ইসরায়েল-ইরান (সঙ্গে আমেরিকাও) যুদ্ধ দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়াচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে কিছু অন্তঃসারশূন্য হুমকি দিয়েছেন, কিন্তু যুদ্ধে সরাসরি আমেরিকার হস্তক্ষেপ করার কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেননি।

ইউরোপীয়রা আরেকটি বড় মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের ঝুঁকি এড়াতে চায়। কারণ, ইতিমধ্যে ইরাক-সিরিয়া যুদ্ধের পরিণতিতে লাখ লাখ শরণার্থীর স্রোত পুরো ইউরোপীয় কল্যাণরাষ্ট্রের বন্দোবস্তকেই নড়বড়ে করে দিয়েছে। ইরানের ৯ কোটি  মানুষের স্রোত ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে। এমন সব কারণে ইউরোপীয়রা যুদ্ধ বন্ধে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তা কাজ করবে কি না, তা নির্ভর করবে ইসরায়েল ও আমেরিকার ডিপস্টেটের ওপর।

এখন পর্যন্ত যুদ্ধ পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে এটি ওয়ার অব এট্রিশন; অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যুদ্ধটি যদি সত্যি সত্যি একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে রূপ নেয়, সে ক্ষেত্রে কী ঘটতে পারে?

সম্ভাবনা আছে তিনটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটার। 

প্রথমত, ইসরায়েলের কোনো দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। তারা সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে (স্যামসন অপশন) ইরানে পারমাণবিক বোমা হামলা চালাতে পারে। তবে তা তাদের চূড়ান্ত পরাজয় ঠেকাতে পারবে বলে মনে হয় না।

দ্বিতীয়ত, প্রলম্বিত যুদ্ধে ইরান কার্যত একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হয়ে পড়বে। এর সব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু ‘মাটির নিচের ইরান’ প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।

তৃতীয়ত, আমেরিকান সাম্রাজ্যের পতন হবে এবং আমেরিকা একটি দীর্ঘস্থায়ী অভ্যন্তরীণ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। আমেরিকান জায়নবাদের যবনিকাপাত হবে ও তার নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটবে। প্রতিটি ঘটনার পরিণতি হবে সুদূরপ্রসারী। এসব বিষয়ের কয়েকটি আঙ্গিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই লেখায়।

১.

ইসরায়েল একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্যের কোঠায়। এর অনেকগুলো রাজনৈতিক ও সামরিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে দুটি কারণ উল্লেখযোগ্য।

প্রথমত, ইসরায়েলের কোনো কৌশলগত গভীরতা (স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ) নেই। ইরানের তা আছে। অর্থাৎ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে ইসরায়েলের প্রায় সব অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে এটি একটি মিনি গাজায় পরিণত হবে। ইসরায়েল বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। মনে রাখতে হবে যে ইসরায়েলের বেশির ভাগ নাগরিকের একাধিক পশ্চিমা নাগরিকত্ব রয়েছে। প্রায় সাত লাখ ইসরায়েলির আমেরিকার নাগরিকত্ব রয়েছে। আমাদের পরিচিত কিছু অধ্যাপকও আছেন এই তালিকায়। তাঁরা ইতিমধ্যে ইসরায়েল ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা অনুমান করা ভুল হবে না যে এই দ্বৈত পশ্চিমা নাগরিকেরা বিধ্বস্ত ইসরায়েল ছেড়ে স্থায়ীভাবে পশ্চিমে পাড়ি দেবেন এবং আর ফিরবেন না।

