নতুন একটি বছর, হিজরি ১৪৪৭ সনে ইসলামি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহররমে উপনীত হয়েছি আমরা। এই মাস আমাদের জন্য কেবল বছরের শুরু নয়; বরং আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণ ও জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের একটি সুযোগ।

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির মতো মাসগুলোয় ধর্মীয় তাৎপর্য না থাকলেও মহররম, রজব, রমজান বা জিলহজের মতো হিজরি মাসগুলো আমাদের ইমানের নানা অনুষঙ্গ স্মরণ করিয়ে দেয়।

সময় ১২ মাসে বিভক্ত, যার মধ্যে চারটি পবিত্র।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,১৯৭কেন হিজরি ক্যালেন্ডারে পরিকল্পনা

বলা যায়, হিজরি ক্যালেন্ডার আমাদের জীবনকে আল্লাহর নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.

) বলেন, ‘সময় ১২ মাসে বিভক্ত, যার মধ্যে চারটি পবিত্র।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,১৯৭)

মহররম এই পবিত্র মাসগুলোর একটি, যেখানে নেক আমলের প্রতিদান বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। হিজরি ক্যালেন্ডার এভাবে আমাদের ইবাদতের মধ্য দিয়ে বিশ্বের ১৮০ কোটি মুসলিমের সঙ্গে একসুতায় গাঁথে।

হিজরি পরিকল্পনা এই জন্য দরকার। কেননা, এটা আমাদের বাগানের মালির মতো তাড়িত করবে। যিনি বীজ রোপণ করেন, যত্ন নেন ও ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করেন। এই ‘মালির মানসিকতা’ আমাদের বলবে যে প্রতিটি ঋতুতে বৃদ্ধির নিজস্ব সময় আছে। তাই ঋতু অনুপাতে আমাদের কাজ করে যেতে হবে এবং ফলাফল থাকবে আল্লাহর হাতে।

আরও পড়ুনমুসলিম জীবনে হিজরি সালের গুরুত্ব৩০ আগস্ট ২০১৯হিজরি পরিকল্পনা এই জন্য দরকার। কেননা, এটা আমাদের বাগানের মালির মতো তাড়িত করবে। যিনি বীজ রোপণ করেন, যত্ন নেন ও ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করেন।

ইবন আতাউল্লাহ বলেন, ‘প্রশংসনীয় পরিকল্পনা হলো, যা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে। নিন্দনীয় পরিকল্পনা হলো, যা নিজের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির চারপাশে ঘোরে, আল্লাহর প্রতি, দায়িত্বের প্রতি উদাসীন থেকে।’ (ইবন আতাউল্লাহ, হিকাম, পৃ. ৪৫, দারুল ফিকর, ২০০৫)

আসুন, এবার সাতটি ধাপ নিয়ে আলাপ করা যাক।

১. একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী নিয়ত নির্ধারণ

বছরের শুরুতেই ‘উন্নত মনোবল’ ধারণ করবেন বলে নিয়ত করুন, যা আল্লাহকেন্দ্রিক, পরিবার ও সমাজের জন্য প্রভাবশালী কাজে উদ্দীপিত করবে এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হতে আপনাকে সাহায্য করবে। যেমন ‘সন্তানদের আত্মবিশ্বাসী মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলব’ বা ‘কোরআন হিফজ করব’। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১) এই নিয়তই হবে আপনার বছরের পথপ্রদর্শক।

২. তিনটি ভাগে পরিকল্পনা

আপনার পরিকল্পনাকে তিন ভাগে ভাগ করুন—

ক) আধ্যাত্মিক: চরিত্র উন্নয়ন, ইবাদতের ধারাবাহিকতা ও ইসলামি জ্ঞানার্জন। যেমন নিয়ত করলেন যে এ বছর হাদিসে বর্ণিত সব কটি নফল রোজা রাখব। এখন রাখতে পারেন আশুরার রোজা।

খ) ব্যক্তিগত বা অর্থনৈতিক: স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মজীবন বা আর্থিক পরিকল্পনা। যেমন ভাবলেন যে অন্তত সপ্তাহে তিন দিন ব্যায়াম করবেন।

গ) সামাজিক: পরিবার, প্রতিবেশী ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক জোরদার করা। যেমন ঠিক করলেন যে সপ্তাহে এক দিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে পরামর্শ করবেন।

আরও পড়ুনহজরত উমর (রা.) হিজরি সন প্রবর্তন করেন০৬ জানুয়ারি ২০২৪৩. অভ্যাসে জোর দেওয়া

লক্ষ্য নির্ধারণ করার চেয়ে অভ্যাস গড়ে তুলতে মনোযোগী হন। এ মাসে তিন পারা কোরআন হিফজ করার পরিবর্তে বলুন, প্রতি সপ্তাহে এক পৃষ্ঠা হিফজ করবেন। মাসে একবার ম্যারাথন দৌড়ানোর পরিবর্তে ঠিক করুন, প্রতিদিন আধা ঘণ্টা হাঁটবেন। দীর্ঘ ও গতিশীল এই পদ্ধতি আপনার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করবে।

