সাইপ্রাসে কি ‘মিনি ইসরায়েল’ গড়ে উঠছে
Published: 3rd, July 2025 GMT
গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীরা যেভাবে বাড়ি-জমি কিনছেন, তা নিয়ে সে দেশের জনমনে এবং রাজনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে লারনাকা ও লিমাসল এলাকায় ইসরায়েলিদের জায়গা–জমি কেনার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে।
বিরোধী দলের নেতারা বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসরায়েল যেন ধীরে ধীরে সাইপ্রাসে তাদের একধরনের ‘অঘোষিত উপস্থিতি’ তৈরি করে ফেলছে।
এখন গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। ফলে জনসংখ্যাগত ভারসাম্য ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাসের স্বঘোষিত তুর্কি প্রজাতন্ত্রের (টিআরএনসি) দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
‘নতুন ইসরায়েল’—এ কথা এখন গ্রিক সাইপ্রাসের রাজনীতিতে জোরালোভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। দেশটির প্রধান বিরোধী দল একেলের নেতা স্টেফানোস স্টেফানু এই পরিস্থিতিকে ‘পরিকল্পিত বসতি স্থাপন কৌশল’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি সতর্ক করেছেন, গ্রিক সাইপ্রাস যেন ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
জনসভায় দেওয়া বক্তৃতা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একেলের নেতারা গ্রিক সাইপ্রাসকে এখন ‘ইসরায়েলের দখলে নতুন দেশ’ বলেও আখ্যায়িত করছেন। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ইসরায়েলি উপস্থিতি নিয়ে সেখানে একটি গুরুতর রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে।
স্টেফানু দাবি করেছেন, ইসরায়েলি নাগরিকেরা সেখানে যে বসতি গড়ে তুলছেন, তা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত নয়। এর মধ্যে রয়েছে শুধু ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য আবাসন প্রকল্প, তাঁদের নিজস্ব শিক্ষা, খাবার, উপাসনালয় ও নিরাপত্তাব্যবস্থা। স্থানীয় সমাজের সঙ্গে মেলামেশার পরিবর্তে নিজেদের আলাদা করে রাখার মতো জায়গা বানাচ্ছেন তাঁরা। এর ফলে এই বসতির বাসিন্দারা স্থানীয় সংস্কৃতি বা সমাজে মিশে যাচ্ছেন না, বরং নিজেদের আলাদা একটি ‘মিনি ইসরায়েল’ বানিয়ে নিচ্ছেন।
এই বসতি স্থাপনের পেছনে সক্রিয় সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘ছাবাদ’। এটি একটি আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় অতিরক্ষণশীল ইহুদি ধর্মীয় আন্দোলন। ছাবাদ ইতিমধ্যে গ্রিক সাইপ্রাসে সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়), কিন্ডারগার্টেন (শিশু শিক্ষাকেন্দ্র), কোশার খাবারের দোকান এবং কবরস্থানের মতো কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিশ্লেষকদের মত হলো, ইসরায়েলি সম্প্রদায় শুধু পর্যটক বা অস্থায়ী বাসিন্দা নন, তাঁরা গ্রিক সাইপ্রাসে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত উপস্থিতি গড়ে তুলছেন। তাঁরা বলছেন, সিনাগগ, কবরস্থান, কোশার খাবারের দোকান, কিন্ডারগার্টেন ইত্যাদি অবকাঠামো স্থাপন আসলে একটি স্থায়ী প্রভাব বিস্তারের অংশ, যা ভবিষ্যতের কোনো সংকটকালে সামাজিক প্রভাব বা গোপন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে।
তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাস এই পরিস্থিতিকে বহুস্তরবিশিষ্ট ঝুঁকি হিসেবে দেখছে। তুরস্কের দৈনিক পত্রিকা মিল্লিয়েত-এর এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষকেরা বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে কেবল জনসংখ্যাগত পরিবর্তন নয়, বরং একটি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবেও দেখা উচিত।
আঙ্কারার সোশ্যাল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এমেতে গোজুগোজেল্লি সেখানকার সংবাদমাধ্যম মিল্লিয়েত-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এটি কেবল জমি কেনাবেচার বিষয় নয়—এটি নিরাপত্তা, গোয়েন্দা এবং কূটনৈতিক উদ্বেগের বিষয়।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, এমন ধর্মীয় গোষ্ঠী, যারা শক্তিশালী মতাদর্শিক নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করে, তারা নজরদারি, প্রচার এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মতো কাজও করতে পারে।
