ষাট বছর আগে এক বাঙালি তরুণ প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট (পিএইচডির সমতুল্য) ডিগ্রি লাভ করেন বাংলার মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের ওপর গবেষণা করে। সেই গবেষণায় ১৮৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার মুসলমান লেখকদের ওপর আলোচনা করা হয়। ১৯৭১ সালে অভিসন্দর্ভটি বই আকারে প্যারিস ও হেগ থেকে একযোগে প্রকাশ করে মাউটন অ্যান্ড কোম্পানি। আর ২০১৬ সালে ঢাকার অঁদ্রে মালরো ইনস্টিটিউট অব কালচার থেকে এর ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ‘ক্রিসেন্ট অ্যান্ড লোটাস: আ স্টাডি অন দ্য ইন্টেলেকচুয়াল হিস্টরি অব দ্য মুসলিমস অব বেঙ্গল (আপ টু ১৯৪৭)’ শিরোনামে।
যে বাঙালি তরুণ এই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন, তাঁর নাম মাহমুদ শাহ্ কোরেশী। এ ছিল ফরাসি ভাষায় বাঙালি মুসলমানদের চিন্তাশীলতা ও সৃজনশীলতা বিষয়ে অন্যতম পথিকৃৎ কাজ। সে সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কোরেশী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডিলিট অভিসন্দর্ভ নিয়ে চূড়ান্তভাবে পরীক্ষকদের মুখোমুখি হওয়ার অধিবেশন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। মানে পরীক্ষকদের বাইরে যে কেউ আগ্রহী হলে দর্শক হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেন। তবে কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য করতে পারেন না। আমি ১৯৫৯ সালে ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে প্যারিসে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বিষয়টা জানতে পারি। এরপর বিভিন্ন সময় এ রকম কয়েকটি অধিবেশনে দর্শক হিসেবে যোগদান করি। সে অভিজ্ঞতা আমার বেশ কাজে লেগেছিল। আমি পরীক্ষকদের মোকাবিলা করার কিছু কৌশল রপ্ত করতে পেরেছিলাম।’
মাহমুদ শাহ্ কোরেশী সর্বোচ্চ কৃতিত্বের সঙ্গে—হাইয়েস্ট ডিসটিংশন নিয়ে—ডিলিট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। এ কারণে তাঁর অভিসন্দর্ভটি বই আকারে প্রকাশের জন্য ফ্রান্সের জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র থেকে অনুদান পায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাহমুদ শাহ্ কোরেশী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার কিছুদিন পরই প্যারিসে যান। সেটা ১৯৫৯ সালের অক্টোবর মাস। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাঁর সঙ্গে আরেক বাঙালি ছাত্র ফরাসি সরকারের বৃত্তি পেয়ে প্যারিস গিয়েছিলেন। তিনি অর্থনীতির মোজাফ্ফর আহমদ। ‘মোজাফ্ফর অবশ্য বছরখানেক প্যারিসে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। আর আমি রয়ে যাই প্যারিসে।’ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বললেন কোরেশী।
ফরাসি ভাষার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল কীভাবে—জানতে চাইলে কোরেশী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যপ্রেমী ছিলাম। বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের পাশাপাশি ফরাসি সাহিত্য নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী হিসেবে পাই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, জহির রায়হান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, নেয়ামাল বশীর প্রমুখকে। বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে জানার সুযোগ বিস্তৃত হয়। তখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ফরাসি ভাষার একটি কোর্সে ভর্তি হই আমি। এভাবে ফরাসি ভাষা শিখতে শুরু করি।’
১৯৫৭ সালে ফরাসি দার্শনিক ও লেখক আলব্যের কামু সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ফরাসি সাহিত্য নিয়ে কোরেশীর আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। কামুর বইপত্র পাওয়ার জন্য তিনি ঢাকায় ফরাসি উপদূতাবাসে চিঠি লেখেন। এর সূত্র ধরেই পরে তিনি গবেষণার জন্য ফরাসি সরকারের বৃত্তি পান। তৎকালীন পাকিস্তানে ফরাসি সরকারের শিক্ষা ও গবেষণার বৃত্তিগুলো একচেটিয়াভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরাই নিয়ে যেত। কোরেশী আর মোজাফ্ফরই পাকিস্তান আমলে ফরাসি সরকারের বৃত্তি পাওয়া প্রথম দুই বাঙালি ছাত্র।
