২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন মোড় এনে দেয়। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাখাতে বৈষম্য, যুব সমাজের বেকারত্ব এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের ক্ষোভ জমতে থাকে। এরই প্রেক্ষাপটে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে ছাত্র আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি।

এ সময় জবি শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও আন্দোলনের গতি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পেছনে থেকে তাদের সংগঠিত করেন জবি শাখা ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি আসাদুজ্জামান আসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সুজন মোল্লা।

আরো পড়ুন:

কিছু দিন পর দেখা যাবে, গণঅভ্যুত্থানটাই নাই: সারজিস

জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান চলছে

আন্দোলনের শুরু থেকে জবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে আন্দোলনে অংশ নিলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তাৎপরতার ফলে তা বেশিদিন দীর্ঘায়িত হয়নি। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ও কারফিউ জারি করা হলে ধীরে ধীরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কিছুটা কমলে প্রকাশ্যে আন্দোলনে নামে ছাত্রদল।

এমন পরিস্থিতিতে পুরান ঢাকা কেন্দ্রীক আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা ও আন্দোলনের গতি বাড়াতে ধীরে ধীরে সম্মুখে এসে আন্দোলনের হাল ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারা। বিশেষ করে ১৭ জুলাই থেকে রাজধানীর সদরঘাট, ধোলাইখাল, রায় সাহেব বাজার, তাঁতি বাজার, সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী ছাড়াও বেশ কয়েকটি জায়গায় আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেন জবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।

গত বছর ১১ জুলাই যখন একযোগে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের চরম মারমুখী অবস্থানের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারছিলেন না, ঠিক সেই সময় সিদ্ধান্ত হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শাহবাগে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে রায়সাহেব বাজার মোড়ে আসলে পুলিশি ব্যারিকেডে আটকে যায়।

বাধা পেরিয়ে মিছিল সামনের দিকে যেতে থাকলে গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে এসে ফের আটকে দেয় পুলিশ। সেখান থেকে পুলিশি বাধা অতিক্রম করে মিছিল হাইকোর্টের সামনে গেলে ফের বাধার মুখে পড়ে। মিছিলে অংশ নেওয়া জবি শিক্ষার্থীদের সরাসরি শাহবাগ না গিয়ে দোয়েল চত্ত্বর হয়ে টিএসসির দিকে এগিয়ে যেতে বললে তা প্রত্যাখ্যান করে শাহবাগে যায় সেই মিছিল।

এদিন ঠিক একইভাবে রায়সাহেব বাজার এলাকা থেকে আরো একটি মিছিল নিয়ে শাহবাগে যায় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। ১১ জুলাইয়ের এ মিছিলে সরাসরি অংশ নেন জবি ছাত্রদল নেতা মোস্তাফিজুর রহমান রুমি, ডেনি, রবিউল ইসলাম শাওন, মেরাজ হোসেন, মোবাইদুর রহমান, হিমু রহমান, মাহিদ হোসেন শাহাদত হোসেনসহ আরো অনেকে। এ খবর পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসে শাহবাগ দখলে নেয়।

১৪ জুলাই পলাতক প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশাল মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। ১৫ জুলাই প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে বিজয় একাত্তর হলের সামনে জবি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এই মিছিলের অগ্রভাগে থেকে স্লোগানে প্রকম্পিত করে তোলে ছাত্রদল কর্মী আতিকুর রহমান তানজীল।

ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই বিক্ষোভ মিছিল বের করলে মিছিলে সরাসরি গুলি করে আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছোটনসহ তার অনুসারীরা। এতে গুলিবিদ্ধ হন ছাত্রদল কর্মী ফেরদৌস, নাসিম, অনিক। এছাড়া জবি শিক্ষার্থী প্রভা গুলিবিদ্ধ হন।

গুলিবিদ্ধ অনিককে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায় জুলাইয়ের অগ্রসর সৈনিক ছাত্রদলের আবু বক্কর খান। তিনি খুলনা জেলার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র প্রতিনিধি ছিলেন। আহত হন আরো অর্ধ শতাধিক শিক্ষার্থী। তবে পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর ছাত্রদল থেকে বের হয়ে গণতান্ত্রীক ছাত্র সংসদে (বাগছাস) যোগ দেন ফয়সাল মুরাদ ও ফেরদৌস।

