করপোরেটের ধাক্কায় নিতাইগঞ্জের ব্যবসায় মন্দা
Published: 18th, October 2025 GMT
নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে গড়ে ওঠা নিতাইগঞ্জ একসময় ছিল দেশের অন্যতম পাইকারি মোকাম। আটা, ময়দা, চিনি, লবণ, ডাল, ভোজ্যতেলসহ নানা ধরনের খাদ্যপণ্য ও গবাদিপশুর খাদ্যও এখান থেকে দেশের ৪০ টির বেশি জেলায় সরবরাহ হতো। প্রতিদিন লেনদেন হতো কয়েক শ কোটি টাকার। নৌ ও সড়কপথে যাতায়াতের সুবিধা থাকায় এখান থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মালামাল সহজেই পৌঁছাত।
কিন্তু নিতাইগঞ্জের সেই ব্যস্ততা এখন আর নেই। অনেক মিলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, গুদামগুলোর অধিকাংশ জায়গাই ফাঁকা, ক্রেতার সমাগম খুব কম—সব মিলিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই ব্যবসাকেন্দ্রে নেমেছে মন্দার ছায়া।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জের বিবি সড়কের নিতাইগঞ্জে শ্রমিকেরা ট্রাকে আটা-ময়দা তুলছেন, কেউ ঠেলাগাড়িতে মাল আনছেন। গম, চাল, ডাল আনলোডের কাজও চলছে। কিন্তু কর্মচাঞ্চল্য আগের মতো নেই। পাইকারি বেচাকেনা কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ী, কর্মচারী ও শ্রমিকেরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। অথচ আগে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকারি ব্যবসায়ীদের পদচারণে নিতাইগঞ্জ মুখর থাকত। এলাকাটি এখন অনেকটাই যেন নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে।
নিতাইগঞ্জের জয় ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক কৃষ্ণ বাবু, যিনি ৩৫ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন, বলেন, ‘আগে প্রতিদিন শতাধিক ট্রাকে মাল লোড-আনলোড হতো, এখন তার অর্ধেকও হয় না।’
পাইকারি মুদি ব্যবসায়ী দিলীপ রায় বলেন, ‘একসময় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বেচাকেনা হতো। এখন ব্যবসার কর্মব্যস্ততায় ভাটা পড়েছে, ক্রেতাও কম।’
করপোরেট আগ্রাসন ও বাজার সংকোচন
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বিদেশ থেকে গম, চিনি, সয়াবিন ইত্যাদি আমদানি করে প্রক্রিয়াজাত করে সরাসরি সুপারশপ ও পরিবেশকদের কাছে সরবরাহ করছে। ফলে নিতাইগঞ্জের পাইকাররা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না।
ভাই ভাই ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক পরিতোষ সাহা বলেন, ‘নব্বইয়ের দশক থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ছিল সোনালি সময়। তখন দিনে শতাধিক ট্রাক মাল আসত, এখন ৩০-৪০ ট্রাকও আসে না। বড় বড় করপোরেট কোম্পানি সরাসরি বাজারে আসায় আমাদের মতো মাঝারি ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা ব্যবসায়ী সজীব হোসেন বলেন, ‘আগে সবকিছু নিতাইগঞ্জ থেকেই নেওয়া হতো। এখন কোম্পানি থেকেই দোকানে মাল পৌঁছে দেয়। পরিবহন খরচ বাঁচে। তাই মাসে তিন-চারবারের বদলে এক-দুবার নিতাইগঞ্জে আসি।’
ডাল ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আগে আমরা নিজেরাই ভারত থেকে ডাল ও ছোলা আনতাম। এখন বড় গ্রুপগুলো কার্গো জাহাজে মাল আনে—আমাদের পক্ষে টেকা সম্ভব নয়।’
অর্থনৈতিক সংকট ও প্রভাব
একসময় নিতাইগঞ্জের ব্যাংকগুলোতে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হতো, এখন সেটিও অর্ধেকে নেমে এসেছে। ব্যবসায়ে ধস নামায় স্থানীয় অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়েছে। আগে শত শত শ্রমিক পণ্য ওঠানো–নামানো, বস্তা সেলাই, ট্রাকে পণ্য লোড–আনলোডের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এখন তাঁদের অনেকেই কাজ হারিয়েছেন।
বরিশালের বাকেরগঞ্জের দুলাল হাওলাদার, যিনি ৩৮ বছর ধরে এখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন, তিনি বলেন, ‘আগে কাজের চাপ সামলানো যেত না, এখন কাজ অর্ধেক কমে গেছে। তাই অনেক শ্রমিক অন্য পেশায় চলে গেছেন।’
খাজা গরীবে নেওয়াজ লবণ মিলের মালিক পুলক দেওয়ান বলেন, ব্যবসা আগের মতো নেই। পাইকারদের আনাগোনা কমায় প্রভাব পড়েছে। আগে পাঁচজন শ্রমিক ছিলেন, এখন দুজনেই কাজ চালাতে হয়।
অবকাঠামো সমস্যা
ব্যবসায়ীরা জানান, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো পাড়া–মহল্লা পর্যন্ত পণ্য পৌঁছে দেওয়ায় নিতাইগঞ্জ যেমন মার খেয়েছে তেমনি যানজট, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি ও ডলার–সংকটের কারণেও ব্যবসা দুর্বল হয়েছে। এখানকার ৭২টি ফ্লাওয়ার মিলের অর্ধেকই এখন বন্ধ, অন্যগুলোও ঠিকমতো চলছে না।
১৯৭২ সাল থেকে ব্যবসা করছেন ওয়াজেদ আলী বাবুল। তিনি অটো ফ্লাওয়ার মিল বিজনেস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের সভাপতি। বলেন, আগে নারায়ণগঞ্জ পাটের জন্য বিখ্যাত ছিল, এখন পাটের ব্যবসা নেই। মদনগঞ্জে ধান-চালের গাল্লাও নেই। নিতাইগঞ্জও একই পথে হাঁটছে। এর অস্তিত্ব টিকবে কিনা সন্দেহ।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক আহমেদুর রহমান বলেন, নিতাইগঞ্জ দেশের পাইকারি ব্যবসার ঐতিহ্য। ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা ও সহজ ঋণ না দিলে ঐতিহ্যবাহী এই পাইকারি মোকামটি টিকবে না। এটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
