সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), জন্ম-মৃত্যু, বিয়ে ও বিয়েবিচ্ছেদ ইত্যাদি নিবন্ধন এবং ইউনিক আইডিসহ বিভিন্ন নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার একটি স্থায়ী নাগরিক নিবন্ধন কমিশন (সিআরসি) গঠন করতে যাচ্ছে। এ খবর থেকে এটিও জানা যায় যে, উপদেষ্টা পরিষদের নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ইতোমধ্যে ওই কমিশনের সম্ভাব্য কাঠামো, কার্যক্রম ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সংবলিত একটি অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়ন করেছে, যা নিয়ে গত ৩ ফেব্রুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তৎপরতার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, উল্লিখিত কমিশন গঠনের বিষয়টিকে সরকার বিশেষ অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব দিয়ে খুবই দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। 

এখন কথা হচ্ছে, যেসব কাজ সম্পাদনের কথা বলে ওই কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সে কাজগুলো সর্বোচ্চ দক্ষতার সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ও হয়রানিমুক্ত ব্যবস্থার অধীনে সম্পন্ন করার জন্য এরূপ একটি কমিশন গঠন সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত কিনা, তা কি যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়েছে? নাকি এনআইডি সেবা আগের মতো নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে যাবে নাকি জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অধ্যাদেশ ২০২৩-এর বিধান অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত হবে মর্মে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে, সে বিতর্ককে প্রশমনের জন্যই এটি করা হয়েছে? প্রশ্নটি কেন উঠল সেটি এবং উল্লিখিত কর্মকাণ্ড সম্পাদনের জন্য সিআরসি গঠন কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে আলোচনা হওয়াটা জরুরি বলে মনে করি। কারণ, নানা অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানের আধিক্যের ভারে বাংলাদেশের রাষ্ট্র খাতের এমনিতেই ন্যুব্জদশা। তার ওপর যদি আগে থেকে চলে আসা একটি পুরোনো কাজের জন্য নতুন করে এনআরসি’র মতো আরেকটি মাথাভারী প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাতে রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যয়ই শুধু বাড়বে না,  আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের সমস্যাও নিশ্চিতভাবেই বাড়বে এবং সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নতুনতর জটিলতার সৃষ্টি হবে। 

এনআইডি-সংক্রান্ত কার্যক্রম গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচন কমিশনের আওতাতেই চলে আসছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে অনেকটা হঠাৎ করে এ দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় ন্যস্তকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কাজটি দীর্ঘদিন থেকে নির্বাচন কমিশনের আওতায় চলে আসার সুবাদে অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে আইডি কার্ডের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকার কারণে নির্বাচন কমিশন এটি তাদের নিজেদের আওতাতেই রাখতে চায়, যে দাবি তাদের প্রতিনিধি গত ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকেও উত্থাপন করেছেন। তদুপরি এ দাবি পুনর্ব্যক্ত করে গত ৯ মার্চ তারা মন্ত্রিপরিষদের কাছে পুনরায় একটি চিঠিও পাঠিয়েছে। অন্যদিকে, এনআইডি কার্ড প্রদানের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় ন্যস্ত করার কারণটি মোটেও বোধগম্য নয়। কারণ, নাগরিক মাত্রেরই, এমনকি তিনি যদি চিহ্নিত বা দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীও হন, এনআইডি কার্ড পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ অবস্থায় এনআইডি কার্যক্রম কার আওতায় সম্পন্ন হবে– এ নিয়ে উল্লিখিত দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে নতুন করে নাগরিক নিবন্ধন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা, তা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এনআইডি প্রদানের কাজটি উল্লিখিত দুই প্রতিষ্ঠানের কেউই করে না, করে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো, যেটি বাংলাদেশেও হওয়া উচিত। ফলে এ কাজের জন্য নতুন করে কমিশন (সিআরসি) গঠন না করে কাজটি কীভাবে ক্রমান্বয়ে পুরোপুরিভাবে স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত করা যায়, তা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে মনে করি।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজটি বিশ্বজুড়ে প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবেই স্থানীয় সরকার কর্তৃক সম্পন্ন হয়ে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও সে ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এখানে এটি চালু হয়েছে পাসপোর্ট ও এনআইডি প্রদান-সংক্রান্ত কাজের শর্তের অংশ হিসেবে, স্বতন্ত্র ব্যবস্থা হিসেবে নয়। আসলে একে নিয়মিত বাধ্যতামূলক নাগরিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে চালু করা প্রয়োজন। এ কাজের জন্য সিআরসি করা হলে তা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও স্বনির্ভর করে তোলার চিন্তাভাবনাকে আরও পিছিয়ে দেবে। এমনিতেই কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনীতিক ও আমলাদের কেউই নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী হতে দিতে চান না। এ অবস্থায় রাজধানীকেন্দ্রিক সিআরসি গঠন করা হলে রাজনীতিক ও আমলাদের ওই হীনআকাঙ্ক্ষাই আরও প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে যাবে বৈকি! মোটকথা, সিআরসি গঠন পরিপূর্ণভাবেই সংবিধান নির্দেশিত স্বনির্ভর-শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলাসংক্রান্ত ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। 

