‘উৎসব’ চলচ্চিত্রের স্ব-ঐতিহ্যে ফিরে আসার টার্নিং পয়েন্ট
Published: 23rd, June 2025 GMT
সমকালীন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে ‘উৎসব’ একটি বিস্ময়কর চ্যালেঞ্জ। যে বিস্ময়টি শুরু হয় চলচ্চিত্রটির প্রচারের প্রাথমিক উপকরণ পোস্টার থেকে। যেখানে লেখা আছে ‘পরিবার ছাড়া দেখা নিষেধ’।
৮০ এবং ৯০ দশকের প্রথমভাগে যাদের শৈশব-কৈশোর এবং যৌবন কেটেছে, রেডিও থেকে বিনাতারে ভেসে আসা নাজমুল হোসাইনের কণ্ঠ শুনতাম। তখন অবশ্য তার নাম আমরা জানতাম না, অথচ সেই কণ্ঠই তৈরি করে দিতো আমাদের স্বাপ্নিক কল্পনার রঙীন ভুবন। যেখানে খুব বলিষ্ঠতায় পুন পুন বলা হতো, সপরিবারে দেখার মতো ছায়াছবি.
বিলাসী কিংবা বিনোদনময় আনন্দের সবচেয়ে বড় মাধ্যমটি ছিলো তখন চলচ্চিত্র, সাধারণে কথিত ‘বই’ কিংবা ‘ছায়াছবি’। প্রতিটি শহরে একটি-দু’টি হল ছিলো। ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত নতুন ছবি ছিলো। টিকেটের কালোবাজারি ছিলো। আনন্দ কিংবা উদযাপনের একমাত্র বিলাসবহুল যাত্রা ছিলো সিনেমা হলমুখী। বাড়িতে নতুন জামাই এসেছে কিংবা বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের উপলক্ষ। দল বেঁধে হলে চলো সিনেমা হল।
তখনও আমাদের সিনেমার নাম ‘মুভি’ হয়নি। প্রেমিক প্রেমিকা তখনও বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড হয়নি। নতুন বর বউ ‘মুভি’ দেখতে যাবে সাথে আত্মীয় পরিজনের বিশাল বহর আবশ্যিক। ছবি দেখার এও এক আবশ্যিক অনুষঙ্গ। সপরিবারে না দেখা গেলে এই আনন্দের পূর্ণতা নেই।
মাঝপথে পথ হারিয়ে ফেলা কিংবা চোরাগলিতে পথ হারিয়ে ফেলা আমাদের সিনেমা শিল্পে ঢুকে গেলো পোশাকী বিশেষণ। কাটপিস, মুম্বাইয়ের ব্যর্থ অনুকরণে আইটেম সংয়ের দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গি। শ্লীল-অশ্লীল এর আপেক্ষিক ব্যাখ্যা অতিক্রম করে সিনেমা টিমটিমে হয়ে টিকে থাকলো নিম্নরুচির মানুষের বিনোদনের খোরাক হয়ে। তারপর আকাশ সংস্কৃতি আর ডিজিটাল দুনিয়া উন্মুক্ত হয়ে গেলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের একরকম করুণ মৃত্যু ঘটলো। একের পর এক বন্ধ হতে থাকলো হল, দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিলো।
বড় বড় শহরগুলোতে, শপিং মলে সিনেপ্লেক্সে চলচ্চিত্র কিছুটা এলিট হয়ে উঠার চেষ্টা করছে বটে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের কয়েকটি সিনেমা দেখে বড়ই হতাশাগ্রস্ত হয়েছি। নির্মাণের প্রযুক্তিগত দিক কিংবা চলচ্চিত্রের ব্যাকরণে অজ্ঞ হলেও নিতান্ত সাধারণ দর্শক হিসেবেই সেসব ছবির নানাবিধ দুর্বলতা আর অসারতা চিহ্নিত করতে পারতাম। আর উপলব্ধি করতাম নির্মমতম সত্য এসব ছবি দিয়ে দর্শককে হলে ফেরানো তো সম্ভব নয়ই, আর সপরিবারে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার যে নস্টালজিক ঐতিহ্য তার প্রত্যাবর্তন তো কল্পনাতীত।
