ঢাকার বাইরে যেতে চান না সমবায় কর্মকর্তারা, মাঠপর্যায়ে অনিয়ম
Published: 5th, July 2025 GMT
সমবায় অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত ক্যাডারভুক্ত অনেক কর্মকর্তা ঢাকার বাইরে যেতে চান না। ফলে ঢাকার বাইরের কার্যালয়গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ পদ ফাঁকা পড়ে আছে। এ বিষয়টির পাশাপাশি জনবলসংকটের কারণে সমবায় সমিতিগুলোর কার্যক্রম সঠিকভাবে নজরদারি হচ্ছে না। এ সুযোগে সমিতিগুলো অনিয়ম করছে।
অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্যাডার কর্মকর্তা হয়েও অনেকে চাকরিজীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়ে দিয়েছেন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে। ঢাকার বাইরে বদলি করা হলেও অনেকে যেতে চান না। এর প্রভাব পড়ছে মাঠপর্যায়ে।
বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কর্মকর্তাদের প্রতি মাসে নির্ধারিত সংখ্যক সমবায় সমিতি পরিদর্শনের কথা। কিন্তু জনবলসংকটের কারণে তা হচ্ছে না। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অনেক সমবায় সমিতি।
অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্যাডার কর্মকর্তা হয়েও অনেকে চাকরিজীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়ে দিয়েছেন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে। ঢাকার বাইরে বদলি করা হলেও অনেকে যেতে চান না। এর প্রভাব পড়ছে মাঠপর্যায়ে।গত বছরের ২ মে অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের যুগ্ম নিবন্ধক রিক্তা দত্তকে বরিশাল বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ে বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেখানে যুগ্ম নিবন্ধক হিসেবে যোগ দেননি।
এ বিষয়ে বিসিএস ২১ ব্যাচের সমবায় ক্যাডারের কর্মকর্তা রিক্তা দত্ত গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তাঁর চাকরিজীবনে কখনো ঢাকার বাইরে কাজ করেননি। তাই ঢাকার বাইরে যেতে তাঁর আগ্রহ নেই। বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানালে তাঁর বদলি আদেশ স্থগিত করা হয়।
কর্মকর্তাদের প্রতি মাসে নির্ধারিত সংখ্যক সমবায় সমিতি পরিদর্শনের কথা। কিন্তু জনবলসংকটের কারণে তা হচ্ছে না।একইভাবে প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত অতিরিক্ত নিবন্ধক জেবুন নাহার, যুগ্ম নিবন্ধক রাশিদা মুসতারীন, উপনিবন্ধক সামিয়া সুলতানাকে গত বছর ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছিল। যদিও পরে তা স্থগিত করা হয়।
অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখার তথ্য অনুসারে, চাকরিজীবনের বেশির ভাগ সময় ঢাকায় কাটিয়ে দেওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে আরও আছেন অতিরিক্ত নিবন্ধক মোহাম্মদ হাফিজুল হায়দার চৌধুরী, যুগ্ম নিবন্ধক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, যুগ্ম নিবন্ধক মো.
ঢাকা বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ে আট বছর ধরে উপনিবন্ধক পদে কর্মরত আছেন নূর-ই-জান্নাত। তিনি গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বদলি আমাদের ইচ্ছায় হয় না। বদলি করে থাকে মন্ত্রণালয়। আমি নিজেও বদলি হতে চাই। কিন্তু করা হয় না। কেন বদলি করা হয় না, আমি জানি না।’
এ নিয়ে মাঠপর্যায়ে থাকা ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ আছে। তাঁরা বলছেন, এঁদের জন্যই তাঁরা ঢাকায় আসতে পারছেন না।
জানতে চাইলে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মুনিমা হাফিজ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদবির করে অনেকে থেকে যাচ্ছেন। এই দপ্তরে আমি অতিরিক্ত দায়িত্বে আছি। এসব আমার দেখার বিষয় নয়।’
এমন প্রেক্ষাপটে আজ ৫ জুলাই পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সমবায় দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘কো-অপারেটিভস: ড্রাইভিং ইনক্লুসিভ অ্যান্ড সাসটেইনেবল সলিউশনস ফর আ বেটার ওয়ার্ল্ড’। দিবসটি উপলক্ষে ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে সমবায় অধিদপ্তর। আলোচনা সভায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার উপস্থিত থাকার কথা।
