ইরানে ইসরায়েলের আক্রমণের সিদ্ধান্তটি মধ্যপ্রাচ্যে গভীর উত্তেজনা বৃদ্ধির সূচনাবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন এবং আরও অস্থির অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

‘রাইজিং লায়ন’ নামে পরিচালিত ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘাত বাস্তবে রূপ পেল। ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইরান পাল্টা জবাব দিচ্ছে। এ জবাব ইরানের জন্য শুধু প্রত্যাশিতই ছিল না, বরং দেশটির প্রতিরোধ সক্ষমতা ও জাতীয় মর্যাদার জন্য রাজনৈতিকভাবে অপরিহার্য ছিল।

এ পরিস্থিতি এমন এক সহিংস সংঘাতের চক্র তৈরির হুমকি তৈরি করছে, যা দুই দেশকেই দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার মধ্যে আটকে ফেলবে।

আরও পড়ুনআরব দেশগুলো সাহস দেখানোর এই সুযোগ আর পাবে?২০ জুন ২০২৫

ইসরায়েল তাদের হামলার যুক্তি হিসেবে বলছে যে ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংসের জন্য এটি একটি প্রতিরোধমূলক অভিযান। কিন্তু বিশ্লেষকদের এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন করা ইসরায়েলের পক্ষে আদৌ সম্ভব কি না। এর কারণ হলো, ইরান ফর্দোর মতো পারমাণবিক স্থাপনা তৈরি করেছে, যেটা মাটির অনেক গভীরে অবস্থিত। এ ধরনের স্থাপনায় আঘাত করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকা ‘ব্যাংকার–বিধ্বংসী’ প্রযুক্তি প্রয়োজন।

ইসরায়েলের এ আক্রমণ ইরানের পারমাণবিক উচ্চাশাকে থামানোর বদলে উল্টো পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (এনপিটি) থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে আনতে পারে। উত্তর কোরিয়ার পথ অনুসরণ করে ইরানও খোলাখুলিভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে এগিয়ে যেতে পারে।

ইরান এরই মধ্যে তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিকে ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধতায় উন্নীত করেছে। নতুন সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা প্রতিষ্ঠারও ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচির পথে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে।

ইরানের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধকে ইসরায়েল পারমাণবিক হুমকি প্রশমনের যুদ্ধ বললেও এর অন্তর্নিহিত লক্ষ্য হলো, ইসরায়েলের আধিপত্যের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাকাঠামো নতুনভাবে সাজানো। জনরোষ, আরব রাষ্ট্রগুলোর দুর্বল হওয়া ও চরমপন্থীদের উত্থানের বিনিময়ে সেটা ঘটছে।

এ ছাড়া ইসরায়েলের আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চলমান পরমাণু আলোচনা ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। ইসরায়েলে হামলা শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই পরমাণু আলোচনা শুরু হওয়ার কথা ছিল।

ওয়াশিংটন আনুষ্ঠানিকভাবে ইরানে ইসরায়েলি হামলায় নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করলেও তেহরান ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করে যে এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত। ফলে তেহরান যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েলের দোসর হিসেবে গণ্য করতে পারে। ফলে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জটিল করে তুলতে পারে। আবার ইরান যদি মধ্যপ্রাচ্যে থাকা মার্কিন সম্পদের ওপর হামলা চালায়, তাহলে এ যুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনীও সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে।

আরও পড়ুন২৫০০ বছরের পুরোনো দুশমনি: ইসরায়েল কি ‘মরদখাই’? ইরান কি ‘হামান’?১৭ জুন ২০২৫নতুন জোট

উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ, যারা অর্থনীতিকে বহুমুখীকরণ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা চায়, তারা ইরানে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এসব দেশের সরকারগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে যুদ্ধ আরও বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তারা উত্তেজনা প্রশমন ও কূটনৈতিক পথে সমাধানের পক্ষে কথা বলেছে।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে প্রধান ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ছে। এটি ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে নতুন কিন্তু ভঙ্গুর একটি জোটের জন্ম দিতে পারে। সেটা হলে আরব দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন জটিলতা তৈরি হবে। কেননা এসব দেশের জনমত প্রবলভাবে ইসরায়েলি আগ্রাসনবিরোধী।

