ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেছেন, “দেশে বৈষম্য চলছে। ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টে বৈষম্য দূর করতে জানের মায়া ত্যাগ করে আন্দোলন করেছিলাম। তবে, ৫ আগস্টের পরে আবারো জুলুম, অত্যাচার, খুন, অবিচার, দখলদারি এবং চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। এর জন্য আমরা আন্দোলন করিনি। চাঁদাবাজদের হাত ভেঙে দেওয়া হবে।” 

তিনি বলেন, “আন্দোলন শেষ হয়নি, আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। এবার সব ইসলামী দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন হবে চাঁদাবাজি, দখলদারি এবং খুনিদের বিরুদ্ধে। আন্দোলন হবে মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।” 

শনিবার (২১ জুন) বিকেলে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে দলীয় গণসমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি। প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কার, গণহত্যার বিচার এবং সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে এ সমাবেশের আয়োজন করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কুড়িগ্রাম শাখা।

সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেন, “এ দেশ থেকে মাত্র ১৬ বছরে পাচার হয়েছে ২৮ লাখ কোটি টাকা। দেশের প্রত্যেকের মাথার ওপরে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ। তারা এ দেশকে বিক্রি করার চক্রান্ত করেছে। ভারতের সঙ্গে গোলামি চুক্তি করছে। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন, তারা রক্ত দিতে পারে, জীবন দিতে পারে; কিন্তু গোলামি করতে পারে না। ভারতের সামনে বাংলাদেশের মানুষ কখনো মাথা নত করবে না, গোলামি করবে না।” 

তিনি বলেন, “ইসলাম প্রতিষ্ঠা হলে বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষদের নিয়ে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। ধনী ও গরিবের বৈষম্য দূর করা হবে। এ কারণে সব ইসলামী দলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।”

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর এই নেতা বলেন, “রাজনীতিতে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির শাসন দেখেছি, কেউ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। এজন্য হাতপাখা মার্কায় ভোট চাই।”

ইসলামী আন্দোলন কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি শাহাজাহান মিয়ার সভাপতিত্বে সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন- দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন্দ। 

সমাবেশে শেষে জেলার চারটি সংদীয় আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম। প্রার্থীরা হলেন- কুড়িগ্রাম-১ আসনে রাইসুল বারী রনি, কুড়িগ্রাম-২ আসনে আলহাজ্ব নুর বখত, কুড়িগ্রাম-৩ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য ডা.

আক্কাস আলী ও কুড়িগ্রাম-৪ আসনে আলহাজ্ব হাফিজুর রহমান।

ঢাকা/বাদশাহ/মাসুদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন

১৯৭২ সালে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫টি। পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে ২০১১ সালে এসে এই সংখ্যা ৫০–এ উন্নীত হয়। ১৫ থেকে ৫০-এ আসতে প্রায় ৩৯ বছর লেগেছে। অথচ বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী।

স্বাধীনতার পর শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত অনেক নারী এখনো ঠিকমতো মজুরিই পান না, জাতীয় ন্যূনতম মজুরি তো দূরের কথা। স্বাস্থ্য উন্নয়নের ডামাডোলে সবচেয়ে নিচে চাপা পড়ে থাকে নারীর শিক্ষা।

এর মধ্যেই লড়াই করছেন নারীরা। লড়াই করতে গিয়ে সম্মুখসারিতে থাকছেন। কিন্তু রাজনৈতিক পরিসরে এসে পেছনের আসনে বসতে বাধ্য হচ্ছেন।

এত দিনের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট যে রাজনৈতিক দলগুলোর সংসদে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে নারী আসন বণ্টন করা হলে রাজনৈতিক নেতাদের স্ত্রী, কন্যা বা আশীর্বাদপুষ্টরা মনোনীত হন। অনেক ক্ষেত্রে মনোনয়ন পেতে মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেন ঘটে। এর মধ্য দিয়ে সংসদে নারীর প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় না। তাই সরাসরি নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণের দরকার রয়েছে।

কিন্তু বিদ্যমান অসম সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে হুট করে পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে নারীদের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে না। তাই প্রথমে কতগুলো সংরক্ষিত আসনে নারীদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের পথ সুগম হবে। ফলে ধীরে ধীরে সংরক্ষিত আসনের বাইরে সাধারণ আসনগুলোতেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে এবং একসময় আর সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন হবে না।