‘উৎসব’ প্রচারণার ঘোষণাতেই সেই নস্টালজিক অতীতের চ্যালেঞ্জে নিয়ে যায় আমাদের। সিনেপ্লেক্সের বাইরে লম্বা লাইন দ্বিতীয়বারের মতো চমকে দেবে আপনাকে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে নানা বয়সী দর্শকের উপচে পড়া ভিড়। অনলাইনে টিকেটের ক্রাইসিস। প্রতিটি শো হাউসফুল। ভাবা অবান্তর নয় যে চাইলেই সিনেমার অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা বাস্তবিকই অসম্ভব নয়।
সিনেমায় আসি। চার্লস ডিকেন্সের ক্রিসমাস ক্যারোলের অনুপ্রেরণায় এর গল্প। কিন্তু কোথায় ক্যারোল, কোথায় ডিকেন্স? বহিরাঙ্গে খাইস্টা (কৃপণ অর্থে, খাইস্টা শব্দের যথার্থ ব্যবহার) জাহাঙ্গীর এর চরিত্র, আর তিন ভূতের পরপর আগমনের যোগসূত্র ছাড়া পুরো সিনেমাটি একদম আমাদের ঘরের সিনেমা। আমাদের দেশীয় সংগীত, নব্বই দশকের জীবন আর প্রেম আর সংকট এমনকি ‘উৎসব’র ক্যারোলে আমাদের নজরুলের সেই বিখ্যাত গান-ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে...।
চাঁন রাতে, টিভিতে যখন ঘোষণা আসতো জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির বরাতে- একমাত্র ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিটিভিতে বেজে উঠতো-ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে...ঈদ আনন্দ হাজারটা রঙিন ফানুস উড়িয়ে শুরু হতো ঠিক তক্ষুনি।
সেই কালে আমরা যারা সিনেমা দেখতে পারতাম না, আকুল হয়ে বসে থাকতাম দেখনেওয়ালাদের কাছে গল্পের কাহিনীটা শুনবো বলে। সিনেমার কাহিনী শোনাও অর্ধেক সিনেমা দেখার মতোই আনন্দময়।
কিন্তু সে যুগ হয়েছে বাসি। শাবানার ফ্যাঁচফ্যাঁচ কান্না, যা এখন আমাদের ট্রলের বিষয়। একদা কী মনোযোগেই না সেই সেলাই মেশিন আর জসিমের ঠেলা গাড়ি চালনার গল্প শুনে কাঁদতাম।
‘উৎসব’ দেখে আপনি কাঁদবেন, নিশ্চিত কাঁদবেন কিন্তু কারো মুখে গল্প শুনে তা মোটেই পারবেন না। কারণ, ঐ যে খাইস্টা জাহাঙ্গীরের ঔরসজাত কন্যা যখন কফির বিল দিতে গিয়ে বলবে- কী দুই কাপ কফির এতো দাম! খাইস্টা জাহাঙ্গীর, যে কিনা এতোদিন জানতোই না তার আত্মজা বড় হচ্ছে অন্যের ঘরে। সে তখন ডিএনএ টেস্ট ছাড়াই নিশ্চিত হবে এ নিশ্চয়ই তারই মেয়ে। আর নিশ্চিত হওয়ার পর সে যে হাসিটা দেবে হলভর্তি দর্শক তাতে সংক্রামিত হবে আর হো হো হেসে উঠবে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন মেয়ের হাত ধরে আকুল আকুতি জানাবে একবেলা খাওয়ার জন্য, পিতৃত্বের আক্ষেপে পার্থিব সকল সম্পদ দিয়ে দিতে চাইবে মেয়ের নামে।