তিনি বিশেষভাবে ছাবাদ সংগঠনের কার্যক্রমের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কারণ, এই সংগঠনের প্রভাব এরই মধ্যে তুর্কি সাইপ্রাস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বাহ্যিকভাবে নিরীহ দেখালেও এই ধরনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে অনেকে বৃহত্তর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। এর মধ্যে অনেকে ইসরায়েলের ডায়াসপোরা ডিপ্লোম্যাসি, গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম বা সমাজে মতাদর্শগত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা আছে বলে মনে করছেন।
গোজুগোজেল্লি সতর্ক করে বলেন, এই গোষ্ঠীগুলো ‘সফট পাওয়ার’ (নরম কৌশলগত শক্তি) হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তারা এমন বিকল্প জনসমষ্টি তৈরি করতে পারে, যারা ইসরায়েলের নীতির প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। এর ফলে গ্রিক ও তুর্কি সাইপ্রাস উভয়ের রাজনৈতিক অখণ্ডতা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ভূরাজনৈতিক প্রভাবএ ঘটনাগুলো এমন সময়ে ঘটছে, যখন তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সামুদ্রিক সীমা নিয়ে নানা জটিল বিরোধের মুখে রয়েছে। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাস নিয়ে গঠিত একটি কৌশলগত জোটকে বিশ্লেষকেরা তুরস্কের আঞ্চলিক প্রভাব প্রতিরোধে গঠিত প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে দেখছেন। এই জোট মূলত গ্যাস অনুসন্ধান, যৌথ সামরিক মহড়া ও প্রতিরক্ষা সমন্বয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি তুরস্ককে সামুদ্রিকভাবে কার্যত ঘিরে ফেলেছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাসে নতুন ইসরায়েলি বসতিগুলো এই বৃহত্তর কৌশলগত নেটওয়ার্কের অংশ হতে পারে। যদি লারনাকা ও লিমাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সামরিক পর্যায়ের নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়, তাহলে তা তুরস্কের নৌ ও বিমান কার্যক্রম নজরদারির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
নাগরিক নাকি গোয়েন্দাপর্যবেক্ষকদের মতে, গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলিদের আগমনকে শুধু সাধারণ অভিবাসন ভেবে ভুল করা যাবে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো গোপনে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, মানচিত্রভিত্তিক পর্যবেক্ষণ বা ভবিষ্যতের সংঘাতকালীন তৎপরতার জন্য প্রস্তুত আছেন।
আইনবিশেষজ্ঞ এমেতে গোজুগোজেল্লি বলেন, ‘এটি নিরীহ অভিবাসনের ঢেউ নয়।’ তিনি নীতিনির্ধারকদের সতর্ক করে বলেছেন, এ ধরনের আদর্শিকভাবে সংযুক্ত ও সংগঠিত জনসংখ্যা শুধু নিরাপত্তাজনিত ভারসাম্যই নয়, দ্বীপের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিঘ্নিত করতে পারে।
ইসরায়েলিদের জমি কেনা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগইসরায়েলিদের জমি কেনার পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে তা এখন মালিকানা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে যদি কোনো শান্তিচুক্তি হয়, তাহলে এসব জনসংখ্যাগত ও অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ব্যবহার করে নতুন সীমানা দাবি বা রাজনৈতিক শর্ত হাজির করা হতে পারে।
তাঁরা এটিও বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যেসব একতরফা প্রতিরক্ষা ও বসতি স্থাপন চুক্তি হচ্ছে, সেগুলো ১৯৬০ সালের ‘ট্রিটি অব গ্যারান্টি’ বা ‘গ্যারান্টি চুক্তি’ লঙ্ঘন করতে পারে। এই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক, গ্রিস ও যুক্তরাজ্য সাইপ্রাসের নিরাপত্তার গ্যারান্টর (নিশ্চয়তাদানকারী) দেশ। ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে এই একতরফা চুক্তিগুলো দ্বীপের শক্তির ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
