প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে পদত্যাগ করতে পারেন– অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ মাস পূর্ণ হওয়ার পক্ষকাল আগে আচম্বিতে এই খবরে দেশজুড়ে সাড়া পড়ে। সাধারণ মানুষ উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠেন; রাজনৈতিক দলগুলো একের পর এক প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। আলোচনাগুলো মোটাদাগে নির্বাচন, জুলাই গণহত্যার বিচার ও রাজনৈতিক সংস্কার– এই তিন বিষয়েই প্রধানত আবর্তিত হয়। রাজপথও ছিল যথারীতি উত্তাল। গত ৯ মাসে অন্তত আড়াইশ আন্দোলন রাজপথে যার যার দাবিদাওয়া নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।

ড.

ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর এ যাবৎ ১১ বার বিদেশ সফর করলেও দেশে ফিরে কোনো প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত হননি। এমনকি তিনি যে পদত্যাগ করতে চাইছেন মর্মে সংবাদে তোলপাড় হলো, তা নিয়েও কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে এখন পর্যন্ত সরাসরি কথা বলেননি। উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সংবাদমাধ্যমে মতামত দিয়েছেন। যেমন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘দায়িত্ব পালন তখনই সম্ভব হবে, যখন সবার সহযোগিতা থাকবে। দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। তাই সরকার দায়িত্ব পালন করবে কিনা, চিন্তা করছে। না পারলে কী করণীয়, তাও চিন্তা করছে’ (সমকাল, ২৪ মে ২০২৫)। 

শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শত বাধার মধ্যেও গোষ্ঠীস্বার্থকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে প্রকাশ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। 

২.
প্রধান উপদেষ্টা শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেননি। তবে পদত্যাগের আশঙ্কাটিই বহু প্রশ্নের অবতারণা করেছে। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না, অথচ তা কেউ জানতেই পারছিলেন না! প্রায় দেড় হাজার মানুষের প্রাণ ও ত্রিশ হাজার মানুষের অঙ্গহানি এবং বহু মানুষের বিয়োগ ব্যথার বিনিময়ে অসামান্য গণঅভ্যুত্থানজয়ী অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে সত্যিকার গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে নিয়ে যাবে– এই আকাঙ্ক্ষা দেশের মানুষের। তাহলে সরকারপ্রধানকে এ কাজে বাধা দিচ্ছে কে?

রাজপথে আন্দোলনের কথা ধরা যাক। কথায় কথায় যেমন যমুনা ঘেরাও হচ্ছে, তেমনি এক যাত্রায় পৃথক ফলও দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ৮ থেকে ১০ মে হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে যমুনামুখী জমায়েতকে সরকার বাধা দেওয়া দূরে থাক, শীতল পানি ছিটিয়ে গরমে শ্রান্তি বিলিয়েছে। ওই আন্দোলন জয়যুক্তও হয়েছে। দেশে আইন-আদালত রয়েছে; আইনের এখতিয়ার যখন রাজপথে মীমাংসার বিষয় হয়, তা অন্যদেরও রাস্তায় নামতে উৎসাহিত করে বৈকি। 

বর্তমান সরকারের দায়িত্বকালে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা– মবতন্ত্রের সীমাহীন উত্থান! সরকারপক্ষীয় কারও সঙ্গে মত না মিললেই ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা। আওয়ামী লীগ আমলে যেভাবে মত না মিললেই বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দেওয়া হতো। এখন ট্যাগের সঙ্গে বাড়তি উপহার মবতন্ত্র। জনতা রাস্তায় নির্বিকারচিত্তে নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। 

শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড...’। জি, মাননীয় উপদেষ্টাবৃন্দ। একটি রেডিও ভাষণের অজুহাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়িটি দু’দিন ধরে বুলডোজার দিয়ে ভাঙার মধ্য দিয়েই এ দেশে মবতন্ত্রের বিষবৃক্ষ চারা থেকে মহিরুহে পরিণত হয়েছিল। কোথায় ছিল সেদিন সরকার বা উপদেষ্টা পরিষদ? কেন থামানো হয়নি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অসহিষ্ণু উগ্রবাদীদের? ৩২ নম্বর ফ্যাসিবাদের প্রতীক কী করে? ৮ বছরের শিশু রাসেলের বুকের তাজা রক্তও কেন মুছে দিতে হবে? মুক্তিযুদ্ধ যেমন শেখ হাসিনার বাপের সম্পত্তি নয়; আবার মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো এ দেশের সকলের বাপের সম্পত্তিও বটে। 
মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, মাজার– লাগাতার ভাঙতে ভাঙতে ভয়াবহ তাণ্ডব ছড়িয়ে দেবার পরও সরকার থেকে আইনি উদ্যোগ দূরে থাক, টুঁ শব্দটিও শোনা যায়নি কেন? 

