বিশ্ববাজারে তেল ও ডলারের দাম বেড়েছে, ইরানে মার্কিন হামলার জের
Published: 23rd, June 2025 GMT
আজ সোমবার এশিয়ার শেয়ারবাজারে সূচকের কিছুটা পতন হয়েছে—তেলের দাম ছুঁয়েছে পাঁচ মাসের সর্বোচ্চ সীমা। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর তেহরান পাল্টা জবাব দেবে কি না—এ উদ্বেগে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চাপা উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। এর প্রভাব পড়তে পারে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও মূল্যস্ফীতিতে।
গতকাল রোববার সাপ্তাহিক ছুটি ছিল পশ্চিমা বিশ্বের শেয়ারবাজারে। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে বাজারে প্রভাব পড়ার সুযোগ ছিল না। নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ডলারের চাহিদা বাড়লেও বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে ডলারের দিকে ছুটেছেন, তেমন প্রবণতা ছিল না। তেলের দাম প্রায় ২ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে, যদিও দিনের শুরুতে যতটা বেড়েছিল, পরে কিছুটা কমেছে।
আশাবাদীরা ভেবেছিলেন, পারমাণবিক কার্যক্রমে লাগাম পড়ায় ইরান হয়তো এক ধাপ পেছাবে, এমনকি দেশটির সরকারও বদলে যেতে পারে। জে পি মরগ্যানের বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে দিয়েছেন, অতীতে মধ্যপ্রাচ্যে সরকার পরিবর্তনের পর তেলের দাম হঠাৎ করে ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে—দীর্ঘ মেয়াদে বেড়েছে গড়ে ৩০ শতাংশ।
এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে হরমুজ প্রণালির নিয়ন্ত্রণ। এই জলপথ দিয়েই বিশ্বের প্রায় এক–চতুর্থাংশ তেল ও ২০ শতাংশ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবহন হয়। এই প্রণালির পুরো নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে নেই, যদিও এটি দেশটির অন্যতম কৌশলগত অস্ত্র।
কমনওয়েলথ ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়ার পণ্য বিশ্লেষক বিবেক ধর বলছেন, ‘হরমুজ প্রণালি পুরোপুরি বন্ধ না করে কৌশলগতভাবে কিছুটা ঝুঁকি তৈরি করাই ইরানের জন্য যৌক্তিক; কারণ, প্রণালি বন্ধ হলে তাদের তেল রপ্তানিও বন্ধ হয়ে যাবে।’
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান কৌশলগতভাবে হরমুজ প্রণালিতে জাহাজ চলাচলে বাধা দিলে ব্রেন্ট তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি কমপক্ষে ১০০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তবে আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। সোমবার ব্রেন্ট তেলের দাম ২ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ১২ ডলার আর যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেলের দাম ২ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭৫ দশমিক ৯৮ ডলার। অন্যদিকে সোনার দাম সামান্য শূন্য দশমিক ১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি আউন্স ৩ হাজার ৩৬৩ ডলার।
শেয়ারবাজার বন্ধ থাকায় মূলত ফিউচার্সের লেনদেন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ফিউচার্স শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে; নাসডাক ফিউচার্স কমেছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শেয়ারবাজারগুলোর মধ্যে জাপান বাদে এমএসসিআই সূচক শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পড়ে গেছে আর জাপানের নিক্কি কমেছে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।
ইউরোপের বাজারেও পতনের ধারা দেখা গেছে—ইউরোস্টক্স ৫০-এর ফিউচার শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, এফটিএসই ফিউচার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ও ডিএএক্স ফিউচার শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইউরোপ ও জাপান আমদানি করা তেল ও তরল গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এখন নেট রপ্তানিকারক দেশ।
মুদ্রাবাজারের অবস্থাঅনিশ্চয়তার মধ্যে সাধারণত সোনা ও ডলারের মান বাড়ে। তবে এবার এখন পর্যন্ত সেই প্রবণতা অতটা শক্তিশালী নয়। জাপানি ইয়েনের বিপরীতে ডলারের মান বেড়েছে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে প্রতি ডলারে পাওয়া যাচ্ছে ১৪৬ দশমিক ৪৮ ইয়েন। অন্যদিকে ইউরোর বিপরীতে ডলারের মান শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে প্রতি ইউরোতে পাওয়া যাচ্ছে ১ দশমিক ১৪৮১ ডলার। ডলার ইনডেক্সের মান শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৯৯ দশমিক শূন্য ৭৮।
বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগমাধ্যম হলো যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড। কিন্তু গতকাল এই বন্ডের বিষয়েও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি দেখা যায়নি, বরং ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদহার ২ ভিত্তি পয়েন্ট বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৩৯৭ শতাংশ।
ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার নিয়ে আগাম অনুমানের বাজারে (ফিউচার্স) সামান্য পতন দেখা গেছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, তেলের দাম দীর্ঘ মেয়াদে বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতিতে আরও চাপ তৈরি হবে—এই আশঙ্কা থেকেই এই প্রতিক্রিয়া।
আগামী ৩০ জুলাই ফেডারেল রিজার্ভের পরবর্তী বৈঠকে সুদের হার কমতে পারে—বিনিয়োগকারীরা এমন সম্ভাবনা এখনো খুব একটা দেখছেন না। যদিও ফেডের গভর্নর ক্রিস্টোফার ওয়ালার ভিন্নমত পোষণ করে জুলাইতেই হার কমানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