দুই
১৯৬১ সালে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ‘এ উপলক্ষে আমাকে একটি প্রবন্ধ লিখতে বলা হয়,’ বললেন কোরেশী। ‘আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। তারপরও সাহস করে লিখে ফেলি। তখনো ফরাসি ভাষা পুরো রপ্ত করিনি বলে ইংরেজিতেই প্রথমে খসড়া করি। তারপর কয়েকজনের সহায়তায় ওটা ফরাসি রূপ দিই।’ পরে ইংরেজি প্রবন্ধটি দ্য ইউনেসকো কুরিয়ার–এর ডিসেম্বর ১৯৬১ সংখ্যায় প্রকাশ পায় ‘রিভেলশনস অব আ নোবেল প্রাইজ ইন লিটারেচার’ নামে। ওই সংখ্যাটি পুরোটাই ছিল রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত। তাতে মাহমুদ শাহ্ কোরেশী ছাড়া আর যে দুজন বাঙালির রচনা মুদ্রিত হয়, তাঁরা হলেন হুমায়ুন কবীর ও সত্যজিৎ রায়।
কবি বুদ্ধদেব বসু সে বছর সরবোনে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ওপর বক্তৃতা করতে। তাঁর সঙ্গে কোরেশীর পরিচয় হয়। পরে তাঁদের মধ্যে একাধিক পত্র বিনিময়ও হয়েছিল। কোরেশী তাঁর বিয়ের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসুকে। জবাবে তিনি চিঠি লিখে শুভেচ্ছা জানান। একটি কবিতাও লেখেন নবদম্পতির উদ্দেশে, যা পরে দেশ পত্রিকায় (৩৮ বর্ষ ২৪ সংখ্যায়) প্রকাশিত হয়। অবশ্য ছাপা কবিতায় কোরেশীর নাম পাল্টে দিয়েছিলেন ‘স্নেহভাজনের অমঙ্গল আশঙ্কায়।’
‘ওই বছরই সরবোনের ওরিয়েন্টাল স্কুলে বাংলা ভাষার কোর্স চালু হয়। আমাকে ওখানে ক্লাস নিতে বলা হয়।’ যোগ করলেন কোরেশী। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর স্ত্রী আন–মারি তিবো বাংলা শিখতে ছাত্রী হিসেবে ওই কোর্সে ভর্তি হন। আর সেখান থেকেই ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয় মাহমুদ শাহ কোরেশীর।
‘আসলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নামের সঙ্গে তো কৈশোর থেকেই আমার পরিচয়। আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত সওগাত পত্রিকায় প্রথম তাঁর লেখা পড়ি। আমরা দুজনই চট্টগ্রামের মানুষ। আমার বাড়ি রাঙ্গুনিয়ায়, তাঁর ষোলশহরে।’ বললেন কোরেশী। ‘আমি যখন প্যারিসে যাই, তখন তিনি পশ্চিম জার্মানির বনে পাকিস্তান দূতাবাসে প্রেস অ্যাটাশে। পরের বছর, মানে ১৯৬০ সালে তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসে বদলি হয়ে আসেন। তাঁর সঙ্গে আমার সখ্য ও হৃদ্যতা গড়ে ওঠে, যা আমৃত্যু বজায় ছিল। আমি তাঁর অফিসে মাসে অন্তত একবার গিয়ে দীর্ঘ সময় কাটাতাম, খবরের কাগজ পড়তাম। মাঝেমধ্যে তাঁর বাসভবনে আনুষ্ঠানিক মধ্যাহ্নভোজ বা নৈশভোজে যোগ দিতাম। এখানো তাঁর মেয়ে সিমিন ও ছেলে ইরাজের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে।’
চট্টগ্রামের মানুষ হলেও ওয়ালীউল্লাহ চাটগাঁইয়া ভাষা বলতে পারতেন না, তবে বুঝতেন। ‘তিনি আমাকে ফরাসি ভাষা রপ্ত করতে বেশ সাহায্য করেছেন। পরে আমরা ফরাসি ভাষাতেও আলাপচারিতায় মেতে উঠতাম।’ বললেন কোরেশী। ‘১৯৬৮ সালে আমি দেশে ফিরে আসার আগপর্যন্ত নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হতোই। ওই বছরই তাঁর শেষ উপন্যাস কাঁদো নদী কাঁদো প্রকাশিত হয়। তখন তিনি ইউনেসকোতে। এক বিকেলে প্যারিসের ইউনেসকো অফিসে বসে তিনি আমাকে উপন্যাসটির বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করেছিলেন।’
প্যারিসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন মাহ্মুদ শাহ্ কোরেশী। এ বছরই বাংলা একাডেমি থেকে সেটি প্রকাশিত হওয়ার কথা। ‘আশা করছি, এই বই থেকে আপনারা ওয়ালীউল্লাহর প্যারিস জীবনের বিভিন্ন বিষয় জানতে পারবেন,’ বললেন তিনি।
তিন
