উন্মত্ত না হইয়া যতদিন আয়ু আছে, আমার এই প্রদীপটিকে জ্বালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব।’ ১৯০৬ সালের ২৮ মার্চ ‘বিদায়’ (খেয়া) কবিতায় লেখেন, ‘বিদায় দেহো, ক্ষম আমায় ভাই/ কাজের পথে আমি তো আর নাই।/ অনেকদূরে এলেম সাথে সাথে,/ চলেছিলেম সবাই হাতে হাতে।/.
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময়ে (১৯০৫-১১) রচিত হয়েছে তাঁর বহু প্রবন্ধ। আমরা এগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি প্রবন্ধ নিয়ে দেশ-সমাজ নিয়ে একালের চিন্তার বৈশিষ্ট্য যদি বিচার করি তাহলে তাঁর দূরদৃষ্টি লক্ষ করব। তিনি সমস্যার মূল হিসেবে চিহ্নিত করেন হিন্দু-মুসলিম অনৈক্যকে এবং এর জন্য প্রধানত দায়ী করেন হিন্দু সমাজকে।
‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ (শ্রাবণ ১৯০৭) প্রবন্ধে সমসময়ের অভিঘাতগুলোর নিবিড় বিশ্লেষণসহ আত্মসমালোচনা ও ভবিষ্যৎ করণীয়ের কথা প্রকাশিত হয়েছে। কঠোর ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের অবজ্ঞা ও মমত্বহীনতার প্রকাশই সমগ্র ঘটনায় যে প্রকট হয়ে উঠেছে তার যথার্থ উপলব্ধি এখানে আছে। তাঁর মতে, এর ফলে দেশবাসীর মনে অপমানের ব্যথার পাশাপাশি আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। বাংলার জনগণের মধ্যেকার বিভক্তি-বিচ্ছিন্নতাই সরকারের এরূপ উপেক্ষার কারণ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার বাংলাকে যে ভাগ করেছে সেটা বাহ্যিক। তাঁর দৃষ্টিতে, আমাদের জনগণের মধ্যে বিভক্তির বিষ বিপুলভাবে বিদ্যমান, সরকার তার সুযোগ নিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ‘ইংরেজ মুসলমানদের গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছে’ এমন অভিযোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ কথা যদি সত্যও হয় তবু ইংরেজদের এমন সুযোগসন্ধানী কার্যক্রমে রাগ করে তো কোনো লাভ নেই। বরং মুসলমানকে হিন্দুর বিরুদ্ধে কে লাগাল তা নিয়ে ভাবার চেয়ে ভাবা দরকার, ছিদ্র না জেনে শনি তো প্রবেশ করতে পারে না। তাঁর বিবেচনায়, শনির চেয়ে ছিদ্র সম্পর্কেই বেশি সাবধান হওয়া দরকার। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেন এক ঐতিহাসিক সত্য। বলেন : হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক দিন ধরে চলে-আসা একটা পাপ আছে। এর ফল ভোগ না করে আমাদের কোনোমতে নিষ্কৃতি নাই। তিনি বলেন, অভ্যস্ত পাপের ব্যাপারে সচেতনতা থাকে না। দুই সম্প্রদায়ের ভেতরকার কলুষতার দিকটি বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে এমন বীভৎস আকারে দেখা না দিলে হিন্দু সমাজ একে স্বীকারই করত না। তাঁর মতে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার বিরোধকে আমাদের স্বীকার করতেই হবে। বলেন, বহুশত বছর পাশে পাশে থাকলেও প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত ধর্মবিহিত তা আমাদের মধ্যে হয়নি। বরং আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরে এমন এক পাপ আমরা পোষণ করেছি, যার ফলে একত্রে মিলেও বিচ্ছেদকে ঠেকাতে পারিনি। এক ফরাসে হিন্দু-মুসলমানের না-বসা, মুসলমানের জন্য হুঁকার জল ফেলে দেওয়া, মুসলমানের প্রতি ঘৃণা প্রভৃতিকে তিনি পাপ হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, আমাদের ভেতরকার এই পাপই ইংরেজের শক্তি। তাঁর অভিমত, বিদেশি রাজা চলে গেলেই দেশ যে আমাদের স্বদেশ হয়ে উঠবে তা নয়। আমরা মানুষ হিসেবে যদি এক না হতে পারি সেটা লজ্জা, সেটা অধর্ম।
