রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অদম্য মাহবুবের গল্প
Published: 6th, May 2025 GMT
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ডিনস কমপ্লেক্সের শান্ত ছায়া ঘেরা পথ ধরে হাঁটলেই চোখে পড়বে এক আন্তরিক মুখ। পুরনো আর নতুন বইয়ের স্তূপের মাঝে বসে থাকা এই তরুণ উদ্যোক্তার নাম মাহবুব আলম।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ২০০৮ সালে একটি দুর্ঘটনায় ডান চোখটি হারিয়ে ফেলেন তিনি। চোখের দৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তার মনের আলোয় উদ্ভাসিত বইয়ের জগৎ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানেই চলে তার বই বিক্রি ও সাহিত্য আড্ডা।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রাজশাহী মহানগরীর মেহেরচণ্ডীর বুধপাড়ার বাসিন্দা। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট।
আরো পড়ুন:
পেটানোর পরিকল্পনা করা গ্রুপের অ্যাডমিন ছাত্রদল সম্পাদক
শিক্ষার্থীদের পেটানোর পরিকল্পনা রাবি ছাত্রদলের, স্ক্রিনশট ভাইরাল
২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে মাহবুব বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। ক্লাসের ফাঁকে অথবা ছুটির দিনগুলোতে ডিনস কমপ্লেক্সের পেছনে তার অস্থায়ী দোকানে ভিড় করেন বইপ্রেমীরা। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি তার গভীর টান। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে জেলা লাইব্রেরি পর্যন্ত ছিল তার অবাধ আনাগোনা। সেই ভালোবাসাই তাকে বই ব্যবসার পথে টেনে এনেছে।
মাহবুব জানান, পুরনো বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ তাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। বিভিন্ন জায়গা থেকে পুরনো বই সংগ্রহ করে অনলাইনে বিক্রি শুরু করেন তিনি। অপ্রত্যাশিত সাড়া পেয়ে উৎসাহের সঙ্গে এই কাজ চালিয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বই বিক্রিকে উপার্জনের একটি উৎস হিসেবে দেখেন তিনি।
বিভিন্ন জায়গা থেকে বই সংগ্রহ করে কম দামে বিক্রি করার ভাবনা তার কাছে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক, তেমনি তার নিজের চলার পথের পাথেয়। শুধু বই বিক্রিই নয়, মাহবুবের রয়েছে একটি ছোট প্রকাশনা সংস্থাও; নাম ‘বর্ণ প্রকাশনা’। এই প্রকাশনা থেকে তার প্রথম দুটি বই, একটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ ও একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রকাশনা নিয়েই কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। এবারের বইমেলায় তার লেখা ‘ফিলিস্তিনে শিশু নির্যাতন’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
তবে তার এই স্বপ্নযাত্রায় সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। মাহবুব অকপটে বলেন, “বইগুলো সংগ্রহ করতেও তো অর্থের প্রয়োজন। ছোট ও বড় ভাইয়েরা বিভিন্ন বইয়ের খোঁজ করেন। আমার কাছে যদি পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা থাকত, তাহলে আমি সেই বইগুলো স্টক করে রাখতে পারতাম এবং সবার চাহিদা পূরণ করতে পারতাম।”
বন্ধুরা তার এই উদ্যোগকে অকুণ্ঠ সমর্থন জুগিয়েছে। এক বন্ধু ১ বছর তার এই কাজে সহযোগিতা করেছে। পরবর্তীতে চাকরির সন্ধানে সেই বন্ধু সরে গেলেও অন্যদের সমর্থন আজও অটুট। বরং মাহবুবের এই কর্মোদ্যোগ তাদের মাঝেও এক ধরনের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। অনেকেই তার কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তে ও জ্ঞানার্জন করতে আগ্রহী।
পরিবার থেকে মাহবুবের এই প্রচেষ্টাকে সম্মান জানায়। নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই বহন করতে পারায় তারা খুশি। মাহবুব কখনোই অর্থনৈতিক বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন না। তার এই স্বনির্ভরতা তাদের কাছে বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। প্রতিদিন ১ থেকে ২ হাজার টাকার মতো বই বিক্রি করেন। এই টাকায় দৈনন্দিন খরচ ঠিকমতো চলে যায় তার।
এক চোখে স্বপ্ন আর বুকে সাহিত্যের ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে চলা মাহবুব আলম আজ অনেক শিক্ষার্থীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। বইয়ের জগতে তার এই নিরলস পথচলা শুধু তার ব্যক্তিগত সংগ্রাম নয়, বরং জ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি এক অদম্য ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পুরনো বইয়ের পাতায় নতুন দিনের স্বপ্ন বোনা এই তরুণ উদ্যোক্তা নিশ্চিতভাবেই একদিন তার ‘বর্ণ প্রকাশনা’কে আরো বিস্তৃত দিগন্তে নিয়ে যাবেন।