যেখানে সুবিধা সেখানে ভারতীয় জুজু আবিষ্কার করে সরকার উগ্রবাদীদের আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেয়। আজ তারই ধারাবাহিকতা সমাজে দৃশ্যমান। নারীর প্রতি সহিংসতা, নারীকে ছোট করে কথা বলা যে কোনো সময়কে ছাড়িয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এর মধ্যে নারী কমিশনের সুপারিশ নিয়ে যেভাবে উগ্রবাদীরা আক্রমণ করেছে, সে ব্যাপারেও সরকার এখন পর্যন্ত কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি। এসব প্রশ্রয়ের গন্তব্য কী?

৩.
অন্যায়, অনৈতিকতা বিকাশের সুযোগ দিয়ে বিচার ব্যবস্থাকে সংকুচিত করে ফেললে সমাজে সুশাসন অন্তর্হিত হতে বাধ্য। হতাশা ও অভিমান ভুলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেই নির্মোহ চিত্তে ভেবে বের করতে হবে– কেন তাঁর ১০ মাস শাসনকালে সমাজের এই রুগ্‌ণ দশা? যে আলোকিত সমাজের আকাঙ্ক্ষায় কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে– সেই মানুষের আবেগ ও শক্তিকে ড. ইউনূস যদি দেশের কাজে লাগাতে না পারেন, তাহলে কে পারবেন? তবে তিনি কোন খাতে ও কতটুকু কাজ করবেন– স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ, নারীর অধিকার ও মর্যাদা, দেশের ঐতিহ্য দেখভালের দায়িত্ব সরকারপ্রধানের। তিনি এসব ব্যাপারে নির্বিকার থাকতে পারেন না। আর সংস্কার ও বিচার নিয়ে এত হতাশ না হয়ে কথা বলুন সরাসরি! রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী কেন প্রেস কনফারেন্সে সরাসরি কথা বলবেন না? অনেক ঢাকঢাক গুড়গুড় তাহলে আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে যায়। 

এনসিপিকে অন্তর্বর্তী সরকার কেন এত প্রাধান্য দিচ্ছে? এই দৌর্বল্য আখেরে সরকারের নিরপেক্ষতাই শেষ করে দিতে পারে। আর বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল মতপার্থক্য কোথায়? বিএনপি চাইছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন; ড. ইউনূস বলছেন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে। এখনও সাত মাস সময় আছে ডিসেম্বর আসবার; তারপর আরও ছয় মাস কেন লাগবে? গত ১০ মাস সময়ে নির্বাচন নিয়ে কতখানি অগ্রগতি হয়েছে? সমকাল বলছে, ‘প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, প্রশাসন, পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। সব জায়গায় বিএনপিপন্থিরা রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দায় অধ্যাপক ইউনূস নিতে চান না (২৫ মে, ২০২৫)।

সব জায়গায় বিএনপিপন্থিরা অলৌকিক উপায়ে আসীন হন নাই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশ্রয়েই সব হয়েছে, হচ্ছে। তাহলে প্রশাসনে আরও কাউকে বসাতে চান? এনসিপিপন্থি? জামায়াতপন্থি? বিশেষ কোনো পন্থিকে না বসিয়ে নিয়ম ও আইন অনুযায়ী প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র কাজ করলেই সব শৃঙ্খলামতো এগোয়। আইনের শাসনের শিক্ষাই তাই– সকলের জন্য আইন এক। 
‘অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই’– হৃদয়দৌর্বল্যজাত পরিস্থিতি থেকে ড. ইউনূস বেরিয়ে এসে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক থেকে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন আয়োজন করে বহুল আকাঙ্ক্ষিত জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেবেন– এই প্রত্যাশায় পুরো জাতি অপেক্ষমাণ।  

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আইন পদত য গ সরক র র ব এনপ আইন র ইউন স