মজঃফরপুর হত্যাকাণ্ড, যেখানে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর ছুড়ে দেওয়া বোমার আঘাতে দুই ইংরেজের মৃত্যু ঘটে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে লেখা ‘পথ ও পাথেয়’ (জ্যৈষ্ঠ ১৯০৮) প্রবন্ধে ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি বাঙালি জাতির আত্মসমালোচনাও করেন তিনি। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বাঙালি যে উত্তেজনাকর আবেগ প্রদর্শন করে তা যে আন্দোলনকে সফল করতে পারবে না, বরং দেশের কল্যাণের জন্য প্রয়োজন যে তপস্যার সেই অনুভূতিকেই তিনি এখানে গুরুত্ব দেন। সাময়িক উত্তেজনাকে তিনি স্ফুলিঙ্গ বলে অভিহিত করে বলেন, ‘স্ফুলিঙ্গের সঙ্গে শিখার যে প্রভেদ উত্তেজনার সঙ্গে শক্তির সেই প্রভেদ’। স্ফুলিঙ্গ অন্ধকার দূর করতে পারে না, তার জন্য প্রয়োজন হয় প্রদীপের। প্রদীপের জন্য সলতে পাকাতে হয়, তেল জোগাতে হয়। তিনি বলেন, সাময়িক উত্তেজনার আবেগ দিয়ে বৃহত্তর কল্যাণসাধন সম্ভব না। বলেন, মাতাল হয়ে মানুষ খুন করা যায়, যুদ্ধ করা যায় না। সেজন্য প্রয়োজন স্থিরবুদ্ধির। প্রবন্ধের শেষে তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। ইংরেজ তার নির্মমতা, ঔদাসীন্য ও ঔদ্ধত্য দ্বারা ভারতের সকলকেই ব্যথিত করে তুলেছে। তাই বলে ইংরেজের প্রতি সর্বসাধারণের বিদ্বেষই যে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে তুলবে তাও না। অথচ শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশের মঙ্গলসাধনের জন্য এই ঐক্যের বিকল্প নেই। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ দেশের উচ্চ-নীচ, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান সকলের মধ্যে হৃদয়ের যোগ সৃষ্টির আহ্বান জানান।
‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধ সম্বন্ধে কোনো কোনো পাঠকের উপলব্ধির অনুকূলতার অভাব লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ ‘সমস্যা’ (আষাঢ় ১৯০৮) নামে আরেকটি প্রবন্ধ লেখেন। এ প্রবন্ধেও তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির অন্যায়ের সমালোচনা করে বলেন, তারা তো এ দেশবাসীকে মানুষ বলেই গণ্য করতে চায় না। শাসক হিসেবে তারা মনে করে শাসিতেরই শুধু জবাবদিহি করার প্রয়োজন, শাসকের নয়। এ প্রবন্ধেও রবীন্দ্রনাথ শাসকের অন্যায়ের প্রতিকার সাধনের জন্য ভারতবাসীর আপন শক্তি অর্জনের ওপর গুরুত্ব দেন এবং মনে করেন, ঐক্যের মাধ্যমেই এই শক্তি অর্জন সম্ভব। অনৈক্যের দুর্বলতা দেশের কল্যাণ সাধনেরও অন্তরায়। যারা মনে করেন, ইংরেজ চলে গেলেই আমাদের অনৈক্যজনিত ছিদ্র পূরণ হবে তাদের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারেননি। তিনি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেকার দূরত্বকে কল্যাণবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন। ইংরেজই মুসলমানকে হিন্দুর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার দূরত্বের ক্ষেত্রে হিন্দুর কোনো দায়িত্ব নেই – এটা মনে করেন না তিনি। বলেন, ইংরেজ যদি মুসলমানকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সত্যই দাঁড় করিয়ে থাকে তাহলে ইংরেজ একটি বড় উপকার করেছে। কেননা, হিন্দু সমাজ এতদিন মুসলমান সম্পর্কে অসচেতন ছিল, দুই সম্প্রদায়ের দূরত্ব সম্পর্কে অন্ধ ছিল। এখন এই দূরত্ব অতিক্রম করার চেষ্টা করতে হবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা যে পরস্পরকে শ্রদ্ধা করি নাই, সহায়তা করি নাই, আমরা যে পরস্পরকে চিনিবার মাত্রও চেষ্টা করি নাই...– পরস্পর সম্বন্ধে আমাদের সেই ঔদাসীন্য অবজ্ঞা সেই বিরোধ আমাদিগকে একান্তই ঘুচাইতে হইবে...’। এটা শুধু ইংরেজদের কাছে শক্তি প্রদর্শনের জন্যই না। তাঁর মতে, এটা না হলে ধর্ম পীড়িত হবে, মনুষ্যত্ব সংকুচিত হবে। নির্ভীক নির্বাধ বিপুল মনুষ্যত্বের অধিকারী হওয়ার জন্যই আমাদের পরস্পরকে ধর্মের বন্ধনে বাঁধতে হবে। এ ছাড়া মানুষ হিসেবে বড় হওয়া যাবে না, সত্যে পৌঁছা সম্ভব হবে না। ভারতবর্ষে যারা আছে আর যারা এসেছে সকলকে নিয়েই সম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে এবং কিছুদিনের মধ্যে আন্দোলন থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে রবীন্দ্রনাথ এভাবেই সংকটের মূলসহ দেশের আত্মাকে চিহ্নিত করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের চণ্ডনীতির চেয়ে তাঁর কাছে এ দেশের দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যকার বিভেদ ও অনৈক্যই সংকটের মূল বলে প্রতিভাত হয়েছিল। অতঃপর তিনি তাঁর মননশীল ও সৃষ্টিশীল বিভিন্ন রচনায় ও কার্যক্রমে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিভেদভঞ্জনের চেষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের সারার্থকে যদি দেশের মানুষ যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হতো, এবং ঐক্যের পক্ষে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হতো, তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিভেদ থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারতাম। একশ বছরের বেশি কাল আগে লেখা রবীন্দ্রনাথের এসব প্রবন্ধের বক্তব্য আজও তাই খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। মনে হয়, রবীন্দ্রনাথই হতে পারেন আমাদের ঐক্যের প্রতীক।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ঔপন ব শ ক শ ম সলম ন র ন র জন য প রবন ধ সরক র র কর ছ ল র জন ত আম দ র কল য ণ জন য প অন ক য ত হয় ছ হওয় র
এছাড়াও পড়ুন:
ঐক্যের প্রতীক হতে পারেন রবীন্দ্রনাথ
বিশ শতকের শুরুতে অখণ্ড বাংলায় উপনিবেশবাদবিরোধী রাজনীতি প্রবল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তখনকার ব্রিটিশ-ভারতীয় ঔপনিবেশিক শাসকচক্র একে দমন করার কৌশল হিসেবে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। শাসক লর্ড কার্জন ছিলেন এর মুখ্য পরিকল্পনাকারী ও উদ্যোক্তা। তাদের নিশ্চিত উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের স্বার্থ রক্ষা। আঠারো শতকে এই বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ নির্বিঘ্ন করার স্বার্থে শাসক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেমন এ দেশের প্রধান দুই ধর্মীয় পরিচয়ধারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি গ্রহণ করেছিল, এবারেও তার ভিন্নতা হয়নি। পার্থক্য ঘটেছিল শুধু কোন সম্প্রদায়কে শাসককুল নিজ স্বার্থের পক্ষভুক্ত করবে তা নির্ধারণে। আঠারো শতকের কৌশলে তারা বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়কে নিজ পক্ষপুটে আশ্রয় দিয়ে নানাভাবে ফুলেফেঁপে ওঠার সুযোগ দিয়েছিল। শতাধিক বছরের ব্যবধানে এই সম্প্রদায়ের সুবিধাপ্রাপ্ত অংশ শিক্ষা, প্রশাসন, অর্থনীতি, বাণিজ্য সবদিক থেকে প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠলে শাসককুলের সঙ্গে স্বার্থের দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। কিন্তু শাসকশক্তি তা মানবে কেন? এবারে তারা বিভেদের নীতি ঠিক রেখে কৌশল বদলায়।
উপনিবেশবাদীদের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত এতদিনকার সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের স্বার্থে আঘাত করেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু একইসঙ্গে অখণ্ড বাংলার জনমানসে যে ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী দেশাত্মবোধ প্রবলভাবে জাগ্রত করেছিল সে-সত্যও অনস্বীকার্য। এই স্বাদেশিকতার জাগরণে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় ১৯০৫-এর ১৬ অক্টোবর। কিন্তু এর প্রস্তাব সরকারের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয় অনেক আগেই। শুরু থেকেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
