ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মান–অভিমান ও সহমত–দ্বিমত
Published: 21st, June 2025 GMT
‘লন্ডন বৈঠকের’ পর মনে হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় গতি এসেছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে যে কালো মেঘ ঘনীভূত হয়েছিল, তা অনেকটা কেটে গেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
সার্বিকভাবে নির্বাচনী রাজনীতিতে কতটা সুবাতাস এসেছে, সেই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে কিছু না বললেও তলেতলে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার প্রথম তিন দিনের বৈঠকে বেশ কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। দেশবাসী কোনো কোনো দলের মান–অভিমানও প্রত্যক্ষ করল। লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে যে ‘সমঝোতা’ হলো, জামায়াত ও এনসিপি তা ভালোভাবে নেয়নি। তারা বলেছে, এর মাধ্যমে সরকার একটি দলের প্রতি ঝুঁকে গেছে। প্রতিবাদস্বরূপ জামায়াত অভিমান করে প্রথম দিনের বৈঠকে যোগ দেয়নি।
প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে অনুরোধ পাওয়ার পর দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে তারা অংশ নেয় এবং নজিরবিহীনভাবে তিন নেতা বক্তব্য দেন। জামায়াত নেতাদের বেশি সময় দেওয়া ও গণফোরাম নেতার বক্তৃতায় বাধাদানের প্রতিবাদে সম্মেলনকক্ষ থেকে বেরিয়ে যান সিপিবি, ১২–দলীয় জোট ও গণফোরামের নেতারা। কিছুক্ষণ পর অবশ্য তাঁরা ফিরে যান।
এসব মান–অভিমান সত্ত্বেও ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে, যা রাজনৈতিক সমঝোতার পূর্বাভাস বলে ধারণা করি। সংবিধানে জগদ্দল পাথরের মতো যে ৭০ অনুচ্ছেদ চেপে বসেছিল, সেটা সরানো গেছে। সব দল একমত হয়েছে যে অর্থবিল, সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব ও যুদ্ধাবস্থা ছাড়া সব বিষয়ে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে ও ভোট দিতে পারবেন।
৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে সংসদ সদস্যদের হাত–পা ও মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন তাঁরা যেকোনো আইনকে জনস্বার্থবিরোধী মনে করলে বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। এই স্বাধীনতাটুকু অর্জন করতে আমাদের ৫৩ বছর লেগেছে।
তাত্ত্বিকভাবে এই সিদ্ধান্ত ভালো হলেও দলীয় মনোনয়নের বর্তমান ধারা অক্ষুণ্ন থাকলে এর সুফল তেমন পাওয়া যাবে না। এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় কমিটি থেকে আসা তালিকাকে বাধ্যতামূলক করেছিল। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার সেটা তুলে নেয়। তবে স্থানীয় কমিটিও যে সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়, তা–ও নয়। একটি উদাহরণ দিই। বিগত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সেলিনা হায়াৎ আইভীর নাম পাঠায়নি। ওই কমিটি ছিল শামীম ওসমানের নিয়ন্ত্রণে।
প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদ নিয়ে আপত্তি তুলেছে বিএনপি। এটা যদি ভূতাপেক্ষ না হয়, তাদের এই আপত্তির পক্ষে যুক্তি আছে বলে মনে করি না। একজন দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ক্ষমতা ধরে না রেখে সব দলেরই উচিত নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী পদে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করা উচিত ক্ষমতাপ্রত্যাশী সব দলেরই। নেতৃত্ব চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়।এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শামসুল হুদা কমিশনের বিধান ফিরিয়ে আনা গেলে মনোনয়ন–বাণিজ্য কমবে আশা করা যায়। দল না করেও কেউ টাকার জোরে মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে পারবেন না। এ ছাড়া স্থানীয় কমিটির সিদ্ধান্তে মনোনয়ন পেলে সংসদ সদস্যরা নিজ এলাকার জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন। ওপর থেকে মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ওপরের দিকেই তাকিয়ে থাকতেন। এলাকার মানুষের কথা ভাবতেন না।