সরবোনে পড়ালেখা করার সময় কোরেশী ফরাসি ভাষা ও ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ে একাধিক কোর্স করেন। ফরাসি ভাষায় তাঁর দক্ষতা পরে ব্যক্তিজীবনে তো বটেই, জাতীয় জীবনেও খুব কাজে লাগে, বিশেষ করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারণা চালানোর অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে জনমত গঠনের জন্য মুজিবনগর সরকার মোল্লা জালাল উদ্দীন (এমএনএ) ও মাহমুদ শাহ্ কোরেশী—এই দুই সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। তাঁরা কলকাতা থেকে লেবাননের রাজধানী বৈরুত যান। এরপর লেবানন ও সিরিয়ায় সেখানকার বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপচারিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। এই দুই দেশের মানুষ, বিশেষত শিক্ষিত শ্রেণির ফরাসি ভাষা জানা ছিল। কোরেশীর ফরাসি ভাষার ওপর দক্ষতা তাই বেশ কাজে লাগে। কোরেশী বলেন, ‘পাকিস্তান আরব বিশ্বে বেশ জোরেশোরে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল যে ভারত আসলে পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য এই যুদ্ধ করাচ্ছে। এর পাল্টা জবাব দিতে আমরা ওসব দেশের লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে আমরা ভারতের পক্ষ নিয়ে কোনো যুদ্ধ করছি না, বরং আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও ন্যায্য অধিকারের জন্য যুদ্ধ করছি, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করছি।’
মোল্লা জালাল উদ্দীন ও মাহমুদ শাহ্ কোরেশী জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রচারণার কাজ চালিয়ে যান। মাহমুদ শাহ্ কোরেশী বলেন, ‘ওই সময়ে আমি বাংলাদেশের নির্যাতিত মানবতা নামে একটি ছোট পুস্তিকা রচনা করি ইংরেজিতে। তারপর তা পড়ে শোনাই মোল্লা জালাল ও ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে। তাঁরা এটি অনুমোদন দিলে লেবাননের সাংবাদিক নাবিল বারেদে সেটি আরবিতে রূপান্তর করেন। উদ্দেশ্য, আরব বিশ্বের মানুষজনের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা। এটিই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আরবিতে প্রথম পুস্তিকা,’ বললেন কোরেশী।
‘এর মধ্যে এক ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ে যে জনৈক মাহমুদ আল কাশেম বাংলাদেশের দূত হিসেবে ইসরায়েল গিয়েছে। এ খবর আমাদের এত দিনের পরিশ্রম ও প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করার জন্যই ছড়ানো হয়েছিল,’ যোগ করলেন কোরেশী। ‘আরব বন্ধুরা আমাদের ওপর খেপে গেল। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ জানাতে চাইলেও ভারতীয় কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপে কিছু করতে পারলাম না।’
এ রকম একটা বেকায়দা পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক, লেখক ও মুক্তিসংগ্রামী অঁদ্রে মালরো ঘোষণা দেন যে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক। তাঁর এই ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে এক বিরাট আলোড়ন তৈরি হয়। ‘বিশ্বের সর্বত্র সাড়া পড়ে গেল। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই হাজার হাজার চিঠি পৌঁছাল মালরোর কাছে। সবাই তাঁর সংগ্রামের সঙ্গী হতে চান।’ বললেন কোরেশী।
‘মালরোর ঘোষণার পর আমি তাঁকে একটি চিঠি লিখে জানাই যে এখানে এলে তাঁর তো একজন বাঙালি দোভাষী দরকার হবে। আমি বিনা বেতনে খাটতে রাজি আছি,’ স্মৃতির পাতা উল্টে বললেন কোরেশী। তাঁর ব্যক্তিগত সচিব প্রত্যুত্তরে চিঠি লিখে জানালেন যে মঁসিয়ে মালরো ভারতে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সময়মতো খবর দেওয়া হবে।
মালরোর অবশ্য আর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া হয়নি। তাঁর ঘোষণার দুই মাসের মাথায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু মালরোর দোভাষী হিসেবে কাজ করার সুযোগ ঠিকই হয়েছিল কোরেশীর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দুই বছর পরে ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে মালরো বাংলাদেশে আসেন।