বিয়ে ও বিয়েবিচ্ছেদ-সংক্রান্ত নিবন্ধন ব্যবস্থাটি বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি কাজ। জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের মতো এটিও যত দ্রুত সম্ভব স্থানীয় সরকারের আওতায় ন্যস্ত করা উচিত বলে মনে করি। এনআরসি’র আওতায় ইউনিক আইডি প্রদান-সংক্রান্ত যে সেবা সহায়তার কথা বলা হচ্ছে, সেটি বস্তুত আইডি কার্ড সেবারই সম্প্রসারিত অংশ। ফলে এটিও যে খুব স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় সরকারের আওতায় থাকা উচিত, তা বলাই বাহুল্য। তারপরও বলতে হচ্ছে এ কারণে যে, সিআরসি গঠনের যুক্তি হিসেবে ইউনিক আইডি প্রদানকেও একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কাজ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, যা ধারণাগতভাবে একেবারেই সঠিক নয়।

তারপরও যদি উল্লিখিত বাস্তবতা এবং তথ্য ও যুক্তিকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার সিআরসি গঠনে অটল থাকে, তাহলে একেবারে প্রথমেই তাকে যে সমস্যায় পড়তে হবে তা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের সমস্যা। কারণ, মাঠ পর্যায়ে সিআরসির কোনো বিস্তৃততর নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে উল্লিখিত তথ্যের জন্য তাদের শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের ওপরই নির্ভর করতে হবে। এতে করে সমন্বয়ের সমস্যাই শুধু বাড়বে না– পুরো প্রক্রিয়াটিই এক বিদঘুটে জটিল আকার ধারণ করবে। যদি বলা হয় যে, সিআরসি সারাদেশে তার বিস্তৃততর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে, তাহলে সেটি হবে মাথাভারী প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে আরেক অনাকাঙ্ক্ষিত ও অবাস্তব চিন্তা। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের আওতায় যেকোনো নতুন কমিশন বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা মানেই রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়া, যা ইতোমধ্যে সামন্ত যুগের রাজসিক কায়কারবারকেও ছাড়িয়ে গেছে। বাজেটের আওতায় বাংলাদেশের ‘রাজ কর্মচারীদে’র পেছনে ব্যয়িত অর্থের হিস্যা এখন প্রায় ৪৩ শতাংশ। সিআরসি গঠনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয় এটিকে আর বাড়াতে চাইবেন না। সরকারের সংস্কার কর্মসূচির অন্যতম উদ্দেশ্য তো রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা জনসেবাকে জটিলতামুক্ত করা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় জোরদারকরণ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যয় কমিয়ে আনা। কিন্তু সিআরসি গঠনের মধ্য দিয়ে এসবের মধ্যকার সবক’টিই লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।


আবু তাহের খান: অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি; সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), শিল্প মন্ত্রণালয়
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন গর ক স থ ন য় সরক র র উল ল খ ত র আওত য় ব যবস থ র জন য মন ত র সমস য স আরস গঠন র

এছাড়াও পড়ুন:

নাইক্ষ্যংছড়িতে হতদরিদ্রদের নামে ২৫০ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ নিয়ে লোপাট