বদলি আমাদের ইচ্ছায় হয় না। বদলি করে থাকে মন্ত্রণালয়। আমি নিজেও বদলি হতে চাই। কিন্তু করা হয় না। কেন বদলি করা হয় না, আমি জানি নাঢাকা বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ে উপনিবন্ধক নূর-ই-জান্নাতনজরদারির ঘাটতি, ঝুঁকিতে হাজারো সমিতি
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের বাসিন্দা রোকেয়া বেগম (৪০)। তিনি চাঁনপুর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামের একটি সমবায় সমিতিতে ৩০ লাখ টাকা রেখেছিলেন। সমিতির কার্যালয়ে এখন তালা ঝুলছে। সমিতির চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম উধাও। টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় রোকেয়া।
জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় গত এপ্রিলে গ্রাহকের টাকা নিয়ে একসঙ্গে ২৩টি সমবায় সমিতি হাওয়া হয়ে যায়। এসব সমিতিতে গ্রাহকের জমার পরিমাণ ৭৩০ কোটি টাকা। সমিতিগুলোর কয়েক হাজার গ্রাহক এখন নিঃস্ব।
গ্রাহকের টাকা নিয়ে সমিতি উধাও, সঞ্চয় হারিয়ে মানুষের কান্না, প্রতিবাদে সরকারি দপ্তর ঘেরাও—সমবায় সমিতি নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের গ্রাহকদের এমন অভিজ্ঞতার কথা প্রায়ই সামনে আসে।
সম্প্রতি সমবায় অধিদপ্তর দেশের ১ হাজার ২৪১টি সমবায় সমিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গত ৫ মার্চ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে একটি সমন্বয় সভা হয়। সভায় এ তথ্য তুলে ধরেন অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক মোহাম্মদ ইমরান হাবীব।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, নজরদারির ঘাটতির পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনিয়মকারী সমবায় সমিতিগুলোকে ধরা যাচ্ছে না। তারা নানা কৌশলে পার পেয়ে যাচ্ছে।সভায় বলা হয়, এই সমবায় সমিতিগুলো কোনো ধরনের নিয়মনীতি মানছে না। তারা প্রতিনিয়ত আইন ভাঙছে। আটটি বিভাগের এসব সমবায় সমিতিকে নজরদারিতে এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে সভায় জানানো হয়।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, নজরদারির ঘাটতির পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনিয়মকারী সমবায় সমিতিগুলোকে ধরা যাচ্ছে না। তারা নানা কৌশলে পার পেয়ে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সমবায় সমিতিগুলোর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সুসম্পর্ক থাকে। সে কারণে সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
সমবায় অধিদপ্তরে নানা সমস্যা। সমবায় সমিতিগুলো নজরদারিতে নেই। এসব অনিয়মের সঙ্গে কর্মকর্তারা জড়িত থাকেন। এই অধিদপ্তরে মহাপরিচালক দেওয়া হয় অন্য ক্যাডার থেকে। কিন্তু সমবায় ক্যাডার থেকেই মহাপরিচালক হওয়া উচিত ছিল। বর্তমান কাঠামো দিয়ে সমবায় চলবে না। পেশাদার লোক দিয়ে সমবায়কে চালাতে হবে।স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদকমিশনের সুপারিশ
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সমবায় অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডকে (বিআরডিবি) একীভূত করে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সমবায় ক্যাডারকে অন্য প্রাসঙ্গিক ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সমবায় ও খাদ্য ক্যাডারকে প্রশাসনিক সার্ভিসের সঙ্গে একীভূত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সমবায় অধিদপ্তরে নানা সমস্যা। সমবায় সমিতিগুলো নজরদারিতে নেই। এসব অনিয়মের সঙ্গে কর্মকর্তারা জড়িত থাকেন। এই অধিদপ্তরে মহাপরিচালক দেওয়া হয় অন্য ক্যাডার থেকে। কিন্তু সমবায় ক্যাডার থেকেই মহাপরিচালক হওয়া উচিত ছিল। বর্তমান কাঠামো দিয়ে সমবায় চলবে না। পেশাদার লোক দিয়ে সমবায়কে চালাতে হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সমব য় ক য ড র স থ ন য় সরক র র র কর মকর ত কর মকর ত দ র প রথম আল ক কর মকর ত র ম ঠপর য য় ক সমব য় নজরদ র পর য য় গ র হক ও অন ক বলছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
সাইপ্রাসে কি ‘মিনি ইসরায়েল’ গড়ে উঠছে
গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীরা যেভাবে বাড়ি-জমি কিনছেন, তা নিয়ে সে দেশের জনমনে এবং রাজনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে লারনাকা ও লিমাসল এলাকায় ইসরায়েলিদের জায়গা–জমি কেনার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে।