অন্যদিকে ইরান ইসরায়েলের ৮০ গুণ বড়। এর কৌশলগত স্থাপনাগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে। তারা বছরের পর বছর সংঘাত চালিয়ে যেতে পারবে। এ ছাড়া অনেক ইরানি পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তুরস্কসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিলেও বেশির ভাগ ইরানির যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, সুতরাং তারা দেশেই থাকবে। অনেকেই ইরানি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মিলে প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দিতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ইসলামি বিপ্লবের পর, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর ইরান প্রায় ৪০ বছর ধরে এ ধরনের যুদ্ধের জন্যই প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা জানে যে আকাশযুদ্ধে তারা দুর্বল। যার কারণে এই চার দশকে ইরান মাটির নিচে আরেকটি ইরান তৈরি করেছে। সেখানে কেবল কয়েক ডজন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড মিসাইল সিটি’ই নয়; বরং আন্ডারগ্রাউন্ড নেভাল বেইজ, এয়ার বেজ—সবই তারা তৈরি করেছে।

ধারণা করা যায় যে ইরান দেশের সামরিক সক্ষমতার ৮০ শতাংশ মাটির নিচে নিয়ে গেছে। আর সেগুলো প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব। আপনি এগুলো জিপিএস দিয়ে ট্র্যাক করতে পারবেন না এবং জানবেনও না যে এগুলো আছে। এগুলো ধ্বংস করার একমাত্র উপায় স্থল অভিযান। কিন্তু ইরানকে বলা হয় আগ্রাসনকারীদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক। ইরান কার্যত একটি দুর্গ সমতুল্য। এটি প্রায় তিন দিকে সুবিশাল পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা, এক পাশে কৃষ্ণসাগর।

২.

ইরানে বড় ধরনের স্থল অভিযান পরিচালনার সামর্থ্য আছে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু এমনকি যুক্তরাষ্ট্র স্থল অভিযান চালালেও এটি ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের পাল্লায় পড়ে ইরানের ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় বাংকার ব্লাস্টার বোমা অথবা অন্য কোনো উপায়ে আক্রমণ করে ও ইরান যদি জবাবে আশপাশের মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা করে হতাহতসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে এবং তার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ইরানে স্থল অভিযান পরিচালনা করে, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধের চেয়ে বড় ফাঁদ হয়ে আবির্ভূত হতে পারে। সেখানে হাজার হাজার মার্কিন সেনার প্রাণ হারানোর ঝুঁকি থাকবে। কিন্তু চূড়ান্ত অর্জন হবে নেহাতই শূন্য। কেন?

বলা হয় যে শক্তিশালী আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে টিকে থাকলে আপনি জিতে যাবেন; অর্থাৎ শক্তিশালী আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে আপনাকে ‘জিততে’ হবে না, কেবল ‘টিকে থাকলেই’ হবে। যে কারণে ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ‘টিকে যাওয়া’ হিজবুল্লাহকে বিজয়ী গণ্য করা হয়। সুতরাং একটা জোরদার সম্ভাবনা হচ্ছে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও ইরান প্রতিরোধ করে যাবে এবং ‘টিকে যাবে’।

যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর যুদ্ধ চালিয়ে ইরাক ও আফগানিস্তানের মতো রণে ক্ষান্ত দেবে ইরাক যুদ্ধের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়ে। মনে রাখতে হবে, ইরাক যুদ্ধে আমেরিকা প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে; অর্থাৎ একটা প্রলম্বিত ইরান যুদ্ধে আমেরিকা ৮-১০ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করতে হতে পারে। এই পরিমাণ আমেরিকার বর্তমান জিডিপির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আর সেটি করলে আমেরিকান অর্থনীতি কার্যত দেউলিয়া হয়ে যাবে। আমেরিকা তার বৈশ্বিক সামরিক আধিপত্য হারাবে।

৩.

