ক্ষমতা মানে হচ্ছে অন্য কাউকে দিয়ে আপনি যা চাইছেন, তা করিয়ে নেওয়া। এটা বল প্রয়োগে (কূটনীতির ভাষায় যাকে বলে ‘স্টিক’ বা ‘লাঠি’ দিয়ে) করা যায়; অর্থ বা সুবিধা দিয়ে (কূটনীতিতে যাকে বলে ‘ক্যারট’ বা ‘গাজর’), কিংবা আকর্ষণের মাধ্যমেও (কূটনীতিতে যাকে বলা হয় ‘মধু’) করা যায়। প্রথম দুটি উপায় হচ্ছে হার্ড পাওয়ার বা কঠোর ক্ষমতার ধরন। আর আকর্ষণের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারই হলো ‘সফট পাওয়ার’।
একটি দেশের সংস্কৃতি, রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং তার পররাষ্ট্রনীতি থেকেই সফট পাওয়ার জন্ম নেয়। স্বল্প মেয়াদে হার্ড পাওয়ারই বেশি কার্যকর হয়। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সফট পাওয়ারই অনেক সময় বিজয়ী হয়। জোসেফ স্তালিন একবার তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, ‘পোপের কয়টা ডিভিশন (সেনাদল) আছে?’ কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, পোপ এখনো টিকে আছেন, কিন্তু স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন বহু আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
শীতল যুদ্ধের সময় ইউরোপ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল: একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবাধীন এলাকা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা জোট। এক নরওয়েজিয়ান ইতিহাসবিদ এ দুটি অংশকে যথাক্রমে ‘সোভিয়েত সাম্রাজ্য’ ও ‘আমেরিকান সাম্রাজ্য’ বললেও তিনি ব্যাখ্যা করেন, সোভিয়েত সাম্রাজ্য ছিল জোরপূর্বক, আর আমেরিকার প্রভাব ছিল স্বেচ্ছায় গৃহীত।
সোভিয়েত ইউনিয়নকে ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরি এবং ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠাতে হয়েছিল। কারণ, ওই দেশের মানুষ বা সরকার সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণ চায়নি। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত ন্যাটো জোটে দেশগুলো স্বেচ্ছায় যুক্ত হয় এবং সময়ের সঙ্গে সদস্যসংখ্যা বাড়ায়। এর মানে হলো তারা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও মূল্যবোধকে বিশ্বাসযোগ্য ও আকর্ষণীয় বলে মনে করেছে।
যদি ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের বিশ্বাস ধ্বংস করে, উপসাগরীয় সাম্রাজ্যবাদী আচরণ দেখিয়ে, ইউএসএআইডি ধ্বংস করে, ভয়েস অব আমেরিকা বন্ধ করে, দেশের আইন চ্যালেঞ্জ করে এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা থেকে বেরিয়ে গিয়ে তিনি চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবেন, তাহলে তিনি ভুল করছেন।আসলে ক্ষমতা বুঝতে হলে তার হার্ড ও সফট—দুই রূপই বুঝতে হবে। রাজনৈতিক নেতারা অনেক সময় হার্ড পাওয়ারের দিকে ঝুঁকে পড়েন—চাপে ফেলা কিংবা টাকাপয়সা দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চান। কিন্তু হার্ড পাওয়ার একা ব্যবহার করলে তার খরচ বেশি পড়ে। আর সফট পাওয়ারের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করলে সেই খরচ অনেক কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ বার্লিন দেয়াল গোলাবর্ষণ করে ধ্বংস করা হয়নি। এটা ভেঙেছিল সেসব সাধারণ মানুষ, যারা কমিউনিজমে আস্থা হারিয়েছিল এবং পশ্চিমা মূল্যবোধের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। এই হলো সফট পাওয়ারের প্রকৃত শক্তি—যেটা ধীরে ধীরে আসে কিন্তু একবার এলে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজস্ব মূল্যবোধকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এর ফলে তৈরি হয় তথাকথিত ‘উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা’। এ ব্যবস্থায় ছিল জাতিসংঘ, ব্রেটন উডস অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক) এবং অন্যান্য বহুপক্ষীয় সংস্থা। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র সব সময় তাদের এই উদার মূল্যবোধ মেনে চলেনি এবং শীতল যুদ্ধের সময় এই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ছিল বিশ্বের কেবল অর্ধেক মানুষের জন্য প্রযোজ্য।