বিরোধী দলের নেতারা বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসরায়েল যেন ধীরে ধীরে সাইপ্রাসে তাদের একধরনের ‘অঘোষিত উপস্থিতি’ তৈরি করে ফেলছে।
এখন গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। ফলে জনসংখ্যাগত ভারসাম্য ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাসের স্বঘোষিত তুর্কি প্রজাতন্ত্রের (টিআরএনসি) দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
‘নতুন ইসরায়েল’—এ কথা এখন গ্রিক সাইপ্রাসের রাজনীতিতে জোরালোভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। দেশটির প্রধান বিরোধী দল একেলের নেতা স্টেফানোস স্টেফানু এই পরিস্থিতিকে ‘পরিকল্পিত বসতি স্থাপন কৌশল’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি সতর্ক করেছেন, গ্রিক সাইপ্রাস যেন ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
জনসভায় দেওয়া বক্তৃতা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একেলের নেতারা গ্রিক সাইপ্রাসকে এখন ‘ইসরায়েলের দখলে নতুন দেশ’ বলেও আখ্যায়িত করছেন। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ইসরায়েলি উপস্থিতি নিয়ে সেখানে একটি গুরুতর রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে।
স্টেফানু দাবি করেছেন, ইসরায়েলি নাগরিকেরা সেখানে যে বসতি গড়ে তুলছেন, তা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত নয়। এর মধ্যে রয়েছে শুধু ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য আবাসন প্রকল্প, তাঁদের নিজস্ব শিক্ষা, খাবার, উপাসনালয় ও নিরাপত্তাব্যবস্থা। স্থানীয় সমাজের সঙ্গে মেলামেশার পরিবর্তে নিজেদের আলাদা করে রাখার মতো জায়গা বানাচ্ছেন তাঁরা। এর ফলে এই বসতির বাসিন্দারা স্থানীয় সংস্কৃতি বা সমাজে মিশে যাচ্ছেন না, বরং নিজেদের আলাদা একটি ‘মিনি ইসরায়েল’ বানিয়ে নিচ্ছেন।
এই বসতি স্থাপনের পেছনে সক্রিয় সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘ছাবাদ’। এটি একটি আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় অতিরক্ষণশীল ইহুদি ধর্মীয় আন্দোলন। ছাবাদ ইতিমধ্যে গ্রিক সাইপ্রাসে সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়), কিন্ডারগার্টেন (শিশু শিক্ষাকেন্দ্র), কোশার খাবারের দোকান এবং কবরস্থানের মতো কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিশ্লেষকদের মত হলো, ইসরায়েলি সম্প্রদায় শুধু পর্যটক বা অস্থায়ী বাসিন্দা নন, তাঁরা গ্রিক সাইপ্রাসে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত উপস্থিতি গড়ে তুলছেন। তাঁরা বলছেন, সিনাগগ, কবরস্থান, কোশার খাবারের দোকান, কিন্ডারগার্টেন ইত্যাদি অবকাঠামো স্থাপন আসলে একটি স্থায়ী প্রভাব বিস্তারের অংশ, যা ভবিষ্যতের কোনো সংকটকালে সামাজিক প্রভাব বা গোপন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে।
তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাস এই পরিস্থিতিকে বহুস্তরবিশিষ্ট ঝুঁকি হিসেবে দেখছে। তুরস্কের দৈনিক পত্রিকা মিল্লিয়েত-এর এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষকেরা বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে কেবল জনসংখ্যাগত পরিবর্তন নয়, বরং একটি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবেও দেখা উচিত।
আঙ্কারার সোশ্যাল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এমেতে গোজুগোজেল্লি সেখানকার সংবাদমাধ্যম মিল্লিয়েত-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এটি কেবল জমি কেনাবেচার বিষয় নয়—এটি নিরাপত্তা, গোয়েন্দা এবং কূটনৈতিক উদ্বেগের বিষয়।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, এমন ধর্মীয় গোষ্ঠী, যারা শক্তিশালী মতাদর্শিক নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করে, তারা নজরদারি, প্রচার এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মতো কাজও করতে পারে।
তিনি বিশেষভাবে ছাবাদ সংগঠনের কার্যক্রমের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কারণ, এই সংগঠনের প্রভাব এরই মধ্যে তুর্কি সাইপ্রাস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বাহ্যিকভাবে নিরীহ দেখালেও এই ধরনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে অনেকে বৃহত্তর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। এর মধ্যে অনেকে ইসরায়েলের ডায়াসপোরা ডিপ্লোম্যাসি, গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম বা সমাজে মতাদর্শগত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা আছে বলে মনে করছেন।