খাইস্টা জাহাঙ্গীরের ভূমিকায় অভিনয়রত জাহিদ হাসানের যে অকৃত্রিম অভিনয় একজন গল্পকথকের সাধ্য কি এই এক্সপ্রেসন মুখের ভাষায় ব্যাখ্যা করে! যা কিনা মুহূর্তে হো হো হাসি থেকে হু হু কান্নায় রূপান্তরিত হয়। প্রতিটি চরিত্র এমন একাত্ম হয়েছেন, এমনকি তিন সেলিব্রিটি ভূত সেই সেলিব্রিটিদেরই সবলতা দুর্বলতা বলতে গিয়ে কখন যে অভিনীত বিগত চরিত্রগুলোকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে নিজ নিজ ভূমিকা নিয়েছেন তা দর্শক টেরই পায়নি। চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান অপি করিম তিনজনই অভিনয় বাদ দিয়ে অভিনয় করছেন অবলীলায়। আর প্রটাগনিস্ট এর তারুণ্যে সৌম্য কী পোশাকে, চুলের কাটিং আর ভীরু ভীরু প্রেমিকের চাহনিতে নিজের সময় ডিঙিয়ে নিজেকে অতীতে প্রতিস্থাপনের পরীক্ষায় একশো তে একশো পেয়ে দর্শককে জয় করেছেন। আর মূল চরিত্রে জাহিদ হাসান প্রচুর হিউমারাস দৃশ্য আর ডায়লগে নিজেকে সংযত আর ন্যাচারাল রাখার চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করেছেন নিজের শক্তিমত্তায়।
‘আজ রবিবার’ নাটকের সেই নাকি নাকি ‘তিতলি ভাইয়া, কঙ্কা ভাইয়া’ বলা হাস্যকর চরিত্রাভিনয়ের বৃত্ত ভেঙে নিজের সেরাটুকুই দিয়েছেন হয়তোবা।
‘উৎসব’ নব্বই দশকের গল্প বলে বটে, কিন্তু নব্বই দশকের মতো এ সিনেমার গল্প অন্যের কাছে শুনলে মোটেই চলবে না। দেখতে হবে হলে গিয়েই। হলে গিয়ে দেখার মতো এর ঘটনা পরম্পরা, নির্মাণ শৈলী। চার্লস ডিকেন্স থেকে নিয়েও যা কিনা আর চার্লস ডিকেন্সের থাকেনা। একেবারে আমাদের গল্প হয়ে উঠে।
যে গল্পের চরিত্র এবং ঘটনাগুলো আমাদের খুব চেনা বোধ হয়। আমাদের চারপাশে তারা ছিলো তাদের সকল ঘটনা নিয়ে,আমরা যারা চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ অতিক্রম করেছি। ঠিক এমন মোবারকের মতো মামাতো ভাই। রাজের মতো ভাগ্নে। ভিডিও ক্যাসেটের দোকান। ভাড়া দেয়া ক্যাসেট ফেরত দিতে একদিন দেরি হলে একটাকা জরিমানা। একসাথে সাইকেল শেখা। সিনেমা হলে সিটি বাজিয়ে সিনেমা দেখা। ওয়ার্ল্ড কাপের দিনে বাড়িতে রঙিন টিভি আসা। ভুল করে জেসমিনকে ভুল ক্যাসেট দেওয়া। বাবার কাছে মিথ্যা বলে বন্ধুর বাড়ি ভাড়া করা ক্যাসেটে ছবি দেখা। কী অমূল্য দিন ছিলো আমাদের। আনন্দগুলো কতো সহজে আসতো আর গভীর রেখাপাত করে রেখে যেতো যাপনের একঘেয়েমিতে।
আমরা সেসব স্মৃতি ভুলতে বসেছিলাম। পরিচালক তানিম নূর মনে করিয়ে দিলেন- কী অনায়াসে, কী যত্নে স্পর্শ করলেন আমাদের ঘুমিয়ে পড়া অতীতের স্মৃতি। আচ্ছা তানিম নূর সেই একদিন দেরি হলে এক টাকা ফাইনের ঘটনাটি কার কাছ থেকে জেনেছিলেন? সেলুলয়েডের পর্দায় এই একটি হীরক খণ্ডের মতো জ্বলজ্বলে দশক দেখে কী ভাবছে তরুণ প্রজন্ম?
এরা কি ভাবতে পারে, হারাবার ভয় থেকে কোনো স্বামী-স্ত্রীর ভার্সিটি পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড লুকিয়ে রাখার অধিকার খাটাতে পারে? অথচ এটাকে সে অপরাধ তো ভাবেই না বরং স্ত্রীকে উপদেশ দেয়, ডানা থাকলেই উড়তে হয়না!
