পানে চিনিপোকার আক্রমণে দিশেহারা চাষিরা
Published: 10th, May 2025 GMT
আকারে খুবই ছোট, নরম দেহ। গায়ে সাদা মোমের মতো স্তর। দেখতে চিনির দানার মতো। তাই, কৃষকরা এ পোকার নাম দিয়েছেন ‘চিনিপোকা’। এরা পানগাছের পাতা, কাণ্ড ও ডগায় দল বেঁধে থাকে। রস চুষে খায়। ফলে, পাতায় অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তামাটে দাগ দেখা দেয়। কোনোভাবেই এ পোকা দমন করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন রাজশাহীর পানচাষিরা।
পানচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন বছর আগে তারা প্রথম চিনিপোকার আক্রমণ দেখতে পান। তারপর বহু কীটনাকশক স্প্রে করেছেন, কিন্তু লাভ হয়নি। কেউ ব্যবহার করেছেন নিমের তেল। কেউ পানিতে মরিচের গুড়া ও হ্যান্ডওয়াশ মিশিয়ে স্প্রে করেছেন। কেউ আবার পানিতে গুল ও উঁকুননাশক শ্যাম্পু স্প্রে করেছেন। তাতেও কোনো কাজ হয়নি।
চিনিপোকায় আক্রান্ত পানপাতা যে বিক্রি হয় না, তা নয়। অল্প দামে গ্রামের হাটে এ পানও বিকিয়ে যায়। তারপর দোকানে দোকানে এই পানের খিলি বানিয়ে দেওয়া হয়। ভোক্তারাও তা খান। কিন্তু, এই পানপাতা খেলে স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
রাজশাহীর মোহনপুর, পবা, দুর্গাপুর, বাগমারা ও পুঠিয়া উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে পানবরজ আছে। এসব বরজ থেকে বছরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার পান বিক্রি হয়। রাজশাহীর পানের বাজার আমের বাজারের চেয়েও বড়। রাজশাহীর মিষ্টি পানের সুনামও সবখানে। তাই, গত বছর ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ‘রাজশাহীর মিষ্টি পান’। এই মিষ্টি পানের রস চুষে খাচ্ছে চিনিপোকা।
সম্প্রতি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার দাওকান্দি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বরজ থেকে পানপাতা তুলে বাড়ির উঠোনে সাজাচ্ছিলেন নাজমুল হক। তখন চিনিপোকায় আক্রান্ত পাতাগুলো তিনি আলাদা করে রাখছিলেন।
নাজমুল জানান, অন্য পানপাতা বিক্রি হয় বেশি দামে, চিনিপোকায় আক্রান্ত পাতা বিক্রি হয় কম দামে। গ্রামের হাট থেকে এসব পান বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। তারপর দোকানে দোকানে খিলি করে বিক্রি হয়। আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল মানুষও বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এ পান খেয়ে থাকেন।
ওই গ্রামের পানচাষি মোশাররফ হোসেন জানান, তিন বছর আগে তারা প্রথম চিনিপোকার আক্রমণ দেখেন। চিনিপোকা ওঠে মাটি থেকে। তাপমাত্রা বেশি থাকলে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়। তবে, শীতেও দেখা যায়। বৃষ্টি হলে এ পোকা পাতা থেকে ধুয়ে পড়ে যায়। চিনির মতো দেখতে এ পোকায় হাত দিলেই গলে যায়।
মোশাররফের ধারণা, বরজে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এ পোকার আক্রমণ ঘটেছে।
রাজশাহীর পবা উপজেলার কালুপাড়া গ্রামে শহীদুল ইসলামের বরজে গিয়ে দেখা যায়, পানপাতায় চিনিপোকা আক্রমণ করেছে।
শহীদুল জানান, ওষুধ কোম্পানির লোকজন এসে পানবরজ দেখে যান। তিন বছর ধরে নানা ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ নিমের তেলের সঙ্গে ডিটারজেন্ট কিংবা হ্যান্ডওয়াশ মিশিয়ে স্প্রে করেন। কেউ আবার পানির সঙ্গে গুল ও উঁকুননাশক শ্যাম্পু স্প্রে করেন। কিন্তু, তেমন কাজ হয় না। ১০ দিন বরজ ভালো থাকে। তারপর আবার পাতায় পাতায় পোকার আক্রমণ দেখা যায়।
দাওকান্দি বাজার থেকে বিড়া বিড়া পান কিনে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। হাটে গিয়ে দেখা যায়, এক বিড়া (৬৪ পাতা) বড় আকারের ভালো পান বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১২০ টাকায়, চিনিপোকায় আক্রান্ত পান বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়।
হাটে কথা হয় পানচাষি রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, “এ এক ভয়ঙ্কর পোকা। তিন বছর আগে একটা-দুইটা করে দেখা গিয়েছিল। পরে অনেক পোকা হয়। বহু চেষ্টা করেছি, কিন্তু দমন করতে পারিনি। এমন কোনো বরজ নেই, যেখানে এ পোকা পাওয়া যাবে না। রস চুষে খাওয়ার কারণে অনেক পাতা হলুদ হয়ে বরজেই ঝরে পড়ে। এর ফলে উৎপাদন কমে যাচ্ছে, লোকসান হচ্ছে। কারণ, সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন বরজ করতে অতিরিক্ত খরচ।”
চিনিপোকায় আক্রান্ত পানপাতা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে ভোক্তাদের স্বাস্থ্যেও। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের পান খেলে সরাসরি বড় কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি না থাকলেও পরোক্ষভাবে বেশকিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। চিনিপোকা গাছের পাতায় মিষ্টি রস নিঃসরণ করে, ফলে পাতার গায়ে গাঢ় রঙের ছাঁচ জন্ম নেয়। এ ছাঁচ পরিষ্কার না করা হলে তা মানুষের পরিপাকতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। আবার পোকা দমনের জন্য ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ পাতায় থেকে যায়। এসব পান স্বাস্থ্যের জন্য হতে পারে বিপজ্জনক।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক শংকর কে বিশ্বাস বলেছেন, “চিনিপোকার আক্রমণ থাকা পান খেলে হালকা বিষক্রিয়া হতে পারে। এ ধরনের পান একাধিক বার খেলে বমি, আমাশয়, ডায়রিয়া, জন্ডিস, পেটে অস্বস্তি কিংবা অরুচির মতো সমস্যা দিতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এ পান খেলে ক্যান্সার হতে পারে।”