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের দুর্গম একটি গ্রাম হলদ্যাশিয়া। এ গ্রামের লোকসংখ্যা প্রায় দুই হাজার। পাহাড়ঘেরা গ্রামটির চারদিকে রাবার বাগান। পুরুষদের পেশা দিনমজুরি। করোনা ভাইরাসের প্রকোপের সময় এই গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আইয়ুব, ফরিদুল আলমসহ আরও কয়েকজনের কাছে আর্থিক ও খাদ্যসহায়তা এবং চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংগ্রহ করা হয়। এর প্রায় এক মাস পর তাঁদের পটিয়া সাবরেজিস্ট্রি অফিসের পাশের একটি দোকানে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁদের ২০-৩০ হাজার টাকা দিয়ে ইংরেজিতে লেখা নথিপত্রে স্বাক্ষর ও টিপসই নেওয়া হয়।

এরপর ২০২৩ সাল থেকে তাঁদের নামে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে ঋণের নোটিশ আসা শুরু হয়। তখন তাঁরা বুঝতে পারেন স্বাক্ষর ও টিপসই দিয়ে ফেঁসে গেছেন। তাঁরাসহ ইউসিবি ব্যাংক থেকে ঋণ পরিশোধের চিঠি পেয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী, ঈদগড় ও গর্জনিয়া ইউনিয়নের ২২ জন নারী-পুরুষ। তাঁরা সবাই হতদরিদ্র-দিনমজুর ও ভূমিহীন।

২০২৩ সাল থেকে এ বছরের মে মাস পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের চিঠি এসেছে তাঁদের কাছে। এই ২২ জনের নামে ২৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে ইউসিবিএলের চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী, চকবাজার ও চট্টগ্রাম বন্দর শাখা থেকে। এই ঋণ জালিয়াতির নেপথ্যে রয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের পরিবার। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই পরিবারের সদস্যরা নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ বের করে নেন। সেই অর্থে বিশ্বের একাধিক দেশে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন তাঁরা। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যে এই সাবেক মন্ত্রীর পরিবারের সম্পদ জব্দও করা হয়েছে।

যেভাবে ঋণের ফাঁদ পাতা হয়

কক্সবাজারের রামু উপজেলার ঈদগড়ের বাসিন্দা মিজানুর রহমান ও বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারীর নুরুল বশর হতদরিদ্রদের কাছ থেকে এনআইডি সংগ্রহ করে দেওয়ার দায়িত্ব পান। তাঁরা পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে এনআইডি সংগ্রহ করেন। একসময় তাঁরা নিজেরাও ঋণের ফাঁদে পড়েন। মিজানুর রহমান ৯ কোটি টাকা ও নুরুল বশর ১৩ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়েছেন।

দিনমজুর-ভূমিহীন ২২ জনের নামে ইউসিবি ব্যাংকে হিসাব খুলে ঋণ জালিয়াতি।

মিজানুর রহমান বলেন, ঈদগড়ের পানিস্যাঘোনা এলাকার আবুল কালাম তাঁদের দিয়ে এ কাজ করিয়েছেন। আবুল কালাম নুরুল বশরের ভগ্নিপতি। অর্থসহায়তা ও চাকরির কথা বলে কালাম এনআইডি সংগ্রহ করেন।

নুরুল বশর বলেন, তাঁর ভগ্নিপতি আবুল কালামের ফাঁদে পড়ে তিনি এখন এলাকাছাড়া। আবুল কালাম বর্তমানে চট্টগ্রামের পটিয়ায় বসবাস করেন। আবুল কালামের কথা অনুযায়ী পটিয়ায় গিয়ে তাঁরা মোস্তাফিজুর রহমান, মো. শাহজাহান ও নুরুল আনোয়ারের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর কাগজে সই করেন। পটিয়ার এই তিন ব্যক্তি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের হয়ে কাজ করেন বলে জেনেছেন তাঁরা। এলাকায় তাঁরা ‘দালাল’ হিসেবে পরিচিত।

এ প্রসঙ্গে জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর, শাহজাহান ও নুরুল আনোয়ারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। স্থানীয় লোকজন জানান, সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান ও মামলা করার পর সবাই আত্মগোপনে চলে গেছেন।