গণ-অভ্যুত্থানে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণের পর অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণ নিয়ে দেশব্যাপী নারীদের সোচ্চার হতে দেখা গেছে। আবার একের পর এক নারীদের রাজনীতির ময়দান ছেড়ে দিতেও দেখা যাচ্ছে। তাঁদের রাজনীতির ময়দান ছেড়ে দেওয়ার গল্পগুলো যেমন আমাদের নিরাশ করে, তেমনি নারীকে সামাজিকভাবে হেয় করাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করাটা ক্ষুব্ধও করে। এমন একটি সময়ে আমরা দেখলাম, ঐকমত্য কমিশন নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় একমত হতে পারেনি।

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার পর গত ৩১ জুলাই ঐকমত্য কমিশন জানায়, ১০০ আসনে উন্নীত করার ব্যাপারে বেশির ভাগ দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি) জানিয়েছে। তাই সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা ৫০ রাখা এবং ৩০০ আসনের মধ্যে ন্যূনতম ৫ শতাংশ আসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে নারী প্রার্থী মনোনীত করার আহ্বান জানায় কমিশন।

এখন দেখা যাক, নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়ে তিনটি ভিন্ন সংস্কার কমিশন কী কী প্রস্তাব দিয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, ৪০০ আসন নিয়ে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে। ৩০০ জন সদস্য একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি নির্বাচিত হবেন। আরও ১০০ নারী সদস্য সারা দেশের নির্ধারিত ১০০টি নির্বাচনী এলাকা থেকে কেবল নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরাসরি নির্বাচিত হবেন।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে উল্লেখ আছে, সংসদের (নিম্নকক্ষ) আসনসংখ্যা ১০০ বাড়িয়ে মোট সংখ্যা ৪০০ করা হোক। এই ৪০০ আসনের মধ্যে নারীদের জন্য নির্ধারিত ১০০ আসন ঘূর্ণমাণ পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিধান করা হোক, যাতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট আসন থেকে নারীদের সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং দ্বৈত প্রতিনিধিত্বের অবসান হয়।

আর নারী সংস্কার কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে, সংসদ নির্বাচনে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য সংসদীয় আসনসংখ্যা ৬০০-তে উন্নীত করা, যেখানে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় একটি সাধারণ আসন এবং নারীদের জন্য একটি সরাসরি নির্বাচিত সংরক্ষিত আসন থাকবে। জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ করার সিদ্ধান্ত হলে সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন করা হবে, যেখানে নারী-পুরুষ মনোনয়ন পর্যায়ক্রমে জিপার পদ্ধতিতে দেওয়া হবে।

জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে নারী আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বের জন্য কমপক্ষে পাঁচটি আসন সংরক্ষণ করতে হবে। রাজনৈতিক দলে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের বিধান না মানলে দল পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা হারাবে, এমন বিধান রাখতে হবে।

লক্ষণীয় হলো, পুরুষপ্রধান সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন নারীর জন্য সংরক্ষিত ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন এই ১০০টি এলাকায় পর্যায়ক্রমে ঘূর্ণমাণ পদ্ধতিতে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের কথা বলেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ১০০টি নির্ধারিত এলাকা থেকে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের কথা বললেও এলাকাগুলো কীভাবে নির্ধারিত হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেনি।

আর নারী সংস্কার কমিশন নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব রেখেছে। এরপর এই প্রস্তাবগুলো বিবেচনার জন্য আনা হলো। নারী সংস্কার কমিশন আর ঐকমত্য কমিশনে রইল না। আমরা ঐকমত্য কমিশনে একটা ‘বয়েজ ক্লাব’ পেলাম। যে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রধানকে নিয়ে ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেখানে কোনো নারী নেই। যদিও যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হয়তো নারীর প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন, তবু এটাই সত্য যে সেখানে নারীদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কোনো নারী ছিলেন না। অন্যদিকে যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁরা বসেছেন, সেখানেও নারীর উপস্থিতি ছিল খুবই কম।

ঐকমত্য কমিশন তিন ধরনের প্রস্তাব দিয়ে আলাপ শুরু করেছে, যেখানে আগেই মতৈক্য ছিল না। এরপর যুক্ত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দলের নিজ নিজ স্বার্থ। এখানে এসে আলোচনা হয়েছে বাস্তবায়ন কীভাবে হবে। সব দল নিজ সমস্যা নিয়ে এসেছে। ফলে ঐকমত্য না হওয়ারই তো কথা। আসনসংখ্যা বাড়ানো, সরাসরি নির্বাচন, রাজনৈতিক দলের নারী প্রার্থী মনোনয়নের বাধ্যবাধকতা নিয়ে একেক দলের একেক অবস্থান থেকে সরে না আসার প্রবণতা দেখা গেছে। এই প্রবণতা থাকবে ধরে নিয়ে কিছু বিষয় শুধু রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে না করে বরং জনসংখ্যার অনুপাতে নারীর প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে হওয়া প্রয়োজন ছিল।

ড. মোশাহিদা সুলতানা: সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