সেই আশির দশকের গোড়াতে; ১৯৮১ সাল—সবে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি জামালপুরের সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে এক রাস্তার নিরিবিলি গ্রামবেষ্টিত ছোট্ট জামালপুর শহরের একপ্রান্তে একেবারেই মফস্বলী গন্ধেভরা কলেজের ইন্টারমিডিয়েট হোস্টেলে থাকি। সতের বছর গ্রামবাস, মাঝে দু’বছর নান্দিনা পাইলট স্কুল, এরপর জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজ—এই জার্নির মধ্যে জীবনের অনেক গল্প যুক্ত হয়েছে, যার একটি হলো—প্রথম হলে বা পেক্ষাগৃহে গিয়ে বাংলা ছবি বা চলচ্চিত্র দেখা।
একদিন হোস্টেলের বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, রাতের শো দেখতে যাবো; রাত ন’টায়। হলের নাম ‘কথাকলি’। সেই হলটি ছিল তৎকালে খুব আধুনিক! শহরের মাঝখানে মূল মার্কেটের ভিতরে সিনেমা হল। সন্ধ্যায় দু’বন্ধু গিয়ে ছবির টিকিট কেটে আনলো। আমরা সাড়ে আটটায় রিকশাযোগে চললাম কথাকলি সিনেমা হলের দিকে। ছবির নাম ‘অবুঝ মন’। এই ছবিটি ১৯৭২ সালে মুক্তি পায়। ছবিটি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত পরিচালক কাজী জহির। এই বছরই স্বাধীনতার পরপর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ওরা ১১ জন’ ও পরে ‘অবুঝ মন’ ছবি দুটি সারাদেশে অসম্ভব জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি লাভ করে। ছবির প্রধান দুইটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক ও শাবানা। পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুজাতা, শওকত আকবর, নারায়ণ চক্রবর্তী, খান জয়নুল, সাইফুদ্দিন ও হাসমত। সিনেমাটি ১৯৭৩ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য নির্বাচিত সাতটি চলচ্চিত্রের একটি ছিল।
যে বন্ধুরা ইতোমধ্যে ছবিটি দেখে এসেছে, তাদের মুখে শুনে ভিতরে ভিতরে যারপরনাই পুলকভাব এবং এক ধরনের শিহরণ কাজ করছিল। মনের মধ্যে আরো নানান কথা, আগে সিনেমা দেখতে না পাওয়ার কষ্ট এবং জীবনে প্রথম ছবি দেখতে যাওয়ার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা—সব মিলিয়ে ভিতরে তোলপাড় করছে সমুদ্র ঢেউ! কিন্তু রিকশায় পাশের সিটে বসা বন্ধু সুজন হয়তো এই ঢেউ দেখতে পাচ্ছে না। কিম্বা ওর ভিতরেও একই রেখার ছাপ হয়তো-বা, কারণ সুজনও আমার মতো প্রথম সিনেমা দেখার যাত্রী। আসলে প্রথমতঃ বয়স, গ্রামবাস, ছোট্ট মফস্বলবাস, মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবার ও সামাজের এক ধরনের বাঁধা-নিষেধ এবং তখনো সিনেমা দেখার সার্বিক সুযোগ-সুবিধার অভাব, সব মিলিয়ে ছবি দেখা হয়নি আঠার বছরের এই আমার।
আরো পড়ুন:
‘তাণ্ডব’ চলাকালে কারিগরি ত্রুটি, ছায়াবাণী হল ভাঙচুর
ঈদের ছয় সিনেমার কোনটি কত হলে মুক্তি পেল
ভাবনা শেষ না হতেই কথাকলি হলের সামনে এসে নামলাম। এরপর টিকিট চেক করিয়ে প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করলাম। পুরো হলগৃহ আলো-আঁধারি, দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীরা টর্চের আলো দিয়ে পথ দেখিয়ে যারযার সিটে বসিয়ে দিলেন। সিটে বসে অন্যরকম অনুভূতি ও শিহরণ সঞ্চারিত হলো। বড় পর্দা, অবুঝ মন, আহা! শুনেছি, ছবিটি সামাজিক ও প্রেমের ছবি। কাহিনী এরকম—নায়ক তার বন্ধুর সাহায্যে পড়াশোনা করে সদ্য ডাক্তারি পাস করে গ্রামে যাবে ডাক্তারি করার জন্য। গ্রামের পথে ট্রেনে তার পরিচয় হয় জমিদারকন্যা নায়িকার সঙ্গে এবং তারপর প্রেম। নায়িকার পিতা মনে করেন, এটি অসম সম্পর্ক তাই এই প্রেমের বাধা হয়ে দাঁড়ান এবং নায়ককে গ্রাম থেকে চলে যেতে বলেন। নায়ক কাউকে না জানিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যান। নায়িকাকে অর্থাৎ মেয়েকে তার পিতা অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়— প্রেমের এই বিরহের কাহিনী, আমরা তন্ময় হয়ে তিন ঘণ্টা ধরে দেখে বের হলাম রাত বারোটায়।
