প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে পদত্যাগ করতে পারেন– অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ মাস পূর্ণ হওয়ার পক্ষকাল আগে আচম্বিতে এই খবরে দেশজুড়ে সাড়া পড়ে। সাধারণ মানুষ উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠেন; রাজনৈতিক দলগুলো একের পর এক প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। আলোচনাগুলো মোটাদাগে নির্বাচন, জুলাই গণহত্যার বিচার ও রাজনৈতিক সংস্কার– এই তিন বিষয়েই প্রধানত আবর্তিত হয়। রাজপথও ছিল যথারীতি উত্তাল। গত ৯ মাসে অন্তত আড়াইশ আন্দোলন রাজপথে যার যার দাবিদাওয়া নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।

ড.

ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর এ যাবৎ ১১ বার বিদেশ সফর করলেও দেশে ফিরে কোনো প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত হননি। এমনকি তিনি যে পদত্যাগ করতে চাইছেন মর্মে সংবাদে তোলপাড় হলো, তা নিয়েও কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে এখন পর্যন্ত সরাসরি কথা বলেননি। উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সংবাদমাধ্যমে মতামত দিয়েছেন। যেমন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘দায়িত্ব পালন তখনই সম্ভব হবে, যখন সবার সহযোগিতা থাকবে। দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। তাই সরকার দায়িত্ব পালন করবে কিনা, চিন্তা করছে। না পারলে কী করণীয়, তাও চিন্তা করছে’ (সমকাল, ২৪ মে ২০২৫)। 

শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শত বাধার মধ্যেও গোষ্ঠীস্বার্থকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে প্রকাশ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। 

২.
প্রধান উপদেষ্টা শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেননি। তবে পদত্যাগের আশঙ্কাটিই বহু প্রশ্নের অবতারণা করেছে। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না, অথচ তা কেউ জানতেই পারছিলেন না! প্রায় দেড় হাজার মানুষের প্রাণ ও ত্রিশ হাজার মানুষের অঙ্গহানি এবং বহু মানুষের বিয়োগ ব্যথার বিনিময়ে অসামান্য গণঅভ্যুত্থানজয়ী অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে সত্যিকার গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে নিয়ে যাবে– এই আকাঙ্ক্ষা দেশের মানুষের। তাহলে সরকারপ্রধানকে এ কাজে বাধা দিচ্ছে কে?

রাজপথে আন্দোলনের কথা ধরা যাক। কথায় কথায় যেমন যমুনা ঘেরাও হচ্ছে, তেমনি এক যাত্রায় পৃথক ফলও দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ৮ থেকে ১০ মে হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে যমুনামুখী জমায়েতকে সরকার বাধা দেওয়া দূরে থাক, শীতল পানি ছিটিয়ে গরমে শ্রান্তি বিলিয়েছে। ওই আন্দোলন জয়যুক্তও হয়েছে। দেশে আইন-আদালত রয়েছে; আইনের এখতিয়ার যখন রাজপথে মীমাংসার বিষয় হয়, তা অন্যদেরও রাস্তায় নামতে উৎসাহিত করে বৈকি। 

বর্তমান সরকারের দায়িত্বকালে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা– মবতন্ত্রের সীমাহীন উত্থান! সরকারপক্ষীয় কারও সঙ্গে মত না মিললেই ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা। আওয়ামী লীগ আমলে যেভাবে মত না মিললেই বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দেওয়া হতো। এখন ট্যাগের সঙ্গে বাড়তি উপহার মবতন্ত্র। জনতা রাস্তায় নির্বিকারচিত্তে নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। 

শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড...’। জি, মাননীয় উপদেষ্টাবৃন্দ। একটি রেডিও ভাষণের অজুহাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়িটি দু’দিন ধরে বুলডোজার দিয়ে ভাঙার মধ্য দিয়েই এ দেশে মবতন্ত্রের বিষবৃক্ষ চারা থেকে মহিরুহে পরিণত হয়েছিল। কোথায় ছিল সেদিন সরকার বা উপদেষ্টা পরিষদ? কেন থামানো হয়নি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অসহিষ্ণু উগ্রবাদীদের? ৩২ নম্বর ফ্যাসিবাদের প্রতীক কী করে? ৮ বছরের শিশু রাসেলের বুকের তাজা রক্তও কেন মুছে দিতে হবে? মুক্তিযুদ্ধ যেমন শেখ হাসিনার বাপের সম্পত্তি নয়; আবার মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো এ দেশের সকলের বাপের সম্পত্তিও বটে। 
মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, মাজার– লাগাতার ভাঙতে ভাঙতে ভয়াবহ তাণ্ডব ছড়িয়ে দেবার পরও সরকার থেকে আইনি উদ্যোগ দূরে থাক, টুঁ শব্দটিও শোনা যায়নি কেন? 

যেখানে সুবিধা সেখানে ভারতীয় জুজু আবিষ্কার করে সরকার উগ্রবাদীদের আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেয়। আজ তারই ধারাবাহিকতা সমাজে দৃশ্যমান। নারীর প্রতি সহিংসতা, নারীকে ছোট করে কথা বলা যে কোনো সময়কে ছাড়িয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এর মধ্যে নারী কমিশনের সুপারিশ নিয়ে যেভাবে উগ্রবাদীরা আক্রমণ করেছে, সে ব্যাপারেও সরকার এখন পর্যন্ত কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি। এসব প্রশ্রয়ের গন্তব্য কী?

৩.
অন্যায়, অনৈতিকতা বিকাশের সুযোগ দিয়ে বিচার ব্যবস্থাকে সংকুচিত করে ফেললে সমাজে সুশাসন অন্তর্হিত হতে বাধ্য। হতাশা ও অভিমান ভুলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেই নির্মোহ চিত্তে ভেবে বের করতে হবে– কেন তাঁর ১০ মাস শাসনকালে সমাজের এই রুগ্‌ণ দশা? যে আলোকিত সমাজের আকাঙ্ক্ষায় কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে– সেই মানুষের আবেগ ও শক্তিকে ড. ইউনূস যদি দেশের কাজে লাগাতে না পারেন, তাহলে কে পারবেন? তবে তিনি কোন খাতে ও কতটুকু কাজ করবেন– স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ, নারীর অধিকার ও মর্যাদা, দেশের ঐতিহ্য দেখভালের দায়িত্ব সরকারপ্রধানের। তিনি এসব ব্যাপারে নির্বিকার থাকতে পারেন না। আর সংস্কার ও বিচার নিয়ে এত হতাশ না হয়ে কথা বলুন সরাসরি! রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী কেন প্রেস কনফারেন্সে সরাসরি কথা বলবেন না? অনেক ঢাকঢাক গুড়গুড় তাহলে আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে যায়। 

এনসিপিকে অন্তর্বর্তী সরকার কেন এত প্রাধান্য দিচ্ছে? এই দৌর্বল্য আখেরে সরকারের নিরপেক্ষতাই শেষ করে দিতে পারে। আর বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল মতপার্থক্য কোথায়? বিএনপি চাইছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন; ড. ইউনূস বলছেন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে। এখনও সাত মাস সময় আছে ডিসেম্বর আসবার; তারপর আরও ছয় মাস কেন লাগবে? গত ১০ মাস সময়ে নির্বাচন নিয়ে কতখানি অগ্রগতি হয়েছে? সমকাল বলছে, ‘প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, প্রশাসন, পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। সব জায়গায় বিএনপিপন্থিরা রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দায় অধ্যাপক ইউনূস নিতে চান না (২৫ মে, ২০২৫)।

সব জায়গায় বিএনপিপন্থিরা অলৌকিক উপায়ে আসীন হন নাই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশ্রয়েই সব হয়েছে, হচ্ছে। তাহলে প্রশাসনে আরও কাউকে বসাতে চান? এনসিপিপন্থি? জামায়াতপন্থি? বিশেষ কোনো পন্থিকে না বসিয়ে নিয়ম ও আইন অনুযায়ী প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র কাজ করলেই সব শৃঙ্খলামতো এগোয়। আইনের শাসনের শিক্ষাই তাই– সকলের জন্য আইন এক। 
‘অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই’– হৃদয়দৌর্বল্যজাত পরিস্থিতি থেকে ড. ইউনূস বেরিয়ে এসে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক থেকে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন আয়োজন করে বহুল আকাঙ্ক্ষিত জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেবেন– এই প্রত্যাশায় পুরো জাতি অপেক্ষমাণ।  