আমেরিকার পরাজয় কেবল আমেরিকান সাম্রাজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, এটি আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করবে। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরেকটি ওয়াইমার রিপাবলিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যেখানে সাধারণ আমেরিকানরা ইসরায়েলের এই যুদ্ধে আমেরিকাকে জড়ানো ও রাষ্ট্রকে দেউলিয়া করার ‘অপরাধে’ জায়নবাদীদের দায়ী করবে এবং তাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে হামলে পড়বে।

এটি প্রথম ‘ওয়াইমার রিপাবলিক’–এর পুনর্মঞ্চায়ন হবে মাত্র। মনে রাখতে হবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানিতে জাতীয়তাবাদী জার্মানরা জায়নবাদীদের ওপর ব্যাপক আক্রোশে হামলে পড়েছিল। তাদের অভিযোগ ছিল যে জায়নবাদী গোষ্ঠীগুলো তৎকালীন জার্মানির বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, বিনোদনজগতের ওপর প্রায় নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। অভিযোগ ছিল যে যুদ্ধে তারা যথেষ্ট দেশপ্রেমী ছিল না ও শত্রুর সঙ্গে ‘কোলাবোরেট’ করেছিল। জায়নবাদীদের এই ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ অভিযোগকে পুঁজি করে জার্মানরা ব্যাপক ইহুদিবিদ্বেষ তৈরি করে। যার পরিণতি আমরা দেখি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের ওপর জার্মানদের চূড়ান্ত আক্রোশ। বর্ণিত এই পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমান আমেরিকার মিল পাওয়া অস্বাভাবিক নয়।

৪.

দুশ্চিন্তার কারণ আছে যে আমেরিকাতেও ওয়াইমার রিপাবলিকের পুনর্মঞ্চায়নের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। আমেরিকায় প্রগতিশীলদের একটা বড় অংশ আগে থেকেই জায়নবাদী লবির অতি ইসরায়েলপ্রীতি এবং আমেরিকাকে মধ্যপ্রাচ্যের নিরন্তর যুদ্ধে জড়ানোর কারণে ক্ষিপ্ত। তবে রক্ষণশীলরা বরাবরই জায়নবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। কিন্তু এবার নতুন একটি ঘটনা ঘটছে। সেটি হলো, আমেরিকার রক্ষণশীলদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইরান যুদ্ধের ডামাডোল ঘিরে (কিংবা তারও আগে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে) জায়নবাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে। টাকার কার্লসন, স্টিভ ব্যানন, ক্যান্ডেস ওয়েন্সসহ নামীদামি রক্ষণশীল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও প্রচারণাকারীরা কেবল সক্রিয়ভাবে ইরান যুদ্ধের বিরোধিতাই করছে না, তারা ইসরায়েল ও জায়নবাদের বিরুদ্ধে কার্যত তথ্যযুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমেরিকার রাজনীতিতে এর প্রভাব হবে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।

৫.

অনুমান করা যায় যে আমেরিকা যদি ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, আমেরিকার প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল উভয় অংশ মিলে সারা আমেরিকায় জায়নবাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা উৎপাদন করবে।

জাতীয়তাবাদী জোয়ার তৈরির চেষ্টা হবে। ঠিক যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যয়ের পর জার্মান জাতীয়তাবাদীরা জায়নবাদীদের দায়ী করে করেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জায়নবাদীদের প্রতি জাতীয়তাবাদী আমেরিকানদের এই সম্ভাব্য আক্রোশে অনেক নিরীহ ইহুদিও লক্ষ্যবস্তু হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীও আক্রোশের লক্ষ্যবস্তু হবে।

হাজার হাজার বছরের লিখিত মানব–ইতিহাস পাঠ করলে মনে হতে পারে যে মানুষ যতই উৎকর্ষ অর্জন করুক, তারা যেন রাগ-ক্রোধ, তথা আমাদের ষড়্‌রিপুর দ্বারা সীমাবদ্ধ। শান্তিকালীন সময়ে মানুষ শক্তি অর্জন করতে চায়। আবার শক্তিশালী হলে দুর্বলের ওপর শোষণ করতে চায়। এই শোষণের জবাবে দুর্বল নিজে শক্তি অর্জনের চেষ্টা করে, অর্জন করেও। তারপর দুর্বল সবলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যার ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই শান্তি ও সংঘাতের চক্রটি মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে সামষ্টিক বা গোষ্ঠীজীবনের একটি নিরন্তর চক্র। অলঙ্ঘনীয়। তবু এতক্ষণ ধরে বলা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে এই অনুমান বাস্তব না হওয়াই মঙ্গলজনক হবে।

[মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে যেকোনো অনুমান কঠিন। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি অনেক বেশি জটিল। এখানে আন্তরাষ্ট্রীয় একরৈখিক কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। ফলে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে কে কী বলছেন এবং সেটি কতটুকু নির্ভরযোগ্য, তা নির্ভর করবে লেখকের এই অঞ্চল সম্পর্কে গভীর জানাশোনা ও নিজস্ব প্রজ্ঞার সমন্বয়ের ওপর। প্রায় দুই দশকের কাছাকাছি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির একাগ্র পাঠ, কিছু গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এটি লেখা হয়েছে। যাঁরা এই লেখা পড়বেন, তাঁরা যেন এসব পূর্বানুমান আক্ষরিকভাবে গ্রহণ না করেন। বর্তমানে যা ঘটছে, সে রকম পরিস্থিতি নিকট অতীতেও ছিল। সেসবের সঙ্গে তুলনা ও বিশ্লেষণ করে বর্তমানের পরিণতি আনুমানের একটি প্রয়াস এই লেখা।]

সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব রিজওনাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসন

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র জ য়নব দ দ র ইসর য় ল র জ য়নব দ র আম র ক র পর স থ ত আম র ক ন ইউর প য় অন ম ন অর থ ৎ র জন য ক র যত র জন ত দ র বল র ওপর র একট ধরন র র বছর

এছাড়াও পড়ুন:

‘রক্তাক্ত মহাসড়ক’, সাত ঘণ্টায় ৬০ জনকে হত্যা

মহাসড়কের ১ কিলোমিটার অংশ। সেখানে মাত্র সাত ঘণ্টায় হত্যা করা হয় অন্তত ৬০ জন মানুষকে। তাঁদের মধ্যে ৫৬ জন শহীদ হন প্রাণঘাতী গুলিতে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের দিন যাত্রাবাড়ী থানাকেন্দ্রিক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে। সেই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা ও প্রমাণ উঠে এসেছে প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্রে। উল্লেখ্য, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে যাত্রাবাড়ী এলাকায় অন্তত মোট ১১৭ জন শহীদ হয়েছেন বলে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

রক্তাক্ত মহাসড়ক: যাত্রাবাড়ী হত্যাকাণ্ড শিরোনামের এই প্রামাণ্যচিত্র গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করা হয়। দর্শকেরা প্রথম আলোর ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেলে গিয়ে এটি দেখতে পারছেন।

আরও পড়ুনআমার ধারণা, শেখ হাসিনার শেষ দিন ভারতেই কাটবে : আসিফ নজরুল১৮ ঘণ্টা আগেযাত্রাবাড়ী হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রথম আলোর প্রামাণ্যচিত্রটি সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় অনুসন্ধান।ডেভিড বার্গম্যান, সাংবাদিক

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল দুপুরে প্রামাণ্যচিত্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, পলায়নরত, নিরস্ত্র, মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন—এমন মানুষকে যুদ্ধক্ষেত্রেও হত্যা করা যায় না। পৃথিবীর যেকোনো আইনে এটা যুদ্ধাপরাধ। কিন্তু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে দেখা গেছে, পালিয়ে যাচ্ছেন, এমন মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর একজন মানুষ হাতজোড় করছেন, তাঁকে কাছে থেকে গুলি করা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, পুলিশকে যিনি এ রকম একটা অমানুষ, বেপরোয়া, ভয়াবহ বাহিনীতে রূপান্তর করেছেন, তিনি কত বড় অমানুষ?