তুরস্কের জন্য নজরদারি ও প্রতিরোধ বাড়ানোর আহ্বানগোজুগোজেল্লি পরামর্শ দিয়েছেন, তুরস্ক এবং উত্তর সাইপ্রাসকে পূর্ব উপকূল বরাবর নজরদারি এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সীমান্তের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে ড্রোন দিয়ে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি চালানো উচিত। ছাবাদের মতো সংগঠনের উপস্থিতি কূটনৈতিক পর্যায়ে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতিকে দক্ষিণে দখল হয়ে থাকা তুর্কি সম্পত্তির অনিরসনকৃত ইস্যুর সঙ্গে যুক্ত করে দেখতে হবে। এতে আইনি ও রাজনৈতিক বৈপরীত্যগুলোও স্পষ্ট হবে।
*তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টার্কি টুডে থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল দ র ইসর য় ল র র র জন ত র জন ত ক ত রস ক র জনস খ য উপস থ ত ক শলগত নজরদ র র জন য ব যবহ বলছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্বেগ কেন
কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশ্বের অন্যতম ঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারত্ব, যেখানে ২০২৩ সালে প্রতিদিনের পণ্য ও সেবার লেনদেন দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ৯০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (ঐতিহাসিক সর্বোচ্চ)। যুক্তরাষ্ট্রের মোট পণ্য বাণিজ্যের ১৫ শতাংশ আসে কানাডা থেকে। কানাডার ৭৫ শতাংশ রপ্তানি পণ্য যায় যুক্তরাষ্ট্রে। দ্বিপক্ষীয় এ বাণিজ্যের মূল খাত অটোমোটিভ, জ্বালানি, কৃষি। যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেল আমদানির ৬০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে কানাডা। দুই দেশের মধ্যে গাড়ির যন্ত্রাংশ সীমান্ত অতিক্রম করে একাধিকবার।
কিন্তু এ পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্কটি বাণিজ্যিক টানাপোড়েন থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ, শিল্প পুনর্গঠন এবং বৈশ্বিক নীতির নতুন পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের টানাপোড়েন আরও ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ আমাদের চোখে আনে উদার আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা। আবার একই সঙ্গে দীর্ঘদিনের মিত্রদেশগুলোর মধ্যকার প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিস্থাপকতার দিকটিও স্পষ্ট করে। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য–বিরোধ ইস্যুটি প্রথম প্রকাশ্যে আসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর।
আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও যা ভাবা দরকার ১৩ আগস্ট ২০২৫যদিও জনসমক্ষে আলোচনায় প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনা প্রাধান্য পায়। তবু কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘ ইতিহাসে নানা বিরোধ দ্বারা চিহ্নিত হয়ে আছে, যা ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে সামনে আসেনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৬০-এর দশকের তথাকথিত ‘চিকেন ওয়ার’ এবং দীর্ঘস্থায়ী সফটউড লাম্বার নিয়ে বিরোধ। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কাল, অর্থাৎ ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ অর্থনৈতিক নীতির যুগ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড এক্সপানশন অ্যাক্টের সেকশন ২৩২–এর আওতায় জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে কানাডিয়ান ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় কানাডা পাল্টা ব্যবস্থা নেয় এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের গতিশীলতায় পরিবর্তন আসে।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সেকশন ২৩২-এর আওতায় কানাডিয়ান ইস্পাতের ওপর ২৫ শতাংশ ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর জবাবে কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের কিছু নির্বাচিত পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। এ পদক্ষেপগুলো বিদ্যমান সাপ্লাই চেইনকে ব্যাহত করে এবং দুই দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। ফলে উভয় দেশ সক্রিয়ভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়।