হলের অর্ধেক ছিলো নতুন প্রজন্ম। সিনেমা শেষ করে যাবার সময় আমি এদের চোখেমুখে বিস্ময় পাঠ করেছি। আমরা যে কথায় কথায় আমাদের সময় আমাদের সময় বলি, ঈদের নাটক আর আনন্দমেলার কথা বলি, পাক্ষিক ‘নক্ষত্রের রাত’ আর ‘বহুব্রীহি’র জন্য অপেক্ষার উন্মত্ততার কথা বলি, হাতে হাতে অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস নিয়ে ঘোরা প্রজন্ম, এক মিনিট রিলস দেখা প্রজন্ম- বেশ উন্নাসিকতায় তাকায় আমাদের দিকে।
হ্যাঁ, পাক্কা দুই ঘণ্টা তারা হলে বসেছিলো, এক মিনিট যাদের ধৈর্যের আয়ু তারা কেউ উঠে যায়নি। বোধ করি, তারা এই সিনেমা দেখে টের পেয়েছে নব্বই দশকের আত্মিক শক্তিটা কী। খুন জখম নেই, রক্তপাত নেই, আইটেম সং নেই, তামিল তেলেগুর অন্ধ অনুকরণ নেই, থ্রিল নেই। তবু দর্শক তা সে যে বয়সেরই হোক, তরুণ থেকে বৃদ্ধ, শিশু থেকে প্রৌঢ় কেউ উঠে যেতে পারছেন না। পারেননি।
এই সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জটি ছিলো এর সংলাপ। সবার থেকে একটু একটু জীবন নিয়ে বাঁচা কিংবা জীবনের সালমান শাহ হতে গিয়ে আহমেদ শরীফ হয়ে যাওয়া, উড়তে হলে একটা খোলা আকাশও লাগে, মাফ চাওয়ারও একটা এক্সপায়ার ডেইট থাকে- ইত্যাদি কয়টা মনে রাখা যায় এক বসায়? আর মনে রেখে সব বলেই যদি দেই, দর্শক হলে গিয়ে দেখবেন কি? কথায় কথায় হাসাবার, কাঁদাবার মতো এমন সংলাপ, ফাঁক ফোঁকরে সমকালীন হাওয়া সিনেমা, বৃন্দাবন দাসের হাড় কিপটে নাটক কিংবা জয়া আহসান কাঁদলে হাঁপানির রোগীর মত লাগে ইত্যাদি প্রসংগ সংলাপে এমন মসৃণ করে গুঁজে দেওয়া যা কোনোভাবেই আরোপিত মনে হয়না।
হলে গিয়েই দেখুন দর্শক। দেখুন দর্শককে হলে ফেরাতে ‘উৎসব’ এর মতো ছবি কতটা ভূমিকা রাখতে পারে। ছবি দেখতে দেখতে আপনারও মনে হবে, আরে আমিই তো একজন জাহাঙ্গীর, তার চরিত্র বা জীবনের সবটুকু না হোক মতো ছোট খাটো আফসোস তো আমারও।
কোন ঘটনাটা হতে পারতো জাহাঙ্গীরের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট! জেসমিনকে ঢাকায় পড়তে যেতে দেওয়া, ঠিকসময় রেলস্টেশনে পৌঁছানো...কোনটা। আমাদের মধ্যবিত্ত মানসিকতা আমাদের সব আফসোস নিয়ে যেনো হলেই ভাবতে বসি, আসলেই তো কোনটা হতে পারতো আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট!
এই যে নিজেকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার অসাধারণ কাজটি ‘উৎসব’ করে নিপুণ নির্মাণ দক্ষতায়। আমরা টেরও পাইনা কখন জীবনের কৃত সব অপরাধগুলোর মুখোমুখি আমাদেরও অনুশোচনা জাগিয়ে দেয়।
তানিম নূরের নির্মাণ কুশলতা এতোটাই সুক্ষ্ম যে ‘উৎসব’র কেন্দ্রীয় চরিত্র যে জাহাঙ্গীর তার খাইস্টা চরিত্রের উত্তরণের জন্য যে ভূতগুলোর সাথে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ পরিভ্রমণ করে, তার একটা পটভূমি সে তৈরি করে শুরু থেকেই। দর্শক হয়তো ভাববেন- এই জাহাঙ্গীর ওয়াশ রুম থেকে, খাবার টেবিলে সবসময় মোবাইলে নাটক দেখে কেন?
চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান কিংবা অপি করিমকে ভূত হিসাবে আবির্ভাব ঘটানোর একটা প্রেক্ষিত তৈরি করেন পরিচালক। ঠিক যখন তৃতীয় ভূত অপি করিম জাহাঙ্গীরকে নিয়ে জেসমিনের বাসার সামনে দাঁড়ায়, দৃশ্যের বাইরে এক নারীকণ্ঠ বিদায় সম্ভাষণ জানায়। খুব মনোযোগ দাবি করে তানিম নূরের এই সুক্ষাতিসুক্ষ্ম নির্মাণ।
‘উৎসব’ আসলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের স্ব-ঐতিহ্যে ফিরে আসার টার্নিং পয়েন্ট। একটা এসিড টেস্ট বলা যায়। শিল্পের নবরসের মধ্যে কেবল বীভৎস রসে হারিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্র শিল্প যে আবার মধ্যবিত্তের বিনোদনে নতুন মাত্রা নিয়ে আবির্ভূত হতে পারে সেই বার্তা পৌঁছে দিলেন পরিচালক দর্শক আর বোদ্ধা সকাশে। চলচ্চিত্রের অভিনয় থেকে ব্যাক স্টেইজ সবাই সবার সেরাটুকু দিয়ে এই টিম ওয়ার্কটিকে শক্তপোক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। যে চলচ্চিত্র সপরিবারে দেখা যায়, দর্শক হলমুখী হয়, মুঠোফোনের বিনোদন থেকে মানুষ বিনোদন উদযাপন করতে হলে যায়, আনন্দ বেদনার মিশ্রণে, অশুভ বোধের বিপরীতে এক শুভ বোধের উন্মেষে উদ্বোধিত হয়ে ঘরে ফিরে।
দেখা যাক এরপর আমাদের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা কোন পথ বেছে নেন, কীভাবে এই সম্ভাবনা কাজে লাগান। তানিম নূর এক গুরু দায়িত্ব চাপিয়েছেন জাতির কাঁধে।
ঢাকা/টিপু
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর চলচ চ ত র র য় আম দ র আম দ র স র চর ত র প রজন ম সপর ব র ন র এক র গল প জ বন র পর ব র র সময় আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
নারায়ণগঞ্জে রঙতুলির আঁচড়ে সেজে উঠছে দেবী দুর্গা,
আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা, তারপরই শুরু হবে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। পূজাকে কেন্দ্র করে সারাদেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও চলছে সাজসজ্জা আর প্রস্তুতির ব্যস্ততা।
প্রতিটি মণ্ডপে এখন বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ, কোথাও রঙতুলির ছোঁয়ায় রাঙানো হচ্ছে প্রতিমা, কোথাও চলছে আলোকসজ্জা ও প্যান্ডেল সাজানোর শেষ মুহূর্তের কাজ। একদিকে শিল্পীরা দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমা নির্মাণে, অন্যদিকে আয়োজকরা তৎপর নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজে।
আগামী রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হবে দেবী দুর্গাকে বরণ করার আনুষ্ঠানিকতা। পরবর্তী দিনগুলোতে একে একে অনুষ্ঠিত হবে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও মহা-নবমীর পূজা।
আর বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে এই মহা উৎসব। আনন্দ, ভক্তি আর মিলনমেলার আবহে বাঙালি হিন্দু সমাজে দুর্গাপূজা ইতোমধ্যেই বয়ে এনেছে উৎসবের রঙিন বার্তা।
সরজমিনে শহরের দেওভোগ আখড়া, পালপাড়া, উকিলপাড়া, সাহাপাড়া, আমলাপাড়া, নয়ামাটি, নিতাইগঞ্জের বলদেব জিউর আখড়া মন্দির, সাহাপাড়া মন্ডপে, মীনাবাজার গোপীনাথ জিউর আখড়া মন্দির, বঙ্গবিহারী, গলাচিপা মন্দির পূজামণ্ডপে ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে জোরেসোরে।
শেষ মুহুর্তে প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ স্থানে প্রতিমা তৈরির কাজ প্রায় ৯০ ভাগ শেষ হয়েছে। চলছে রঙতুলির আঁচড়।
এদিকে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। শারদীয় দুর্গাপূজাকে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে নারায়ণগঞ্জ পূজা উদযাপন পরিষদ এবং মন্দির কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন আনসার,পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা।
