কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কালজয়ী উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝিতে লিখেছিলেন, ‘গতিশীল জলতলে পদ্মার মাটির বুক কেহ কোনোদিন দ্যাখে নাই, চিরকাল গোপন হইয়া আছে।’ তবে রাজশাহীতে পদ্মার এই ‘গোপন বুকে’ চলছে ধান চাষ। সেখানে এখন বোরো ধানের হাসি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী কার্যালয় বলছে, এবার পদ্মা নদীর চরে ১ হাজার ৭৬২ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে।
প্রতিবছরই পদ্মা নদীর মানচিত্র বদল হয়। এক বছর যেখানে পানি থাকে, নৌকা চলাচল করে। পরের বছর হয়তো এলাকাটি বদলে যায়। সেখানে হয়তো উঁচু চর পড়ে। পলিপড়া এই জমিতে সোনা ফলে।
গত শনিবার সকালে রাজশাহীর নগরের টি-গ্রোয়েন থেকে নৌকা নিয়ে পদ্মা নদীর বুকে জেগে ওঠা জমির ধান দেখতে বের হয়ে বুলনপুরে দেখা গেল বিরাট একটি চর পড়েছে। উপরিভাগে বালুর উঁচু আস্তরণ। দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যত্ন করে বালু সাজিয়ে রেখেছে। সেখান থেকে শহরের লোকজন প্রয়োজনে বালু বস্তায় ভরে নিচ্ছেন। অথচ গত বছরই সেখানে ছিল অথই পানি। স্থানীয় লোকজন জানালেন, এখন এই বালুর ওপরে পলির একটি আস্তরণ পড়লে এখানেও ধান চাষ করা যাবে।
সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে নৌকা চালিয়ে গেলে দেখা পাওয়া গেল সেলিম রেজা (৪২) ও মনোয়ারা বেগমের (৪৪) ধানখেত। দুই ভাই–বোন পদ্মা নদীর চরে বোরো ধান কাটছেন। কোনো শ্রমিক নেই। নিজের কোনো জমি নেই, তবু সাত বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। তাঁরা জানালেন, গত বছর যেখানে ধান চাষ করেছিলেন, এবার সেখানে অথই পানি। তার আগের বছর যেখানে করেছিলেন, সেখানে আরও গভীর পানি। এবার যেখানে চাষ করেছেন গতবার সেখানে পানি ছিল।
প্রতিবছরই পদ্মা নদীর মানচিত্র বদল হয়। এক বছর যেখানে পানি থাকে, নৌকা চলাচল করে। পরের বছর হয়তো এলাকাটি বদলে যায়। সেখানে হয়তো উঁচু চর পড়ে। পলিপড়া এই জমিতে সোনা ফলে।সেলিম রেজা ও মনোয়ারা বেগম যেখানে ধান চাষ করেছেন, সেটি জেলার পবা উপজেলার মধ্যে পড়েছে। তাঁরা দুই ভাই–বোন সাত বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। তাঁদের বাড়ি রাজশাহী নগরের রাইপাড়া মহল্লায়। ইতিমধ্যে ব্রি-২৮ ধান পাকতে শুরু করেছে। তাঁরা গত শুক্রবার থেকে ধান কাটছেন। এ ছাড়া তাঁরা এই জমিতে ব্রি-৭৫ ও ৯০ এবং জিরা ধানের চাষ করেছেন।
তাঁদের জমির এক মাথা এখনো পদ্মার পানির সঙ্গে লাগোয়া। ছোট ছোট ঢেউ দুলছে সেই খেতে। সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর একটি ছবি তৈরি হয়েছে। ওপরে আকাশ, নিচে পদ্মা নদী। তার মাঝে ধানখেত। চোখ ফেরানো যায় না!
