ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর: কুকুর লেজ নাড়ছে, নাকি লেজ কুকুরকে
Published: 26th, May 2025 GMT
গত সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর (যার মধ্যে ছিল সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত) তাঁর আগের ইসরায়েল–ঘেঁষা অবস্থান থেকে এক বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে।
সফরের আগে ট্রাম্প হুতিদের সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সমঝোতা করেন। ওই সমঝোতায় ইয়েমেনের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের ওপর হামলা বন্ধের কোনো শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়নি। একই সঙ্গে তিনি হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার অনুমতি দেন। সে আলোচনায় একটি মার্কিন-ইসরায়েলি বন্দিমুক্তির বিনিময়ে গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলের দিক থেকে স্পষ্ট আপত্তি থাকা সত্ত্বেও এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে। এ কারণেই প্রশ্ন উঠছে, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে সিদ্ধান্ত আসলে কে নেয়—ওয়াশিংটন নাকি তেল আবিব?
এই প্রশ্ন বহু বছর ধরেই ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের আলোচনার বিষয় হয়ে আছে।
অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক আসলে ইসরায়েলপন্থী লবি নিয়ন্ত্রণ করে। এই লবির মূল লক্ষ্য ইসরায়েলি স্বার্থ পূরণ করা।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানী জন মিয়ারশেইমার ও স্টিফেন ওয়াল্ট, তাঁদের বিখ্যাত বই দ্য ইসরায়েল লবি অ্যান্ড ইউএস ফরেন পলিসিতে এই দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়েছেন।
তাঁরা সেখানে বহু দশকের নানা উদাহরণ তুলে ধরেছেন। সেসব উদাহরণ দেখায় কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলপন্থী লবি, বিশেষত কংগ্রেসে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে এবং একের পর এক প্রশাসনের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে আসছে।
উদাহরণস্বরূপ, তাঁরা উল্লেখ করেন, ইসরায়েলপন্থী লবি ও নব্য রক্ষণশীলদের প্রভাব ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের সিদ্ধান্তে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল।
সাংবাদিক জে জে গোল্ডবার্গ তাঁর ‘জুইশ পাওয়ার’ বইয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে ইসরায়েলি স্বার্থ রক্ষায় প্রভাবশালী লবি কাজ করে এবং তাদের ক্ষমতার গঠন ও কার্যপ্রণালী কী।
এই লবির প্রভাব আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বিখ্যাত ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইলান পাপে। তাঁর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে জায়নাবাদী লবি শত বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রনীতি প্রভাবিত করেছে ও নিয়ন্ত্রণ করেছে।
অন্যদিকে মার্কিন লেখক ও বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি একাধিক বইয়ে লিখেছেন, আসলে যুক্তরাষ্ট্রই জায়নাবাদী শাসনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে তার নিজের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য। চমস্কির মতে, ইসরায়েল কেবল যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাতিয়ার, যার মাধ্যমে তারা মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে এবং বৃহত্তর বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখে।
এই ব্যাখ্যার পক্ষে ঐতিহাসিক নজিরও রয়েছে। যেমন ১৯৫৬ সালে ইসরায়েল, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য মিলে মিসরে হামলা চালায়। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার নিজে নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ইসরায়েলকে সিনাই উপত্যকা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
আরেকটি উদাহরণ ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ। তখন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্পষ্টভাবে বলেছিল, ইরাকের স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে তারা যেন প্রতিক্রিয়া না জানায়, যাতে আরব মিত্ররা ক্ষিপ্ত না হয়।
এই সব নজির আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মধ্যপ্রাচ্যে সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হয়, তা বোঝার জন্য একটি প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ: কে কাকে চালায়? ইসরায়েল কি সেই ‘লেজ’, যা ‘কুকুর’ যুক্তরাষ্ট্রকে নাড়ায়? নাকি বরং যুক্তরাষ্ট্রই সেই শক্তিমান কুকুর, যার হাতে ইসরায়েল নামের লেজটি ধরা?
ইসরায়েল এই দুটি চুক্তিরই বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তারা কিছু করতে পারেনি। যদি এটি কোনো ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট করতেন, তাহলে নেতানিয়াহু রিপাবলিকানদের সমর্থন নিয়ে হয়তো চুক্তি বানচাল করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু যেহেতু এটি এসেছে রিপাবলিকান সরকারের পক্ষ থেকে এবং ইসরায়েল এতে নেই, তাই তিনি কিছুই করতে পারেননি।২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ‘তুফান আল-আকসা’ হামলার পর, ইসরায়েল এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে গাজায় যে যুদ্ধ শুরু করেছে, সেটি কার্যত গণহত্যা ও জাতিগত নিধন অভিযানে রূপ নিয়েছে।
এই যুদ্ধের মাধ্যমে তারা কয়েকটি উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। তারা দীর্ঘ মেয়াদে ফিলিস্তিনি জনসংখ্যা হ্রাস করে ডেমোগ্রাফিক সমস্যার সমাধান করতে চায়; তারা পশ্চিম তীরে আগ্রাসী বসতি স্থাপন ও জমি দখল চালিয়ে এমন বাস্তবতা তৈরি করতে চায়, যাতে ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ হয়।
এই পুরো সময় (প্রায় ১৫ মাস ধরে) যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন এমন একটি নীতি অনুসরণ করেছে, যা ইসরায়েলের অবস্থান থেকে আলাদা ছিল না; বরং তারা ইসরায়েলের আগ্রাসনের গণহত্যামূলক চরিত্রকেই সরাসরি টিকিয়ে রেখেছে।
এই নীতি ইসরায়েলপন্থী লবির চাপের কারণে হয়েছে, নাকি যুক্তরাষ্ট্রের নিজের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এতে আসল বিষয় বদলায় না।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একবার স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘ইসরায়েল না থাকলে আমাদের একটি ইসরায়েল তৈরি করতে হতো।’ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের জন্য একটি শক্তিশালী জায়নাবাদী শাসনের প্রয়োজন হয়, যেন সেটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করে।
এই যে যুক্তরাষ্ট্র আজ ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে, এটা নতুন কিছু নয়। বরং শুরু থেকেই জায়নাবাদী নেতারা বুঝে নিয়েছিলেন, ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রকল্প কাকে এবং কীভাবে উপকার দেবে।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই গণহত্যার দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হলেন চৌধুরী মামুন
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ট্রাইব্যুনালে তিনি বলেছেন, ‘আমি জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।’
জুলাই গণহত্যা চলাকালীন পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পালন করা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘এই মামলায় আমি রাজসাক্ষী হতে চাই।’
আজ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ বক্তব্য দেন তিনি।
এর আগে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। বিচারপতি মো গোলাম মোর্তোজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইবুনাল আজ এ অভিযোগ গঠন করেন।
অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম কোনো মামলার বিচার শুরু হল। পাশাপাশি এ মামলার সব সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ৩ আগস্ট দিন ধার্য করেন ট্রাইবুনাল।
মামলার অপর দুই আসামি হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও কারাগারে থাকা সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। অভিযোগ গঠনের সময় মামুন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন।
ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।