ইসরায়েলের সামরিক কৌশলের আপাতলক্ষ্য হচ্ছে, ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক নেতৃত্বকে ধ্বংস করে দেওয়া। যদিও ইসরায়েলের আক্রমণের মুখে তেহরান এখনো দৃঢ়তা দেখাতে পারছে, কিন্তু চলমান অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ইরানের আরও বিশৃঙ্খলা বাড়াতে পারে।

অন্যদিকে ইসরায়েলও নানা সংকটে জর্জরিত। গাজায় ৬০০ দিনের বেশি সময় ধরে তারা যুদ্ধ করছে। এতে করে তাদের সামরিক খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের ভেতরে রাজনৈতিক বিভাজন গভীর হচ্ছে। আর সরকারের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত রাজননৈতিক স্বার্থে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার অভিযোগ উঠেছে। এর ফলাফল হলো, ইসরায়েলে হতাশা বাড়ছে। জিম্মি মুক্তি নিয়ে অচলাবস্থা ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসরায়েলের অবস্থান ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে।

আরও পড়ুনকোনো ইহুদিরাষ্ট্র ৮০ বছর টেকে না—যে ভয়ে ভীত ইসরায়েল০৬ নভেম্বর ২০২৩

ছোটখাটো সংঘর্ষে থেমে না থেকে ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত লক্ষ্য হচ্ছে, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক চিত্র বদলে ফেলা, ‘প্রতিরোধের জোটকে’ দুর্বল করা এবং ইসরায়েলি আধিপত্যকে সুদৃঢ় করা। হামাস ও হিজবুল্লাহ দুর্বল হলেও এসব গোষ্ঠী এখনো সক্রিয় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কা প্রবল।

এ যুদ্ধের অর্থনৈতিক অভিঘাতও অনেক বড়। জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। হরমুজ প্রণালির মতো জাহাজ চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ পথে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ার যে আশঙ্কা আছে, তাতে করে গোটা বিশ্বের বাণিজ্য ঝুঁকিতে পড়বে।

ইসরায়েলের ইরান আক্রমণ ও গাজায় গণহত্যা—পুরো আরব বিশ্বে ব্যাপক জনরোষের জন্ম দিয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পক্ষে জনসমর্থন (এমনকি যেসব দেশ আব্রাহাম আকর্ডে স্বাক্ষর করেছে) ব্যাপকভাবে কমে গেছে। উল্লেখ্য যে ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে পশ্চিমা শক্তির ওপর আরব জনসাধারণের আস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।

গত কয়েক মাসে আরব দেশগুলোয় যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা হয়তো অঞ্চলটির কর্তৃত্ববাদী শাসকদের উৎখাত করতে পারবে না। কিন্তু এ আন্দোলন আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। জনগণকে শান্ত রাখতে হলে আরব দেশগুলোকে তাদের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে।

আরও পড়ুনইরানে হামলা ইসরায়েলের জন্য কৌশলগত বিপর্যয় ডেকে আনবে ১৭ জুন ২০২৫

ইরান তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করতে পাল্টা নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এর মধ্যে থাকতে পারে সাইবার আক্রমণ, পশ্চিমা সামরিক ঘাঁটিতে হামলা অথবা সামুদ্রিক বাণিজ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি। এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার বৃত্ত একপর্যায়ে রাশিয়া ও চীনের মতো বড় শক্তিগুলোকেও এ সংঘাতে জড়িয়ে ফেলতে পারে।