বাইশারী ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারণার ফাঁদে পড়া মানুষগুলো দিনমজুর ও ভূমিহীন। বিপদ থেকে রক্ষার জন্য তাঁরা ইউপি কার্যালয়ে এসে ধরনা দিচ্ছেন।

সরেজমিনে যা পাওয়া গেল

পাহাড়ঘেরা হলদ্যাশিয়া গ্রামের রাবার বাগানের দক্ষিণ পাশে দিনমজুর মোহাম্মদ আয়ুবের টিনের ছাউনির ঝুপড়ি ঘর। স্ত্রী, দেড় থেকে দশ বছর বয়সী দুই মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে আয়ুবের টানাটানির সংসার। দুর্গম এই গ্রামের দিনমজুর মোহাম্মদ আয়ুবকে ঋণ পরিশোধের নোটিশ দিয়েছে ইউসিবি। তাঁর ঋণের পরিমাণ ৬ কোটি ১২ লাখ টাকা।

 সম্প্রতি আয়ুবের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি বাড়ির আঙিনায় গৃহস্থালির টুকিটাকি কাজ সারছিলেন। ঋণ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘টেনশনে রাতে ঘুমাইতে পারি না। জীবনে একসঙ্গে ১ লাখ টাকা দেখি নাই। ৬ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে কীভাবে নিলাম, বুঝতে পারতেছি না।’

মোহাম্মদ আয়ুব জানান, ১৪৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম শহরে যেতে হলে তাঁর গাড়ি ভাড়া জোগাড় করতে কয়েক দিন লেগে যায়। এত দূরের শহরে তাঁর নামে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে জেনে তিনি বিস্মিত হন। তবে অর্থসহায়তা ও চাকরির কথা বলে এলাকার কিছু মানুষ তাঁর কাছ থেকে এনআইডি নিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, তারাই হয়তো এ কাজ করেছে। তিনি কখনো চট্টগ্রাম শহরের ইউসিবি ব্যাংকের কোনো শাখায় যাননি।

টেনশনে রাতে ঘুমাইতে পারি না। জীবনে একসঙ্গে ১ লাখ টাকা দেখি নাই। ৬ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে কীভাবে নিলাম, বুঝতে পারতেছি না।দিনমজুর মোহাম্মদ আয়ুব

গত ২৫ জুলাই ব্যাংকটির তিন কর্মকর্তা এসেছিলেন বাইশারীর হলদ্যাশিয়া গ্রামে। তাঁরা ভুক্তভোগী মোহাম্মদ আয়ুবের কাছেও গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের কর্মকর্তারা আমাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। যাঁদের নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে, তাঁদের সহায়-সম্পত্তির বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন। সবাইকে চট্টগ্রামে গিয়ে ব্যাংক হিসাব হালনাগাদ করতে বলেছেন।’

বাড়ির আঙিনায় বসে কথা বলতে বলতে দুশ্চিন্তায় ডুবে যান মোহাম্মদ আয়ুব। বলেন, ‘বাইশারী থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার গাড়ি ভাড়াই নেই আমাদের কাছে। ব্যাংকে যে অ্যাকাউন্ট আছে, তাই তো জানি না। আবার ঋণও নাকি আমাদেরই পরিশোধ করতে হবে।’

হলদ্যাশিয়া গ্রামের আরেক দিনমজুর মো. ফরিদুল আলমের ঘরে স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে। লোকজনের বাড়িতে বাঁশের বেড়া তৈরি করে সংসার চালান। তাঁর নামেও ইউসিবি চট্টগ্রামের বন্দর শাখা থেকে পাঠানো হয় ১০ কোটি ৮২ লাখ টাকার বকেয়া ঋণ পরিশোধের নোটিশ। নোটিশে ফরিদুল আলমকে চট্টগ্রাম জুবিলি রোডের ইউনিক এন্টারপ্রাইজের মালিক দেখানো হয়। ২০২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পাঠানো ওই নোটিশে স্বাক্ষর করেন পোর্ট শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক মো. আরিফ হোসেন।

দরিদ্র ফরিদুল আলমের (৩৯) কাছে ইউনিক এন্টারপ্রাইজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি হেসে ওঠেন। প্রতিষ্ঠানটির নামও ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘হ, শুনছি, আমি নাকি কিসের মালিক।’ চট্টগ্রামে তাঁর কোনো ব্যাংক হিসাব নেই বলেও জানালেন তিনি।