ইবন আতাউল্লাহ বলেন, ‘প্রশংসনীয় পরিকল্পনা হলো, যা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে। নিন্দনীয় পরিকল্পনা হলো, যা নিজের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির চারপাশে ঘোরে, আল্লাহর প্রতি, দায়িত্বের প্রতি উদাসীন থেকে।’ ইবন আতাউল্লাহ, হিকাম, পৃ. ৪৫৪. নির্দিষ্ট দোয়া তৈরি

প্রতিটি কাজের নিয়ত করার সঙ্গে সঙ্গে সেই কাজের নির্দিষ্ট নাম ধরে ধরে সময় বের করে দোয়া করুন। যেমন ‘আল্লাহ, আমাকে এই বছর সুরা–বাকারা হিফজ করতে সাহায্য করুন।’ কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ (সুরা মুমিন, আয়াত: ৬০)

দোয়া কবুলের যে সময় ও দিনক্ষণ আছে, যেমন মাগরিবের আগে, জুমার দিনের আগের রাতে, আরাফার দিন, রমজান, শবে কদরসহ কোনো মর্যাদাপূর্ণ সময়ে যেন দোয়াগুলো স্মরণ করতে ভুল না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখুন। প্রয়োজনে এই দোয়াগুলো লিখে রাখুন।

৫. জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পরিকল্পনা

যে কাজেরই নিয়ত করেছেন, তার জন্য কী কী জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন, তা চিহ্নিত করুন। জিজ্ঞাসা করুন, কোন জ্ঞান প্রয়োজন? কোন দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে? কে আমাকে গাইড করতে পারে? যেমন বই লেখার জন্য লেখার কোর্সে ভর্তি হন। জ্ঞানের জন্য দক্ষতা অর্জন করা জ্ঞানেরই অংশ।

প্রতিটি কাজের নিয়ত করার সঙ্গে সঙ্গে সেই কাজের নির্দিষ্ট নাম ধরে ধরে সময় বের করে দোয়া করুন। যেমন ‘আল্লাহ, আমাকে এই বছর সুরা–বাকারা হিফজ করতে সাহায্য করুন।’৬. পর্যালোচনার আবহ তৈরি

নিয়মিত পর্যালোচনা আমাদের পরিকল্পনাকে জীবন্ত রাখবে। সাপ্তাহিক, মাসিক ও ত্রৈমাসিক পর্যালোচনার দিন ও তারিখ ঠিক করুন। মহররম থেকে রবিউল আউয়াল পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে অগ্রগতি মূল্যায়ন করুন। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, কী কাজ হয়েছে? কী পরিবর্তন দরকার? আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের পরিবর্তন করে।’ (সুরা রাদ, আয়াত: ১১)

আরও পড়ুনহিজরি সন গণনা শুরু হয় যেভাবে১০ এপ্রিল ২০২৫৭. প্রকৃত তাওয়াক্কুলের চর্চা

ফলাফলের ওপর নির্ভর না করে আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। আপনার কাজ বীজ রোপণ, সেচ ও যত্ন নেওয়া; ফলাফল আল্লাহর হাতে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা যদি আল্লাহর ওপর যথাযথ তাওয়াক্কুল করো, তিনি তোমাদের রিজিক দেবেন, যেমন পাখিদের দেন।’ (সুনান তিরমিজি, হাদিস: ২,৩৪৪)

কখনো আল্লাহ আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী ফল দেবেন, কখনো সেভাবে দেবেন না, কিন্তু নিশ্চয় তার চেয়ে উত্তম কিছু দেবেন, কখনো দেবেন ধৈর্যের শিক্ষা।

বছরব্যাপী তিনটি সাধারণ ভুল এড়িয়ে চলুন

১. অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতি নিজের ওপর চাপাবেন না; বরং অল্প কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করা ভালো।

২. আপনার বয়স ভুলে যাবেন না। নতুন সন্তান এলে বা বয়স্ক পিতামাতার দায়িত্ব থাকলে পরিকল্পনা তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করুন।

৩. অন্যের স্বপ্নের পেছনে ছুটবেন না। আপনার নিয়ত আপনার হৃদয়কে উদ্দীপ্ত করবে, অন্যকে প্রভাবিত করবে না।

তোমরা যদি আল্লাহর ওপর যথাযথ তাওয়াক্কুল করো, তিনি তোমাদের রিজিক দেবেন, যেমন পাখিদের দেন।সুনান তিরমিজি, হাদিস: ২,৩৪৪