গোজুগোজেল্লি সতর্ক করে বলেন, এই গোষ্ঠীগুলো ‘সফট পাওয়ার’ (নরম কৌশলগত শক্তি) হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তারা এমন বিকল্প জনসমষ্টি তৈরি করতে পারে, যারা ইসরায়েলের নীতির প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। এর ফলে গ্রিক ও তুর্কি সাইপ্রাস উভয়ের রাজনৈতিক অখণ্ডতা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ভূরাজনৈতিক প্রভাবএ ঘটনাগুলো এমন সময়ে ঘটছে, যখন তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সামুদ্রিক সীমা নিয়ে নানা জটিল বিরোধের মুখে রয়েছে। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাস নিয়ে গঠিত একটি কৌশলগত জোটকে বিশ্লেষকেরা তুরস্কের আঞ্চলিক প্রভাব প্রতিরোধে গঠিত প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে দেখছেন। এই জোট মূলত গ্যাস অনুসন্ধান, যৌথ সামরিক মহড়া ও প্রতিরক্ষা সমন্বয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি তুরস্ককে সামুদ্রিকভাবে কার্যত ঘিরে ফেলেছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাসে নতুন ইসরায়েলি বসতিগুলো এই বৃহত্তর কৌশলগত নেটওয়ার্কের অংশ হতে পারে। যদি লারনাকা ও লিমাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সামরিক পর্যায়ের নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়, তাহলে তা তুরস্কের নৌ ও বিমান কার্যক্রম নজরদারির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
নাগরিক নাকি গোয়েন্দাপর্যবেক্ষকদের মতে, গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলিদের আগমনকে শুধু সাধারণ অভিবাসন ভেবে ভুল করা যাবে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো গোপনে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, মানচিত্রভিত্তিক পর্যবেক্ষণ বা ভবিষ্যতের সংঘাতকালীন তৎপরতার জন্য প্রস্তুত আছেন।
আইনবিশেষজ্ঞ এমেতে গোজুগোজেল্লি বলেন, ‘এটি নিরীহ অভিবাসনের ঢেউ নয়।’ তিনি নীতিনির্ধারকদের সতর্ক করে বলেছেন, এ ধরনের আদর্শিকভাবে সংযুক্ত ও সংগঠিত জনসংখ্যা শুধু নিরাপত্তাজনিত ভারসাম্যই নয়, দ্বীপের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিঘ্নিত করতে পারে।
ইসরায়েলিদের জমি কেনা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগইসরায়েলিদের জমি কেনার পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে তা এখন মালিকানা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে যদি কোনো শান্তিচুক্তি হয়, তাহলে এসব জনসংখ্যাগত ও অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ব্যবহার করে নতুন সীমানা দাবি বা রাজনৈতিক শর্ত হাজির করা হতে পারে।
তাঁরা এটিও বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যেসব একতরফা প্রতিরক্ষা ও বসতি স্থাপন চুক্তি হচ্ছে, সেগুলো ১৯৬০ সালের ‘ট্রিটি অব গ্যারান্টি’ বা ‘গ্যারান্টি চুক্তি’ লঙ্ঘন করতে পারে। এই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক, গ্রিস ও যুক্তরাজ্য সাইপ্রাসের নিরাপত্তার গ্যারান্টর (নিশ্চয়তাদানকারী) দেশ। ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে এই একতরফা চুক্তিগুলো দ্বীপের শক্তির ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
তুরস্কের জন্য নজরদারি ও প্রতিরোধ বাড়ানোর আহ্বানগোজুগোজেল্লি পরামর্শ দিয়েছেন, তুরস্ক এবং উত্তর সাইপ্রাসকে পূর্ব উপকূল বরাবর নজরদারি এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সীমান্তের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে ড্রোন দিয়ে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি চালানো উচিত। ছাবাদের মতো সংগঠনের উপস্থিতি কূটনৈতিক পর্যায়ে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতিকে দক্ষিণে দখল হয়ে থাকা তুর্কি সম্পত্তির অনিরসনকৃত ইস্যুর সঙ্গে যুক্ত করে দেখতে হবে। এতে আইনি ও রাজনৈতিক বৈপরীত্যগুলোও স্পষ্ট হবে।
*তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টার্কি টুডে থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