সাইপ্রাসে কি ‘মিনি ইসরায়েল’ গড়ে উঠছে
Published: 3rd, July 2025 GMT
গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীরা যেভাবে বাড়ি-জমি কিনছেন, তা নিয়ে সে দেশের জনমনে এবং রাজনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে লারনাকা ও লিমাসল এলাকায় ইসরায়েলিদের জায়গা–জমি কেনার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে।
বিরোধী দলের নেতারা বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসরায়েল যেন ধীরে ধীরে সাইপ্রাসে তাদের একধরনের ‘অঘোষিত উপস্থিতি’ তৈরি করে ফেলছে।
এখন গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। ফলে জনসংখ্যাগত ভারসাম্য ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাসের স্বঘোষিত তুর্কি প্রজাতন্ত্রের (টিআরএনসি) দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
‘নতুন ইসরায়েল’—এ কথা এখন গ্রিক সাইপ্রাসের রাজনীতিতে জোরালোভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। দেশটির প্রধান বিরোধী দল একেলের নেতা স্টেফানোস স্টেফানু এই পরিস্থিতিকে ‘পরিকল্পিত বসতি স্থাপন কৌশল’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি সতর্ক করেছেন, গ্রিক সাইপ্রাস যেন ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
জনসভায় দেওয়া বক্তৃতা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একেলের নেতারা গ্রিক সাইপ্রাসকে এখন ‘ইসরায়েলের দখলে নতুন দেশ’ বলেও আখ্যায়িত করছেন। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ইসরায়েলি উপস্থিতি নিয়ে সেখানে একটি গুরুতর রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে।
স্টেফানু দাবি করেছেন, ইসরায়েলি নাগরিকেরা সেখানে যে বসতি গড়ে তুলছেন, তা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত নয়। এর মধ্যে রয়েছে শুধু ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য আবাসন প্রকল্প, তাঁদের নিজস্ব শিক্ষা, খাবার, উপাসনালয় ও নিরাপত্তাব্যবস্থা। স্থানীয় সমাজের সঙ্গে মেলামেশার পরিবর্তে নিজেদের আলাদা করে রাখার মতো জায়গা বানাচ্ছেন তাঁরা। এর ফলে এই বসতির বাসিন্দারা স্থানীয় সংস্কৃতি বা সমাজে মিশে যাচ্ছেন না, বরং নিজেদের আলাদা একটি ‘মিনি ইসরায়েল’ বানিয়ে নিচ্ছেন।
এই বসতি স্থাপনের পেছনে সক্রিয় সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘ছাবাদ’। এটি একটি আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় অতিরক্ষণশীল ইহুদি ধর্মীয় আন্দোলন। ছাবাদ ইতিমধ্যে গ্রিক সাইপ্রাসে সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়), কিন্ডারগার্টেন (শিশু শিক্ষাকেন্দ্র), কোশার খাবারের দোকান এবং কবরস্থানের মতো কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিশ্লেষকদের মত হলো, ইসরায়েলি সম্প্রদায় শুধু পর্যটক বা অস্থায়ী বাসিন্দা নন, তাঁরা গ্রিক সাইপ্রাসে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত উপস্থিতি গড়ে তুলছেন। তাঁরা বলছেন, সিনাগগ, কবরস্থান, কোশার খাবারের দোকান, কিন্ডারগার্টেন ইত্যাদি অবকাঠামো স্থাপন আসলে একটি স্থায়ী প্রভাব বিস্তারের অংশ, যা ভবিষ্যতের কোনো সংকটকালে সামাজিক প্রভাব বা গোপন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে।
তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাস এই পরিস্থিতিকে বহুস্তরবিশিষ্ট ঝুঁকি হিসেবে দেখছে। তুরস্কের দৈনিক পত্রিকা মিল্লিয়েত-এর এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষকেরা বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে কেবল জনসংখ্যাগত পরিবর্তন নয়, বরং একটি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবেও দেখা উচিত।
আঙ্কারার সোশ্যাল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এমেতে গোজুগোজেল্লি সেখানকার সংবাদমাধ্যম মিল্লিয়েত-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এটি কেবল জমি কেনাবেচার বিষয় নয়—এটি নিরাপত্তা, গোয়েন্দা এবং কূটনৈতিক উদ্বেগের বিষয়।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, এমন ধর্মীয় গোষ্ঠী, যারা শক্তিশালী মতাদর্শিক নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করে, তারা নজরদারি, প্রচার এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মতো কাজও করতে পারে।