১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে চট্টগ্রামে ওয়াসিম ও রংপুরে আবু সাইদ নিহতের প্রতিবাদে রাজধানীর বায়তুল মোকাররমে গায়েবানা জানাজা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জবি ছাত্রদল নেতা সুমন সরদারকে। ১৮ জুলাই জবি সমন্বয়ক গ্রুপ থেকে ঘোষণা করা হয় দুপুর দেড়টায় বাংলা বাজারে মিছিল করা হবে। এ সময় মিছিল করতে গেলে ফয়সাল মুরাদসহ ছাত্রদল কর্মী আয়াতুল্লা আল মাহমুদকে ঘেরাও করে পুলিশ। পরে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ।

১৯ জুলাই শুক্রবার সারা দেশে কারফিউ চলাকালে বাদ জুম্মা পুরান ঢাকা এলাকায় শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করলে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এদিন পুলিশের গুলিতে লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার এলাকায় চারজন নিতহ হন। এদিনই পুলিশের গুলিতে চোখ হারান জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালয়ের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সুজন মোল্লা।

আন্দোলন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ২০ জুলাই কারফিউ ভেঙ্গে যাত্রাবাড়ী এলাকায় স্থানীয়দের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন জবি ছাত্রদল নেতা জাফর আহম্মেদ, মাশফিক, শামীম। মিরপুরে সাখাওয়াতুল ইসলাম পরাগ, আরিফ। বিএনপি পার্টি অফিসের সামনে ব্যাপক পুলিশ, সেনাবাহিনী অবস্থান নিলে ফকিরাপুল এলাকায় মিছিল করেন ছাত্রনেতা কাজী জিয়া উদ্দিন বাসেতসহ মিয়া রাসেলসহ অনেকে। এদিনও রণক্ষেত্রে পরিণত হয় লক্ষ্মিবাজার এলাকা। 

আন্দোলন যখন চরম পর্যায়ে, চারদিকে লাশের মিছিল ঠিক সেই সময় ৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করেন। সেদিন রাতেই সমন্বয়ক কমিটির একটি অনলাইন মিটিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ৪ আগস্ট ছাত্রদল, শিবির ও বাম সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। চোখে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই পল্টনে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ফেলে সুজন মোল্লা ও আসাদুজ্জামান আসলাম এই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার কথা জানান আন্দোলনকারীদের। 

এদিন পরিস্থিতি যখন থমথমে, সেই সময় জবি ছাত্রদলের বর্তমান আহ্বায়ক মেহেদী হাসান হিমেল, সদস্য সচিব শামসুল আরেফিনসহ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা রায় সাহেব বাজার মোড়ে অবস্থা নেন। পরে সেখান থেকে মিছিল বের নিয়ে সেন্ট গ্রেগরির সামনে গেলে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের জবি শাখার সভাপতি ইব্রাহিম ফরাজি ও সাধারণ সম্পাদক আখতার হোসেন এবং ছোটন, রঞ্জন ও হযরত কমিশনারসহ যুবলীগের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র ও বন্দুক নিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসে। পরে ছাত্রদলের সম্মিলিত প্রতিরোধে তারা পিছু হঠতে বাধ্য হয়।

জুলাইয়ে অগ্রভাগ থাকা আহ্বায়ক সদস্য আবু বক্কর খান বলেন, “জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিলের স্লোগানে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার; কখনো শেখ হাসিনা।’ এই স্লোগান আমি ই দিই। সঙ্গে ছাত্রদলের আরও সদস্য ছিলো। ১৫ জুলাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন উপার্চয়ের কাছে সকল আন্দোলন কারীর পক্ষ থেকে আমি সহ ০৫ জনের প্রতিনিধি টিম দেখা করি এবং সকল শিক্ষকের সার্মথন চাই। ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় নির্দেশনা মোতাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই এবং শহীদুল্লাহ্ হলের সামনে জীবন বাজি রেখে শিক্ষার্থী রক্ষা , যেটা বিভিন্ন টিভি মিডিয়ায় প্রচার হয় ( ডিবিসি নিউজ )। ১৬ জুলাই ক্যাম্পাস থেকে আন্দোলন বের হলে যুবলীগ গুলি করে , গুলিতে আহত অনিক কে হাসপাতালে আমি নিয়ে গেছি, যেটা তখন সকল টিভি মিডিয়ায় প্রচার করে। ১৯ জুলাই জুম্মার নামাজের পর লক্ষ্মীবাজার ছাত্র জনতা প্রতিরোধ গড়ি তুলি।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান রুমি বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থী এবং সমন্বয়করা শাহবাগ অবরোধ কর্মসূচিতে যোগদিতে যখন দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যায় তখন শিক্ষার্থীদের একটা অংশ বিছিন্ন ভাবে ক্যাম্পাস থেকে শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলো। আমি ও আমার সহযোদ্ধারা কোর্টের মধ্যে অপেক্ষারত ছিলাম। যদিও ১১ তারিখ পরিস্থিতি বিবেচনায় শাহবাগ পৌঁছানোটা আমাদের জন্য ওতোটা সহজ ছিলোনা তবুও বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার্থীরা যখন শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলো তখন আমরা তাঁতিবাজার থেকে শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ করে ছাত্রলীগ ও পুলিশের দেওয়া বেশ কয়েকটি বেরিকেড ভেঙে যখন দ্বিতীয় মিছিল নিয়ে শাহবাগ পৌঁছাই তখন উপস্থিত সকলের মধ্যে সাহস সঞ্চারিত হয়।

