প্রতিবছরই উত্তাপ বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রের উচ্চতা। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে মিঠাপানির এলাকা লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। খালেও পানি নেই। অর্ধেকের বেশি খাল ভরাট হয়ে গেছে। এসবের প্রভাব পড়ছে কৃষিজমিতে। প্রতি মৌসুমে অনাবাদি থাকছে ৯ হাজার হেক্টর জমি। টাকার অঙ্কে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১১৫ কোটি ২০ লাখ টাকা।
এ চিত্র সাগর উপকূলীয় বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলায়। খাল ভরাটের কারণে পানির অভাবে সেচ দেওয়া যায় না ফসলি জমিতে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, অতি তাপমাত্রায় পানির প্রবাহ কমে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট আঞ্চলিক কার্যালয় পটুয়াখালীর ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশিক এলাহি বলছেন, ধান চাষে লবণ সহনশীলতার মাত্রা ৪ দশমিক ১ থেকে ৮ ডিএস/এম পর্যন্ত। বোরো এবং সবজি চাষে লবণ সহনশীলতার মাত্রা দশমিক ৭৫ থেকে ১ পর্যন্ত। তালতলীর বেশির ভাগ খালবিল ও পার্শ্ববর্তী পায়রা নদীর মোহনায় মার্চ থেকে মাটিতে ১২ থেকে ১৬ ডেসিসিমেন (ডিএস/এম) লবণাক্ততা রয়েছে। কোনো কোনো স্থানে এর পরিমাণ আরও বেশি। এ অবস্থায় ফসল উৎপাদন একবারেই সম্ভব নয়। 
উপজেলায় মাটির লবণাক্ততা নিয়ে গবেষণা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব গ্রিফিত অস্ট্রেলিয়ার গবেষক ডক্টর মৃন্ময় নিয়োগি বলেন, জানুয়ারি মাসে উপজেলার মাঠে লবণের পরিমাণ থাকে ৭-৮ ডেসিসিমেন পার মিটার। মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮-১৬ পর্যন্ত। এ সময় আর্দ্রতা কমে যাওয়ায় মাটির উপরি ভাগে লবণের আবরণ জমে জমি ফেটে যায়। কোনো ফসল উৎপাদন সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, লবণাক্ত জমিতে রিলে পদ্ধতিতে গম আবাদ করা যেতে পারে। এ ছাড়া লবণের হাত থেকে রক্ষা পেতে মজে যাওয়া খাল খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করলে সারাবছর ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।

অপরিকল্পিত বাঁধে মরছে খাল
বন্যা থেকে রক্ষায় ১৯৬৭-৬৮ অর্থবছরে পায়রা এবং সাগর তীরবর্তী ৫৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অপরিকল্পিত বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ করা হয়। বাঁধ নির্মাণের পর থেকে খালের পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে খালগুলো মরতে থাকে। বর্তমানে উপজেলার ১৮৬টি খালের মধ্যে ৮৬টি অস্তিত্ব হারিয়েছে। এতে সেচ সংকট দেখা দিয়েছে। ৯১টি গ্রামের মধ্যে ৪০ গ্রামে শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে ফসল আবাদ করা যায় না। 
চাউলাপাড়া গ্রামের কৃষক আইয়ূব আলী জানান, বেসরকারি সংস্থা এনএসএসের উদ্যোগে চাউলা খাল খনন করে সেখানে মিঠাপানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। এতে ১২ মাস ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। এভাবে ভরাট হয়ে যাওয়া অন্য খালগুলো খনন করলে লাভবান হতো কৃষক।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ১৬ হাজার ৪৪১ হেক্টর। আমন মৌসুমে এসব জমিতে ৬৫ হাজার ৭৬৪ টন ফসল উৎপাদন হয়। টাকায় এর পরিমাণ ২১০ কোটি ৪৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ সম্ভব হয় না।

জমিতে বাড়ছে লবণাক্ততা
১৯৭০ সালের ১২ নভেস্বর ঘূর্ণিঝড়ের সময় সাগরের জলোচ্ছ্বাসে তালতলীসহ গোটা উপকূলীয় এলাকা নোনাপানিতে তলিয়ে যায়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর আঘাত হানে সিডর। পরবর্তী সময়ে রোয়ানু, বুলবুল, আম্পান, রিমালের প্রভাবে গ্রামগুলোতে লবণপানি প্রবেশ করে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। 
লবণাক্ততার প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পচাকোড়ালিয়া, নিশানবাড়িয়া এবং সোনাকাটা ইউনিয়ন। ইউনিয়নগুলোর দু-একটি গ্রামে পায়রা নদী থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়। বেশির ভাগ গ্রামে জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। জানুয়ারি থেকেই জমিগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে উপরিভাগে সাদা লবণের আবরণ দেখা যায়। ঘাস পর্যন্ত থাকে না। 