‘মালরো ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম সফর করেছিলেন। চার দিনের এই সফর ছিল নানা কর্মসূচিতে ঠাসা। আর আমি ছিলাম তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তাঁর কথা অন্যদের বাংলায় এবং অন্যদের কথা তাঁকে ফরাসিতে ভাষান্তর করে ক্রমাগত বলে যাওয়ায় কখনো কখনো ক্লান্তি ভর করলেও সেটা ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা, এক আনন্দময় সময়,’ বললেন কোরেশী। ঢাকার অঁদ্রে মালরো ইনস্টিটিউট অব কালচার থেকে কোরেশী রচিত চট্টগ্রামে অঁদ্রে মালরো শিরোনামে যে পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে ২০০২ সালে, তাতে বিভিন্ন ছবিসহ বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
দোভাষী হিসেবে তাঁকে নিযুক্ত করার পেছনে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন ফরাসি রাষ্ট্রদূত পিয়ের মিল বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেছিলেন যে মালরোর মতো মানুষের সঙ্গে কাজ করার ও তাঁর কথা বুঝে সঠিকভাবে অনুবাদ করার জন্য বাংলাদেশে একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি কোরেশী। ফলে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে দোভাষী নিযুক্ত করে। অবশ্য একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বাদ সেধেছিলেন। তাতে কোনো কাজ হয়নি। বরং মালরোর বাংলাদেশ সফরের চার মাস পরে প্যারিসে আবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় কোরেশীর।
‘মালরো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বৈশ্বিক সমর্থন জোগাতে যে ভূমিকা রেখেছেন, তা তুলনাহীন,’ কোরেশী বলেন। ‘আমরাও তাই তাঁকে যথাসম্ভব সম্মান জানানোর চেষ্টা করেছি।’
মালরোর ২০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ফরাসি সরকার ১৯৯৬ সালকে মালরো বর্ষ ঘোষণা করে। তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাকের আমন্ত্রণে কোরেশী তখন ফ্রান্সে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
মাহমুদ শাহ্ কোরেশীঅধ্যাপক, গবেষক, লেখক ও ভাষাবিদ ড.
কর্মজীবনে কোরেশী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। রাজশাহীতে ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস) প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মাঝে এক বছর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। রচনা ও সম্পাদনা করেছেন ৩০টির বেশি বই। এগুলোর মধ্যে আছে: ছিন্নমূল (১৯৫৮), সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য (১৯৭৯), চাঁদের অপেরা (১৯৮৪), দার্শনিক দিদরো ও তাঁর সাহিত্য কীর্তি (১৯৮৪), সৈয়দ আলী আহসান সংবর্ধনাগ্রন্থ (১৯৮৫), অঁদ্রে মালরো: শতাব্দীর কিংবদন্তি (১৯৮৬), মাহবুব উল আলম (১৯৮৮), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার সমস্যা (১৯৯৭), শতবর্ষের জ্যাকপ্রেভের (১৯৯৯), মুহাম্মদ ইউনূস: তাঁর স্বপ্ন ও সাফল্য (২০০৫), সিমন দ্য বোভোয়ার (২০০৮), ফ্রান্সে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সমাদর (২০০৯), সৈয়দ আলী আহসান ও বিশ্ব সংস্কৃতি (২০১১), রবীন্দ্রনাথ ও ফরাশি সংস্কৃতি (২০১১), মুক্তিযুদ্ধের মিশন ও আমার জীবন (২০১৭), হজ সেরে এসে এবং ফরাশি ভাষা ও সাহিত্য। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই গুণী ব্যক্তি ফরাসি ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে নিরন্তর কাজ করার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৬ সালে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মাননা লেজিওঁ দনরসহ একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র ব ত ত বলল ন ক র শ ১৯৭১ স ল য দ ধ কর কর ছ ল ন তৎক ল ন র র জন হয় ছ ল কর ছ ন র ফর স র জন য ইউন স অবশ য প রথম সরব ন র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
গুলিতে দৃষ্টি হারালেও স্বপ্ন হারায়নি হিমেল, দেখতে চায় স্বাধীন বাংলাদেশ
ছবি-২: মায়ের কাঁধে ভর করে টাঙ্গাইলের একটি অনুষ্ঠানে যেতে বাড়ি থেকে বের হয় দৃষ্টি হারানো হিমেল। তাঁদের বিদায় জানান হিমেলের ভাই মো. জনি মিয়া। আজ মঙ্গলবার সকালে মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই ইউনিয়নের লালবাড়ী গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