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা বলেছেন, মানুষ সরাসরি পানপাতা খান বলে এতে অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে চাষিদের আপাতত অর্গানিক উপায়ে চিনিপোকা দমনের চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে নিমের তেল, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট ও গুল ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, বরজে গিয়ে তারা চিনিপোকার কথা জানতে পারেন। এখন পর্যন্ত এ পোকা দমনে আলাদা কোনো কীটনাশক নেই। তাই, এ বিষয়ে গবেষণার জন্য বগুড়ার মসলা গবেষণাকেন্দ্রকে বলা হয়েছে। তারা এটা নিয়ে গবেষণা করে। তবে, তারাও এ পর্যন্ত কোনো পরামর্শ দিতে পারেননি।
মসলা গবেষণাকেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.
তিনি বলেন, “চিনিপোকার আলাদা ওষুধের জন্য গবেষণা প্রয়োজন। রাজশাহীর মিষ্টি পান নিয়েও গবেষণা হওয়া দরকার। গত বছর ডিসি সম্মেলনে এ দাবি উঠেছিল। এরপর সরকারের তরফ থেকে আমাদের মতামত চাওয়া হয়। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলাম। কিন্তু, এখন আর এটার কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এটা হলে রাজশাহীর পানের জন্য খুব ভালো হবে।”
ঢাকা/রফিক
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবহ র কর ক ব যবহ র ত ন বছর কর ছ ন র জন য ত রপর ক রমণ
এছাড়াও পড়ুন:
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া
রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর-সংলগ্ন মিরপুর সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
আজ সোমবার বিকেলে সাড়ে তিনটার দিকে এই চিত্র দেখা যায়। এই ঘটনায় উভয় পক্ষের কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
দুপুরের দিকে দুটি এক্সকাভেটর নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙতে গিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীরা। পরে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এরপর বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে দফায় দফায় ৩২ নম্বর সড়কে যাওয়ার চেষ্টা করে আসছেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি ঘটনাস্থলে আছেন র্যাব ও বিজিবির সদস্যরা। তাঁরা শক্ত অবস্থানে আছেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আজ দুপুরের দিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সামনের মিরপুর সড়কে দুটি এক্সকাভেটর দেখা যায়।
পরে বিক্ষোভকারীরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে এক্সকাভেটর ঢোকানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লাঠিপেটা করে।
কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিক্ষোভকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ করে ইটপাটকেল ছোড়ে। এ সময় পুলিশের অন্তত এক সদস্য আহত হন।
আরও পড়ুনএক্সকাভেটর নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যাওয়া বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ৪ ঘণ্টা আগেপরে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড মেরে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গের চেষ্টা করে। এ সময় দফায় দফায় সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দ শোনা যায়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
বেলা পৌনে ২টার দিকে দুই ভাগে ভাগ হয়ে বিক্ষোভকারীরা আবার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে তাঁদের আবার ছত্রভঙ্গ করে দেয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ।
বিক্ষোভকারীদের ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে যাওয়ার জন্য দফায় দফায় চেষ্টা এবং তাঁদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। নিউমার্কেট থেকে মিরপুরমুখী সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুনরায়কে কেন্দ্র করে ঢাকায় নিরাপত্তা জোরদার, ১৫ হাজার পুলিশ মোতায়েন৫ ঘণ্টা আগেবিক্ষোভকারীরা পুরোপুরি সরে না যাওয়ায়, বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে দফায় দফায় ৩২ নম্বর সড়কে আসার চেষ্টা করায় এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসংখ্যা বাড়ানো হয়। এখন এলাকায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানমন্ডি অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার জিসানুল হক দুপুরে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমরা কোনোমতে কাউকে আইন হাতে তুলে নিতে দেব না।’
গত ফেব্রুয়ারিতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটির অর্ধেকের বেশি অংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ৩২ নম্বরের বাড়িটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুনআড়াই ঘণ্টা ধরে পড়া হলো রায়, এরপর এল মৃত্যুদণ্ডের আদেশ২ ঘণ্টা আগে