ঝাড়াখালী গ্রামের কবির আকন বলেন, ‘নুন পানির কারণে জমি নষ্ট অইয়া গ্যাছে। ধান অয় না। বাইশ্যাকালে আমন লাগাই। হেই ধান দিয়া বছরের ছয় মাস খোরাক রাহি, বাকি ছয় মাস কিন্যা খাই। নুনে মোগো সব শ্যাষ কইরা দেছে।’ একই কথা বলেন, নলবুনিয়া গ্রামের লতিফ আকন ও শারিখখালী গ্রামের আবু বক্কর। 
কাজ নেই, শহরে ছুটছে মানুষ সোনাকাটা, নিশানবাড়িয়া, শারিখখালী, পচাকোড়ালিয়া ইউনিয়নের  কৃষি শ্রমিকরা শুকনো মৌসুমে ঢাকার ইটভাটা বা বিকল্প কোনো কাজ করেন। বর্ষায় কৃষিকাজের জন্য বাড়ি চলে আসেন। 
নিন্দ্রা গ্রামের জামাল মোল্লা বলেন, কৃষি আমাদের বাপ-দাদার পেশা। পানি সংকট ও লবণাক্ততার কারণে বছরে ছয় মাস আমাদের কাজ থাকে না। নিরুপায় হয়ে ঢাকা শহরে রাজমিস্ত্রির কাজ করি। 
নিশানবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান বাচ্চু বলেন, শুষ্ক মৌসুমে লবণ পানির প্রভাবে আউশ, আমন, বোরো চাষ করা যায় না। ভরাট হয়ে যাওয়া খাল খনন করে মিঠাপানি সংরক্ষণ করে রাখা গেলে কৃষকরা লাভবান হবেন। 
পঁচাকোড়ালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক  বলেন, আমার ইউনিয়নের ১২ গ্রামে শুষ্ক মৌসুমে ফসল হয় না। বেশীরভাগ খাল ভরাট হয়ে গেছে। সংকট নিরসনে খাল পুনর্খননের বিকল্প নেই। 
কৃষি কর্মকর্তা আবু জাফর মো.

ইলিয়াস জানান, লবণাক্ততার কারণে বছরের ছয় মাস জমি পড়ে থাকে। এসব জমি কাজে লাগাতে হলে ভরাট হয়ে যাওয়া খাল খননের উদ্যোগ নিতে হবে। 
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালমা বলেন, ভরাট হয়ে যাওয়া খাল পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিএডিসির মাধ্যমে পুনর্খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কাজ করতে পারলেই ১২ মাস ফসল ফলানো নিশ্চিত করা যাবে। এ ছাড়া শ্যালো মেশিন বসানোর বিষয়টিও পরীক্ষা করে দেখা হবে। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র পর ম ণ খ ল খনন লবণ ক ত ছয় ম স লবণ র উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

গ্যাস-বিদ্যুৎ দিতে না পারলে সরকার কারখানা চালাক

প্রতিশ্রুতি দিয়েও শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহে ব্যর্থতার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন বস্ত্র ও পোশাকশিল্প খাতের উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলছেন, সরকার যদি শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন সরকার নিজেই এসব কারখানা চালাক, অথবা যেসব বিদেশিকে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হচ্ছে, তাদের হাতে এসব শিল্প তুলে দেওয়া হোক।

গতকাল রোববার রাজধানীর গুলশান ক্লাবে আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ), বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিটিএমএলইএর শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআই, বিসিআই এবং আইসিসি-বাংলাদেশসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক চেম্বারের প্রতিনিধিরা।

দেশে বেকার সংকট বৃদ্ধির কারণে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলন হয়েছিল। তারপরই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে– স্মরণ করিয়ে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, এ সরকারের দায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া। অথচ উল্টো শিল্প বন্ধ করা হচ্ছে; মানুষ নতুন করে বেকার হচ্ছে। একদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে কারখানা বন্ধ থাকবে; অন্যদিকে ব্যাংকে বেশি সুদ দিতে হবে। আবার এনবিআর কর্মকর্তাদের আন্দোলনে জাহাজীকরণও বন্ধ। এত কিছুর পর সময়মতো শ্রমিকদের বেতন-ভাতাও দিতে হবে। ব্যর্থ হলে মালিকদের গাড়ি-বাড়ি বিক্রি করে বেতন পরিশোধ করবে সরকার। এমনকি জেলে পাঠানোরও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের বসিয়ে রেখে কীভাবে বেতন দেওয়া হবে? 

বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘কভিড মহামারিকালেও শ্রমিকদের বেতন দিয়েছি। আন্দোলনের সময়েও কারখানা বন্ধ রেখে বেতন দিয়েছি। এখন আর পারছি না। নিয়মিত বিল দিচ্ছি, তবুও গ্যাস পাচ্ছি না।’

সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন বিটিএমএ পরিচালক রাজীব হায়দার, খোরশেদ আলম, বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী, বিটিটিএমএলইএর চেয়ারম্যান হোসেন মাহমুদ, একই সংগঠনের সাবেক চেয়ারম্যান শাহাদৎ হোসেন সোহেল, বিটিএমএ সহসভাপতি সালেউদ জামান খান, পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন, এফবিসিসিআইর সদস্য জাকির হোসেন নয়ন প্রমুখ। 

তীব্র গ্যাস সংকট সমাধানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ, স্কয়ার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান তপন চৌধুরী, বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল এবং বিটিএমএর সাবেক সভাপতি মতিন চৌধুরী।

মতিন চৌধুরী সমকালকে জানান, গ্যাস সংকটে দেশের কারখানাগুলোতে কী সংকট চলছে, তা জ্বালানি উপদেষ্টাকে বলা হয়েছে। এতে যে রপ্তানি ব্যাহত হবে– সতর্ক করা হয়েছে সে বিষয়ে। উপদেষ্টা বাস্তব অবস্থা দেখতে সোমবার (আজ) ঢাকার অদূরে আশুলিয়া অঞ্চলে বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শনে যাবেন। এর পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