প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় হলো, তিনি ওই এলাকার বাসিন্দা কি না। আমাদের জনপ্রতিনিধিদের বেশির ভাগই ‘অনাবাসী’। মনোনয়ন পাওয়ার পর অনেকে এলাকায় যান। তার আগে বা পরে এলাকাসীর সঙ্গে বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধির যোগাযোগ ক্ষীণ।
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ বাড়ানোর বিষয়ে দু–একটি ধর্মভিত্তিক দল ছাড়া সবাই একমত হয়েছে; কিন্তু নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বিমত আছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বর্তমান পদ্ধতিতেই নির্বাচন করার পক্ষপাতী। অন্যদিকে জামায়াত, এনসিপি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি সরাসরি ভোটের পক্ষে। উচ্চকক্ষের বিষয়েও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সহমত প্রকাশ করেছে কিন্তু নির্বাচনটি কোন পদ্ধতিতে হবে, তা নিয়ে দ্বিমত আছে।
বিএনপি ও এর সমমনারা চাইছে নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন। এনসিপি, জামায়াত ও বাম দলগুলো মনে করে, ভোটের আনুপাতিক হারে এটা হওয়া উচিত। একসময় বিজয়ী দলই সংরক্ষিত সব নারী আসন পেত। বিএনপি সেই আইন বদলে নারী আসনে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে। সেখান থেকে এখন পিছু হটার যুক্তি কী?
বিতর্ক আছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়েও। সংবিধান সংস্কার কমিশন যে ইলেকটোরাল কলেজের প্রস্তাব করেছে, সেটা কাদের নিয়ে হবে?
বিএনপি বলেছে, নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষের সদস্যদের ভোটে। বিরোধীরা বলেছে, যদি উচ্চকক্ষের নির্বাচন আনুপাতিক ভোটে না হয়, তাহলে সেখানে সংখ্যাগুরু দলেরই একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে। আবার একদিকে তারা স্থানীয় সরকার সংস্থাকে বিরাজনীতিকরণ করতে চাইছে, অন্যদিকে তাদের দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পদে নির্বাচনের কথা বলছে—এটা স্ববিরোধী।
প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদ নিয়ে আপত্তি তুলেছে বিএনপি। এটা যদি ভূতাপেক্ষ না হয়, তাদের এই আপত্তির পক্ষে যুক্তি আছে বলে মনে করি না। একজন দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ক্ষমতা ধরে না রেখে সব দলেরই উচিত নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী পদে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করা উচিত ক্ষমতাপ্রত্যাশী সব দলেরই। নেতৃত্ব চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বা হবে, সেসব ভিত্তি ধরেই এগোতে হবে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য বা সমঝোতা খুব জরুরি।
অনেক বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও তারা আগের অনড় অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের সঙ্গে আমরা আশাবাদী হতে চাই যে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা অবিলম্বে কেটে যাবে এবং জুলাইয়ের মধ্যেই জুলাই সনদ পাওয়া যাবে।
এদিকে লন্ডন বৈঠকের পর নির্বাচন কমিশনও নড়েচড়ে বসেছে। বৃহস্পতিবারের বৈঠকে তারা রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য আচরণবিধি সংশোধন করে খসড়া অনুমোদন করেছে। এতে নির্বাচনী প্রচারে প্রার্থীদের পোস্টার বাদ দেওয়া হলেও বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন সমস্যা তৈরি করল কি না, সেটাও দেখার বিষয়। দলীয় অঙ্গীকারনামা, এক প্ল্যাটফর্মে সব প্রার্থীর ইশতেহার ঘোষণার বিষয়টিও সমর্থনযোগ্য। নির্বাচনী প্রচারসভাও সব প্রার্থী মিলে একসঙ্গে করতে পারেন। এতে প্রার্থীদের খরচ ও পারস্পরিক কাদা–ছোড়াছুড়ি কিছুটা হলেও কমবে।
সংসদ নির্বাচনের আগে সীমানা নির্ধারণের বাধ্যবাধকতা থাকায় ৩০০ আসনের সীমানার খসড়া প্রকাশ করেছে ইসি। এ খসড়া প্রস্তাবের ওপর দাবি-আপত্তি শুনানি শেষে চূড়ান্ত সীমানার গেজেট প্রকাশ করা হয়। এখন পর্যন্ত সংসদের ৭৫টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য ৬০৭টি আবেদন পেয়েছে ইসি।
এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন একটি ভালো নির্বাচন করে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু তারা কিছু মন্দ নজিরও তৈরি করেছে। গ্রামাঞ্চলের আসন কমিয়ে শহরের আসন বাড়িয়ে দেওয়া হয় ২০০৮ সালের নির্বাচনে। কার পরামর্শে তারা এটি করেছিল, জানা নেই। এর ফলে অবহেলিত গ্রামাঞ্চল আরও অবহেলিত থেকে গেছে এবং শহুরে নাগরিকদের সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। রাষ্ট্রটি এখনো সংখ্যালঘু শহুরে নাগরিকদের থেকে গেল। গণমানুষের রাষ্ট্র হলো না।