গুলিতে দৃষ্টি হারালেও স্বপ্ন হারায়নি হিমেল, দেখতে চায় স্বাধীন বাংলাদেশ
প্রতিনিধি,
গত বছরের ৪ আগস্ট টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে গোড়াই হাইওয়ে থানা ঘেরাওয়ের সময় পুলিশের গুলিতে চোখের দৃষ্টি হারায় হিমেল ইসলাম (১৬)। চিকিৎসকেরা তাকে ও তার পরিবারকে জানিয়েছেন, সে আর কখনো চোখে দেখতে পারবে না।
তবু চোখে স্বপ্ন আছে হিমেলের—আবার সুন্দর করে বাঁচার, আবার স্বাধীন বাংলাদেশকে দেখার। মঙ্গলবার সকালে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে এমনটাই বলল হিমেল।
উপজেলার লালবাড়ী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, খাটের ওপর বসে আছে হিমেল। তার মা নাছিমা বেগম ও বড় ভাই মো. জনি মিয়া (২৫) তাকে নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন টাঙ্গাইলের শিল্পকলা একাডেমিতে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ছেলের চোখ হারানো নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন নাছিমা বেগম। তিনি বলেন, তাঁর পরিবারে মা, দুই ছেলে, বড় ছেলের স্ত্রী ও এক নাতি আছে। প্রায় ১৫ বছর আগে স্বামী আফাজ উদ্দিন তাঁদের ফেলে অন্যত্র চলে যান। এরপর থেকে নাছিমা বেগমের জীবনে নামে দুর্ভোগ। ছেলেদের নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের পড়াশোনা করাতে থাকেন। বড় ছেলে জনি ১৩-১৪ বছর বয়সে পড়াশোনা ছেড়ে শ্রমিকের কাজ শুরু করে। হিমেলও ১২-১৩ বছর বয়সে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্থানীয় এক ডেকোরেটরের দোকানে কাজ করত।
গত বছরের ৪ আগস্ট গোড়াই হাইওয়ে থানা ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেয় হিমেল। সে সময় তার চোখ, মুখ ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লাগে। আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসার পর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে এক সপ্তাহ পর ছুটি দেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, সে আর চোখে দেখতে পারবে না। পরে চোখের ক্ষত না শুকানোয় হিমেলকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়। এখন নিয়মিত তাকে সিএমএইচে চিকিৎসা নিতে হয়।
নাছিমা বেগম বলেন, ‘আমার বয়স হইছে। এখন আর কাজ করতে পারি না। বড় ছেলেডা এক ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে, ১০ হাজার টাকা বেতন পায়। তা দিয়্যা ছেলে, বউ, মা আর নাতি নিয়া খুব কষ্টে দিন কাটাইতাছি।’
হিমেলের ভাই জনি মিয়া বলেন, ‘আমি উত্তরা স্পিনিং মিলে ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করি। সংসারে ছয়জন মানুষ নিয়া খুব কষ্টে চলি। আল্লায় ভাইডারে যদি ভালো কইর্যা দিত, তাইলে আগের মতো কাজ করা পারত। আমাগো সবাই ভালো কইর্যা চলতে পারতাম।’
হিমেল ইসলাম বলে, ‘আমি ৫ আগস্টের আগে পড়ালেখা করতাম। ক্লাস নাইনের ছাত্র ছিলাম। ডেকোরেশনের কাজ করতাম। এখন আমার চোখে গুলি লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। আগস্টের ৪ তারিখে আন্দোলনে যোগ দিই। হাইওয়ে থানায়। থানা থেকে আমাদের গুলি করে। আহত অনেকের মধ্যে আমি একজন। আমার সারা মুখে এখনো বুলেট আছে। এই বুলেটে আমার অনেক ক্ষতি হয়। দুই চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। আমার পরিবারের অনেক কষ্ট এখন। এখন আমার চাওয়া একটাই—আবার আমি সুন্দর করে বাঁচতে চাই; স্বাধীন বাংলাদেশ আবার দেখতে চাই।’
নাছিমা বেগম জানান, সরকারিভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং রাজনৈতিক দল ও কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু সহায়তা পেয়েছেন। এর সবই হিমেলের চিকিৎসার পেছনে ব্যয় হয়ে গেছে।
এদিন হিমেলকে নিয়ে টাঙ্গাইলের পথে রওনা দেন মা নাছিমা বেগম। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ভাই জনি মিয়া হিমেলের পায়ে জুতা পরিয়ে দেন, ময়লা মুছে দেন। এরপর গাড়িতে তুলে দেন মা ও ভাইকে।