তিনি বিশেষভাবে ছাবাদ সংগঠনের কার্যক্রমের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কারণ, এই সংগঠনের প্রভাব এরই মধ্যে তুর্কি সাইপ্রাস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বাহ্যিকভাবে নিরীহ দেখালেও এই ধরনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে অনেকে বৃহত্তর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। এর মধ্যে অনেকে ইসরায়েলের ডায়াসপোরা ডিপ্লোম্যাসি, গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম বা সমাজে মতাদর্শগত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা আছে বলে মনে করছেন।
গোজুগোজেল্লি সতর্ক করে বলেন, এই গোষ্ঠীগুলো ‘সফট পাওয়ার’ (নরম কৌশলগত শক্তি) হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তারা এমন বিকল্প জনসমষ্টি তৈরি করতে পারে, যারা ইসরায়েলের নীতির প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। এর ফলে গ্রিক ও তুর্কি সাইপ্রাস উভয়ের রাজনৈতিক অখণ্ডতা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ভূরাজনৈতিক প্রভাবএ ঘটনাগুলো এমন সময়ে ঘটছে, যখন তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সামুদ্রিক সীমা নিয়ে নানা জটিল বিরোধের মুখে রয়েছে। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাস নিয়ে গঠিত একটি কৌশলগত জোটকে বিশ্লেষকেরা তুরস্কের আঞ্চলিক প্রভাব প্রতিরোধে গঠিত প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে দেখছেন। এই জোট মূলত গ্যাস অনুসন্ধান, যৌথ সামরিক মহড়া ও প্রতিরক্ষা সমন্বয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি তুরস্ককে সামুদ্রিকভাবে কার্যত ঘিরে ফেলেছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাসে নতুন ইসরায়েলি বসতিগুলো এই বৃহত্তর কৌশলগত নেটওয়ার্কের অংশ হতে পারে। যদি লারনাকা ও লিমাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সামরিক পর্যায়ের নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়, তাহলে তা তুরস্কের নৌ ও বিমান কার্যক্রম নজরদারির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
নাগরিক নাকি গোয়েন্দাপর্যবেক্ষকদের মতে, গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলিদের আগমনকে শুধু সাধারণ অভিবাসন ভেবে ভুল করা যাবে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো গোপনে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, মানচিত্রভিত্তিক পর্যবেক্ষণ বা ভবিষ্যতের সংঘাতকালীন তৎপরতার জন্য প্রস্তুত আছেন।
আইনবিশেষজ্ঞ এমেতে গোজুগোজেল্লি বলেন, ‘এটি নিরীহ অভিবাসনের ঢেউ নয়।’ তিনি নীতিনির্ধারকদের সতর্ক করে বলেছেন, এ ধরনের আদর্শিকভাবে সংযুক্ত ও সংগঠিত জনসংখ্যা শুধু নিরাপত্তাজনিত ভারসাম্যই নয়, দ্বীপের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিঘ্নিত করতে পারে।
ইসরায়েলিদের জমি কেনা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগইসরায়েলিদের জমি কেনার পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে তা এখন মালিকানা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে যদি কোনো শান্তিচুক্তি হয়, তাহলে এসব জনসংখ্যাগত ও অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ব্যবহার করে নতুন সীমানা দাবি বা রাজনৈতিক শর্ত হাজির করা হতে পারে।
তাঁরা এটিও বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যেসব একতরফা প্রতিরক্ষা ও বসতি স্থাপন চুক্তি হচ্ছে, সেগুলো ১৯৬০ সালের ‘ট্রিটি অব গ্যারান্টি’ বা ‘গ্যারান্টি চুক্তি’ লঙ্ঘন করতে পারে। এই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক, গ্রিস ও যুক্তরাজ্য সাইপ্রাসের নিরাপত্তার গ্যারান্টর (নিশ্চয়তাদানকারী) দেশ। ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে এই একতরফা চুক্তিগুলো দ্বীপের শক্তির ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
তুরস্কের জন্য নজরদারি ও প্রতিরোধ বাড়ানোর আহ্বানগোজুগোজেল্লি পরামর্শ দিয়েছেন, তুরস্ক এবং উত্তর সাইপ্রাসকে পূর্ব উপকূল বরাবর নজরদারি এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সীমান্তের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে ড্রোন দিয়ে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি চালানো উচিত। ছাবাদের মতো সংগঠনের উপস্থিতি কূটনৈতিক পর্যায়ে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতিকে দক্ষিণে দখল হয়ে থাকা তুর্কি সম্পত্তির অনিরসনকৃত ইস্যুর সঙ্গে যুক্ত করে দেখতে হবে। এতে আইনি ও রাজনৈতিক বৈপরীত্যগুলোও স্পষ্ট হবে।
*তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টার্কি টুডে থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল দ র ইসর য় ল র র র জন ত র জন ত ক ত রস ক র জনস খ য উপস থ ত ক শলগত নজরদ র র জন য ব যবহ বলছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
নতুন ঘটনা নেই, নজরদারিতে শিথিলতা
দেশে গত ৯ বছরে বড় কোনো জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেনি। জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের উল্লেখযোগ্য প্রকাশ্য তৎপরতাও দেখা যায়নি। যদিও বিভিন্ন সময়ে ভেতরে-ভেতরে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছিল উগ্রবাদে সম্পৃক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী। তবে বড় হামলার শক্তি অর্জন করতে পারেনি তারা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এই গণ-আন্দোলনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং গুলি করে মানুষ হত্যায় জড়িয়ে পড়েন একশ্রেণির পুলিশ সদস্য। ফলে জনরোষের মুখে পড়ে পুলিশও। ভঙ্গুর অবস্থা থেকে পুলিশকে আবার সংগঠিত করে পুলিশি কার্যক্রম শুরু হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একরকম বন্ধ হয়ে গেছে উগ্রবাদীদের ওপর নজরদারি।
দেশে গত তিন দশকে যেসব জঙ্গি হামলা হয়েছে, তাতে চারটি সংগঠনের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে। এগুলো হলো হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামি বাংলাদেশ (হুজি-বি), জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), নব্য জেএমবি ও আনসার আল–ইসলাম।
আরও পড়ুনহোলি আর্টিজানে হামলা: নৃশংসতার সেই রাতের ৯ বছর আজ ৫২ মিনিট আগেবড় হামলার ঘটনা না থাকলেও নজরদারি বন্ধ হলে পাল্টে যাওয়া পরিস্থিতিতে উগ্রবাদের ঝুঁকি বাড়তে পারে।২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর বেশি আলোচনায় আসে নব্য জেএমবি। সেই হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী ১৫টি অভিযানে ৬৪ জন নিহত হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সিরিয়ায় আইএসের পতনের পর অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও তাদের অনুসারীরা আর সংগঠিত হতে পারেনি।
এবার বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকেও বাংলাদেশের ৩ ধাপ উন্নতি হয়েছে। এ বছরের ৫ মার্চ সিডনিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান দ্য ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিসের (আইইপি) বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচক বা জিটিআই ২০২৫ প্রকাশ করে। এবার সন্ত্রাসবাদের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫তম। স্কোর ৩.০৩। আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩২তম। এবার দক্ষিণ এশিয়ায় সূচকে সাতটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। দক্ষিণ এশিয়ায় খারাপের দিক থেকে শীর্ষে অবস্থানে আছে পাকিস্তান, দ্বিতীয় স্থানে আফগানিস্তান ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারত।
জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, জঙ্গিবাদের বিস্তার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার অংশ। অনেক ক্ষেত্রে বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক প্রভাব জঙ্গিবাদে বড় ভূমিকা রাখে। এ জন্য বাংলাদেশ বর্তমানে ঝুঁকিমুক্ত অবস্থায় আছে তা বলার সুযোগ নেই। কারণ, অনলাইনে এখনো উগ্রবাদ প্রচারের তৎপরতা রয়েছে।
আরও পড়ুনহোলি আর্টিজানে হামলা: ৭ জনের আমৃত্যু কারাদণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ১৭ জুন ২০২৫এদিকে মালয়েশিয়ায় জঙ্গি নেটওয়ার্কে জড়ানোর অভিযোগে ৩৬ জন প্রবাসী বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন। মালয়েশিয়ার গণমাধ্যম দ্য স্টার ও দ্য ভাইবস–এর খবর অনুযায়ী, গত ২৪ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করে। ওই দেশের সরকার জানিয়েছে, এই ব্যক্তিরা মালয়েশিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতাদর্শ প্রচার করছিলেন। পাশাপাশি তাঁদের কমিউনিটির (যাঁদের সঙ্গে থাকেন) ভেতরে সদস্য সংগ্রহের সেল গঠন করেছিলেন।