মনোয়ারা বলেন, ‘জোজিরার মাঠের এই জমিতে এবার ধান হয়েছে। আগামীবার হবে কি না, তা বলার কোনো জো নেই। আমহারকে ধান কাইটে। জমি থাইকে উইঠে যাতি হবি। তারপর জমি পানির তলে পইড়বে। পরের বছর উঠতেও পারে, না উঠতেও পারে।’
পদ্মার বিস্তীর্ণ চরে বাতাসে দোল খায় ধানের শীষ। রাজশাহীর পবা উপজেলার জোজিরার মাঠে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ধ ন চ ষ কর ছ চ ষ কর ছ ন বছর য খ ন পদ ম র র বছর
এছাড়াও পড়ুন:
জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হলো একটু সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপান্তর এগিয়ে নেওয়া। এ জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার নিশ্চিত করা। আর কয়েক মাস পর নির্বাচন। নির্বাচন ভালোমতো করার জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করার জন্য এখন মনোযোগ দেওয়া দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা। পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা। অথচ এসব দিকে সরকারের মনোযোগ বা সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচনের এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে যেটিতে তাদের এখতিয়ার নেই, সেই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতেই সরকারের যত আগ্রহ। রীতিমতো জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে। দেশের মানুষ, বিশেষজ্ঞ—কারও কথা না শুনে, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা না করে ভয় দেখিয়ে একের পর এক চুক্তি করছে সরকার।
একটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার কোনো এখতিয়ার এ রকম অস্থায়ী সরকারের থাকে না। এসবের জন্য নির্বাচিত সরকার দরকার হয়। শুধু নির্বাচিত সরকারও এভাবে করতে পারে না। নির্বাচিত সরকার এ ধরনের চুক্তি করলে সেগুলো সংসদে তুলতে হবে, সেখানে তর্ক-বিতর্ক হবে, দেশের মানুষ জানবে। আর কয় মাস পর নির্বাচন। এই সময় সরকারের এই ধরনের চুক্তিতে এত আগ্রহ কেন? বন্দর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি যদি দেশের উন্নয়নের জন্যই হয়, তাহলে এত গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা ও তাড়াহুড়া কেন?
চুক্তি নিয়ে এই সরকারের অতি আগ্রহ বড় সন্দেহের কারণ। মনে হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির কিছু লবিস্ট এই সরকার চালাচ্ছে। তাদের কাজ হলো কোনো না কোনোভাবে বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় গোপনে অস্বচ্ছভাবে চুক্তি করে ফেলা। সেটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, যাতে পরবর্তী কোনো সরকার এসে কিছু করতে না পারে। কিন্তু এই চুক্তির বোঝা বাংলাদেশের মানুষকে ভোগ করতে হবে বহু বছর।
গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, স্বচ্ছতা নিয়মনীতি মেনে কাজ হবে, তার প্রতি এটা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়। একই সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলাপ-আলোচনা করছে, অথচ সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা নিয়ে তারা যে নিশ্চুপ থাকল, সেটার দায়িত্বও তাদের নিতে হবে।
আমরা দেখেছি, এ রকম চুক্তির আগে সব সময় যুক্তি দেওয়া হয়, বিদেশি কোম্পানি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোম্পানি। আবার মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি করা হয় যে আমরা পারব না। আমাদের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। বিদেশিরা এলে কাজ হবে। আবার আমরা থাকলে দুর্নীতি হবে। বিদেশিরা এলে দুর্নীতি হবে না। এই হীনম্মন্যতা তৈরি করে এবং তার ওপর ভর করে বিদেশি কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। বিদেশিদের পক্ষে বিজ্ঞাপনী প্রচার চালাতে থাকে তাদের সুবিধাভোগী দেশি লোকজন। কিন্তু বিদেশিরা এলে যে দুর্নীতি হবে না, সেটার নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া হয়? আন্তর্জাতিকভাবে কি দুর্নীতি হয় না? চুক্তির আগে মাশুল যে বাড়ানো হলো, এটাও তো দুর্নীতির একটা ধরন।
বিদেশি কোম্পানি যে দক্ষ, আন্তর্জাতিক যে স্বীকৃতি, সেই কোম্পানিগুলো কিন্তু এমনিতেই গড়ে ওঠেনি। জাতীয় সক্ষমতার প্রক্রিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠেছে এসব কোম্পানি। বাংলাদেশকেও জাতীয় সক্ষমতার ওপর দাঁড়াতে হবে। সে জন্য নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। একটা দেশ শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে, যখন নিজের সক্ষমতা তৈরি হয়। এই সরকার দেশকে বিপন্ন করে তার উল্টো দিকে যাত্রা করছে।
লেখক পরিচয়: অর্থনীতিবিদ ও সম্পাদক, সর্বজনকথা