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে নির্বিচারে মানুষ হত্যার অসংখ্য ফুটেজ (ভিডিও) আছে বলে উল্লেখ করেন আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি শেখ হাসিনার স্ট্যান্ডার্ডে (মান) বিচার করতাম, তাহলে এই বিচার চার থেকে পাঁচ মাসে হয়ে যেত। আমরা সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক, জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য, ২০ বছর, ৩০ বছর পরও যেন বিচার নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে, সে জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে এবং আইন সংশোধন করে বিচার করছি।’

জুলাই হত্যাযজ্ঞের দায়ে শেখ হাসিনার বিচার শেষ হলেও তাঁকে হয়তো দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না বলে ধারণা করেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, তাঁর শেষ দিন ভারতেই কাটবে।’

৩৫ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র

প্রথম আলোর প্রামাণ্যচিত্রটি প্রায় ৩৫ মিনিটের। তবে এটি তৈরি করতে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে পাঁচ মাস ধরে। শত শত ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড ধরে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড যেখানে হয়েছে, সেখানে একই সময়ে ধারণ করা বিভিন্ন ফুটেজ ফ্রেম ধরে এবং গুলির শব্দ শুনে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। এভাবে কয়েকটি ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোনো সুনির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ চিত্র দাঁড় করানো হয়েছে। এমনকি কোন ভবন থেকে গুলি করে মানুষ মারা হয়েছে, বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা বের করা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে বিশেষজ্ঞের মতামত।

প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরিতে ভিডিও ধারণকারী ব্যক্তির পাশাপাশি আন্দোলনে যুক্ত অন্তত ৫০ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে শুধু ঘটনা বোঝার জন্য। এর বাইরে সেদিন শহীদ হওয়া ৬০ জনের প্রত্যেকের পরিবারে সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নিহত ব্যক্তিদের ঘটনাস্থলের ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান, মৃত্যুসনদ বিশ্লেষণ করে তাঁর মৃত্যুর কারণ খোঁজা হয়েছে।

প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরি করেছে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ কনটেন্ট ক্রিয়েটর আব্দুল্লাহ আল হোসাইনের নেতৃত্বাধীন একটি দল।

আরও পড়ুনযাত্রাবাড়ী হত্যাযজ্ঞের নির্মম চিত্র২১ ঘণ্টা আগে‘একটি প্রশংসনীয় অনুসন্ধান’

প্রদর্শনী শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেন, যাত্রাবাড়ী হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রথম আলোর প্রামাণ্যচিত্রটি সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় অনুসন্ধান। একটি গল্প কীভাবে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, এটি এমনই একটি অনুসন্ধান।

প্রামাণ্যচিত্রের একটি অংশ দেখা গেছে, কপালে পতাকা বেঁধে ঘুরছেন—এমন একজনের কপালে গুলি করা হয়েছে। সেই কথা উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা তাঁর বক্তব্যে বলেন, এমন দৃশ্য দেখার পর কোনো কথা বের হয় না। এর চেয়ে ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে!

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা, গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ, শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী সঞ্জীব দ্রং, সাইটসেভার্সের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন কো-অর্ডিনেটর খোন্দকার সোহেল রানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তারিক মনজুর, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক কল্লোল মোস্তফা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের হেড অব কমিউনিকেশনস আবদুল কাইয়ুম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানসহ জ্যেষ্ঠ কর্মীরা।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় প্রথম আলোর ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, তখন তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। যখন সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল, এসব তথ্য প্রকাশে বাধা দেওয়া হচ্ছিল। প্রথম আলো সাহসিকতার সঙ্গে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে মৃত্যুর হিসাব রেখেছে। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন উৎস থেকে মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর প্রথম আলো তা প্রকাশ করেছে। প্রথম আলোর চেষ্টা ছিল সঠিক তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরও প্রথম আলো নানা উদ্যোগ নিয়ে মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে।

আরও পড়ুন৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশি হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ চিত্র উঠে এল বিবিসির অনুসন্ধানে০৯ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