ঐতিহ্য বিলুপ্তির আশঙ্কা
নিতাইগঞ্জ শুধু একটি বাজার নয়, এটি নারায়ণগঞ্জের অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রতীক। যুগ যুগ ধরে এখান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খাদ্যপণ্য সরবরাহ হয়েছে। এখন ব্যবসায়ে ধস নামায় স্থানীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে একটি ঐতিহ্য।
ব্যবসায়ী বিকাশ দাস বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদারা এই মোকাম গড়েছিলেন। এখন যদি সরকারি সহায়তা না মেলে, নিতাইগঞ্জের নাম হয়তো ভবিষ্যতে শুধু বইয়ে পড়তে হবে।’
নিতাইগঞ্জ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি শংকর সাহা বলেন, নিতাইগঞ্জ দুই শতকের ঐতিহ্যের পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র। করপোরেট আগ্রাসন, আমদানিনির্ভরতা ও লজিস্টিক সমস্যায় ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেচাকেনা অর্ধেকে নেমেছে। অনেক মিল বন্ধ, গুদাম ফাঁকা, শ্রমিকদের কর্মসংস্থান কমেছে। সরকার যদি ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা ও সহজ ঋণের ব্যবস্থা না করে তাহলে নিতাইগঞ্জ হয়তো ভবিষ্যতে শুধু ইতিহাসের পাতায়ই থাকবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস য় দ র ন ত ইগঞ জ র ন র য়ণগঞ জ করপ র ট র ব যবস অর ধ ক এখন ব
এছাড়াও পড়ুন:
খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় সিদ্ধিরগঞ্জে মান্নানের দোয়া
বিএনপির চেয়ারপারসন, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি ও সুস্থ্যতা কামনায় নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপি ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে ৫টি মাদ্রাসার আলেম-ওলামায় কেরাম ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে দোয়া মাহফিল করেছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য, সোনারগাঁও উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁও-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে বিএনপির মনোনিত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী জনাব আজহারুল ইসলাম মান্নান।
সোমবার (১ ডিসেম্বর) বাদ আছর সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন মধ্য সানারপাড় বিডিডিএল মাঠে এই দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
এতে জামিয়া ইসলামিয়া উলুম সানারপাড় মাদরাসা ও এতিমখানা, জাবালে নূর তাহফিজুল কুরআন মাদরাসা, জামিয়া রাশিদিয়া মাদরাসা সহ ৫টি মাদরাসার আলেম ওলামা ও শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। বিপুলসংখ্যক আলেম ওলামায় কেরামগণ ও এতিমখানার শিক্ষার্থীরা দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে অংশগ্রহণ করেছেন।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুনের সভাপতিত্বে থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক জুয়েল প্রধানের পরিচালনায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব আজহারুল ইসলাম মান্নান।
এতে উপস্থিত ছিলেন জেলা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির ৩নং ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি তৈয়ব হোসেন, বিএনপি নেতা হাজী মোহাম্মদ হোসেন, নারায়ণগঞ্জ মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব মমিনুর রহমান বাবু, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব রেদোয়ান রহমান পাপ্পু, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক রুবেল হোসেন, নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সদস্য আরমান হোসেন, আশিকুর রহমান অনি, থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আহমেদ হুমায়ুন কবির, নুরুল ইসলাম, কর্নেল, সুহিন, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সদস্য জাহাঙ্গীর আলম, মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি সিফাতুর রহমান রাজু, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সবুজ খান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য জামাল হোসেন, সোনারগাঁও উপজেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক ফজলুর হক ভূঁইয়া মেম্বার, যুগ্ম আহ্বায়ক কবির হোসেন, ৪নং ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি সোহেল মাহামুদ, ১নং ওয়ার্ড যুবদলের সেক্রেটারি মোস্তফা, মহানগর জাসাসের যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল হাই, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রদল নেতা জুবায়ের প্রমূখ।