সেই নীল জার্সি ও কিংবদন্তিকে পেয়ে উচ্ছ্বাসে ভাসছেন মেসি
Published: 18th, June 2025 GMT
ক্লাব বিশ্বকাপে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর পাশে বসে ম্যাচ দেখতে দেখা গেছে তাঁকে। আগের সেই ‘ডিভাইন পনিটেইল’ আর নেই—চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা। মাথার পেছনে চুলের সেই ঝুঁটি আর নেই। মুখে বয়সের ছাপ। তবে হাসিটা অমলিন। লিওনেল মেসির পাশে দাঁড়িয়ে রবার্তো বাজ্জোর সেই হাসি আরও চওড়া হয়েছে।
তবে উচ্ছ্বাসটা মেসিই বেশি প্রকাশ করেছেন। ইতালিয়ান কিংবদন্তির সঙ্গে সাক্ষাতের আনন্দে নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে তাঁর ছবিসহ একটি পোস্টও করেছেন মেসি। বাজ্জো অবশ্য খালি হাতে মেসির সঙ্গে দেখা করেননি। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তিকে ইতালি জাতীয় দলে নিজের ১০ নম্বর জার্সি উপহার দিয়েছেন ৫৮ বছর বয়সী সাবেক এই ফরোয়ার্ড।
আরও পড়ুনরামোস–সিলভা–ফাবিও: ক্লাব বিশ্বকাপে ‘বুড়ো হাড়ের ভেলকি’১ ঘণ্টা আগেক্লাব বিশ্বকাপে আটলান্টায় আগামীকাল রাতে পোর্তোর মুখোমুখি হবে ইন্টার মায়ামি। এই টুর্নামেন্টে মেসির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে বাজ্জোর। সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, জার্সিতে সই রয়েছে বাজ্জোর এবং জার্সিটি ১৯৯৪ বিশ্বকাপের। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ যুক্তরাষ্ট্রেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সে বিশ্বকাপের ফাইনালে ইতালির হয়ে টাইব্রেকার মিস করে ‘ট্র্যাজেডি’র শিকার জন বাজ্জো। তাঁর সেই মিসে বিশ্বকাপ জিতে নেয় ব্রাজিল।
বাজ্জোর উপহার হাতে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর ছবি গতকাল রাতে মেসির ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করার পাশাপাশি ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘কী সুন্দর ছবি! এ বিশেষ ও অর্থপূর্ণ উপহার ও দারুণ সব কথার জন্য ধন্যবাদ রবার্তো। আপনি ফুটবলের ঐতিহাসিক কিংবদন্তি। আপনি যখন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চান, তখন আপনাকে স্বাগত জানাতে পারাটা সব সময়ই আনন্দের।’
মেসির এই পোস্টের মন্তব্যে বাজ্জোর ইনস্টাগ্রাম থেকে মন্তব্যে লেখা হয়, ‘বন্ধু, তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারাটা সম্মানের ও আনন্দের।’
আরও পড়ুনট্রাম্পকে ‘শান্তির জন্য খেলা’র বার্তা লিখে জার্সি উপহার রোনালদোর২ ঘণ্টা আগেসংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, মেসি ও বাজ্জোর সাক্ষাৎ হয়েছে ইন্টার মায়ামির ড্রেসিংরুমে। পোর্তোর বিপক্ষে ম্যাচ সামনে রেখে অনুশীলন করছিলেন মায়ামির খেলোয়াড়েরা। বাজ্জো দেখা করতে আসবেন, তা নাকি মেসি জানতেন না। একটু চমকে গেলেও বাজ্জোকে বরণ করে নিতে দেরি করেননি আর্জেন্টাইন এই ফরোয়ার্ড।
ইতালির হয়ে ৫৬ ম্যাচে ২৭ গোল করা বাজ্জো ১৯৯৩ সালে ব্যালন ডি’অর এবং ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার জেতেন। সিরি আ জিতেছেন জুভেন্টাস ও এসি মিলানের হয়ে। জুভেন্টাসের হয়ে জেতেন উয়েফা কাপও। তিনটি আলাদা বিশ্বকাপে গোল করা একমাত্র ইতালিয়ান এই কিংবদন্তি পরিবার নিয়ে যুক্তরাস্ট্রে গিয়েছেন ক্লাব বিশ্বকাপের খেলা দেখতে। সেখানে বিশেষ অতিথির সম্মানই তিনি পাচ্ছেন। বোকা জুনিয়র্সের ম্যাচে আর্জেন্টাইন ক্লাবটির সমর্থনে গলা ফাটাতে দেখা গেছে বাজ্জো ও তাঁর মেয়েকে। বাবা-মেয়ে দুজনেই ক্লাবটির ভক্ত।
মেসির সঙ্গে বাজ্জোর আগেও দেখা হয়েছে। পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনায় খেলাকালে কাতালান ক্লাবটির ড্রেসিংরুমে মেসির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল বাজ্জোর। তখন থেকেই দুজনের বন্ধুত্বের শুরু। ২০১৫ সালে ইতালিয়ান সংবাদমাধ্যম কোরিয়েরে দেয়ো স্পোর্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মেসিকে বিশ্বসেরা আখ্যা দিয়ে বাজ্জো বলেছিলেন, ‘সে গোল করতে চাইলে তা পারে। তার পাশে খেলতে পারলে ভালো লাগত। এমনকি সেটা এখনো চাই।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ল ব ব শ বক প উপহ র বদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
আছে তো হাতখানি...
বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস আমাদের সবাইকে বন্ধুত্বের শক্তিকে মনে করিয়ে দেয়, সেই সঙ্গে বুঝিয়ে দেয় যে মানবতা আমাদের সবার এবং বন্ধুত্বের মাধ্যমেই একটি শান্তিপূর্ণ ও সংযুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব। আজ থেকে ১৪ বছর আগে ২০১১ সালে জাতিসংঘ প্রথম ৩০ জুলাইকে বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তারপর থেকে প্রতিবছরই পৃথিবীর বহু দেশে এ দিনটি নিয়মিতভাবে উদ্যাপিত হচ্ছে। এ ছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশে আগস্টের প্রথম রোববার বন্ধু দিবস হিসাবে পালিত হয়।
কাকে বলব বন্ধুত্ব—ব্যক্তিগত জীবনে, সমাজে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে? বেশ কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুদের আড্ডায় বন্ধুত্বের কথা উঠেছিল—উঠেছিল সেই সনাতন প্রশ্নও, কাকে বলব বন্ধুত্ব। একজন বলেছিল, বন্ধুত্ব মানে হচ্ছে, যাকে সব কিছু বলা যায়। যেখানে কোনো রাখঢাক থাকে না। আরেক জন বলেছিল, বন্ধুত্ব মানে হচ্ছে একদিন সারা দিন দেখা ও কথা বলার পরেও মনে হয়, দেখা বা কথা ফুরায়নি। কাল আবার দেখা আর কথা শুরু করতে হবে। তৃতীয় বন্ধুটি বলেছিল, বন্ধুত্ব মানে একটি নির্ভরতার কাঁধ আর হাত, যে কাঁধে মাথা রাখা যায়, যে হাতে হাত রাখা যায়।
আমাদের এক তার্কিক বন্ধু বলেন, ও সবই কৈশোরের বা যৌবনের কথা। আজ পড়ন্ত বেলায় এসে আছে কি আমাদের সেই উদ্দাম বন্ধুত্ব? ওর কথা শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে পড়লাম। মনে পড়ল দীর্ঘদিনের সেই বন্ধুটির কথা—৫০ বছরের সখ্য, সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম থেকেই। সে সময়ে আমাদের কথার কোনো চিহ্নিত পরিধি ছিল না—না বিষয়বস্তু সম্পর্কে, না সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। আলোচনা চলত অনর্গল নানান বিষয়ে, তুঙ্গ বিতর্কে কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তারুণ্যের ঝাপটায় আমরা তখন উদ্দীপ্ত।
তারপর আমাদের দুজনেই ব্যস্ত হয়ে গেলাম পেশাগত বলয়ে, পারিবারিক জীবন নিয়ে। যৌবনের সে বন্ধুর সঙ্গে নিত্য দেখা হয় না, সাক্ষাৎ পাই মাঝেমধ্যে। মুখোমুখি দেখায় কিংবা দূরালাপনীতে খোঁজখবর নিই। আলোচনা আর যৌবনের বিষয়ে ফিরে যায় না, তারা এখন মোড় নেয় পেশাগত আশা-হতাশার বিষয়ে, ছেলে-মেয়েদের পড়া-শোনা সম্পর্কে। টের পাই পরিবর্তনটি।
দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কথাবার্তার ছায়াও অন্যদিকে সরে গেল। আমাদের কথোপকথনের আলো স্থির হয়ে থাকে ছেলে-মেয়েদের সাফল্য-ব্যর্থতার কাহিনিতে, নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্য বিষয়ে। তারপর কেমন করে যেন কোন এক অমোঘ দিবসে আমরা আলোচনা শুরু করি কার কার শরীর ঠিক নেই, কে কে অসুস্থ, কে কে চলে গেল। ভাবলাম, জীবনের বদলের সঙ্গে সঙ্গে অর্ধশতাব্দীর বন্ধুত্বের মানুষটির সঙ্গে আমার কথোপকথন কেমন করে বদলে গেল। যেন একটি পূর্ণ বৃত্ত ঘুরে সেখানেই কথা বলা ফিরে এল, যেখানে চলে যাওয়াটাই মুখ্য আলোচনার বিষয়। বেশ কিছুদিন আগে সব কথা শেষ করে দিয়ে সে–ও চলে গেল।
পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়, অঞ্চলে অঞ্চলে মানুষের সঙ্গে মানুষের মূল ভিত্তিই তো ছিল এ আত্মিক বন্ধন। তাই খিদে পেলে পাড়ার যেকোনো বাড়িতেই পাত পেতেছি, মহল্লায় অন্যায় দেখলে যেকোনো বয়োজ্যেষ্ঠ যেমন যেকোনো বয়োকনিষ্ঠকে শাসন করেছেন, তেমনি অঞ্চলে বিপদ হলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন একসঙ্গে।সম্বিত ফিরে পেলাম আমাদের দার্শনিক বন্ধুটির উচ্চারণে, চাণক্যের সেই চিরায়ত কথায়, ‘উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু।’ হয়তো–বা; কিন্তু আমার সব সময়েই মনে হয়েছে, বন্ধুতে বন্ধুতে সময় কাটানো হচ্ছে সাহচর্যের, আনন্দের ও সান্নিধ্যের। চূড়ান্ত বিচারে আমরা সে সাহচর্যের, আনন্দের আর সান্নিধ্যের হিরণ্ময় স্মৃতিটুকুই হৃদয়ে ধারণ করি, আর সব তুচ্ছ হয়ে যায়। ভালোবাসার সময়, মমতার সময়, গল্পের সময়, কাছে বসে থাকার সময়, নির্ভরতার সময়, আড্ডার সময়—এটাই বন্ধুত্বের মূল ভিত্তি।
একজন বন্ধু আরেকজনের কাছে সময়টাই শুধু চায় নিজের কথা বলতে, বন্ধুর গল্প শুনতে, দুঃখ আর আনন্দ ভাগ করে নিতে; কিন্তু প্রায়ই এটা আমরা বিস্মৃত হই। আজকের যুগে বন্ধুকে আমরা ‘মুখোমুখি বসিবার’ সময়টুকুই দিতে পারি না। আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা, আমাদের স্বার্থচিন্তা নিয়ে ‘আমি আমাকেই’ নিয়ে মত্ত—বন্ধুকে সময় দেব কখন। তাই বন্ধুত্বের বন্ধন ঢিলা হয়ে যায়, বন্ধুত্বের রং ফিকে হয়ে পড়ে, বাড়ে দূরত্বের মাইলফলক। সংযোগ হয়তো থাকে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে; কিন্তু হৃদয়ের যোগাযোগ?
আমাদের সমাজ অঙ্গনে বন্ধুত্বের সহমর্মিতা একসময় বড় দৃঢ় ছিল। সেই সব গল্প আমরা আজও শুনি—পারিবারিক বলয়ে একটি শক্ত সহমর্মিতার বন্ধনে মানুষ ভালোবাসা, মায়া আর মমতার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। বৃহত্তর পরিবারে সে বন্ধন, সেই একাত্মতা ছড়িয়ে গিয়েছিল এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। ঝগড়াঝাঁটি কি ছিল না, ছিল না কি মনোমালিন্য? অবশ্যই ছিল; কিন্তু তা সহমর্মিতার ওই মানবিক বন্ধনকে নষ্ট করতে পারেনি। দিনের শেষে মানুষ ওই পারিবারিক সৌহার্দ্যের কাছেই মানুষ ফিরে গেছে হাসিতে-আনন্দে, দুঃখ-কষ্ট, বিপদে-আপদে। পরিবারই তো ছিল মানুষের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ।
সময়ের সুতায় আমাদের সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের দুই ধরনের সম্পর্ক ছিল— একটি আত্মিক, একটি ব্যবসায়িক। আত্মিক সম্পর্কটি ছিল বন্ধুত্বের ও সৌহার্দ্যের; ব্যবসায়িক সম্পর্কটি কাজের; আত্মিক সম্পর্কটি মমতা ও মানবিকতার, ব্যবসায়িক সম্পর্কটি অর্থের ও স্বার্থের। ব্যবসায়িক সম্পর্কে লাভ-অলাভের কথা উঠেছে, অংশ-ভগ্নাংশ নিয়ে বিতর্ক চলেছে, চুলচেরা হিসাব-নিকাশ কষা হয়েছে; কিন্তু দিনের শেষে এ সবকিছু ছাপিয়ে অখণ্ড সত্য হিসেবে সর্বদাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজে বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
বন্ধুরা মিলে ঘুড়ি ওড়ানো শেষে বাড়ি ফেরা। খুলনার বিএল কলেজ মাঠ।