চার দশকের বেশি সময় ধরে চলমান এ বিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ—কানাডা তার সফটউড লাম্বার খাতকে ভর্তুকি দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বারবার কানাডার ডেইরি, ডিম ও মুরগির জন্য চালু করা সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নীতিকে সমালোচনা করেছে এবং একে বাজারে প্রবেশাধিকারের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখিয়েছে। দুই দেশের এ টানাপোড়েনে দেখা দিয়েছে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামে দামের অস্থিতিশীলতা। সফটউড লাম্বারে শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে আবাসন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে শুধু ২০১৮ সালেই কানাডায় প্রায় ২৩ হাজার চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়ে।
একই প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রেও, বিশেষত কানাডিয়ান মধ্যবর্তী পণ্যের ওপর নির্ভরশীল শিল্পে। কাঠামোগত কারণ ও কৌশলগত স্বার্থ কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য–বিরোধের স্থায়িত্ব ও বিবর্তনকে কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি ও উদীয়মান কারণে আকার দিচ্ছে।
যেমন অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উত্থান। ২০১৬ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রে সুরক্ষাবাদী অর্থনৈতিক নীতি ও শিল্প বিচ্ছিন্নকরণের (ইন্ডাস্ট্রি ডিকাপ্লিং) প্রবণতা জোরদার হয়েছে। ‘বাই আমেরিকান’ তথা ‘আমেরিকান পণ্য কেনো’ ধরনের নীতি উত্তর আমেরিকার সাপ্লাই চেইন সংহতকরণের মডেলের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক এক যুক্তিহীন ও ভয়াবহ উন্মাদনা২৮ জুলাই ২০২৫এসব ঘটনার পরও বিরোধ নিষ্পত্তির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো—যেমন জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট), ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও) এবং নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (নাফটা), পরে যার পরিবর্তে আসে ইউনাইটেড স্টেটস-মেক্সিকো-কানাডা অ্যাগ্রিমেন্ট (ইউএসএমসিএ)—দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সংঘাত নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে, যা কানাডার কোটার বণ্টন পদ্ধতির কিছু দিককে চুক্তির শর্তাবলির সঙ্গে অসংগত ঘোষণা করে এবং নীতি সংশোধনের নির্দেশ দেয়। এতে কঠোরতর উৎস নিয়ম, একটি ‘সানসেট ক্লজ’ ও পুনর্গঠিত বিরোধ নিষ্পত্তিপ্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত হয়। এসব পরিবর্তন নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রক অনিশ্চয়তা তৈরি করে এবং দুই দেশের অর্থনৈতিক অংশীদারদের জন্য কৌশলগত পুনর্গঠন অপরিহার্য করে তোলে।
কিন্তু একাধিক বিরোধ নিষ্পত্তিপ্রক্রিয়ায় আশাপ্রদ ফল পাওয়া যায়নি; বরং জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কানাডিয়ান সফটউড লাম্বারের ওপর অ্যান্টিডাম্পিং ও কাউন্টারভেইলিং শুল্ক বজায় রাখে, যার গড় ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অস্থিরতার ঝুঁকির কারণে কানাডা রপ্তানি বাজারকে বৈচিত্র্যময় করার প্রচেষ্টা বাড়িয়েছে এবং পদ্ধতিগত ঝুঁকি হ্রাস করা ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে সিপিটিপিপি এবং সিইটিএ প্রোগ্রামের মাধ্যমে এশিয়া-প্যাসিফিক ও ইউরোপীয় অঞ্চলে বহুপক্ষীয়, বহুমুখী ও বহুখাতীয় চুক্তির আওতায় রপ্তানি বৃদ্ধি করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
কানাডার জন্য অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব জোরদার করা মানে হলো উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, কৌশলগত খাতে বিনিয়োগ করা এবং বৈচিত্র্যময় বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো অভ্যন্তরীণ শিল্পনীতির প্রয়োজনীয়তা ও সমন্বিত মহাদেশীয় সাপ্লাই চেইন থেকে প্রাপ্ত দক্ষতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বাণিজ্য–বিরোধের বিশ্লেষণ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত শিক্ষা পাওয়া যায়, যা অন্যান্য দেশের জন্যও প্রযোজ্য।
দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। একতরফা শুল্ক আরোপ ও বিরোধ নিষ্পত্তিপ্রক্রিয়া এড়িয়ে চলা বাজার আস্থাকে ক্ষুণ্ন করে এবং দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধিকে হুমকির মুখে ফেলে।