ফেডের বেশির ভাগ কর্মকর্তাই, বিশেষ করে চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল, এখনো সুদের হার নিয়ে সতর্ক। সে জন্য বাজারের ধারণা, জুলাই মাসের চেয়ে সেপ্টেম্বরেই সুদহার কমানোর সম্ভাবনা বেশি।
এ সপ্তাহে অন্তত ১৫ জন ফেড কর্মকর্তা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কথা বলবেন। সেই সঙ্গে চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল দুই দিনব্যাপী মার্কিন আইনপ্রণেতাদের শুনানিতে অংশ নেবেন। সেখানেও ইরানের ওপর হামলা ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আলোচনা হবে।
এই সপ্তাহে হেগে অনুষ্ঠেয় ন্যাটো নেতাদের বৈঠকে আলোচনার মূল বিষয় হবে মধ্যপ্রাচ্য। বৈঠকের অধিকাংশ সদস্যদেশ প্রতিরক্ষা ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেবে—এ বিষয়েও একমত হয়েছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে এ সপ্তাহে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য প্রকাশিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার, সাপ্তাহিক বেকার ভাতার আবেদনের সংখ্যা ও জুন মাসের কারখানাভিত্তিক উৎপাদন কার্যক্রম নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাথমিক প্রতিবেদন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র র শ য় রব জ র শ ন য দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্ববাজারে কিছুটা কমেছে সোনার দাম, মুনাফা তুলে নেওয়ার প্রভাব
গতকাল সোমবার বিশ্ববাজারে সোনার দাম কিছুটা কমেছে। গত সপ্তাহের লেনদেনে সোনার দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গিয়েছিল। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মুনাফা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল স্পট মার্কেটে সোনার দাম কিছুটা কমেছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেজারি বন্ডের সুদহার বৃদ্ধিও মূল্যবান এই ধাতুর দাম কমার পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে। স্পট মার্কেটে গতকাল সোনার দাম কমেছে দশমিক ১ শতাংশ। প্রতি আউন্সের মূল্য দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩৫৯ ডলার ৯৯ সেন্টে। তবে এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের ফিউচার মার্কেটে মূল্যবান ধাতুটির দাম দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে আউন্সপ্রতি মূল্য পৌঁছেছে ৩ হাজার ৪১৩ ডলার ৪০ সেন্ট।
স্যাক্সো ব্যাংকের হেড অব কমোডিটি স্ট্র্যাটেজিস্ট ওলে হ্যানসেন বলেন, ‘বাজারে গত শুক্রবার সোনার দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়ার পর এই দরপতন স্বাভাবিক। এদিকে সুদহার কিছুটা বেড়েছে এবং শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বাজারে সোনার দাম সীমিত পরিসরে ওঠানামা করছে। তবে মূল্যবান ধাতুটির দাম যদি আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৪৩০ ডলার ছাড়িয়ে যায়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্রয়ের প্রবণতা বাড়বে। এতে সোনার দাম নতুন করে বাড়তে পারে।
অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর মধ্যে স্পট মার্কেটে গতকাল রুপার দাম বেড়েছে দশমিক ৯ শতাংশ। প্রতি আউন্সের মূল্য পৌঁছেছে ৩৭ ডলার ৩৪ সেন্টে। প্লাটিনামের দাম দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে আউন্সপ্রতি মূল্য দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩২০ ডলার ১৯ সেন্টে। গতকাল প্যালাডিয়ামের দাম দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। আউন্সপ্রতি দাম হয়েছে ১ হাজার ২০৫ ডলার ৯৩ সেন্ট।
এদিকে সোনার দাম নিয়ে দেওয়া পূর্বাভাস সংশোধন করেছে সিটি গ্রুপ। গতকাল প্রকাশিত প্রতিবেদনে ব্যাংকটি জানায়, আগামী তিন মাসে সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৫০০ ডলারে উঠতে পারে। এর আগে দেওয়া প্রাক্কলনে যা ছিল আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৩০০ ডলার।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতিসংক্রান্ত দুর্বল পূর্বাভাসের কারণে সোনার দাম নিয়ে দেওয়া প্রাক্কলন সংশোধন করা হয়েছে। সিটি গ্রুপ বলছে, ২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি ও শুল্ক–সম্পর্কিত মূল্যস্ফীতি ওপরের দিকে থাকবে। এ ছাড়া ডলারের বিনিময় হার কমে যাওয়ায় সোনার দাম নতুন রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।
চলতি বছর বিশ্ববাজারে সোনার দাম ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল বলছে, চলতি বছর সোনার দাম বাড়তি থাকবে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ডব্লিউজিসি জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে সোনার মূল্যবৃদ্ধির পেছনে যেসব কারণ আছে, সেগুলো হলো ডলারের বিনিময় হার কমে যাওয়া, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, বিনিয়োগকারীদের চাহিদা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা কেনা বেড়ে যাওয়া। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে স্থবিরতা বা মন্দার ঝুঁকি বাড়লে ভবিষ্যতে এই ধাতুর চাহিদা আরও বাড়তে পারে।
বিশ্বে সোনাকেই সবচেয়ে স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য পণ্য হিসেবে ধরা হয়। বলা হয়, একমাত্র সোনার দামেই সাধারণত বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা দেখা যায় না। সোনা কিনে রাখলে লোকসানের ভয় নেই বলা যায়। এ কারণেই সোনার প্রতি সবার এত আকর্ষণ। ৫০ বছর আগে কেউ সোনা কিনে রাখলেও, তা ভালো বিনিয়োগ হিসেবেই বিবেচিত। শেয়ারবাজার, ডলার বা অন্য কিছু এই নিশ্চয়তা দেয় না।