যা করবেন, করার নিয়ত করছেন, তা এই সপ্তাহেই ঠিক করুন। এখনো মাসের শুরু। দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় নিন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী নিয়তটি নির্ধারণ করুন। তারপর তিনটি ভাগে পরিকল্পনা করে অভ্যাস তৈরি করুন। প্রথম তিন মাসের (মহররম থেকে রবিউল আউয়াল) জন্য ছোট ছোট ভাগ করে তিন থেকে পাঁচটি প্রকল্প বেছে নিন। প্রতিটি কাজের দোয়া লিখুন। পর্যালোচনার দিনক্ষণ ঠিক করুন।

হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসারে করা এই পরিকল্পনা যেন আমাদের জীবনকে ইবাদতে রূপান্তরিত করে। আল্লাহ আমাদের জীবনে বরকত দিন এবং আমাদের নিয়তকে কবুল করুন। আমিন।

সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম

আরও পড়ুনহিজরি কালপঞ্জি: ইসলামি পরিচয়ের ধারণা২৩ মে ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র জ ঠ ক কর ন আল ল হ ন র পর র জন য আপন র ত করব র ওপর করব ন ফল ফল

এছাড়াও পড়ুন:

অন্তরে ত্যাগের মহিমা লালন করতে হবে

আজ পবিত্র আশুরা। হিজরি ১৪৪৭ সনের ১০ মহররম। মুসলমান সম্প্রদায়ের গভীর শোকের দিন। হিজরি ৬১ সনের এই দিনে সত্য-মিথ্যার লড়াইয়ে কারবালার প্রান্তর রক্তাক্ত হয়েছিল। এই লড়াইয়ে ইমাম হোসেন সপরিবার জীবন উৎসর্গ করে সত্যের জয়গান গেয়ে যান, যা আজও পৃথিবীর তাবৎ মুসলিমকে অনুপ্রাণিত করে।  

মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে ইয়াজিদ অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেন এবং এ জন্য ষড়যন্ত্র ও বলপ্রয়োগের পথ বেছে নেন। মহানবী (সা.)-এর আরেক দৌহিত্র হজরত ইমাম হাসান (রা.)-কে বিষপানে হত্যা করা হয়। আশুরার দিন ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসেন, তাঁর পরিবার ও বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে রাখে ইয়াজিদ বাহিনী। কারবালার যুদ্ধ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।

অবরুদ্ধ হয়ে পরিবার-পরিজন, ৭২ জন সঙ্গীসহ শাহাদাতবরণ করেন হজরত ইমাম হোসেন (রা.)। এ হত্যাকাণ্ড ছিল অত্যন্ত নির্মম। শাহাদাতের পর ইমাম হোসেন (রা.)–এর শরীরে বর্শা, তির ও তরবারির অসংখ্য জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়।

কারবালা প্রান্তরের সেই শোকাবহ ঘটনার স্মরণে প্রতিবছর ১০ মহররম পবিত্র আশুরা পালিত হয়। শিয়া সম্প্রদায় এদিন তাজিয়া মিছিলসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। সুন্নি সম্প্রদায়ও নফল রোজা রাখাসহ নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে এ দিবস পালন করে থাকে। বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে শিয়া-সুন্নিনির্বিশেষে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আশুরা পালিত হয়ে আসছে।

কারবালার যুদ্ধ ছাড়াও এই দিন ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। হাদিস শরিফে পূর্ববর্তী নবী-রাসুল (সা.)–এর স্মৃতিসংবলিত ও ঘটনাবহুল দিনটির কথা বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে।

এটি শিয়া সম্প্রদায়ের অবশ্যপালনীয় দিন হলেও সব মুসলমানই এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করবে আশা করি। এ বছর যাতে সারা দেশে তাজিয়া মিছিলসহ আশুরার অনুষ্ঠান আয়োজন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতায় আশুরার ত্যাগের শিক্ষাই হোক পাথেয়। এদিনের মূল চেতনা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম। আশুরার শিক্ষা ও চেতনার আলোকে জাতি এগিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশিত।

ঢাকাসহ সারা দেশে যাতে শান্তিপূর্ণভাবে পবিত্র আশুরা পালিত হয়, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। আশুরার মূল চেতনা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে সাময়িক আঘাত এলেও চূড়ান্ত বিজয় অবধারিত। এটাই মহররমের শিক্ষা। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না’।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আশুরা উপলক্ষে রাজশাহীতে তাজিয়া মিছিল
  • হোসনি দালান থেকে শোকাবহ তাজিয়া মিছিল শুরু
  • আশুরা উপলক্ষে পুরান ঢাকায় বের হয়েছে তাজিয়া মিছিল
  • অন্তরে ত্যাগের মহিমা লালন করতে হবে
  • আজ পবিত্র আশুরা
  • মহররম মাসের মর্যাদা ও করণীয়
  • হাওর অঞ্চলে মহররম-সংস্কৃতির নিজস্ব রূপান্তর
  • কারবালার ঘটনার সারসংক্ষেপ
  • ইমামবাড়াতে ভক্তদের মাতম