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আইন পদত য গ সরক র র ব এনপ আইন র ইউন স

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপিকে কেউ কি দুর্বল করতে চাইছে

একই দিনে তিনটি ঘটনা সারা দেশকে আলোড়িত করেছে। একটি ঘটনা বুধবারের। ওই দিন ঢাকার মিটফোর্ডে পৈশাচিক উপায়ে একজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। শুধু হত্যাই করা হয়নি, হত্যার পর লাশের ওপর উঠে নাচানাচিও করেছে খুনিরা।

ভয়ংকর সব দৃশ্য। এই হত্যার দৃশ্য দেখা যায় না। এ ঘটনায় সম্পৃক্ত যুবদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চারজনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।

এ ছাড়া শুক্রবার খুলনায় নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় যুবদলের বহিষ্কৃত এক নেতাকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাড়ির সামনে ৯টি গুলির পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে পায়ের রগ কেটে দিয়েছে খুনিরা।

চাঁদপুরে আরেকটি ঘটনায় মসজিদের এক খতিবকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ওই খতিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননা করেছেন।

জুমার নামাজে খতিব সাহেব বয়ান দেওয়ার পর চাপাতি নিয়ে হামলা করেন মুসল্লির বেশে আসা হামলাকারীরা। হত্যার উদ্দেশ্যেই এ হামলা চালানো হয়েছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুনএ কেমন হত্যাকাণ্ড? এ কেমন বীভৎসতা?১১ জুলাই ২০২৫

তিনটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। মিটফোর্ডের ঘটনার পেছনে রয়েছে এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি। নিহত ব্যক্তি নিজেই ২০০৬ সালে একজনকে হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ আছে, কিছুদিন হাজি সেলিমের সন্ত্রাসী বাহিনীতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। খুলনার হত্যার কারণ হতে পারে রাজনৈতিক রেষারেষি। কারণ, খুন হওয়া ব্যক্তি কুয়েটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মারামারিতে রামদা নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন। আর চাঁদপুরের ধর্ম অবমাননার অভিযোগ।

পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও এসব ঘটনা প্রমাণ করে, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। সারা দেশে প্রতিনিয়তই খুন, জখমের বিবরণ আমরা শুনছি।

সার্বিক পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলাবিহীন এক অন্ধকার সময় অতিক্রম করছি আমরা। সরকার চরমভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। অপরাধীরা মোটেই কাউকে তোয়াক্কা করছে না। সারা দেশে একধরনের অ্যানার্কি বা নৈরাজ্যবাদ চলছে। সবকিছু এখন নৈরাজ্যবাদীদের দখলে চলে গেছে।

আরও পড়ুনসরকার ও বিএনপি—কেউ দায় এড়াতে পারে না৭ ঘণ্টা আগে

আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব নৈরাজ্যবাদী অপরাধীদের সরকারের আচরণও উসকে দিচ্ছে। সারা দেশে একধরনের ‘মবতন্ত্র’ কায়েম হয়েছে, এটা এখন আর অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সরকার ‘মব’ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

সরকার খামখেয়ালিপূর্ণ আচরণ করছে। মবকে সরকারের দায়িত্বশীলরা ‘প্রেশার গ্রুপ’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এ কারণে মবতান্ত্রিকেরা আরও শক্তি অর্জন করছে।

সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দায়িত্বশীলেরা মব, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও প্রেশার গ্রুপের মধ্যে বিভাজন গুলিয়ে ফেলছেন। বরং দেশের মানুষ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, সরকারের একটি অংশ দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে আড়াল থেকে মব, নৈরাজ্যবাদকে উসকানি দিচ্ছে। প্রয়োজনীয় কঠোর পদক্ষেপ না নিয়ে ঘোলাটে অবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে তারা।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানই বিষয়টি প্রমাণ করে। এই পরিসংখ্যান মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়; বরং ভয়ংকর এক হিমশীতল করা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তুলে ধরে।