প্রথম ছবি দেখে আমার জীবনের যেন এক অন্য জগতের দরোজা খুলে গেল। তারপর জামালপুর, ঢাকা, কলকাতা, কানাডায় একের পর এক অসংখ্য ছবি দেখেছি, দেখছি ছোটপর্দা অর্থাৎ টেলিভিশনে। বাংলা, হিন্দি, তামিল, তেলেগু, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষার এতো এতো ছবি দেখেছি, তার হিসাব রাখিনি। এর মধ্যে দুটো বাংলা ছবির কথা বলতেই হবে—সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ এবং গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ আমার ভিতরের দরোজা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই উন্মুক্ত দরোজায় সর্বশেষ দেখলাম ‘উৎসব’।
২০ জুন, ২০২৫, সকালে গৃহিণীকে নিয়ে উবার দিয়ে দৌড়াচ্ছি প্রেক্ষাগৃহের দিকে। এখন অবশ্য ‘প্রেক্ষাগৃহ’ পুরোনো শব্দ, বদলে যাওয়া জামানায় সিনেমা হলগুলোকে বলা হয় ‘সিনেপ্লেক্স’। মন্দ না শব্দটা, যুগের চাহিদায় শব্দটি হয়তো এসেছে, তা আমরা গ্রহণও করেছি। আমরা যারা একটু পুরোনো; একটু খটকা লাগে বৈকি? লাগলেও এই সিনেপ্লেক্সগুলোতে বসে আমি বেশ কয়েকটি ছবি দেখেছি। মন্দ না, বিশ্বের আধুনিক প্রেক্ষাগৃহের আদলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা এই সিনেপ্লেক্সগুলো বেশ সুন্দর, আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক মানের। যাহোক, বাংলাদেশের সর্বশেষ এবং এই সপ্তাহের আলোড়ন তৈরি করা নতুন ছবি বা ছায়াছবি বা চলচ্চিত্র বা সিনেমা বা ফিল্ম হলো ‘উৎসব’। ছবিটি দেখবো দেখবো করে ভাবছিলাম। এর মধ্যে আগের দিন সকালে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে একই গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম, যেতে যেতে তিনি বললেন, শাহরিয়ার ভাই আপনি ‘উৎসব’ দেখেছেন? বললাম, না। তিনি আবার বললেন, আমি এরইমধ্যে দু’বার দেখে ফেলেছি, জাহিদ হাসানের অসাধারণ অভিনয়ে, দারুণ এক চলচ্চিত্র, দেখুন, না দেখলে মিস করবেন?
এই যে বলা, দিন গেল, সন্ধ্যায় অনলাইনে টিকিট কিনলাম, সকালেই দৌড়ালাম বসুন্ধুরা সিনে কমপ্লেক্সের দিকে। তখন সকাল ১১:২০ মিনিট, ছবিটি শুরু হলো। প্রায় হল ভর্তি দর্শক। টর্চের দিন শেষ, এখন আলো-আঁধারির বড় কক্ষে মোবাইলের টর্চেই দর্শক সিট দেখে নিচ্ছেন। বলা যায়, বেশ কিছু সময় পর আমরাও সিনেপ্লেক্সের সিটে বসলাম। এক ধরনের আগ্রহ নিয়েই বড় পর্দার দিকে চোখ রাখলাম। আশা করি আনন্দ পাবো। কারণ আগেই শুনে এসেছি— ছবির মূল আকর্ষণ অভিনেতা জাহিদ হাসান। চমৎকার অভিনয়ে দর্শকদের মন জয় করেছেন। সেই আকর্ষণ নিয়েই চোখ মেললাম।
প্রথম দৃশ্যেই চমৎকৃত হলাম ছবির মূল চরিত্র জাহাঙ্গীর নামক জাহিদ হাসানের স্বতঃস্ফূর্ত সংলাপে। মোটামুটি কাহিনী এরকম— জাহাঙ্গীর নিয়মিতভাবে স্থানীয় যুবকদের সঙ্গীতের আসরে ব্যাঘাত ঘটায়, পশুদের সাথে দুর্ব্যবহার করে, বিদ্যুৎ চুরি করে এবং সাহায্যপ্রার্থী এতিমদের ফিরিয়ে দেয়। তার কর্মকাণ্ড সুপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও, এমনকি স্থানীয় কমিটির সভাপতিও নিষ্ক্রিয় থাকেন। এই অপ্রীতিকর রুটিন তার জীবনকে সংজ্ঞায়িত করে ঈদের আগের রাত পর্যন্ত। সেই রাতে, জাহাঙ্গীর ভূতের মুখোমুখি হয়। পৌরাণিক জিনদের মতো নয় যারা মানুষকে কোকাফের দিকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, এই আত্মারা তাকে তার নিজের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পথ দেখায়। সবশেষে তার আত্মোপলব্ধি হয় যে, আগে যে কাজগুলো করেছে, বিশেষ করে ব্যক্তিগত ও পরিবারের ক্ষেত্রে তা ভুল হয়েছে, সে সেখান থেকে ফিরে আসে। এটি মূলত হাস্যরসাত্মক নাট্য-চলচ্চিত্র। বিখ্যাত উপন্যাস আ ক্রিসমাস ক্যারল অবলম্বনে নির্মিত ‘উৎসব’র অন্যান্য প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন—তারিক আনাম খান, চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান, অপি করিম, সাদিয়া আয়মান, আফসানা মিমি, আজাদ আবুল কালাম, ইন্তেখাব দিনার ও সৌম্য জ্যোতি প্রমুখ। ছবিটি পরিচালনা করেছেন তানিম নূর এবং প্রযোজনা করেছে ডোপ প্রোডাকশনস। ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন আয়মান আসিব এবং সামিউল ভূঁইয়া, চিত্রগ্রাহকের দায়িত্বে ছিলেন রাশেদ জামান।
