এভারেস্টজয়ী প্রয়াত বন্ধু সজল খালেদ স্মরণে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প অভিযান করেছেন লেখক ও গবেষক গাজী মুনছুর আজিজ। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই সবুজ বিশ্ব গড়তে চাই’ স্লোগান নিয়ে তিনি এ অভিযান সম্পন্ন করেন। ১৩ জুন বিকেল পৌনে ৩টায় তিনি বেস ক্যাম্প পৌঁছান। এর আগে ৬ জুন সকালে নেপালের লুকলা থেকে বেস ক্যাম্পের উদ্দেশে ট্র্যাকিং শুরু করেন। অষ্টম দিনের মাথায় তিনি পৌঁছান পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে (৫,৩৬৪ মিটার)।
গাজী মুনছুর আজিজ বলেন, ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে যারা এ অভিযানে সম্পৃক্ত হয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। বিশেষ ধন্যবাদ বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলাদেশে পর্বতারোহণের স্বপ্নদ্রষ্টা ইনাম আল হকের প্রতি এবং বিএমটিসি ক্লাবের সবার প্রতি। এ ছাড়া ধন্যবাদ অল্টিচিউড হান্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিক আহমেদ তমালের প্রতি। তাঁর সার্বিক সহযোগিতায় এ অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন করি।
গাজী মুনছুর আজিজ বলেন, আমরা একটি যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী দেখতে চাই, যেখানে বোমার আঘাতে একটি শিশুও মারা যাবে না। এ ছাড়া একটি দূষণমুক্ত বিশ্ব গড়তে চাই, যেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাঁচবে নির্মল আনন্দে। এসব বার্তা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে বেছে নিয়েছি।
আজিজ আরও বলেন, ২০১৩ সালের ২০ মে এভারেস্ট জয় করে নামার পথে সজল মারা যান। এখন বাংলাদেশের অনেকেই এভারেস্ট জয় করেছেন, সবাই তাদের গল্প শুনছেন। আমি মনে করি তাদের সঙ্গে সজলের গল্পটাও মানুষ জানুক। সেজন্যই তাঁকে স্মরণ করে আমার এ অভিযান। এ ছাড়া ২০০৭ সালে ইনাম আল হকের পরিকল্পনায় এবং সজলের উদ্যোগে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে দেশে প্রথম বারের মতো বাংলা ম্যারাথন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০০৯ ও ২০১০ সালেও সজলের উদ্যোগে ম্যারাথন হয়। সজল মারা যাওয়ার পর আর বাংলা ম্যারাথন হয়নি। এরপর সজলকে স্মরণ করে ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর মেরিন ড্রাইভে আমি একক ম্যারাথন করে আসছি। এখন বাংলাদেশে প্রচুর ম্যারাথন প্রতিযোগিতা হচ্ছে। আমি মনে করি ম্যারাথনের শুরুর গল্পটাও মানুষ জানুক।
সজল চেয়েছেন ম্যারাথনের মাধ্যমে কক্সবাজারসহ বাংলাদেশের পর্যটনকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে তোলা এবং একই সঙ্গে পরিবেশ
সচেতনতার বার্তা দেওয়া।
লেখক ও গবেষক গাজী মুনছুর আজিজ বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাব এবং বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য। ভ্রমণ বিষয়ে তাঁর বেশ ক’টি বই বের হয়েছে। গত একুশে বইমেলায় বের হয়েছে তাঁর ভ্রমণবিষয়ক বই ‘পাখির খোঁজে বাংলাজুড়ে’। বিভিন্ন ম্যারাথন প্রতিযোগিতা, সাইকেল অভিযানসহ নিয়মিত ভ্রমণ ও অভিযানে বের হন। এ ছাড়া পরিবেশ সচেতনতায় গাছ লাগানোসহ নিয়মিত বিভিন্ন কার্যক্রম করে থাকেন। u
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
দমার চরের বিরল পানিকাটা