পুলিশের হিসাব অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ঢাকায় ১৩৬ জন খুন হয়েছেন। এ সময়ে হত্যার শিকার হয়েছেন সারা দেশে ১ হাজার ২৪৪ জন। উল্লিখিত সময়ে ঢাকায় ২০২১ সালে ৫৫ জন, ২০২২ সালে ৫৪, ২০২৩ সালে ৫১ এবং ২০২৪ সালে ৪৭ জন খুন হয়েছিলেন। চলতি বছর সারা দেশে জানুয়ারিতে ২৯৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩০৮, মার্চে ৩১৬ ও এপ্রিলে ৩৩৬ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। কেবল জানুয়ারিতেই গত বছরের তুলনায় তিন গুণ মানুষ খুন হয়েছেন।

পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, হরেদরে মানুষ মেরে ফেলা হচ্ছে দেশে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ, আপনি অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে যে কেউ আপনাকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে এবং আপনার পরিবার কোনো প্রতিকার পাবে না।

আরও পড়ুনঅন্তর্বর্তী সরকারের আমলে কেন অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ৫ ঘণ্টা আগে

সরকার কেবল ব্যস্ত সংস্কার নিয়ে। এর সঙ্গে রয়েছে বিদেশিদের বন্দর প্রদান, করিডর দেওয়া, বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চাভিলাষী নীতি প্রণয়ন করা। মনে হচ্ছে, সংস্কার ও এসব ছাড়া সরকারের আর কোনো কাজ নেই। আইনশৃঙ্খলা, বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সরকার পুরোপুরি উদাসীন।

এই হত্যাযজ্ঞের শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে একজনকে পিটিয়ে মারার মধ্য দিয়ে। এরপর একে একে হত্যার শিকার হয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পারভেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাম্য।

এখন এই হত্যাযজ্ঞ সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুদিন আগে কুমিল্লায় মাদক ব্যবসায়ী অভিযোগে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।

কেরানীগঞ্জে ভোরে নামাজের পর পুকুরপাড়ে হাঁটার সময় এক বিএনপি নেতাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরও বেশ কয়েক দিন আগে কেরানীগঞ্জে একজনকে হত্যা করা হয়। পরিবারের লোকজন কী কারণে ওই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে, তার হদিস করতে পারছেন না। মামলা হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তাও কারণ বের করতে হয়রান হচ্ছেন বলে ওই খুন হওয়া ব্যক্তির স্বজনেরা জানিয়েছেন।

থানা, পুলিশ কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না। হত্যার ধরন কমবেশি একই। গুলি করার পর কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। রগও কাটা হয়।

আরও পড়ুনবিএনপির সামনে এখন যে ৫ সংকট১০ জুলাই ২০২৫

ফলে সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। হত্যাকারী বা অপরাধী যে দলেরই হোক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সরকারের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি লক্ষ করা যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে।

রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকুক। অনেকেই এসব হত্যাকাণ্ডকে পুঁজি করে সুবিধা নিতে চাইবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও পাল্টা জবাব দেবে। কিন্তু সরকার কী করছে?

অভিযোগ রয়েছে, অনেক হত্যাকাণ্ড, মারামারির সঙ্গে বিএনপির নেতা–কর্মীরা জড়িত। বিএনপি দলীয়ভাবে এসব নেতা–কর্মীকে বহিষ্কারও করেছে। এ পর্যন্ত বিএনপি প্রায় চার হাজারের মতো নেতা–কর্মীকে শৃঙ্খলাবহির্ভূত কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে বহিষ্কার করেছে।

কিন্তু তারপরও বিএনপির থেমে থাকার সুযোগ নেই। কেবল বহিষ্কার করেই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এতসংখ্যক নেতা–কর্মীকে বহিষ্কার করার পরও কেন তৃণমূলের নেতা–কর্মীরা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছেন, তা অনুসন্ধান করতে হবে দলটিকে।

দলের শীর্ষ পর্যায়ে এসব উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মীর বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার সতর্ক করার পরও কেন নেতা–কর্মীদের কেউ কেউ বিষয়টি কানে তুলছেন না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।