প্রতিমা শিল্পীরা বলেন, আর বেশি দিন বাকি নেই পূজার, আমরা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি। প্রতিমাগুলো নতুন করে রং ও তুলির আঁচড় দিয়ে সাজিয়ে তুলছি। পূর্বে সম্পূর্ণ প্রতিমা তৈরি করা থেকে সাজানো পর্যন্ত খরচ হত ৭০/৮০ হাজার টাকা। এখন সংশ্লিষ্ঠ মালামালের দাম বৃদ্ধি,শিল্পীদের পারিশ্রমিক বাড়ার কারণে খরচ প্রায় দিগুণ।
তবুও এই কাজ আমাদের করতেই হবে কারণ এটা আমাদের ধর্মীয় রীতিনীতি। শেষ মুহূর্তে দেবীকে পড়ানো হবে পোশাক-পরিচ্ছদসহ অন্যান্য আল্পনা।
নারায়ণগঞ্জ জেলাজুড়ে এবছর ২২৪টি মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হবে দুর্গা উৎসব। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৭৯টি, বন্দরে ২৯টি, সোনারগাঁয়ে ৩৫টি, আড়াইহাজারে ৩৭টি এবং রূপগঞ্জে ৪৪টি মণ্ডপ প্রস্তুত করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জ প্রশাসনের পক্ষে থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। শারদীয় দুর্গাপূজাকে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে নারায়ণগঞ্জ পূজা উদযাপন পরিষদ সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে ও পুলিশ প্রশাসন।
প্রশাসনের নজরদারির বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শিখণ সরকার শিপন বলেন, ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মহোদয় থেকে শুরু করে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি আমাদের শহরের বিভিন্ন মণ্ডপ পরিদর্শন করেছেন, তাঁরা সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, পুলিশ, র্যাব, কমিশনার,সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে সবার সাথে আমাদের ইতোমধ্যে বৈঠক হয়েছে, ওনারা আমাদের মণ্ডপগুলোর সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। এছাড়া যেকোনো ধরণের নাশকতা মোকাবেলায় আমাদের নিজস্ব সেচ্ছাসেবক দল প্রত্যেক মণ্ডপে নিয়োজিত থাকবে।
তিনি আরও বলেন, দুর্গাপূজা শারদীয় উৎসব উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি, হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের সাথে মতবিনিময় সভা হয়েছে। তারাও সবাই আমাদের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা আশা করি উৎসবের কার্যক্রম সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐতিহ্যের এক অনন্য প্রতীক। পূজা উদযাপন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদভাবে সম্পন্ন করার জন্য জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
এদিকে সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) সকালে রামকৃষ্ণ মিশনের পূজা মন্ডপ প্রদর্শন করেন স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, এবারের শারদীয় দুর্গাপূজায় কোন নিরাপত্তার ঝুকি নাই। বিগত সময়ের চেয়ে এবার আরো বেশী সম্প্রতির বন্ধন অটুট থাকবে এবং উৎসমুখর পরিবেশে পূজা অনুষ্ঠিত হবে।
তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জে দূর্গাপুজাকে কেন্দ্র করে কোন ধরনের শংকা নাই। এই পূজাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। সকল মন্ডপে সিসি ক্যামেরার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। এবার পূজা উৎসবমুখর হবে। নিরাপত্তার কোন ঘাটতি নাই। নারায়ণগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি সবসময়ই ছিলো। এবছর সম্প্রিতি আরও ভালো হয়েছে।
দেশে এবছর ৩৩ হাজার পূজামন্ডপ রয়েছে। প্রতিটি মন্ডপে পূজা উদযাপন কমিটি ৭ জন করে ভলেন্টিয়ার নিয়োগ দিবে, আনসার সদস্য থাকবে ৮জন করে। এছাড়াও পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীর সদস্যরাও নিরাশভার কাজে নিয়োজিত থাকবে।