তেহরানকে একঘরে করার বা ভেঙে ফেলার যেকোনো প্রচেষ্টা বুমেরাং হতে পারে। ইরান যদি বিভিন্ন জাতিগত বিভাজনের ভিত্তিতে (কুর্দি, আরব, বেলুচ, আজারবাইজানি ইত্যাদি) খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়, তাহলে সেখান পরিস্থিতি গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়া অথবা সালেহ-পরবর্তী ইয়েমেনের মতো হতে পারে। অরাজক পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এমন পরিস্থিতি সেখানে আল-কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বিস্তার ঘটাতে পারে।

গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার ঘটনায় এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ফুঁসছে।

ইসরায়েলি সামরিক অভিযান এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে আরও নাজুক করে তুলেছে। কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ায় এসব রাষ্ট্রে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, তাতে করে অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো শক্তিশালী হয়েছে।

ইরানের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধকে ইসরায়েল পারমাণবিক হুমকি প্রশমনের যুদ্ধ বললেও এর অন্তর্নিহিত লক্ষ্য হলো, ইসরায়েলের আধিপত্যের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাকাঠামো নতুনভাবে সাজানো। জনরোষ, আরব রাষ্ট্রগুলোর দুর্বল হওয়া ও চরমপন্থীদের উত্থানের বিনিময়ে সেটা ঘটছে।

এখন পুরো মধ্যপ্রাচ্য আবারও সামরিকীকরণের পথে হাঁটছে। কূটনীতির ওপর আস্থা ভেঙে পড়ছে, বিভাজন বাড়ছে। এর ফলে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। এর ধাক্কায় উন্নয়ন পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ছে, জোটগুলো ভেঙে যাচ্ছে এবং বড় ধরনের যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

হেশাম গাফার গবেষক ও ইসলামি চিন্তাধারা, আন্দোলন এবং সংঘর্ষ সমাধান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ

মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র পর স থ ত র জন ত ক লক ষ য দ র বল র জন য ক ষমত আশঙ ক ধরন র ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

‘রক্তাক্ত মহাসড়ক’, সাত ঘণ্টায় ৬০ জনকে হত্যা

মহাসড়কের ১ কিলোমিটার অংশ। সেখানে মাত্র সাত ঘণ্টায় হত্যা করা হয় অন্তত ৬০ জন মানুষকে। তাঁদের মধ্যে ৫৬ জন শহীদ হন প্রাণঘাতী গুলিতে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের দিন যাত্রাবাড়ী থানাকেন্দ্রিক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে। সেই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা ও প্রমাণ উঠে এসেছে প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্রে। উল্লেখ্য, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে যাত্রাবাড়ী এলাকায় অন্তত মোট ১১৭ জন শহীদ হয়েছেন বলে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

রক্তাক্ত মহাসড়ক: যাত্রাবাড়ী হত্যাকাণ্ড শিরোনামের এই প্রামাণ্যচিত্র গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করা হয়। দর্শকেরা প্রথম আলোর ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেলে গিয়ে এটি দেখতে পারছেন।

আরও পড়ুনআমার ধারণা, শেখ হাসিনার শেষ দিন ভারতেই কাটবে : আসিফ নজরুল১৮ ঘণ্টা আগেযাত্রাবাড়ী হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রথম আলোর প্রামাণ্যচিত্রটি সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় অনুসন্ধান।ডেভিড বার্গম্যান, সাংবাদিক

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল দুপুরে প্রামাণ্যচিত্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, পলায়নরত, নিরস্ত্র, মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন—এমন মানুষকে যুদ্ধক্ষেত্রেও হত্যা করা যায় না। পৃথিবীর যেকোনো আইনে এটা যুদ্ধাপরাধ। কিন্তু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে দেখা গেছে, পালিয়ে যাচ্ছেন, এমন মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর একজন মানুষ হাতজোড় করছেন, তাঁকে কাছে থেকে গুলি করা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, পুলিশকে যিনি এ রকম একটা অমানুষ, বেপরোয়া, ভয়াবহ বাহিনীতে রূপান্তর করেছেন, তিনি কত বড় অমানুষ?