তাঁর স্ত্রী মায়মুনাও একই ধরনের নোটিশ পেয়েছেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনের নামে ব্যাংক থেকে ঋণের বোঝা চাপানো হয় ১৩ কোটি টাকা; যা সুদসহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। নোটিশে নুরুল ইসলামকে বলা হয়েছে চট্টগ্রামের ইসলাম ট্রেডার্স এবং পটিয়ার কিছু জমির মালিক।

ফেঁসে গেছেন স্বামী-স্ত্রী দুজনই

হলদ্যাশিয়া থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে রামুর ঈদগড় ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব রাজঘাট গ্রাম। গ্রামের এক পাশে দিনমজুর নুরুল ইসলামের টিনের বাড়ি। সংসারে স্ত্রী ও তিন সন্তান রয়েছে।

নুরুল ইসলাম (৪৮) বলেন, কয়েক মাস আগে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মায়মুনা আক্তারের নামে ইউসিবি চট্টগ্রামের চকবাজার শাখা থেকে দুটি নোটিশ আসে। ওই নোটিশগুলো স্থানীয় শিক্ষিত লোকজনকে পড়তে দিয়ে জানতে পারেন, তাঁর (নুরুল) নামে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার ব্যাংকঋণ রয়েছে; যা সুদসহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

তাঁর স্ত্রী মায়মুনাও একই ধরনের নোটিশ পেয়েছেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনের নামে ব্যাংক থেকে ঋণের বোঝা চাপানো হয় ১৩ কোটি টাকা; যা সুদসহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। নোটিশে নুরুল ইসলামকে বলা হয়েছে চট্টগ্রামের ইসলাম ট্রেডার্স এবং পটিয়ার কিছু জমির মালিক।

নুরুল ইসলামের পাশে আরেক দিনমজুর মো. জহির উদ্দিনের বাড়ি। জহির উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী উম্মে সালমার নামে একই ব্যাংক থেকে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধের নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশে জহির উদ্দিনের নামে ‘জহির ইন্টারন্যাশনাল’ নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেখানো হয়। জহির উদ্দিন অবাক হয়ে বলেন, ‘দিনমজুরি করে সংসার চালাই, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কোথায় পাব।’

এসব অনিয়ম-দুর্নীতি গত পরিচালনা পর্ষদের সময়ে হয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছি। হতদরিদ্র-দিনমজুর হলেও তাঁরা কিছু টাকাও যদি পেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদেরও দুর্নীতির অংশীদার হিসেবে ধরা হবে। আইন নিজস্ব গতিতে চলবেইউসিবি ব্যাংকের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা জীশান কিংশুক হক

নেপথ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর পরিবার

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে ইউসিবি ব্যাংক ছিল সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। তখন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন সাইফুজ্জামানের স্ত্রী রুখমিলা জামান। নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সাইফুজ্জামানের ছোট ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি। তাঁদের নির্দেশনায় নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণ মঞ্জুর করা হতো। ব্যাংকটির তখনকার কর্মকর্তারা ছিলেন এসব জালিয়াতির সহযোগী। সরকার বদলের পর থেকে সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরিবারের পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তারা পলাতক রয়েছেন।

ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন ব্যাংক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রামের আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও পটিয়া এলাকার দীর্ঘ সময় সংসদ সদস্য ছিলেন। এসব এলাকার লোকদের ব্যবহার করেই তাঁরা ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেন। তাঁদের পক্ষে যাঁরা এনআইডি সংগ্রহ করতেন, তাঁরা সবাই পটিয়ার।

২২ হতদরিদ্রের নামে ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউসিবি ব্যাংকের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা জীশান কিংশুক হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব অনিয়ম-দুর্নীতি গত পরিচালনা পর্ষদের সময়ে হয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছি। হতদরিদ্র-দিনমজুর হলেও তাঁরা কিছু টাকাও যদি পেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদেরও দুর্নীতির অংশীদার হিসেবে ধরা হবে। আইন নিজস্ব গতিতে চলবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নাইক্ষ্যংছড়িতে হতদরিদ্রদের নামে ২৫০ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ নিয়ে লোপাট