এই প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে বিলাতি দ্রব্য বর্জন তথা বয়কট প্রস্তাব গৃহীত হলে দেশব্যাপী আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ এ ধরনের বয়কট বা বর্জন নীতির মতো নেতিবাচকতার সমর্থক না-হলেও তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে শুরুর দিকে ছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হওয়ার প্রায় আড়াই মাস পূর্বেই বয়কট আন্দোলনের শুরু। এই আড়াই মাসে রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গান রচনারও এক সমৃদ্ধ কাল। যেমন : ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’, ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে’, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি’, ‘আমি ভয় করব না’ প্রভৃতি গান ১৯০৫ সালের ভাদ্র-আশ্বিন মাসে রচিত।
তখনও বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। এ গানগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো বাংলার নিজস্ব সুরে বাঁধা। এতে রয়েছে বাউল, কীর্তন, রামপ্রসাদী, ভাটিয়ালি, সারিগান প্রভৃতির সুর। সাধারণ মানুষের কাছে এর বাণী যেমন সহজে পৌঁছায়, তেমনি এর সুরও সহজে তাদের মর্মে প্রবেশ করে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ সময় থেকেই দেশীয় সুরের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিলাতি দ্রব্য বর্জন তথা বয়কটের প্রতি সমর্থনের পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্ব দেন দেশবাসীর ঐক্যের প্রতি। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার দিনটিতে তাঁরই প্রস্তাবে ‘রাখিবন্ধন’ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়; তাতে রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় ছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার পর আন্দোলন যখন তীব্র হয়, তখনও রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন যাবৎ তাঁর সক্রিয়তা অব্যাহত রাখেন। এই কিছুদিন বলতে দু-মাসের মতো। অক্টোবরের প্রথমার্ধ থেকে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধ। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করে ক্রমশ তিনি এ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। অথচ আন্দোলন চলে ছ-বছরব্যাপী (১৯১১ পর্যন্ত)। তাঁর কাছে মনে হয়, এ আন্দোলনে উন্মাদনা ও উন্মত্ততাই প্রবল, গঠনমূলক উদ্যোগ তেমন নেই। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে ১৯০৫-এর ১০ ডিসেম্বরে এক পত্রে লেখেন, ‘উন্মাদনায় যোগ দিলে কিয়ৎপরিমাণে লক্ষ্যভ্রষ্ট হইতেই হয় এবং তাহার পরিণামে অবসাদ ভোগ করিতেই হয়। আমি তাই ঠিক করিয়াছি যে, অগ্নিকাণ্ডের আয়োজনে উন্মত্ত না হইয়া যতদিন আয়ু আছে, আমার এই প্রদীপটিকে জ্বালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব।’ ১৯০৬ সালের ২৮ মার্চ ‘বিদায়’ (খেয়া) কবিতায় লেখেন, ‘বিদায় দেহো, ক্ষম আমায় ভাই/ কাজের পথে আমি তো আর নাই।/ অনেকদূরে এলেম সাথে সাথে,/ চলেছিলেম সবাই হাতে হাতে।/... আর তো চলা হয় না সাথে সাথে।’ আন্দোলনের সক্রিয়তা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলেও এ বিষয়ক চিন্তা থেকে তিনি নিজেকে প্রত্যাহার করেননি। সৃষ্টিশীল ও মননশীল বিভিন্ন লেখায়, বক্তৃতায় তিনি অব্যাহতভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁর অভিমত। তিনি বঙ্গভঙ্গ চাননি, কিন্তু এ নিয়ে যেরূপ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে তার প্রকৃতির সঙ্গেও একমত হতে পারেননি।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময়ে (১৯০৫-১১) রচিত হয়েছে তাঁর বহু প্রবন্ধ। আমরা এগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি প্রবন্ধ নিয়ে দেশ-সমাজ নিয়ে একালের চিন্তার বৈশিষ্ট্য যদি বিচার করি তাহলে তাঁর দূরদৃষ্টি লক্ষ করব। তিনি সমস্যার মূল হিসেবে চিহ্নিত করেন হিন্দু-মুসলিম অনৈক্যকে এবং এর জন্য প্রধানত দায়ী করেন হিন্দু সমাজকে।
‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ (শ্রাবণ ১৯০৭) প্রবন্ধে সমসময়ের অভিঘাতগুলোর নিবিড় বিশ্লেষণসহ আত্মসমালোচনা ও ভবিষ্যৎ করণীয়ের কথা প্রকাশিত হয়েছে। কঠোর ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের অবজ্ঞা ও মমত্বহীনতার প্রকাশই সমগ্র ঘটনায় যে প্রকট হয়ে উঠেছে তার যথার্থ উপলব্ধি এখানে আছে। তাঁর মতে, এর ফলে দেশবাসীর মনে অপমানের ব্যথার পাশাপাশি আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। বাংলার জনগণের মধ্যেকার বিভক্তি-বিচ্ছিন্নতাই সরকারের এরূপ উপেক্ষার কারণ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার বাংলাকে যে ভাগ করেছে সেটা বাহ্যিক। তাঁর দৃষ্টিতে, আমাদের জনগণের মধ্যে বিভক্তির বিষ বিপুলভাবে বিদ্যমান, সরকার তার সুযোগ নিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ‘ইংরেজ মুসলমানদের গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছে’ এমন অভিযোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ কথা যদি সত্যও হয় তবু ইংরেজদের এমন সুযোগসন্ধানী কার্যক্রমে রাগ করে তো কোনো লাভ নেই। বরং মুসলমানকে হিন্দুর বিরুদ্ধে কে লাগাল তা নিয়ে ভাবার চেয়ে ভাবা দরকার, ছিদ্র না জেনে শনি তো প্রবেশ করতে পারে না। তাঁর বিবেচনায়, শনির চেয়ে ছিদ্র সম্পর্কেই বেশি সাবধান হওয়া দরকার। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেন এক ঐতিহাসিক সত্য। বলেন : হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক দিন ধরে চলে-আসা একটা পাপ আছে। এর ফল ভোগ না করে আমাদের কোনোমতে নিষ্কৃতি নাই। তিনি বলেন, অভ্যস্ত পাপের ব্যাপারে সচেতনতা থাকে না। দুই সম্প্রদায়ের ভেতরকার কলুষতার দিকটি বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে এমন বীভৎস আকারে দেখা না দিলে হিন্দু সমাজ একে স্বীকারই করত না। তাঁর মতে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার বিরোধকে আমাদের স্বীকার করতেই হবে। বলেন, বহুশত বছর পাশে পাশে থাকলেও প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত ধর্মবিহিত তা আমাদের মধ্যে হয়নি। বরং আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরে এমন এক পাপ আমরা পোষণ করেছি, যার ফলে একত্রে মিলেও বিচ্ছেদকে ঠেকাতে পারিনি। এক ফরাসে হিন্দু-মুসলমানের না-বসা, মুসলমানের জন্য হুঁকার জল ফেলে দেওয়া, মুসলমানের প্রতি ঘৃণা প্রভৃতিকে তিনি পাপ হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, আমাদের ভেতরকার এই পাপই ইংরেজের শক্তি। তাঁর অভিমত, বিদেশি রাজা চলে গেলেই দেশ যে আমাদের স্বদেশ হয়ে উঠবে তা নয়। আমরা মানুষ হিসেবে যদি এক না হতে পারি সেটা লজ্জা, সেটা অধর্ম।
মজঃফরপুর হত্যাকাণ্ড, যেখানে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর ছুড়ে দেওয়া বোমার আঘাতে দুই ইংরেজের মৃত্যু ঘটে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে লেখা ‘পথ ও পাথেয়’ (জ্যৈষ্ঠ ১৯০৮) প্রবন্ধে ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি বাঙালি জাতির আত্মসমালোচনাও করেন তিনি। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বাঙালি যে উত্তেজনাকর আবেগ প্রদর্শন করে তা যে আন্দোলনকে সফল করতে পারবে না, বরং দেশের কল্যাণের জন্য প্রয়োজন যে তপস্যার সেই অনুভূতিকেই তিনি এখানে গুরুত্ব দেন। সাময়িক উত্তেজনাকে তিনি স্ফুলিঙ্গ বলে অভিহিত করে বলেন, ‘স্ফুলিঙ্গের সঙ্গে শিখার যে প্রভেদ উত্তেজনার সঙ্গে শক্তির সেই প্রভেদ’। স্ফুলিঙ্গ অন্ধকার দূর করতে পারে না, তার জন্য প্রয়োজন হয় প্রদীপের। প্রদীপের জন্য সলতে পাকাতে হয়, তেল জোগাতে হয়। তিনি বলেন, সাময়িক উত্তেজনার আবেগ দিয়ে বৃহত্তর কল্যাণসাধন সম্ভব না। বলেন, মাতাল হয়ে মানুষ খুন করা যায়, যুদ্ধ করা যায় না। সেজন্য প্রয়োজন স্থিরবুদ্ধির। প্রবন্ধের শেষে তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। ইংরেজ তার নির্মমতা, ঔদাসীন্য ও ঔদ্ধত্য দ্বারা ভারতের সকলকেই ব্যথিত করে তুলেছে। তাই বলে ইংরেজের প্রতি সর্বসাধারণের বিদ্বেষই যে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে তুলবে তাও না। অথচ শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশের মঙ্গলসাধনের জন্য এই ঐক্যের বিকল্প নেই। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ দেশের উচ্চ-নীচ, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান সকলের মধ্যে হৃদয়ের যোগ সৃষ্টির আহ্বান জানান।
‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধ সম্বন্ধে কোনো কোনো পাঠকের উপলব্ধির অনুকূলতার অভাব লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ ‘সমস্যা’ (আষাঢ় ১৯০৮) নামে আরেকটি প্রবন্ধ লেখেন। এ প্রবন্ধেও তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির অন্যায়ের সমালোচনা করে বলেন, তারা তো এ দেশবাসীকে মানুষ বলেই গণ্য করতে চায় না। শাসক হিসেবে তারা মনে করে শাসিতেরই শুধু জবাবদিহি করার প্রয়োজন, শাসকের নয়। এ প্রবন্ধেও রবীন্দ্রনাথ শাসকের অন্যায়ের প্রতিকার সাধনের জন্য ভারতবাসীর আপন শক্তি অর্জনের ওপর গুরুত্ব দেন এবং মনে করেন, ঐক্যের মাধ্যমেই এই শক্তি অর্জন সম্ভব। অনৈক্যের দুর্বলতা দেশের কল্যাণ সাধনেরও অন্তরায়। যারা মনে করেন, ইংরেজ চলে গেলেই আমাদের অনৈক্যজনিত ছিদ্র পূরণ হবে তাদের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারেননি। তিনি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেকার দূরত্বকে কল্যাণবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন। ইংরেজই মুসলমানকে হিন্দুর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার দূরত্বের ক্ষেত্রে হিন্দুর কোনো দায়িত্ব নেই – এটা মনে করেন না তিনি। বলেন, ইংরেজ যদি মুসলমানকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সত্যই দাঁড় করিয়ে থাকে তাহলে ইংরেজ একটি বড় উপকার করেছে। কেননা, হিন্দু সমাজ এতদিন মুসলমান সম্পর্কে অসচেতন ছিল, দুই সম্প্রদায়ের দূরত্ব সম্পর্কে অন্ধ ছিল। এখন এই দূরত্ব অতিক্রম করার চেষ্টা করতে হবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা যে পরস্পরকে শ্রদ্ধা করি নাই, সহায়তা করি নাই, আমরা যে পরস্পরকে চিনিবার মাত্রও চেষ্টা করি নাই...– পরস্পর সম্বন্ধে আমাদের সেই ঔদাসীন্য অবজ্ঞা সেই বিরোধ আমাদিগকে একান্তই ঘুচাইতে হইবে...’। এটা শুধু ইংরেজদের কাছে শক্তি প্রদর্শনের জন্যই না। তাঁর মতে, এটা না হলে ধর্ম পীড়িত হবে, মনুষ্যত্ব সংকুচিত হবে। নির্ভীক নির্বাধ বিপুল মনুষ্যত্বের অধিকারী হওয়ার জন্যই আমাদের পরস্পরকে ধর্মের বন্ধনে বাঁধতে হবে। এ ছাড়া মানুষ হিসেবে বড় হওয়া যাবে না, সত্যে পৌঁছা সম্ভব হবে না। ভারতবর্ষে যারা আছে আর যারা এসেছে সকলকে নিয়েই সম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে এবং কিছুদিনের মধ্যে আন্দোলন থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে রবীন্দ্রনাথ এভাবেই সংকটের মূলসহ দেশের আত্মাকে চিহ্নিত করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের চণ্ডনীতির চেয়ে তাঁর কাছে এ দেশের দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যকার বিভেদ ও অনৈক্যই সংকটের মূল বলে প্রতিভাত হয়েছিল। অতঃপর তিনি তাঁর মননশীল ও সৃষ্টিশীল বিভিন্ন রচনায় ও কার্যক্রমে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিভেদভঞ্জনের চেষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের সারার্থকে যদি দেশের মানুষ যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হতো, এবং ঐক্যের পক্ষে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হতো, তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিভেদ থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারতাম। একশ বছরের বেশি কাল আগে লেখা রবীন্দ্রনাথের এসব প্রবন্ধের বক্তব্য আজও তাই খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। মনে হয়, রবীন্দ্রনাথই হতে পারেন আমাদের ঐক্যের প্রতীক।