এছাড়াও পড়ুন:

আইনের শাসনের মূল শিক্ষাই সমাধানের পথ

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে পদত্যাগ করতে পারেন– অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ মাস পূর্ণ হওয়ার পক্ষকাল আগে আচম্বিতে এই খবরে দেশজুড়ে সাড়া পড়ে। সাধারণ মানুষ উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠেন; রাজনৈতিক দলগুলো একের পর এক প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। আলোচনাগুলো মোটাদাগে নির্বাচন, জুলাই গণহত্যার বিচার ও রাজনৈতিক সংস্কার– এই তিন বিষয়েই প্রধানত আবর্তিত হয়। রাজপথও ছিল যথারীতি উত্তাল। গত ৯ মাসে অন্তত আড়াইশ আন্দোলন রাজপথে যার যার দাবিদাওয়া নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।

ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর এ যাবৎ ১১ বার বিদেশ সফর করলেও দেশে ফিরে কোনো প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত হননি। এমনকি তিনি যে পদত্যাগ করতে চাইছেন মর্মে সংবাদে তোলপাড় হলো, তা নিয়েও কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে এখন পর্যন্ত সরাসরি কথা বলেননি। উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সংবাদমাধ্যমে মতামত দিয়েছেন। যেমন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘দায়িত্ব পালন তখনই সম্ভব হবে, যখন সবার সহযোগিতা থাকবে। দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। তাই সরকার দায়িত্ব পালন করবে কিনা, চিন্তা করছে। না পারলে কী করণীয়, তাও চিন্তা করছে’ (সমকাল, ২৪ মে ২০২৫)। 

শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শত বাধার মধ্যেও গোষ্ঠীস্বার্থকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে প্রকাশ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। 

২.
প্রধান উপদেষ্টা শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেননি। তবে পদত্যাগের আশঙ্কাটিই বহু প্রশ্নের অবতারণা করেছে। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না, অথচ তা কেউ জানতেই পারছিলেন না! প্রায় দেড় হাজার মানুষের প্রাণ ও ত্রিশ হাজার মানুষের অঙ্গহানি এবং বহু মানুষের বিয়োগ ব্যথার বিনিময়ে অসামান্য গণঅভ্যুত্থানজয়ী অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে সত্যিকার গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে নিয়ে যাবে– এই আকাঙ্ক্ষা দেশের মানুষের। তাহলে সরকারপ্রধানকে এ কাজে বাধা দিচ্ছে কে?

রাজপথে আন্দোলনের কথা ধরা যাক। কথায় কথায় যেমন যমুনা ঘেরাও হচ্ছে, তেমনি এক যাত্রায় পৃথক ফলও দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ৮ থেকে ১০ মে হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে যমুনামুখী জমায়েতকে সরকার বাধা দেওয়া দূরে থাক, শীতল পানি ছিটিয়ে গরমে শ্রান্তি বিলিয়েছে। ওই আন্দোলন জয়যুক্তও হয়েছে। দেশে আইন-আদালত রয়েছে; আইনের এখতিয়ার যখন রাজপথে মীমাংসার বিষয় হয়, তা অন্যদেরও রাস্তায় নামতে উৎসাহিত করে বৈকি। 

বর্তমান সরকারের দায়িত্বকালে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা– মবতন্ত্রের সীমাহীন উত্থান! সরকারপক্ষীয় কারও সঙ্গে মত না মিললেই ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা। আওয়ামী লীগ আমলে যেভাবে মত না মিললেই বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দেওয়া হতো। এখন ট্যাগের সঙ্গে বাড়তি উপহার মবতন্ত্র। জনতা রাস্তায় নির্বিকারচিত্তে নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। 

শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড...’। জি, মাননীয় উপদেষ্টাবৃন্দ। একটি রেডিও ভাষণের অজুহাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়িটি দু’দিন ধরে বুলডোজার দিয়ে ভাঙার মধ্য দিয়েই এ দেশে মবতন্ত্রের বিষবৃক্ষ চারা থেকে মহিরুহে পরিণত হয়েছিল। কোথায় ছিল সেদিন সরকার বা উপদেষ্টা পরিষদ? কেন থামানো হয়নি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অসহিষ্ণু উগ্রবাদীদের? ৩২ নম্বর ফ্যাসিবাদের প্রতীক কী করে? ৮ বছরের শিশু রাসেলের বুকের তাজা রক্তও কেন মুছে দিতে হবে? মুক্তিযুদ্ধ যেমন শেখ হাসিনার বাপের সম্পত্তি নয়; আবার মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো এ দেশের সকলের বাপের সম্পত্তিও বটে। 
মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, মাজার– লাগাতার ভাঙতে ভাঙতে ভয়াবহ তাণ্ডব ছড়িয়ে দেবার পরও সরকার থেকে আইনি উদ্যোগ দূরে থাক, টুঁ শব্দটিও শোনা যায়নি কেন? 