১৭ জুলাই রাজধানীর বয়তুল মোকাররমে শহীদ আবু সাইদ ও ওয়াসিমের গায়েবানা জানাজা থেকে গ্রেফতার হওয়া জবি ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সুমন সরদার বলেন, আমরা একটা মুক্ত বাংলাদেশের অপেক্ষায় ছিলাম। জেলখানায় বিভীষিকাময় সময় পার করেছি। ওই সময়ে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিলো সবাই আতঙ্কে থাকতাম, বিশেষ করে যাদের দলীয় পরিচয় ছিলো। ৪ আগস্ট যখন আমাকে জেলখানার এক সেল থেকে অন্য সেলে নেওয়া হয় তখন আমি ভেবেছি আজকেই আমার সময় শেষ। অবশেষে হাজারো মানুষের রক্তের বিনিময়ে ৫ আগস্ট পেলাম।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক মিয়া রাসেল বলেন, “৫ জুন ২০২৪ সালে হাইকোর্টের রায়ের পর শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। বিএনপির পরামর্শে দেশের সব ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সংগঠিতভাবে আন্দোলন পরিচালনা করেছে। আমরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও রানিং ছাত্রদল হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখি। জুলাইয়ে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে ‘বাংলা ব্লকেড’সহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিই। ১৬ জুলাই নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে আমাদের সহযোদ্ধা অনিক কুমার দাসের সঙ্গে দেখা হয়, সে সেদিন গুলিবিদ্ধ হয় যুবলীগ আওয়ামী লীগের হাতে।”

ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক ও সাবেক কমিটির দপ্তর সম্পাদক সাখাওয়াত ইসলাম খান পরাগ স্মৃতিচারণ করে জানিয়েছেন, শিক্ষা খাতে বৈষম্য, বেকারত্ব ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকেই জবি ছাত্রদল সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আন্দোলনের সূচনা করে। জুলাই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শাহবাগ, সদরঘাট, রায় সাহেব বাজার, সায়দাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে নেতৃত্ব দেন তারা।

তিনি জানান, গুলি, টিয়ারগ্যাস ও হামলায় বহু নেতা-কর্মী আহত হন এবং শহীদ হন ইকরামুল হক সাজিদ। পুলিশি বাধা, গ্রেপ্তার ও ক্যাম্পাস বন্ধ থাকা সত্ত্বেও তারা রাজপথে টিকে থেকে আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেন। গণঅভ্যুত্থান শুধু সরকারের পতন নয়, ছাত্র রাজনীতিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাহসী ভূমিকা ইতিহাসে স্থায়ী দাগ রেখে গেছে।

(লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)

ঢাকা/মেহেদী

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ল ই গণঅভ য ত থ ন ছ ত রদল য় ছ ত রদল র পর স থ ত ১৬ জ ল ই তৎক ল ন র রহম ন এল ক য় শ হব গ র স মন য বল গ অবস থ ইসল ম আগস ট ই সময়

এছাড়াও পড়ুন:

নিষিদ্ধ সময়ে নফল নামাজ: কখন পড়া যাবে, কখন নয়

ইসলামে নামাজের জন্য কিছু সময়কে ‘নিষেধের সময়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যখন সাধারণত নফল নামাজ আদায় করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এই নির্দেশনা এসেছে যেন মুসলিমরা ইবাদতে কোনো ধরনের শিরক বা পৌত্তলিকতার সন্দেহের ধারেকাছেও না যায় এবং নামাজের সময়গুলো কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট থাকে।

হাদিসে এই নিষিদ্ধ সময়গুলোর বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে।

আল-কুদস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিকহ ও উসুল বিশেষজ্ঞ হুসামুদ্দিন আফানাহ এই সংক্রান্ত হাদিসগুলো ও ফিকহবিদদের বক্তব্য সারসংক্ষেপ করেছেন। তবে এই নিষেধাজ্ঞার সময়গুলোতেও কিছু বিশেষ কারণযুক্ত নফল নামাজ আদায় করা বৈধ, যেমন ‘তাহিয়্যাতুল মসজিদ’ (মসজিদে প্রবেশের নামাজ) ইত্যাদি।

স্পষ্ট নিষিদ্ধ ৫ সময়

রাসুলুল্লাহ (সা.) একাধিক হাদিসে মোট পাঁচটি সময়ে বিশেষভাবে নফল নামাজ আদায় করতে নিষেধ করেছেন। এই পাঁচটি সময়ে নিষিদ্ধতা সাধারণ নফল নামাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে এ সময়গুলোতে কাজা নামাজ আদায় করা বৈধ।

ক. তিন নির্দিষ্ট মহাজাগতিক মুহূর্ত: উকবা ইবনে আমের আল-জুহানি (রা.) বলেন, “তিনটি সময়ে আল্লাহর রাসুল আমাদের নামাজ পড়তে বা আমাদের মৃতদের দাফন করতে নিষেধ করতেন: যখন সূর্য উদয় হতে থাকে যতক্ষণ না তা পুরোপুরি উপরে উঠে যায়; যখন সূর্য মধ্যাকাশে থাকে যতক্ষণ না তা পশ্চিম দিকে হেলে যায়; এবং যখন সূর্য ডোবার জন্য ঝুঁকে যায় যতক্ষণ না তা ডুবে যায়।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৩১)

এই হাদিস অনুযায়ী, তিনটি নির্দিষ্ট মুহূর্ত হল:

১। সূর্যোদয়ের সময়: সূর্য পুরোপুরি উঠে যাওয়া পর্যন্ত।

২। মধ্যাহ্নের সময়: যখন সূর্য ঠিক মাথার ওপরে থাকে (ঠিক দ্বিপ্রহরের সময়)।

৩। সূর্যাস্তের সময়: যখন সূর্য অস্ত যেতে শুরু করে এবং পুরোপুরি ডুবে যায়।

আরও পড়ুনইসলামে গিবত নিষিদ্ধ: পরচর্চা ও পরনিন্দা মারাত্মক পাপ১৯ এপ্রিল ২০২৪

খ. দুই ফরজ নামাজের পর: আবু সাইদ খুদরি (রা.) বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, নবীজি বলেছেন, “আসরের ফরজ নামাজের পর সূর্য ডোবা পর্যন্ত কোনো নামাজ নেই, এবং ফজরের ফরজ নামাজের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত কোনো নামাজ নেই।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮২৭)

এই হাদিস অনুযায়ী, আরও দুটি সময় নিষিদ্ধ:

৪। আসরের ফরজ নামাজের পর: সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত।

৫। ফজরের ফরজ নামাজের পর: সূর্য পুরোপুরি উঠে যাওয়া পর্যন্ত।

তবে মনে রাখতে হবে, এই নিষেধাজ্ঞা নামাজের সঙ্গে সম্পর্কিত, সময়ের সঙ্গে নয়। অর্থাৎ কেউ যদি আসরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার অনেক পরে নামাজ আদায় করে, তবে তার নামাজ শেষ হওয়ার পর থেকেই নফল নামাজ নিষিদ্ধ হবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮২৭)

বিশেষ কারণে নিষিদ্ধ অন্যান্য সময়

উপরের পাঁচটি সময় ছাড়াও আরও কিছু পরিস্থিতি আছে, যখন নফল নামাজ আদায় করা উচিত নয়।

ক. ফজরের আজান ও জামাতের মধ্যে: ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি বলেছেন, “ফজরের পর দুই সিজদা ছাড়া আর কোনো নামাজ নেই।” (তিরমিজি, হাদিস: ৪১৯)