এসব বিষয় উল্লেখ করে জঙ্গিবাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সঙ্গে। সিটিটিসির অতিরিক্ত কমিশনার মো. মাসুদ করিম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বর্তমানে জঙ্গি হামলার বড় কোনো ঝুঁকি নেই। তবে স্থিতিশীল অবস্থা ধরে রাখতে নজরদারি চলছে।
আরও পড়ুনচার মাস প্রস্তুতি নিয়ে হোলি আর্টিজানে হামলা০১ জুলাই ২০২৩উঠেছে বিতর্ক, এখন ভয়
উগ্রবাদ নির্মূলে কাজ করা বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপকভাবে তৎপর ছিল। তবে জঙ্গিবাদ মোকাবিলার নামে বিরোধী রাজনৈতিক মত দমনে নিরীহ ব্যক্তিদের হয়রানি ও নির্যাতনের অভিযোগও ছিল। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এমন অভিযোগ আরও তীব্র হয়। এমন পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রকৃত কার্যক্রমও বিতর্কের মুখে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও ওঠে।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনেও এ বিষয়টি উঠে আসে। ১৯ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে একটি বাস্তব হুমকি। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজানে হামলার মতো ঘটনা এর প্রমাণ। তবে এই হুমকি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সততা, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি ও আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অটল থাকা জরুরি। সরকার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণাকে যখন রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তখন তা আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত কর্মকর্তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। আবার জঙ্গিবাদে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেপ্তার হওয়া অনেকে এখন অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বেআইনি আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবাদ নির্মূলের কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউনিটগুলোতে যোগ দেওয়া নতুন কর্মকর্তারাও দায়িত্ব পালনে অস্বস্তিতে আছেন। যার কারণে উগ্রবাদের ওপর নজরদারিতে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুনহোলি আর্টিজান হামলা: যে প্রশ্নগুলো তোলা জরুরি০১ জুলাই ২০২২জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমে অনেক দিন ধরে কাজ করছে ডিএমপির সিটিটিসি ইউনিট। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ মুহূর্তে উগ্রবাদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ওপর তাদের নজরদারি নেই বললেই চলে। উগ্রবাদী কার্যক্রমের বিষয়ে অনলাইন মাধ্যমেও আগের মতো তাদের তৎপরতা (সাইবার প্যাট্রোলিং) নেই। সন্দেহভাজনদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের কার্যক্রমও কখনো খুব সীমিত পরিসরে, আবার কখনো বন্ধ থাকছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উগ্রবাদকে নির্মোহভাবে দেখে ঝুঁকি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
জঙ্গিবাদ বিষয়েবিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে পর পর বেশ কিছু জঙ্গি হামলায় অনেকে নিহত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। পাশাপাশি জঙ্গি বার্তা সামনে নিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে পশ্চিমাদের দৃষ্টি আকর্ষণে কিছু নাটকীয় ঘটনাও ঘটেছে। কেবল ধর্মকর্ম পালনকে পর্যবেক্ষণে নিয়ে আটক করে জঙ্গি তকমা দেওয়ার ঘটনাও দেখা গেছে। তবে ৫ আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের পর প্রকৃতপক্ষে জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত এমন অনেকেই জামিনে মুক্ত বা বিভিন্নভাবে ছাড়া পেয়েছেন। তাঁদের ওপর নজরদারিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শৈথিল্য দেখছি। এটা বেশি দিন চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। এ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব না দিলে সেটা পরে বড় বিপদের কারণ হতে পারে।’