এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ঊর্ধ্বমুখী শেয়ারবাজার। বছরের পর বছর দর পতনে নাকাল হওয়া বিনিয়োগকারীরা নতুন করে ফিরতে শুরু করেছেন বিনিয়োগে। শেয়ারদর বাড়তে থাকায় গত এক মাসেই সূচক বেড়েছে ৪৫২ পয়েন্ট। দৈনিক শেয়ার কেনাবেচার পরিমাণও ২০০ কোটি টাকার ঘর ছেড়ে ৭০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ অবস্থায় নতুন করে শেয়ারের জোগান না বাড়লে ফের কিছু শেয়ারের দর অতিমূল্যায়িত এবং বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি তৈরি হওয়ার উদ্বেগ বাজারসংশ্লিষ্টিদের।
এ উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি অবিলম্বে নতুন শেয়ারের জোগান বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানাতে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড.
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘তাদের উদ্বেগের জায়গাটা বুঝি। সমস্যা হলো, আইপিও আনার কাজ বিএসইসির নয়। এটা মার্চেন্ট ব্যাংকের কাজ। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, আগে যেভাবে অতিরঞ্জিত অডিট রিপোর্ট দিয়ে আইপিও এসেছে, সে ধারা এখনও চলুক, এটা কেউ চাই না। ফলে আগে এর সমাধান বের করতে হবে। তা না হলে, শুধু শেয়ারের জোগান বাড়াতে যে কোনো কোম্পানি আনলে আগের মতোই বিপদ বয়ে আনবে।’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘শেয়ারবাজার সংস্কার নিয়ে কথা বলেছি। তাদের আশ্বস্ত করেছি, শিগগির শেয়ারবাজার সংস্কারের কিছু উদ্যোগ দৃশ্যমান হবে। বিএসইসি সংস্কারের সুপারিশ প্রদানে যে টাস্কফোর্স করেছিল, তারা কিছু সুপারিশ দিয়েছে। এর বাইরে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করছি, যাতে সংস্কারের সবচেয়ে ভালো উপায়টি খুঁজে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে আন্তঃসমন্বয় বাড়াতেও কমিটি করা হয়েছে। ফলে কাজ চলছে। শেয়ারবাজারের মতো ইস্যুতে হুট করে সংস্কার করার ফল ভালো হবে না। আমরা সব দিক বিবেচনায় নিয়ে সংস্কার করার পরিকল্পনা করছি। এ সরকার সব সংস্কার করে যেতে পারবে না। তবে যতটা সম্ভব, শুরু করে যাবে।’
জানতে চাইলে ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বৈঠকটি বেশ ফলপ্রসূ ছিল। ডিবিএর পক্ষ থেকে শেয়ারবাজারের সার্বিক অবস্থা বিষয়ে মতামত দিয়েছি। সরকারের বেশ কিছু উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছি, বাজেটে সরকারের কিছু উদ্যোগ বিনিয়োগকারীরা ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন। ফলে তারা বিনিয়োগে আসছেন। তবে এখন যেভাবে বিনিয়োগ আসছে, মানুষের আগ্রহ ধরে রাখতে ভালো শেয়ারের জোগান বাড়াতে হবে। অন্যথায় একই শেয়ার কেনাবেচা করতে গিয়ে দর অতিমূল্যায়িত হওয়ার ভয় আছে। অতিমূল্যায়িত বাজার কারও জন্য ভালো নয়। তাই সময় থাকতে নতুন শেয়ারের জোগান বাড়াতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।’
সাইফুল ইসলাম জানান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী কোম্পানিগুলোর অডিট রিপোর্টের মান নিয়ে যে প্রশ্ন রয়েছে, তা সমাধানের উপায় জানতে চেয়েছেন। ডিবিএ সভাপতি বলেন, অডিট রিপোর্টের মান বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে সব কোম্পানিরই অডিট রিপোর্ট খারাপ নয়। চাইলে শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল), বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার, সরকারের প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজসহ আরও বেশ কিছু কোম্পানিকে ‘ডিরেক্ট লিস্টিং’ বা সরাসরি তালিকাভুক্তি প্রক্রিয়ায় তালিকাভুক্ত করে শেয়ারের জোগান বাড়ানো সম্ভব।
শেয়ারবাজার সংস্কারে ১০ মাস আগে টাস্কফোর্স গঠন হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো সংস্কার কাজ দেখা না যাওয়া নিয়েও ডিবিএ সভাপতি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া কিছু মিউচুয়াল ফান্ড ম্যানেজারের অর্থ তছরুপ করার প্রমাণ পাওয়ার পর তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে জানান।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ য় রব জ র শ য় রব জ র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
‘সমন্বিত রোডম্যাপে ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধারের টেকসই পথ পুঁজিবাজার’
দেশের ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুঁজিবাজারই হতে পারে টেকসই পথ, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার নতুন ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। এজন্য একটি সমন্বিত রোডম্যাপ তৈরি করা প্রয়োজন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডআরএ) এবং আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে এ রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে।
আরো পড়ুন:
সিএসই-৫০ সূচক সমন্বয়, কার্যকর ১১ নভেম্বর
সাইফুল ইসলাম ডিবিএ’র প্রেসিডেন্ট পুনঃনির্বাচিত
সোমবার (৩ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জ আয়োজিত ‘ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনা: পুঁজি কেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জের অর্থনীতিবিদ হাসনাত আলম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর রিয়াজ।
আলোচনায় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। বিগত সময়ে নন পারফর্মিং লোন (এনপিএল) ২৮ শতাংশে পৌঁছছে। বর্তমানে আস্থা ফেরাতে মূলধন জরুরি। এ কাজে পুঁজিবাজার এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরি।”
