আজ লতিফুর রহমানের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী
Published: 1st, July 2025 GMT
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ১ জুলাই। ২০২০ সালের এই দিনে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চিওড়া গ্রামে নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালে।
দেশের ব্যবসায় জগতে এক অনুকরণীয় নাম লতিফুর রহমান। ব্যবসায় সততা ও নৈতিকতার কারণে সবার কাছে তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব। ব্যবসার ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে ২০১২ সালে লতিফুর রহমানকে সম্মানজনক অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে নরওয়েভিত্তিক বিজনেস ফর পিস ফাউন্ডেশন, অসলো। সৎ ও সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু স্বীকৃতি পেয়েছেন।
বাংলাদেশে স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায়ও লতিফুর রহমানের অবদান স্বীকৃত। তিনি দেশের সর্বাধিক পঠিত বাংলা দৈনিক প্রথম আলো ও ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর উদ্যোক্তা।
লতিফুর রহমানের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ঢাকার সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে। ১৯৫৬ সালে শিলংয়ের সেন্ট এডমন্ডস স্কুলে ভর্তি হন। পরে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষা দেন। ঢাকায় ফিরে এসে ১৯৬৬ সালে লতিফুর রহমান চাঁদপুরের পারিবারিক পাটকল ডব্লিউ রহমান জুট মিলস লিমিটেডে নির্বাহী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭২ সালে টি হোল্ডিংস লিমিটেড চালুর মাধ্যমে নাম লেখান চা রপ্তানি ব্যবসায়। ১৯৮৭ সালে তাঁর নেতৃত্বে ট্রান্সকম গ্রুপের যাত্রা শুরু। ওষুধশিল্প, বৈদ্যুতিক, ইলেকট্রনিকস, গণমাধ্যম, কোমল পানীয়, চা ও ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন ব্যবসা খাতে গ্রুপটির একাধিক কোম্পানি রয়েছে। ২০১৭ সালে ট্রান্সকম বেভারেজেস লিমিটেড পেপসিকোর ‘গ্লোবাল বটলার অব দ্য ইয়ার ২০১৬’ পুরস্কার পায়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সিনিয়র সিটিজেন ক্যাটাগরিতে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর লতিফুর রহমান সর্বোচ্চ করদাতার পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ঢাকার (এমসিসিআই) সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশসহ ব্যবসা খাতের বিভিন্ন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন ২০১৬ সালের এই দিনে রাজধানীর গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন। ফারাজ আইয়াজ হোসেন ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমানের ছেলে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মানুষের নির্মমতার শিকার মহাবিপন্ন বনরুই
সাধারণ মানুষের কাছে বনরুই প্রায় অজানা এক প্রাণী। গভীর বনাঞ্চলের বাসিন্দা বিরল বনরুই মূলত রাতে বিচরণ করে। ফলে এই প্রাণী নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে আছে ভ্রান্ত ধারণা, বিশ্বাস এবং নানা আজগুবি গল্প। নিভৃতচারী হওয়ায় বিজ্ঞানীরাও বনরুই সম্পর্কে এখন পর্যন্ত খুব বেশি জানতে পারেননি। কয়েক দশক ধরে গোটা দুনিয়া থেকে এদের সংখ্যা কমছে আশঙ্কাজনক হারে।
বনরুইয়ের ইংরেজি নাম প্যাঙ্গোলিন; শব্দটি মালয় ভাষা থেকে ইংরেজিতে প্রবেশ করেছে। এর অর্থ গড়িয়ে দেওয়া বা গড়াগড়ি দেওয়া। মানুষ, শিকারি প্রাণী বা অন্য কোনো বিপদ দেখলেই বনরুই তার মুখ, হাত-পা ও লেজ গুটিয়ে বলের মতো আকার ধারণ করে। এমনভাবে মাটিতে পড়ে থাকবে যেন কোনো জড় বস্তু, দেহে কোনো প্রাণ নেই। বিপদ থেকে বাঁচতে বনরুই এমন নিখুঁত অভিনয় করে। দেহ শক্ত বর্মসদৃশ আঁশে? ঢাকা থাকায় এই প্রক্রিয়ায় বনরুই শিকারি থেকে নিজেকে রক্ষা করে।
বাংলায় বনরুই নামটি কীভাবে এল, কেন রাখা হয়েছে—এর হদিস পাওয়া যায় না। সম্ভবত বনে বসবাস, মাছের মতো দৈহিক আকৃতি, সেই সঙ্গে দেহে রুই মাছের মতো আঁশ থাকায় বনরুই নাম দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। এর অন্য নাম পিপীলিকাভুক, ইংরেজিতে অ্যান্ট ইটার। বনের পিঁপড়া, উইপোকা এদের প্রধান খাদ্য। বনে-বাদাড়ে পিপীলিকা ও উইপোকার বাসায় আক্রমণ করে খাবার শিকার করে। এমন খাদ্যাভ্যাস থেকে হয়তো পিপীলিকাভুক নাম রাখা হয়েছে।
পৃথিবীতে প্রাণীর আগমনের ধারা বিবেচনা করলে বনরুইকে বেশ প্রাচীন প্রাণীর তালিকায় রাখা যায়। মাংসাশী প্রাণী থেকে এদের উৎপত্তি হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। একদল প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক জার্মানির প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি পিট থেকে মধ্য ইওসিন সময়ের বনরুইয়ের একটি ফসিল খুঁজে পান। এই ফসিল থেকে বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, বনরুই আজ থেকে প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে এসেছে।
