ছবি :প্রথম আলো

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

দুটি নোবেল পাওয়ার জন্য চবি গর্ববোধ করতে পারে

দুটি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গর্ব করতে পারে উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যখন নিজের পরিচয় দেয়, হয়তো নোবেলের জন্য গৌরববোধ করে। কিন্তু চবির গৌরববোধ করার কারণ দুটি আছে। পুরো কর্মসূচি, যার জন্য নোবেল পুরস্কার, এর গোড়াপত্তন হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটি তো আমি ব্যক্তিগতভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। তারপর যে গ্রামীণ ব্যাংক সৃষ্টি হলো, এই ব্যাংকের গোড়াতেও চবি।”

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে এটা পরিষ্কার লেখা আছে যে, এটা কোথা থেকে এলো? ব্যাংকের জন্ম হয়েছে চবিতে অর্থনীতি বিভাগে, এটা স্পষ্ট উল্লেখ আছে।এই ব্যাংকও নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। কাজেই দুটি নোবেল পুরস্কারের বিষয় চবি তার ছাত্র-ছাত্রীদের এর ইতিহাস জানাতে পারে। তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা ঠিক করবে যে তারা কী ধরনের ভবিষ্যৎ গড়তে চায়।”

বুধবার (১৪ মে) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

আরো পড়ুন:

আঞ্চলিক অর্থনীতি ও নেপালের সঙ্গে জলবিদ্যুৎ সহযোগিতার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন জারি

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার।

এছাড়া উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য (অ্যাকাডেমিক) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন প্রমুখ।

নিজের সাবেক কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তনে এসে স্মৃতিচারণ করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি শিক্ষক হিসেবে এসেছিলাম। যতই দিন গেল দেখলাম আমি ছাত্র হয়ে গেছি। আমি আর শিক্ষকতার ভূমিকায় নাই। আমি শিখছি, ক্রমাগত শিখছি। এই জোবরার (এলাকার নাম) সহ্যাপাড়া, দেওয়াননগরের যে মহিলারা ছিল তারাই আমার শিক্ষক হলো। তাদের কাছ থেকে আমি ও আমার ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক কিছু শিখলাম। তখন অবাক হয়েছিলাম, ক্লাসরুমে যা পড়াই তার সঙ্গে কিছুর মিল নেই।”

চুয়াত্তর সালে দুর্ভিক্ষ ও নিজের কর্মকাণ্ড নিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “চুয়াত্তর সালে বিরাট দুর্ভিক্ষ হলো। সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। মনের মধ্যে বহু জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হলো। মনে মনে ভাবলাম, সারা বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর ক্ষমতা আমার নাই। আমি চেষ্টা করতে পারি কয়েকটি পরিবারের যদি দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে পারি। নজর পড়লো পাশের গ্রাম জোবরার ওপর।কী করবো জোবরাতে? সারা দেশে হাহাকার! জোবরাতে কেউ তখনো মারা যায়নি, কিন্তু অবস্থা কাহিল। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগলো, এই চবি আর জোবরা গ্রামের মাঝামাঝি বিশাল জমি পড়ে আছে। এখানে তো অনেক ফসল হওয়ার কথা, তাতে তো তাদের সারা বছরের খাবার সংস্থান হওয়ার কথা। জিজ্ঞেস করে জানলাম বৃষ্টি হয় না দেখে এখানে ফসল চাষ হয় না।”

চবি সমাবর্তনে বক্তব্য দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস

তেভাগা খামার তৈরির ইতিহাস বর্ণনা করে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বলেন, “পানির সমস্যা মেটাতে ডিপ টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করা হলো। ফসলও হলো। পরের বছর ছড়া থেকে পানি নিয়ে চাষ করবে বললো। ছড়ায় বাঁধ দেওয়া হলো। বাঁধে যে পানি এলো, সেটা ডিপ টিউবওয়েল থেকে অনেক বেশি পানি। নতুন একটা শিক্ষা হলো। বুঝলাম, ইচ্ছা না থাকলে সবকিছু থাকা সত্ত্বেও অভাব থেকে যায়। পানি আছে, জমি আছে, চাষ করা যায় কিন্তু কেউ করেনি কোনোদিন। ফলে জন্মলাভ করলো তেভাগা খামার, সেটা দিয়ে যাত্রা শুরু।”