ইমাম তিরমিজি (রহ.) বলেছেন, এই হাদিসের অর্থ হল, ফজরের আজান হওয়ার পর থেকে ফরজ নামাজের ইকামত দেওয়া পর্যন্ত শুধুমাত্র ফজরের দুই রাকাত সুন্নাত ছাড়া অন্য কোনো নফল নামাজ পড়া মাকরুহ।

হাফসা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, “আল্লাহ রাসুল ফজর উদিত হওয়ার পর কেবল দুটি সংক্ষিপ্ত রাকাত (ফজরের সুন্নাত) পড়তেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৭২)

খ. ফরজ নামাজের ইকামত হলে: আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি বলেছেন, “যখন নামাজের জন্য ইকামত দেওয়া হয়, তখন ফরজ নামাজ ছাড়া আর কোনো নামাজ নেই।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭১০)

গ. দুই ঈদের নামাজের আগে: ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) ঈদের দিন বের হয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়লেন। তিনি এর আগে বা পরে কোনো নামাজ পড়েননি।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৮৯)।

অতএব, ঈদের জামাতের আগে কোনো নফল নামাজ পড়া উচিত নয়।

আরও পড়ুনজীবিকার জন্য পরিশ্রম করা ইবাদত১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ঘ. জুমার খুতবার সময়: আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি বলেছেন, “জুমার দিন যখন ইমাম খুতবা দেন, তুমি যদি তোমার সঙ্গীকে বলো: ‘চুপ করো’দ, তবে তুমিও অনর্থক কাজ করলে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৩৪

ইমাম খুতবা দেওয়ার সময় নফল নামাজে ব্যস্ত থাকা ‘নীরবতা রক্ষা করে খুতবা শোনা’র ওয়াজিবের পরিপন্থী।

নিষিদ্ধ সময়ে বৈধ নামাজ

উপরে বর্ণিত নিষিদ্ধ সময়গুলোর মধ্যে কিছু বিশেষ অবস্থায় নামাজ আদায় করার বৈধতা রয়েছে। এই মতটি অনেক ফিক্‌হবিদের কাছে গ্রহণযোগ্য।

ক. কাজা নামাজ: কেউ যদি নামাজ ভুলে যায় বা ঘুমিয়ে পড়ার কারণে তার ফরজ নামাজ কাজা হয়ে যায়, তবে সেই নামাজ নিষিদ্ধ সময়েও স্মরণ হওয়া মাত্র আদায় করা যাবে।

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, “কেউ যদি নামাজ ভুলে যায় অথবা ঘুমিয়ে থাকে, তবে যখনই তার মনে পড়বে, সে যেন তা আদায় করে নেয়। এর কোনো কাফফারা নেই, কেবল এটিই তার কাফফারা।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৯৭)

খ. তাহিয়্যাতুল মসজিদ: মসজিদে প্রবেশ করার পর বসার আগে দুই রাকাত ‘তাহিয়্যাতুল মসজিদ’ নামাজ মসজিদে ঢোকার আদব হিসেবে পড়া মোস্তাহাব। অনেকের মতে, এটি নিষিদ্ধ সময়েও পড়া বৈধ।

কেননা, নবীজি (সা.) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করে, তখন সে যেন দুই রাকাত নামাজ না পড়ে না বসে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৪৪)

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, জুমার দিন নবীজি (সা.) খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে বসে পড়লেন। নবীজি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি দুই রাকাত নামাজ পড়েছ?” সে বলল, “না।” তিনি বললেন, “তাহলে উঠে দুই রাকাত সংক্ষিপ্ত নামাজ পড়ে নাও।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৪৩)

শরীয়তে নফল নামাজকে উৎসাহিত করা হলেও, কিছু নির্দিষ্ট সময়ে নফল নামাজ বর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ একাগ্রতা নিশ্চিত করার জন্য। এই নিষেধাজ্ঞা মূলত সাধারণ নফল নামাজের জন্য প্রযোজ্য।

তবে কাজা নামাজ এবং তাহিয়্যাতুল মসজিদের মতো কারণযুক্ত নফল নামাজ নিষিদ্ধ সময়েও আদায় করা যায়, যা এই নিষেধের সাধারণ বিধান থেকে ব্যতিক্রম।

আরও পড়ুননফল ইবাদত গোপনে আদায় করা উত্তম০৫ অক্টোবর ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