বনরুইয়ের দেহে সরীসৃপের মতো আঁশ থাকলেও এরা সরীসৃপ নয়, বিশেষ ধরনের বিরল স্তন্যপায়ী প্রাণী। এদের দেহের আঁশের ফাঁকে ফাঁকে হালকা লোম থাকে। বনরুই বাচ্চা প্রসব করে, জন্মের পর বাচ্চাকে দুধ পান করিয়ে বড় করে তোলে মা বনরুই। এসব বৈশিষ্ট্য বনরুইকে স্তন্যপায়ীর দলভুক্ত করেছে।
পৃথিবীতে আট প্রজাতির বনরুই দেখা যায়। এর মধ্যে চার প্রজাতির বনরুই আছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশে আছে দুই প্রজাতির বনরুই—ইন্ডিয়ান ও চায়নিজ। তবে বাংলাদেশে ইন্ডিয়ান বনরুইয়ের উপস্থিতির নির্ভরযোগ্য তথ্য আমাদের হাতে নেই। চায়নিজ বনরুই দেশের বেশ কিছু বনাঞ্চলে দেখা যায়। তবে খুবই বিরল। এরা একদিকে নিভৃতচারী, অন্যদিকে নিশাচর। দৈনন্দিন কাজ সবই সম্পন্ন হয় গভীর রাতের অন্ধকারে। ফলে মানুষের সঙ্গে এদের সাধারণত দেখা হয় না।
বুক ও পায়ের ভেতরের দিক ছাড়া বনরুইয়ের পুরো দেহ শক্ত আঁশে ঢাকা থাকে। লেজ ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার লম্বা হতে পারে। লম্বা লেজ দিয়ে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরতে পারে সহজেই। ফলে গাছে বিচরণ করতে বেশ পারদর্শী বনরুই। এদের ওজন হয় পাঁচ থেকে সাত কেজি। আঁশের ফাঁকে ফাঁকে পাতলা শক্ত লোম দেখা যায়। মাথা খাটো ও কোণাকৃতির। চোখও বেশ ছোট। কেঁচোর মতো সরু জিব ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পাগুলো খাটো। পায়ের আঙুল পাঁচটি, প্রতিটিতে ধারালো নখর থাকে। পিঁপড়ার গর্ত খুঁড়তে বেশ কাজে লাগে নখরগুলো।
বনরুই একা বা জোড়ায় বাস করে। বছরে সাধারণত একটি বাচ্চা প্রসব করে। তবে দুই থেকে তিনটি পর্যন্ত বাচ্চা হতে পারে। বাচ্চারা মায়ের পিঠের ওপর চড়ে বিচরণ করে। জন্মের সময় বাচ্চার আঁশগুলো খুব নরম থাকে। ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে ওঠে। বুনো পরিবেশে বনরুই ঠিক কত বছর বাঁচে, এটি বিজ্ঞানীরা এখনো জানতে পারেননি। চিড়িয়াখানায় ২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার রেকর্ড আছে।
অন্যান্য বুনো প্রাণীর মতো বনরুই নানা ধরনের জীবাণু ধারণ ও বহন করে। গবেষণা বলছে, বনরুই কয়েক ধরনের করোনাভাইরাস ও সার্স ভাইরাস বহন করে। ফলে বনরুইয়ের সংস্পর্শে এলে মানবদেহে এসব ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। তাই বনরুই ধরা বা মারা থেকে বিরত থাকতে হবে।
বর্তমানে যেসব প্রাণীর চোরাকারবার চলে, তার মধ্যে এই বনরুই সবার ওপরে। চোরা শিকারিরা বনরুই হত্যা করে এর মাংস, আঁশ ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার করে। প্রথাগত চীনা ওষুধ তৈরিতে এই বনরুইয়ের ব্যবহার বেশ পুরোনো। চীন, লাওস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে বনরুইয়ের প্রথাগত ব্যবহার বেশ।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বনরুই পাচার হয় বেশি। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নামও আছে। ২০১৬ সালে সাউথ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত সাইটিস (কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেনজার্ড স্পিসিজ) সভায় বনরুই–সম্পর্কিত সব ধরনের ব্যবসার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তদুপরি এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। ২০১৯ সালে বৈশ্বিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন চায়নিজ বনরুইকে মহাবিপন্ন প্রাণী ঘোষণা করে। চোরা শিকার ও বনাঞ্চল ধ্বংস বনরুইয়ের প্রধান হুমকি। আমাদের বনাঞ্চলগুলো থেকেও দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে বনরুই।
সম্প্রতি আইইউসিএন প্রকাশিত বনরুইয়ের পাচার ও অবৈধ চোরা শিকারের ওপর একটি গবেষণায় রোমহর্ষ তথ্য উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনমতে, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ বনরুই চোরা শিকারিরা হত্যা করেছে। এর মধ্যে সাড়ে আট হাজারের মতো এশিয়ান চার প্রজাতির বনরুই। বাকিগুলো আফ্রিকান প্রজাতির। এ তথ্য থেকে বোঝা যায়, বনরুই বিলুপ্তির ঝুঁকির তালিকায় কেন ওপরের দিকে।
পুরোপুরি জানার আগেই হয়তো বিরল এই প্রাণী হারিয়ে যাবে মানুষের এই পৃথিবী থেকে। অপরাপর প্রাণী ও বনাঞ্চল ধ্বংস করে আমরাই আমাদের ভবিষ্যৎকে ধীরে ধীরে বিপন্ন করে তুলছি।
এম এ আজিজ, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়