যেখানে সুবিধা সেখানে ভারতীয় জুজু আবিষ্কার করে সরকার উগ্রবাদীদের আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেয়। আজ তারই ধারাবাহিকতা সমাজে দৃশ্যমান। নারীর প্রতি সহিংসতা, নারীকে ছোট করে কথা বলা যে কোনো সময়কে ছাড়িয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এর মধ্যে নারী কমিশনের সুপারিশ নিয়ে যেভাবে উগ্রবাদীরা আক্রমণ করেছে, সে ব্যাপারেও সরকার এখন পর্যন্ত কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি। এসব প্রশ্রয়ের গন্তব্য কী?

৩.
অন্যায়, অনৈতিকতা বিকাশের সুযোগ দিয়ে বিচার ব্যবস্থাকে সংকুচিত করে ফেললে সমাজে সুশাসন অন্তর্হিত হতে বাধ্য। হতাশা ও অভিমান ভুলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেই নির্মোহ চিত্তে ভেবে বের করতে হবে– কেন তাঁর ১০ মাস শাসনকালে সমাজের এই রুগ্‌ণ দশা? যে আলোকিত সমাজের আকাঙ্ক্ষায় কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে– সেই মানুষের আবেগ ও শক্তিকে ড. ইউনূস যদি দেশের কাজে লাগাতে না পারেন, তাহলে কে পারবেন? তবে তিনি কোন খাতে ও কতটুকু কাজ করবেন– স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ, নারীর অধিকার ও মর্যাদা, দেশের ঐতিহ্য দেখভালের দায়িত্ব সরকারপ্রধানের। তিনি এসব ব্যাপারে নির্বিকার থাকতে পারেন না। আর সংস্কার ও বিচার নিয়ে এত হতাশ না হয়ে কথা বলুন সরাসরি! রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী কেন প্রেস কনফারেন্সে সরাসরি কথা বলবেন না? অনেক ঢাকঢাক গুড়গুড় তাহলে আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে যায়। 

এনসিপিকে অন্তর্বর্তী সরকার কেন এত প্রাধান্য দিচ্ছে? এই দৌর্বল্য আখেরে সরকারের নিরপেক্ষতাই শেষ করে দিতে পারে। আর বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল মতপার্থক্য কোথায়? বিএনপি চাইছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন; ড. ইউনূস বলছেন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে। এখনও সাত মাস সময় আছে ডিসেম্বর আসবার; তারপর আরও ছয় মাস কেন লাগবে? গত ১০ মাস সময়ে নির্বাচন নিয়ে কতখানি অগ্রগতি হয়েছে? সমকাল বলছে, ‘প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, প্রশাসন, পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। সব জায়গায় বিএনপিপন্থিরা রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দায় অধ্যাপক ইউনূস নিতে চান না (২৫ মে, ২০২৫)।

সব জায়গায় বিএনপিপন্থিরা অলৌকিক উপায়ে আসীন হন নাই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশ্রয়েই সব হয়েছে, হচ্ছে। তাহলে প্রশাসনে আরও কাউকে বসাতে চান? এনসিপিপন্থি? জামায়াতপন্থি? বিশেষ কোনো পন্থিকে না বসিয়ে নিয়ম ও আইন অনুযায়ী প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র কাজ করলেই সব শৃঙ্খলামতো এগোয়। আইনের শাসনের শিক্ষাই তাই– সকলের জন্য আইন এক। 
‘অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই’– হৃদয়দৌর্বল্যজাত পরিস্থিতি থেকে ড. ইউনূস বেরিয়ে এসে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক থেকে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন আয়োজন করে বহুল আকাঙ্ক্ষিত জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেবেন– এই প্রত্যাশায় পুরো জাতি অপেক্ষমাণ।  

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