প্রাইম ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হাসান ও. রশিদ বলেন, “ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে পুঁজিবাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য রেগুলেটরদের সমন্বিত মতামতের ভিত্তিতে একটি ফ্রেম ওয়ার্ক তৈরি করতে হবে।”
হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর সিনিয়র পার্টনার এএফএম নেসার উদ্দীন বলেন, “বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশের ব্যাংকের বেশি ছাড় দেওয়ার কারণেই মন্দ ঋণ বেড়েছে। মন্দ ঋণের ব্যাংকগুলোকে আস্থা ফেরাতে অবশ্যাই খেলাপী পরিচালকদের বের করে দিয়ে আমানতকারীদের হাতে ব্যাংকের দায়িত্ব তুলে দিতে হবে।”
ঢাকা স্টক একচেঞ্জ ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নাই। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এ দুইটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা থাকলে অর্থনীতি আগানো কঠিন হবে। একইসঙ্গে অর্থমন্ত্রণালয় ও আইডআরএ-কে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা উচিত।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অন্যতম দূর্বলতা কার্যকর বন্ড মার্কেট না থাকা। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বন্ড মার্কেট খুবই শক্তিশালী। বাংলাদেশকে অর্থনীতিকে নিয়ে সম্পদভিত্তিক বন্ড মার্কেট দরকার। বন্ডের নীতিমালা শক্তিশালী করে ট্রেজারি বন্ডকে পুঁজিবাজারে লেনদেনযোগ্য করতে হবে। এই বন্ডকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছেও পরিচিত করতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “বন্ড মার্কেটকে শক্তিশালীকরণের পাশাপাশি জনপ্রিয় করতে আগামী ১০ বছরের মুনাফার ওপর কর মওকুফ করতে হবে। ক্যাপিটাল গেইনের ওপর যেমন ছাড় ছিল, ঠিক তেমনি বন্ডের ওপর করছাড় দিতে হবে। একইসঙ্গে মার্জার সংক্রান্ত আইনেরও কিছুটা সংশোধনী আনতে হবে। সেটা না হলে দেশের ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা ফেরানো কঠিন হবে “
সিটি ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, “ব্যাংকের ঋণকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ডে বিচার করতে হবে। ঋণগুলোতে তিনভাগে ভাগ করে পৃথক পৃথক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশকে অবশ্যই অর্থনীতির বৈশ্বিক সূচকগুলো মানতে হবে। এর বাইরে বাংলাদেশের ন্যারেটিভ তৈরি করা সম্ভব নয়।”
পুঁজিবাজারবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জানালিস্ট ফোরামের (সিএমএজেএফ) প্রেসিডেন্ট এসএম গোলাম সামদানী ভূঁইয়া বলেছেন, “পুঁজিবাজারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে যে সমস্ত বহুজাতিক কোম্পানি এখনো পুঁজিবাজারে আসেনি বা তালিকাভুক্ত হয়নি, সেগুলোকে দ্রুত তালিকাভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি কোম্পানি যেগুলো এখন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, সেগুলোতে দ্রুত তালিকাভুক্ত করতে হবে। ভালো ভারো কোম্পানি বাজারে আসলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়বে এবং এর ইতিবাচক প্রভাব ব্যাংকগুলোর শেয়ার দরে পড়বে। তখন ব্যাংক রাইট ও বোনাস শেয়ার ছেড়ে টাকা তোলা সম্ভব হবে।”
অর্থসূচকের সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, “বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। আর্থিক খাতের উন্নয়নে সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো জরুরি। এছাড়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুশাসন ফিরিয়ে আনা জরুরি।”
সিএমজেএফ নির্বাহী কমিটির সদস্য ও রাইজিংবিডি ডটকমের সিনিয়র রিপোর্টার নুরুজ্জামান তানিম বলেন, “ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ার ফলে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ ঘাটতি পূরণে ব্যাংকগুলো সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে সরাসরি মূলধন সংগ্রহ করতে পারে। বর্তমানে পুঁজিবাজারই হতে পারে ব্যাংকিং খাতের আস্থা ফিরিয়ে আনার টেকসই পথ। এজন্য বাস্তবায়নযোগ্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, এনবিআর, আইডআরএ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে নীতিগত সমন্বয় প্রয়োজন। সেইসঙ্গে ব্যাংকগুলোতে করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”
আলোচনার শেষ পর্বে বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর রিয়াজ বলেন, “বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে জাতীয় কৌশল নেই। সেইসাথে এই কৌশলের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও নাই। বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে রেগুলেটরি ম্যাপিং প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের ক্যাপিটালাইজেশন ও নন পারফর্মিং লোন রিকভারি- এ দুই জায়গাতেই বাধা আছে। সেখানে সুর্নির্ধারিত বা নিয়মিত নীতিমালা নাই। তবে সেটা আলোচনার মাধ্যমে দূর করতে হবে।”
তিনি বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা একেবারে বড় লাফ দিতে পারব না। স্থানীয় বাস্তবতাকে মাথায় রেখে আমাদের চলতে হবে। সরকারের সহযোগিতা, সমন্বিত রোডম্যাপ প্রণয়ন, আইনগত সংস্কার ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলেই ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।”
আলোচনায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ওয়াজিদ হাসান শাহ প্রমুখ বক্তব্য দেন।
ঢাকা/এনটি/মেহেদী