আশা করি, বর্তমান নির্বাচন কমিশন আসন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলকে গুরুত্ব দেবে। গ্রামাঞ্চল থেকে যেসব আসন কর্তন করা হয়েছিল, সেগুলো ফিরিয়ে দেবে। বৈষম্যবিরোধী সফল আন্দোলনের পর যে নির্বাচন কমিশন এসেছে, তাদের কাছে এটুকু চাওয়া নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]
* মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রস ত ব হয় ছ ল প রক শ ত হয় ছ দ ব মত ক ষমত ব এনপ সরক র আপত ত আসন র দলগ ল
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ ঘোষণায় শুরু হচ্ছে নতুন অধ্যায়
দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন আর আস্থাহীনতার পথ পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে এক সম্ভাবনাময় সন্ধিক্ষণে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর কয়েক মাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল একসঙ্গে চূড়ান্ত করেছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’। এর ওপর ভিত্তি করেই ৫ আগস্ট ঘোষিত হবে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি কেবল একটি রাজনৈতিক দলিল নয়, বরং তা হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার ও সংলাপভিত্তিক ভবিষ্যতের নতুন সূচনা।
আলোচনা ও ঐকমত্যের কাঠামো
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মার্চ ২০২৫ থেকে দুই দফায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসে। প্রথম পর্যায় (২০ মার্চ–১৯ মে): ৩৩টি দলের সঙ্গে পৃথক আলোচনা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায় (২ জুন–৩১ জুলাই): ৩০টি দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন ২৩ দিনব্যাপী ধারাবাহিক বৈঠকে। এ প্রক্রিয়ায় মোট ১৯টি সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কার ইস্যুতে সম্মতির ভিত্তিতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ খসড়া প্রস্তুত হয়।
সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ দফা
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতামতের সুযোগ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর নির্ধারণ,
নির্বাচনকালীন সরকারে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব, উচ্চকক্ষ গঠন ও ইলেক্টোরাল কলেজ চালু, দুদক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও পিএসসির নিয়োগে স্বচ্ছতা, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
আংশিক মতভেদ:
সব দল একযোগে সনদের সব দফা মানছে না। দলভেদে মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপি বলেছে, তারা ১৯টির মধ্যে ১৫টি সংস্কারে একমত, তবে চারটি দফায় তারা সই দেবে না:
১. প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর বা
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) :উচ্চকক্ষে ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিকে অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর বলে মনে করছে।
২. প্রধানমন্ত্রীর দ্বৈত পদ বিলুপ্তি: একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান ও সরকারপ্রধান না থাকার প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করেছে।
৩. দুদক ও পিএসসি নিয়োগে কমিটি গঠন: এটি ক্ষমতার ভারসাম্য ভাঙবে বলে তাদের মত।
৪. তত্ত্বাবধায়ক প্রধান নির্বাচনে র্যাঙ্কড চয়েস: বিএনপি ‘সহজ গঠনমূলক নির্বাচন’ চায়, এই পদ্ধতিকে অকার্যকর বলে মনে করছে।
তবে তারা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনে আংশিক সমর্থন দিয়েছে, বিশেষ করে ‘আস্থা ভোট, নিরাপত্তা ও সংবিধান সংশোধন’ এ দলীয় অবস্থান বজায় রাখার শর্তে।
বাস্তবায়ন ছাড়া সই নয়
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সম্মত হয়েছে বেশিরভাগ সংস্কারে, তবে আইনি ভিত্তি না থাকলে তারা ঘোষণাপত্রে সই দেবে না।