বাংলাদেশের ঈদ-উৎসব কেন্দ্র করে একটি সামাজিক হাস্যরসের মজার ছবি ‘উৎসব’। ২০২৫ সালের ঈদুল আজহায় প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। তারকায় ঠাসা ছবিটি দেখে আমার মতো সকল দর্শক দারুণ আনন্দ পেয়েছে মনে করি। ‘উৎসব’ চলচ্চিত্রটি দেখার মধ্য দিয়ে আমার নিজেরও ছবি দেখার পঁয়তাল্লিশ বছর পূর্ণ হলো। উৎসব সম্পর্কে জাহিদ হাসান নিজেই বলেছেন—‘কেউ আমাকে ভালবাসলে আমার কান্না পেয়ে যায়, আবার কেউ আমাকে আদর করলেও কান্না পেয়ে যায়, যখন আপনারা সবাই আমাকে এভাবে আদর করেন, আমার কান্না পায়। এই ঈদে আমার ছবি এসেছে কয়েকটা, ন্যাশনাল এওয়ার্ডও পেয়েছি কিন্তু এভাবে আমার কোনো ছবি জীবনে আসেনি। এতো ক্যামেরা আমার জীবনে কখনো আসেনি— এটা আমার জীবনে বড় পাওয়া।’
কথা সত্য, কারণ আমরা জাহিদ হাসান অভিনীত বহু নাটক ও চলচ্চিত্র দেখেছি কিন্তু উৎসবে তিনি উজার করে অভিনয় করেছেন। এই ছবি দেখে মনে হলো, বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের কাল আবার ফিরে আসবে এবং প্রেক্ষাগৃহমুখী হবে হারানো দর্শক। কারণ উৎসব একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করা বাংলাদেশের রুচিসম্মত নান্দনিক ছবি।
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ন ম হল চলচ চ ত র উৎসব চলচ চ ত র কর ছ ন চর ত র র জ বন প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
বন্দরের লৌহিয়া খালটি দখল উৎসবে চলছে
বন্দরের ঐতিহ্যবাহী লৌহিয়া খালটি দখল উৎসবে মেতে উঠেছে চিহ্নিত ভূমিদস্যুরা। যে খাল দিয়ে এক সময় শীতলক্ষা-বহ্মপুত্র নদীতে সংযোগ ছিল।
সেই ঐতিহ্যবাহী খালটি অবৈধভাবে দখল করে পাঁকা স্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস, ব্যাটারি ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেছে ওই সকল ভূমিদস্যুরা।
খালটি দখল হয়ে যাওয়ার কারনে পয়নিষ্কাশনসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত স্থানীয়রা। বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময়ে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে উল্লেখিত খাল দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা ।
এলাকাবাসী ও বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা গেছে, বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এম এ রশিদ ও সানাউল্লাহ সানু এবং বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এহসান উদ্দিনের মদদপুষ্ট হয়ে আদর্শ বিদ্যানিকেতন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে গিয়ে খাল দখল করে রাস্তা বানিয়েছে।
তেমনি ভাবে গার্মেন্টস, ব্যাটারি ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে পানি চলাচলের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া খালটি ভরাট করার কারনে বন্দর ইউনিয়নের ৯ নং ওর্য়াডের কদমতলীসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকা পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ড্রেজার দিয়ে ব্যাক্তি মালিকানাধীন জমি ভরাট করতে গিয়ে সরকারি খাল দখল করে নিয়েছে। দেখার যেন কেউ নেই।
বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. শওকত হোসেন সৈকত জানান, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিকবার লিখিতভাবে জানিয়েও কোন সুফল পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে বন্দর উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।
প্রভাবশালী মহল ও ভূমিদস্যুদের কর্তৃক দখলকৃত খালটি উদ্ধার করে পয়নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ভূক্তভোগী এলাকাবাসী।