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে নির্বিচারে মানুষ হত্যার অসংখ্য ফুটেজ (ভিডিও) আছে বলে উল্লেখ করেন আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি শেখ হাসিনার স্ট্যান্ডার্ডে (মান) বিচার করতাম, তাহলে এই বিচার চার থেকে পাঁচ মাসে হয়ে যেত। আমরা সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক, জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য, ২০ বছর, ৩০ বছর পরও যেন বিচার নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে, সে জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে এবং আইন সংশোধন করে বিচার করছি।’

জুলাই হত্যাযজ্ঞের দায়ে শেখ হাসিনার বিচার শেষ হলেও তাঁকে হয়তো দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না বলে ধারণা করেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, তাঁর শেষ দিন ভারতেই কাটবে।’

৩৫ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র

প্রথম আলোর প্রামাণ্যচিত্রটি প্রায় ৩৫ মিনিটের। তবে এটি তৈরি করতে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে পাঁচ মাস ধরে। শত শত ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড ধরে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড যেখানে হয়েছে, সেখানে একই সময়ে ধারণ করা বিভিন্ন ফুটেজ ফ্রেম ধরে এবং গুলির শব্দ শুনে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। এভাবে কয়েকটি ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোনো সুনির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ চিত্র দাঁড় করানো হয়েছে। এমনকি কোন ভবন থেকে গুলি করে মানুষ মারা হয়েছে, বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা বের করা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে বিশেষজ্ঞের মতামত।

প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরিতে ভিডিও ধারণকারী ব্যক্তির পাশাপাশি আন্দোলনে যুক্ত অন্তত ৫০ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে শুধু ঘটনা বোঝার জন্য। এর বাইরে সেদিন শহীদ হওয়া ৬০ জনের প্রত্যেকের পরিবারে সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নিহত ব্যক্তিদের ঘটনাস্থলের ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান, মৃত্যুসনদ বিশ্লেষণ করে তাঁর মৃত্যুর কারণ খোঁজা হয়েছে।

প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরি করেছে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ কনটেন্ট ক্রিয়েটর আব্দুল্লাহ আল হোসাইনের নেতৃত্বাধীন একটি দল।

আরও পড়ুনযাত্রাবাড়ী হত্যাযজ্ঞের নির্মম চিত্র২১ ঘণ্টা আগে‘একটি প্রশংসনীয় অনুসন্ধান’

প্রদর্শনী শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেন, যাত্রাবাড়ী হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রথম আলোর প্রামাণ্যচিত্রটি সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় অনুসন্ধান। একটি গল্প কীভাবে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, এটি এমনই একটি অনুসন্ধান।

প্রামাণ্যচিত্রের একটি অংশ দেখা গেছে, কপালে পতাকা বেঁধে ঘুরছেন—এমন একজনের কপালে গুলি করা হয়েছে। সেই কথা উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা তাঁর বক্তব্যে বলেন, এমন দৃশ্য দেখার পর কোনো কথা বের হয় না। এর চেয়ে ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে!

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা, গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ, শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী সঞ্জীব দ্রং, সাইটসেভার্সের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন কো-অর্ডিনেটর খোন্দকার সোহেল রানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তারিক মনজুর, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক কল্লোল মোস্তফা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের হেড অব কমিউনিকেশনস আবদুল কাইয়ুম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানসহ জ্যেষ্ঠ কর্মীরা।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় প্রথম আলোর ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, তখন তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। যখন সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল, এসব তথ্য প্রকাশে বাধা দেওয়া হচ্ছিল। প্রথম আলো সাহসিকতার সঙ্গে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে মৃত্যুর হিসাব রেখেছে। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন উৎস থেকে মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর প্রথম আলো তা প্রকাশ করেছে। প্রথম আলোর চেষ্টা ছিল সঠিক তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরও প্রথম আলো নানা উদ্যোগ নিয়ে মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে।

আরও পড়ুন৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশি হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ চিত্র উঠে এল বিবিসির অনুসন্ধানে০৯ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