ঢাকা/মেহেদী
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উদ য ক ত ম হব ব র বই ব ক র ত র এই বইয় র
এছাড়াও পড়ুন:
জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হলো একটু সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপান্তর এগিয়ে নেওয়া। এ জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার নিশ্চিত করা। আর কয়েক মাস পর নির্বাচন। নির্বাচন ভালোমতো করার জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করার জন্য এখন মনোযোগ দেওয়া দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা। পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা। অথচ এসব দিকে সরকারের মনোযোগ বা সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচনের এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে যেটিতে তাদের এখতিয়ার নেই, সেই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতেই সরকারের যত আগ্রহ। রীতিমতো জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে। দেশের মানুষ, বিশেষজ্ঞ—কারও কথা না শুনে, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা না করে ভয় দেখিয়ে একের পর এক চুক্তি করছে সরকার।
একটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার কোনো এখতিয়ার এ রকম অস্থায়ী সরকারের থাকে না। এসবের জন্য নির্বাচিত সরকার দরকার হয়। শুধু নির্বাচিত সরকারও এভাবে করতে পারে না। নির্বাচিত সরকার এ ধরনের চুক্তি করলে সেগুলো সংসদে তুলতে হবে, সেখানে তর্ক-বিতর্ক হবে, দেশের মানুষ জানবে। আর কয় মাস পর নির্বাচন। এই সময় সরকারের এই ধরনের চুক্তিতে এত আগ্রহ কেন? বন্দর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি যদি দেশের উন্নয়নের জন্যই হয়, তাহলে এত গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা ও তাড়াহুড়া কেন?
চুক্তি নিয়ে এই সরকারের অতি আগ্রহ বড় সন্দেহের কারণ। মনে হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির কিছু লবিস্ট এই সরকার চালাচ্ছে। তাদের কাজ হলো কোনো না কোনোভাবে বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় গোপনে অস্বচ্ছভাবে চুক্তি করে ফেলা। সেটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, যাতে পরবর্তী কোনো সরকার এসে কিছু করতে না পারে। কিন্তু এই চুক্তির বোঝা বাংলাদেশের মানুষকে ভোগ করতে হবে বহু বছর।
গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, স্বচ্ছতা নিয়মনীতি মেনে কাজ হবে, তার প্রতি এটা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়। একই সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলাপ-আলোচনা করছে, অথচ সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা নিয়ে তারা যে নিশ্চুপ থাকল, সেটার দায়িত্বও তাদের নিতে হবে।
আমরা দেখেছি, এ রকম চুক্তির আগে সব সময় যুক্তি দেওয়া হয়, বিদেশি কোম্পানি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোম্পানি। আবার মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি করা হয় যে আমরা পারব না। আমাদের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। বিদেশিরা এলে কাজ হবে। আবার আমরা থাকলে দুর্নীতি হবে। বিদেশিরা এলে দুর্নীতি হবে না। এই হীনম্মন্যতা তৈরি করে এবং তার ওপর ভর করে বিদেশি কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। বিদেশিদের পক্ষে বিজ্ঞাপনী প্রচার চালাতে থাকে তাদের সুবিধাভোগী দেশি লোকজন। কিন্তু বিদেশিরা এলে যে দুর্নীতি হবে না, সেটার নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া হয়? আন্তর্জাতিকভাবে কি দুর্নীতি হয় না? চুক্তির আগে মাশুল যে বাড়ানো হলো, এটাও তো দুর্নীতির একটা ধরন।
বিদেশি কোম্পানি যে দক্ষ, আন্তর্জাতিক যে স্বীকৃতি, সেই কোম্পানিগুলো কিন্তু এমনিতেই গড়ে ওঠেনি। জাতীয় সক্ষমতার প্রক্রিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠেছে এসব কোম্পানি। বাংলাদেশকেও জাতীয় সক্ষমতার ওপর দাঁড়াতে হবে। সে জন্য নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। একটা দেশ শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে, যখন নিজের সক্ষমতা তৈরি হয়। এই সরকার দেশকে বিপন্ন করে তার উল্টো দিকে যাত্রা করছে।
লেখক পরিচয়: অর্থনীতিবিদ ও সম্পাদক, সর্বজনকথা