জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠন বা সংস্কারের লক্ষ্যে আলোচনা মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ধারাবাহিকতা। চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই আকাঙ্ক্ষা উন্মুক্ত হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা সবাই ইতিহাসের এমন একটা মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত হয়েছি, যখন একটি গণতান্ত্রিক এবং জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র বিনির্মাণের মাধ্যমে সব নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং সে অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার রূপরেখা তৈরির চেষ্টা করছি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা, যা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পথরেখা কেমন হবে তা নির্দেশ করবে।

সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের এল.

ডি হলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন আলী রীয়াজ।

আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ছাড়াও সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম এবং সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সের নেতৃত্বে আলোচনায় দলটির সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপিকা এ এন রাশেদা, কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, অনিরুদ্ধ দাশ অঞ্জন এবং সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষসহ ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করেন।

সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এই কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়।

গত ২৩ মার্চ সিপিবি ঐকমত্য কমিশনে সংস্কার বিষয়ক তাদের প্রস্তাবনা জমা দেয়। সে প্রেক্ষিতে দলটির সঙ্গে আজ আলোচনায় বসে কমিশন। ইতোমধ্যে সিপিবিসহ ৩২টি রাজনৈতিক দল কমিশনের সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় অংশ নিয়েছে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আল র য় জ র লক ষ য

এছাড়াও পড়ুন:

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো জরুরি

কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন—এটিসহ সংবিধান সংস্কারে সাতটি প্রস্তাব তুলে ধরেছে নাগরিক জোট। এসব প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, দেশের বিদ্যমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা দেওয়া আছে। দেশের আইনি কাঠামো, প্রতিষ্ঠানগুলো এমন ছিল যে এখানে স্বৈরাচারের আবির্ভাব সুনিশ্চিত ছিল। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্ষমতার ভারসাম্য এনে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো।

গতকাল রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে ‘সংবিধান সংস্কারে নাগরিক জোটের ৭ প্রস্তাব’ তুলে ধরা হয়। তাদের প্রস্তাবের ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। তবে সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে দলগুলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে যে বক্তব্য দিয়েছিল, এখানেও একই বক্তব্য তুলে ধরে।

রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো সংস্কারে নাগরিক উদ্যোগ ‘নাগরিক কোয়ালিশন’ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ সাহান নাগরিক জোটের সাত প্রস্তাব তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য নাগরিক জোটের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য দুটি পথরেখা তুলে ধরেন লেখক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক জিয়া হাসান।

বিদ্যমান সংবিধানে নির্বাহী বিভাগের কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রীকে অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজ সহসভাপতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনগুরুত্বপূর্ণ হলো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো

এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন—এ প্রস্তাবের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, এটি খুব জনপ্রিয় দাবি। এটি তাঁরও দাবি। কিন্তু এই দাবি শুধু করলেই হবে না। ‘কনভিন্সিং আর্গুমেন্ট’ করতে হবে। পৃথিবীর কোন কোন দেশে এটা আছে, তা দেখতে হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদে থাকতে পারবেন, এমন বিধান আসলে ভারত, যুক্তরাজ্য কোথাও নেই।

এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এমন বিধান করা হলেও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মনে করেন আইন উপদেষ্টা। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ধরুন, দুই মেয়াদের জন্য সালাহউদ্দিন (বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য) ভাই প্রধানমন্ত্রী হলেন। এরপর তাঁর স্ত্রী দুই মেয়াদে হলেন। এরপর তাঁর সন্তান দুই মেয়াদে হলেন।’

প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না, এটা সমাধান বলে মনে করেন না আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো। ভারতে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বা পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন। আর বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করেন। তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করার দরকার আছে। কিন্তু ‘কনভিন্সিং আর্গুমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এমন বিধান করা হলেও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মনে করেন আইন উপদেষ্টা। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ধরুন, দুই মেয়াদের জন্য সালাহউদ্দিন (বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য) ভাই প্রধানমন্ত্রী হলেন। এরপর তাঁর স্ত্রী দুই মেয়াদে হলেন। এরপর তাঁর সন্তান দুই মেয়াদে হলেন।’

সংস্কার বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, জাতীয় সংসদ সংবিধান সংশোধন করে। সংবিধান পরিষদ নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। নতুন সংবিধান প্রণয়ন হতে পার্শ্ববর্তী দেশে আট-নয় বছর লেগেছে, এমন উদাহরণ আছে। নতুন সংবিধান প্রণয়ন হতে বহুদিন লাগতে পারে।

এখন এ জন্য কি ১৯৭২ সালের সংবিধানে চলবে? এমন প্রশ্ন রেখে আসিফ নজরুল বলেন, ‘নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান যে সংসদ থাকবে, যে সংসদটা সংবিধান সংসদ হিসেবে কাজ করবে, তারা ৭২–এর সংবিধানের প্রয়োজনীয় অ্যামেন্ডমেন্টগুলো (সংশোধনী) করে ফেলবে। এটা আপনাদের ইমপ্রুভ করতে হবে যে গণপরিষদ হিসেবে যখন সে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কাজ করতে থাকবে—এটা করতে আমার ধারণা দু–তিন বছর লাগতে পারে।’

প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা

একটি রিপাবলিক তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে উল্লেখ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বিদ্যমান সংবিধানে নির্বাহী বিভাগের কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রীকে অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ‘একজন শেখ হাসিনা’ তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধানে কোনো ধরনের বাধা ছিল না।

১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর প্রসঙ্গ টেনে আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশ যখন সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রবেশ করল, তখন রাষ্ট্রপতির হাতে যে অভাবনীয় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, সেই ক্ষমতার প্রতিটি অংশ প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যক্তির আধিপত্য—সবকিছু মিলেই এই ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন তৈরি হয়েছে।

দুই মেয়াদ নয়, কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—সংস্কার কমিশন এমন প্রস্তাব করেছে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতিতে প্রধানমন্ত্রীর ‘টার্ম লিমিট’ করা হয় না। তাই বাংলাদেশেও এটা করা যাবে না—এই যুক্তি তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করেছে। এর আগে কোথাও এই ব্যবস্থা ছিল?

ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে সংবিধান সংস্কার কমিশন যেসব প্রস্তাব করেছে, তার একটি হলো রাষ্ট্রের তিন বিভাগের সমন্বয়ে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের জন্য নাম দেবে এই কাউন্সিল। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, অতীতে ব্যক্তিগত পছন্দে নিয়োগ হয়েছে। এনসিসি গঠন করা হলে এ ক্ষেত্রে তিন অঙ্গের প্রতিনিধিরা একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো সংস্কার নয়: খসরু
  • সবাই মিলে রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠন করা হবে: আলী রীয়াজ
  • রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে আলোচনা রাজনৈতিক দলগুলোর সংগ্রামের ধারাবাহিকতা: আলী রীয়াজ
  • ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সিপিবির বৈঠক চলছে
  • যুক্তরাষ্ট্র–চীন আলোচনায় বড় অগ্রগতি, ৯০ দিনের জন্য শুল্ক কমাতে ঐকমত্য
  • ফ্যাসিস্ট শাসকের পলায়ন গণতন্ত্রের প্রাথমিক বিজয়: আলী রীয়াজ 
  • ফ্যাসিস্ট শাসকের পলায়নের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রাথমিক বিজয় হয়েছে: আলী রীয়াজ
  • প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো জরুরি
  • সংবিধান পুনর্লিখনের পক্ষে নয় গণফোরাম