গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক মোড় ঘোরানোর দিন ছিল। শেখ হাসিরা সরকার পতনের পর (৮ আগস্ট ২০২৪) দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।

সরকারের এক বছরের সফলতা-ব্যর্থতার আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে অর্থনীতি, বিচার সংস্কার এবং মব ভায়োলেন্সের মতো ইস্যুগুলো। এই এক বছরে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে এনেছে একাধিক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিশেষ করে রমজান ও ঈদুল আজহা দুই বড় ধর্মীয় উৎসবেই বাজার ছিল নজিরবিহীন স্থিতিশীল। যা গত দশকের ইতিহাসে এক বিরল উদাহরণ।

ব্যবসা সহজ করতে নতুন অধ্যায়
ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরোধ, প্রতারণা বা অনৈতিক চুক্তি এসব সমাধানে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে আইনি প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এখন সেই সমস্যার স্থায়ী সমাধান আনতে সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য আদালত প্রতিষ্ঠার।

আরো পড়ুন:

অন্তর্বর্তী সরকার: এক বছরে সফলতা ও ব্যর্থতা

রাজনীতিতে পরিবর্তন ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে

বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন,“বাণিজ্য আদলতের খসড়া আইন প্রণয়ন চলছে। প্রথমে ঢাকা ও বিভাগীয় শহরে এই আদালত চালু হবে, পরে প্রয়োজনে জেলা পর্যায়েও বিস্তৃত হবে। ব্যবসা সহজীকরণে এটি একটি বড় মাইলফলক হবে।”

রেকর্ড নজরদারি ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা
গত বছর যেখানে বাজার পর্যবেক্ষণ দল ছিল ১২টি, এখন সেই সংখ্যা বেড়ে ২৮-এ দাঁড়িয়েছে। তদারকির পরিধি এখন জেলা-উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। রমজান ও কোরবানির সময় ৪০০ এর বেশি নজরদারি টিম সার্বক্ষণিক মাঠে ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম।

সরবরাহ শৃঙ্খল নিশ্চিত করতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) আরো শক্তিশালী করা হয়েছে। প্রায় এক কোটি পরিবারের কাছে ভর্তুকিমূল্যে পণ্য পৌঁছানো হচ্ছে।

স্মার্টকার্ড ও সহায়তাপ্রযুক্তি 
টিসিবির ভর্তুকি কার্যক্রমে স্মার্টকার্ড ব্যবস্থা চালু হলেও গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের অনেকের স্মার্টফোন নেই, ফলে প্রযুক্তি ব্যবহারে জটিলতা দেখা দিয়েছে।

বাণিজ্য সচিব বলেন, “প্রযুক্তিনির্ভর হলেও মানবিক বিবেচনাও রাখতে হচ্ছে, যাতে কেউ বাদ না পড়ে।”

রপ্তানিতে ইতিবাচক সুর ও বহুপাক্ষিক চুক্তি
বিশ্ববাজারে অস্থিরতা সত্ত্বেও রপ্তানি আয় বেড়েছে। পণ্যের বৈচিত্র্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় সাফল্য এসেছে যার নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে। আগস্টে জাপানের সঙ্গে ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (EPA)–এর সপ্তম রাউন্ড শুরু হবে। ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গেও আলোচনা চলছে।

মূল্যস্ফীতির পতন: পরিসংখ্যান বলছে অগ্রগতি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই: খাদ্যসামগ্রীর মূল্যস্ফীতি ১৪.

১০% (১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ)। ২০২৫ সালের জুন: তা কমে দাঁড়ায় ৭.৩৯% (দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন) অখাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিও কমে জুনে ৯.৩৭%-এ দাঁড়িয়েছে।

চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও পাইকারি খুচরা দামের ফারাক
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাবি করছে, বাজারে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পাইকারি ও খুচরা দামের অযৌক্তিক ব্যবধানও এখন সরকারের নজরদারির মধ্যে।

ভবিষ্যতের লক্ষ্য: টেকসই ও দুর্নীতিমুক্ত বাজার
বাণিজ্য সচিব বলেন, “টেকসই বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শুধু সরকারি উদ্যোগ নয়, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। আমরা চাই প্রযুক্তিনির্ভর, দুর্নীতিমুক্ত ও সর্বজনীন বাজার।”

তিনি বলেন, “বাণিজ্য আদালত চালু হলে ব্যবসায়িক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি, লেনদেনে স্বচ্ছতা ও বাজার শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে প্রযুক্তিগত অবকাঠামো ও দক্ষ জনবল নিশ্চিত করাই হবে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।”

রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান বলেন, “এক বছরে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ গতি পেয়েছে নজরদারি, ভর্তুকি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে। তবে কিছু পণ্যের দামের অস্থিরতা, প্রযুক্তি ব্যবহারে গ্রামীণ সীমাবদ্ধতা এবং রপ্তানি বাজারের বৈশ্বিক ঝুঁকি এখনও বিদ্যমান।বাণিজ্য আদালত বাস্তবায়ন হলে ব্যবসা বাণিজ্যে একটি প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা আসতে পারে যা দীর্ঘমেয়াদে বাজার স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে।”