যাঁরা এসব অপরাধী নেতা-কর্মীদের আড়াল থেকে আশকারা দিচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে দলটির প্রতিপক্ষ ঘায়েল করার অস্ত্র হাতে পেয়ে যাবে।

বিএনপিকে আরও কঠোর হতে হবে। সারা দেশে বিশাল জনসমর্থন আছে। কিন্তু কিছু নেতা-কর্মীর এহেন কর্মকাণ্ড এই বিশাল জনসমর্থনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

তাঁরা দলের কোনো উপকারেই আসছেন না, বরং ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। তাঁরা দলের বোঝা। অন্যদের সমালোচনার সুযোগ করে দিচ্ছেন। তাই গুটিকয়েক সন্ত্রাসী ও তাদের মদদদাতাদের দল থেকে বের করে দিলে বিএনপির কোনো ক্ষতিই হবে না।

বরং জনসাধারণ আরও আশ্বস্ত হবে যে বিএনপি দুর্জনদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও কোনো দ্বিধা করছে না।

অপরাধী যে–ই হোক, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মিটফোর্ডের ঘটনার পর অপরাধীদের নিয়ে শুক্রবার সারা দেশে সমালোচনা শুরু হলে পুলিশ কয়েকজনকে আটক করে। মাঝের দুই দিন তাহলে পুলিশ কী করল? বিষয়টি যদি জানাজানি না হতো, তাহলে কি আটক করা হতো না? নাকি ইচ্ছা করেই কালক্ষেপণ করা হয়েছে, যেন বিষয়টি একটি ইস্যু বানানো যায়। তাহলে বিএনপির অভিযোগের সত্যতা মেলে।

বিএনপির উচিত অতিদ্রুত একটি শক্তিশালী ডিসিপ্লিনারি ও লিগ্যাল টিম গঠন করা। ডিসিপ্লিনারি টিম উচ্ছৃঙ্খল নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আর দলের এসব তথাকথিত নেতা–কর্মী দ্বারা কেউ ক্ষতির শিকার হলে লিগ্যাল টিম তাঁদের আইনি সহায়তা প্রদান করবে।

অপরাধের সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে মামলা করা হবে। লিগ্যাল টিম ওই মামলা পরিচালনা করবে দলের পক্ষ থেকে। বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, তারা জনগণের দল। এই দল নিয়ে অন্যান্য দলের অপপ্রচার ও কুৎসা রটানোর পথ বন্ধ করে দিতে হবে।

আজকে সারা দেশের মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। বিএনপির সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িয়ে গেছে। বিএনপি যদি শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে রাজনীতি করতে পারে, তাহলে দেশের লাভ হবে। আর বিএনপি দুর্বল হলে দেশ ঝুঁকির মুখে পড়বে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কেউ কেউ বিএনপিকে দুর্বল করতে চাইছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হয়েছে দলের উচ্ছৃঙ্খল নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সরকারের ভেতরের একটি অংশ এটা করতেই পারে। তারা চাইতেই পারে বিএনপি দুর্বল হয়ে যাক।

এ ধরনের পরিকল্পনা রোধ করতে বিএনপির পক্ষ থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে এবং উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে।

পরিশেষে বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রমাণ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়টি দেশবাসীকে চরমভাবে হতাশ করেছে। শুধু বিএনপি বা অন্যদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না।

অপরাধী যে–ই হোক, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মিটফোর্ডের ঘটনার পর অপরাধীদের নিয়ে শুক্রবার সারা দেশে সমালোচনা শুরু হলে পুলিশ কয়েকজনকে আটক করে। মাঝের দুই দিন তাহলে পুলিশ কী করল?

বিষয়টি যদি জানাজানি না হতো, তাহলে কি আটক করা হতো না? নাকি ইচ্ছা করেই কালক্ষেপণ করা হয়েছে, যেন বিষয়টি একটি ইস্যু বানানো যায়। তাহলে বিএনপির অভিযোগের সত্যতা মেলে।

অভিযোগ করার পরও সরকার ইচ্ছা করেই ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাই এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দায় সরকারের ওপরই বর্তায়। সরকার কোনোভাবেই এই দায় এড়াতে পারবে না।

মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