জামায়াত চায় নারী সরাসরি মনোনয়ন বাতিল করে সংসদে ১০০টি নারী আসন বাড়িয়ে প্রোপোরশনাল নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করা হোক।
এনসিপি নারী প্রতিনিধিত্ব ৭% থেকে বাড়িয়ে ১৫% করার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা চায় গণপরিষদ ভিত্তিক সাংবিধানিক সংশোধন কাঠামো। দুই দলই জোর দিয়েছে আইনি রূপ ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ছাড়া সনদ কোনো অর্থ বহন করবে না।
জুলাই ঘোষণাপত্র
সরকার জানিয়েছে, ৫ আগস্ট বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনের মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ চত্বরে এক বিশেষ আয়োজনে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা বলেছেন, ঘোষণাপত্র রাজনৈতিক দলিল হবে, নাকি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসম্পন্ন সাংবিধানিক রেফারেন্স হিসেবে গণ্য হবে।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “এ ঘোষণাপত্রটি যদি কেবল রাজনৈতিক অনুচ্চার প্রতিশ্রুতি হয়, তবে এর সাংবিধানিক গুরুত্ব থাকবে না। আমরা চাই, এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হোক।”
ঘোষণাপত্রে কী আছে
খসড়া ঘোষণাপত্রে মোট ২৬টি দফা রয়েছে।
প্রথম ২১টি দফা: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান, গণআন্দোলনের ঐতিহাসিকতা ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিবরণ
শেষ ৫টি দফা: গুম-খুনের বিচারের অঙ্গীকার, মানবাধিকার রক্ষা, আইনের শাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি
এতে ২০২১–২০২৪ সালের রাজনৈতিক সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বিরোধীদলের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের স্বীকৃতি রাখা হয়েছে।
বিকল্প পথে বাস্তবায়ন: আইন, অধ্যাদেশ, গণভোট?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘোষণাপত্র কার্যকর করতে হলে থাকতে হবে একটি আইনি ভিত্তি। সম্ভাব্য ৩টি পথ:
১. রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ: জরুরি ভিত্তিতে এটি রূপান্তর করা যায়
২. সংসদীয় বিল: আলোচনা শেষে সংসদে প্রস্তাব পাশের মাধ্যমে স্বীকৃতি
৩. গণভোট: জনগণের প্রত্যক্ষ রায়ের মাধ্যমে সাংবিধানিক অনুমোদন
তবে এর কোনটি হবে, এখনো পরিষ্কার নয়। সরকার বা কমিশন এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট ঘোষণা দেয়নি।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতা কাটাতে জুলাই সনদ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে তা বাস্তবায়নে একটি স্পষ্ট রূপরেখা দরকার।”
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “সবার জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্র উন্মুক্ত করতে হবে। যারা বর্তমানে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ, তাদের বিষয়েও ভাবতে হবে। তাহলেই গণতন্ত্র প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী হবে।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “এটি ইতিহাসের এক মোড়লগ্ন মুহূর্ত। আমরা ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে যে সনদ চূড়ান্ত করেছি, তা ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর বাস্তবায়ন কাঠামো নির্ধারণ।”
৫ আগস্টের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তেজনা। এতে থাকবেন ছাত্র আন্দোলনের নেতা, নিহতদের পরিবার, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে এই ঘোষণা কি কেবল অতীত স্মরণে একটি আয়োজিত মুহূর্ত, নাকি বাস্তব রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রথম ধাপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র রাশিদুল হক বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ ও তার ভিত্তিতে প্রস্তুত ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হতে পারে। যতি এটি আইনি কাঠামোতে প্রণীত হয়। সব রাজনৈতিক দল সম্মত হয়ে স্বাক্ষর করে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাস্তব বাস্তবায়ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। অন্যথায়, এই সনদ কেবল ঐতিহাসিক একটি প্রতীক, কিন্তু বাস্তব রাজনৈতিক পরিবর্তনের বাহক হয়ে উঠবে না।”
ঢাকা/এএএম/ইভা