যদিও আগের অনেক মার্কিন প্রেসিডেন্টই কিছু ক্ষেত্রে এই উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নীতি লঙ্ঘন করেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি সরাসরি সফট পাওয়ার বা ‘আকর্ষণের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার’-এর মূল্যই অস্বীকার করেছেন। তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর যেসব কাজ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়া। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন ও মহামারির ঝুঁকি যে কতটা বড়, তা তখন স্পষ্ট ছিল।
একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি সফট পাওয়ার ব্যবহার ছেড়ে দেন, তাহলে তার ফলাফল অনুমান করাই সহজ। গণতান্ত্রিক মিত্রদেশ, যেমন ডেনমার্ক বা কানাডাকে ভয় দেখানো হলে তাদের আস্থায় ফাটল ধরে।
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি চার বছর ক্ষমতায় থাকেন, এরপরও দেশটির গণতন্ত্র বেঁচে থাকবে—এমনটাই ধারণা করা যায়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের একটি দৃঢ় রাজনৈতিক সংস্কৃতি আছে এবং এর সংবিধান সরকারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিভিন্ন ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা দিয়েছে।
যদি ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের বিশ্বাস ধ্বংস করে, উপসাগরীয় সাম্রাজ্যবাদী আচরণ দেখিয়ে, ইউএসএআইডি ধ্বংস করে, ভয়েস অব আমেরিকা বন্ধ করে, দেশের আইন চ্যালেঞ্জ করে এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা থেকে বেরিয়ে গিয়ে তিনি চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবেন, তাহলে তিনি ভুল করছেন।
● জোসেফ এস নাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের সহকারী সচিব
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ব যবস থ ধ ব স কর আম র ক ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় এক দিনে ১৫৩ টন বোমা ফেলেছে ইসরায়েল, পার্লামেন্টে নেতানিয়াহু
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গত রোববার এক দিনে ১৫৩ টন বোমা ফেলেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দেশটির পার্লামেন্ট নেসেটে নিজেই এ তথ্য জানিয়েছেন।
নেসেটের সদস্যদের উদ্দেশে নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমাদের এক হাতে অস্ত্র, অন্য হাত শান্তির জন্য প্রসারিত। দুর্বলের সঙ্গে নয়, শক্তিশালীর সঙ্গে শান্তি স্থাপন করুন। আজ ইসরায়েল আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।’
আনাদোলু নিউজের তথ্য, নেসেটের শীতকালীন অধিবেশনের শুরুতে দেওয়া ভাষণে নেতানিয়াহু এ কথা বলেন। তাঁর এমন বয়ানে গাজায় চলা যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত ইসরায়েল কতটা মেনে চলছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ইসরায়েলের অভিযোগ, হামাসের হামলায় তাদের দুজন সেনা নিহত হয়েছেন। প্রতিক্রিয়ায় গাজা উপত্যকায় কয়েক দফায় বিমান হামলা চালানো হয়েছে। যদিও হামাস বলছে, এমন কোনো হামলার তথ্য তাদের কাছে নেই।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৪৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ইসরায়েলের দাবি, এতে ১ হাজার ১০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া প্রায় আড়াই শ মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নেওয়া হয়।
আরও পড়ুনগাজায় যুদ্ধবিরতি নেতানিয়াহুর জন্য ডেকে এনেছে ৬টি বড় বিপদ১৮ অক্টোবর ২০২৫আরও পড়ুনগাজায় ৯৭ ফিলিস্তিনিকে হত্যার পরও ট্রাম্প বললেন, যুদ্ধবিরতি টিকে আছে১১ ঘণ্টা আগেজবাবে ওই দিনই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। দুই বছরের হামলায় গাজায় নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা ৬৮ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
সম্প্রতি গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে হামাস ও ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা মেনে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে।
যুদ্ধবিরতির আওতায় ইসরায়েলি বাহিনীর গাজায় অভিযান বন্ধ করার কথা। বিনিময়ে গাজায় জিম্মি থাকা ব্যক্তিদের (জীবিত ও মৃত) ছেড়ে দেবে হামাস।
আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন নিয়ে ইসরায়েল ও হামাসের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ১৬ অক্টোবর ২০২৫আরও পড়ুনগাজাবাসীর ওপর হামলা চালাতে পারে হামাস, ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য’ রয়েছে: দাবি যুক্তরাষ্ট্রের১৯ অক্টোবর ২০২৫