ভোলার দমার চর ও সেখানকার বিচিত্র চঞ্চুর পাখিটি দেখার ইচ্ছা বহুদিনের। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও সঙ্গীর অভাবে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ ৬ জানুয়ারি ২০১৬-এ হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের একটি সুযোগ এল। কিন্তু পাখি দেখার ভ্রমণ না হওয়ায় ক্যামেরা নিলাম ঠিকই, তবে পাখির ছবি তোলার উপযোগী কোনো লেন্স নিলাম না সঙ্গে। সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে এমভি ফারহান-৪ লঞ্চে হাতিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে ৭ জানুয়ারি নিঝুম দ্বীপ পৌঁছালাম।
রাতের খাবার শেষে টিম লিডার সাইফুর রহমান সজীব ঘোষণা দিলেন, ‘আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে।’ আমি বললাম, ‘কী সারপ্রাইজ?’ ‘নৌকা ঠিক করেছি, কাল আমরা দমার চর যাব।’ শুনে প্রথমে খুশি হলেও পরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। হায় রে! সেই তো দমার চর যাচ্ছি, কিন্তু লেন্স কোথায়? কীভাবে ছবি তুলব? তবে মন খারাপের বিষয়টা কাউকে বুঝতে দিলাম না।
পরদিন সকাল সকাল নৌকা ছাড়ার কথা থাকলেও পৌনে ১০টার আগে রওনা দিতে পারলাম না। যাত্রার শুরুতেই একঝাঁক কালো লেজ জৌরালি ও একটি লাল পা পিউ দেখলাম। এরপর পর্যায়ক্রমে লালশির, যাঠুয়া বক, বড় গুলিন্দা, ছোট গোতরা, খোয়াজ, বদরকৈতর, ছোট টিটি জিরিয়া দেখতে দেখতে দুঘণ্টা পর দমার চরে পৌঁছালাম। কিন্তু কাদাপানির কারণে চরে নামার কোনো চেষ্টাই করলাম না। চরের সামনে এসে প্রথমেই চোখে পড়ল ছোট ও বড় গুলিন্দার ঝাঁক। এরপর এক জোড়া খোয়াজ, একঝাঁক কাস্তেচরা ও শেষে সৈকত পাখির এক বিশাল মিশ্র ঝাঁক। কিন্তু দমার চরের সেই বিচিত্র চঞ্চুর পাখিদের তো দেখছি না?
এমন সময় কোত্থেকে হঠাৎ শ তিনেক পাখির বিশাল একটি ঝাঁক উড়ে এল। ঝাঁকের পাখিদের ওড়া দেখেই বুঝলাম ওরা কারা। কিন্তু ঢাল-তলোয়ার ছাড়া কি আর যুদ্ধ করা যায়? কাজেই যা হওয়ার তা–ই হলো। সাক্ষী ছবি ছাড়া আর কিছুই তুলতে পারলাম না। এরপর বেশ কয়েকবার রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ওদের দেখা গেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে তো ওরা প্রজননও করেছিল। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সে সময় যেতে পারিনি।
ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সরদার হয়ে যে পাখির ছবি তুললাম সে আর কেউ নয়, এ দেশের বিরল ও মহাবিপন্ন আবাসিক পাখি পানিকাটা। অবশ্য বেশসংখ্যক পাখি বরিশাল, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের উপকূলে শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। থেলাজাল, জলখোর, পানিচরা বা গাঙচষা নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ান স্কিমার। ল্যারিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Rynchops albicollis। বিশ্বব্যাপী শঙ্কাগ্রস্ত পাখিটিকে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশে দেখা যায়।
প্রাপ্তবয়স্ক পানিকাটা লম্বায় ৩৮ থেকে ৪৩ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৩৫০ গ্রাম। প্রজননকালীন পাখির মাথা, ঘাড়ের পেছনটা, কাঁধ, ডানা ও লেজ কালো এবং পিঠ কালচে-বাদামি। কপাল, গলাবন্ধ, ডানার মধ্য পালকের আগা, দেহতল ও ডানার পালকতল সাদা। চোখের রং বাদামি। বৈচিত্র্যপূর্ণ কমলা-লাল চঞ্চুর গোড়া আলতা লাল ও আগা হলদে। নিচের চঞ্চু ওপরেরটি থেকে অনেক লম্বা। খাটো পা ও পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। প্রজননহীন পাখির পিঠ অনুজ্জ্বল ও তুলনামূলকভাবে বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রী খানিকটা ছোট।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়