স্মৃতিচারণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “তেভাগা খামারে চাষ করতে গিয়ে আবার সমস্যা হলো। ইরি ধান চাষ করতে গেলে লাইন ধরে রোপা (ধানের চারা) লাগাতে হয়, এমনিতে তো ধান ছিটিয়ে দিলে ফসল হয়ে যায়। কিন্তু ইরিতে কষ্ট করতে হয়। তো, আমি বললাম খাবেন যখন কষ্ট তো করতে হবে। বলে-‘না, বেশি কষ্ট’। তখন আমি ছাত্রদের সঙ্গে বসলাম। তারা দলে দলে মাঠে নামল, লাইন ধরে ইরি ধানের রোপা লাগাল। পরে অন্যান্য গ্রামেও নজর পড়ল।”

গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকালীন স্মৃতি বর্ণনা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “যে কাজে হাত দিলাম তা মহিলাদের খুব পছন্দ হলো। তাদের হাতে ৫ টাকা, ১০ টাকা করে ঋণ দিলাম। ৫ টাকা ১০ টাকা যে মানুষের জীবনে এত আনন্দ আনতে পারে কোনোদিন ভাবি নাই। আমি কিন্তু মাগনা টাকা তাদের দেইনি। তাদের বলেছি, এই টাকা খাটিয়ে রোজগার করে আমার টাকা আমাকে ফেরত দেবেন। তারা এতেই খুশি। তখন তাদের অনেক বিষয় জানলাম। সেই মহিলারা নিজের নাম পর্যন্ত জানে না। আমাদের সমাজ এমন যে মহিলাদের নিজের নাম পর্যন্ত জানতে দেয়নি। কেউ জন্মের পর থেকে বাবার নামে, বিয়ের পরে স্বামীর নামে পরিচিত ছিল। আমার ছাত্রীদের দিয়ে তাদের নাম শেখানোর ব্যবস্থা করলাম। যাদের নাম ছিল না তাদের নতুন নাম দিলাম। তখন বললাম, আমরা দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাব। অনেকে বলল, আপনি কে জাদুঘরে পাঠানোর, এটা সরকারের কাজ। আমি বললাম, আমার কাজ করতে থাকি, সরকার বাধা দিলে তখন দেখব। আমার কাজ চলতে থাকে। জোবরা গ্রামের মহিলাদের থেকে নতুন অর্থনীতি শেখা আরম্ভ করলাম। সে হিসেবে জোবরা আমার নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। আজ পর্যন্ত যা কিছু করে যাচ্ছি তা এই জোবরা থেকে যা শিখেছি তার বহিঃপ্রকাশ।”

সমাবর্তন প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “সমাবর্তন একজন মানুষের জীবনে একটি মস্তবড় ঘটনা। সনদ নেবে, ছবিটি সংরক্ষণ করবে, সেটা সবাইকে দেখায়, সেই বিশেষ দিনটি আজ।”

তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টা কত তাড়াতাড়ি চলে যায়, কেটে যায় বোঝা যায় না। যখন শেষ হয়ে যায়, তখন মনে বড় কষ্ট লাগে। জীবনের একটা বড় অধ্যায় শেষ হলো। নতুন অধ্যায়ের শুরু। আমরা যে ধরনের বিশ্ব গড়তে চাই, সেই বিশ্ব গড়ার ক্ষমতা আমাদের আছে, সব মানুষেরই আছে। কিন্তু আমরা গৎবাঁধা পথে চলে যাই বলে নতুন পৃথিবীর কথা চিন্তা করি না।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যেন সবসময় এটা স্মরণ রেখেই তার পাঠদান কর্মসূচি, তার গবেষণা শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য চালু রাখে।”

ঢাকা/রেজাউল/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