ঢাকা/এসবি

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সরক র সরক র র নজরদ র এক বছর ব যবস বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক বিলিয়ন ডলারের সয়াবিন আনা হবে

বাংলাদেশের তিনটি বড় শিল্পগোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক বছরে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের সয়াবিনবীজ আমদানি করবে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, সিটি গ্রুপ ও ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ।

এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল (ইউএসএসইসি) ও ইউএস সয়ের সঙ্গে দেশীয় তিন প্রতিষ্ঠান আগ্রহপত্র (এলওআই) সই করেছে। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত এলওআই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য আফেয়ার্স ট্রেসি জ্যাকবসন, ইউএসএসইসির নির্বাহী পরিচালক কেভিন এম রোপকি; মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ও পরিচালক তানজিমা বিনতে মোস্তফা; সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হাসান; ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি আমিরুল হক; স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয়সহ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি আমিরুল হক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের মান সব সময়ই অন্যদের চেয়ে ভালো থাকে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিনবীজের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক। আমাদের সামনে আরও অনেক সুযোগ রয়েছে। আমরা চাইলে বাংলাদেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারি। দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য–ঘাটতি রয়েছে। আমরা এলপিজি, অপরিশোধিত তেল ও সয়াবিন আনতে পারলে দুই দেশের মধ্যে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হবে।’

মেঘনা গ্রুপের পরিচালক তানজিমা বিনতে মোস্তফা বলেন, ‘আমরা গর্বিত যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানির মাধ্যমে বাংলাদেশের খাদ্য ও পশুখাদ্যের সরবরাহব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার অংশীদারত্বে যুক্ত হতে পেরেছি। গত এক বছরে আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছি। এ বছর মেঘনা গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০ লাখ টন সয়াবিন আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে সেই লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।’

তানজিমা বিনতে মোস্তফা আরও বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নিয়েছি তাদের পণ্যের মান, পরিবহনব্যবস্থা ও স্বচ্ছ নিয়মভিত্তিক বাণিজ্যের কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আগ্রহপত্র বা এলওআই স্বাক্ষর দেশে খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, কৃষিশিল্পকে আরও জোরদার করা এবং টেকসই সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। বর্তমানে সয়াবিন আমদানিতে যে শুল্ককাঠামো রয়েছে, তা আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করছে। শুল্ককাঠামো ঠিক করা হলে পোলট্রি ও মৎস্য খাতের খাদ্যের দাম সাশ্রয়ী থাকবে।’

আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নিয়েছি তাদের পণ্যের মান, পরিবহনব্যবস্থা ও স্বচ্ছ নিয়মভিত্তিক বাণিজ্যের কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আগ্রহপত্র বা এলওআই স্বাক্ষর দেশে খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, কৃষিশিল্পকে আরও জোরদার করা এবং টেকসই সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাহায্য করবেতানজিমা বিনতে মোস্তফা, পরিচালক, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ।

সিটি গ্রুপের এমডি মো. হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশের খাদ্য সরবরাহব্যবস্থায় গুণগত মান বজায় রাখা ও তা টেকসই করে তুলতে আমরা সব সময় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা উচ্চমানের মার্কিন সয়াবিনের ব্যবহার বাড়াতে চাই। এতে ভোক্তাদের কাছে উন্নতমানের পণ্য পৌঁছে দেওয়া যাবে। তাতে দেশের ক্রমবর্ধমান প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হবে। এই এলওআই দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে এবং জ্ঞান ও প্রযুক্তি বিনিময় এবং কৃষি উদ্ভাবন ও অগ্রগতির নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।’

এলওআই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য আফেয়ার্স ট্রেসি জ্যাকবসন বলেন, ‘আমরা আসলে দুই দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের কথা বলছি, যেখানে কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ৭৭ কোটি ৯০ লাখ ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। আর এ বছর তা এক বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে বলে আশা করছি।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী সয়াবিনবীজ আমদানি হয় মূলত ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৭৮ কোটি ডলারের ১৭ লাখ ৩৫ হাজার টন সয়াবিন আমদানি হয়েছিল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হয়েছিল ৩৫ কোটি ডলারের সয়াবিনবীজ, যা এবার আরও বাড়তে পারে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মিয়ানমার সংঘাতের আঞ্চলিক প্রভাব যাচাইয়ে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন জার্মানির সংসদ সদস্য
  • পেঁয়াজের দামবৃদ্ধিতে কার পকেট ভারী?
  • ধামরাইয়ের বাজারে বাড়ছে সবজির সরবরাহ, দাম অপরিবর্তিত 
  • বালু নিয়ে দ্বন্দ্ব, বাঁধের কাজ বন্ধ
  • চাঁপাইনবাবগঞ্জে পেঁয়াজের দামে সেঞ্চুরি
  • যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক বিলিয়ন ডলারের সয়াবিন আনা হবে
  • মধ্যস্থতা নিয়ে আদানির প্রস্তাবে রাজি নয় পিডিবি