কানাডার জন্য অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব জোরদার করা মানে হলো উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, কৌশলগত খাতে বিনিয়োগ করা এবং বৈচিত্র্যময় বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো অভ্যন্তরীণ শিল্পনীতির প্রয়োজনীয়তা ও সমন্বিত মহাদেশীয় সাপ্লাই চেইন থেকে প্রাপ্ত দক্ষতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।
অর্থনৈতিকভাবে পারস্পরিক নির্ভরশীল মিত্রদেশগুলোর মধ্যেও বাণিজ্যিক উত্তেজনা উদার আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কাঠামোর ভঙ্গুরতা প্রকাশ করে। অভিযোজন, বিচক্ষণ নীতি ও ধারাবাহিক কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা এ সম্পর্কের স্থায়িত্বের জন্য অপরিহার্য।
আগামী দিনে জলবায়ু-সম্পর্কিত বাণিজ্যনীতি, ডিজিটাল বাণিজ্য ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের ভূরাজনীতি বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভিযোজন ক্ষমতাকে পরীক্ষা করবে।
২০২৪ সাল পর্যন্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন উভয়ের সরকারি বক্তব্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহযোগিতার প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। যদিও দেশীয় ও বৈশ্বিক চাপ অব্যাহত রয়েছে। কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক প্রায়ই অর্থনৈতিক সংহতির মডেল হিসেবে বিবেচিত হলেও এটি নিয়মিত বিরোধ ও অভিযোজনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। সাম্প্রতিক বিরোধ উত্তর আমেরিকার বাণিজ্যকাঠামোর শক্তি ও দুর্বলতা উভয়কেই স্পষ্ট করেছে। নীতিনির্ধারক ও গবেষকদের জন্য এ অভিজ্ঞতা শিক্ষা দেয় যে এক অনিশ্চয়তার যুগে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, প্রমাণভিত্তিক নীতি এবং দূরদর্শী অর্থনৈতিক কূটনীতি অপরিহার্য।
আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক উন্মাদনায় এলোমেলো বিশ্ববাণিজ্য১০ এপ্রিল ২০২৫উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশিদের সংগঠন ফোবানা তার ২০২৫-এর সম্মেলনের আয়োজন করে মন্ট্রিয়ল শহরে। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন শুরু হয় গত ২৯ আগস্ট। ৩০ আগস্ট নির্ধারিত ছিল সেমিনার সিরিজ।
রঙ্গরসপ্রিয় বাঙালি গানবাজনা-নৃত্যের বিনোদন বাদ দিয়ে সম্মেলনের একটি অংশ রেখেছে সেমিনারের জন্য এবং উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বা সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এর মানে হলো আয়োজকেরা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন।
এর প্রধান কৃতিত্ব সেমিনার সিরিজের সমন্বয়ক অণুজীব বিজ্ঞানী ড. শোয়েব সাঈদের, যিনি অনেক দিন ধরে এ কঠিন কাজটি করে আসছেন। কিন্তু সেমিনারের কার্যকরী পর্ষদের সদিচ্ছা-সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব হতো না। পর্ষদের সভাপতি জিয়াউল হক জিয়া, মেম্বার সেক্রেটারি ইকবাল কবীর, কালচারাল ডিরেক্টর শামসাদ রানা, ফোবানার কেন্দ্রীয় সভাপতি আতিকুর রহমান, নির্বাহী সচিব নেহাল রহিম, কেন্দ্রীয় কর্মকর্তা বেদারুল ইসলাম বাবলাসহ অসংখ্য মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনুষ্ঠানটি সফল হতে পেরেছে।
চারটি সেশনের একটির আলোচ্য বিষয় ছিল ‘অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের যুগে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা বাণিজ্যযুদ্ধ’। এই সেশনে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কি-নোট স্পিচ দেওয়ার জন্য। সেশন চেয়ার ছিলেন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও কানাডিয়ান ইকোনমিকস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন গ্যালব্রেইথ। বিষয় নির্ধারণ থেকেই বোঝা যায়, কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকেরা যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা বাণিজ্যযুদ্ধে উদ্বিগ্ন।
এ নিবন্ধ আমার বক্তৃতার অংশ। বক্তৃতায় আমি বলেছি, এ উদ্বিগ্ন হওয়াটা ভালো লক্ষ্মণ। তাঁদের পরামর্শ দিয়েছি, কানাডার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণ নিয়ে কানাডার চাকরির বাজারে ঢুকে যেতে এবং রাষ্ট্রের আদর্শ, সমাজের মূল্যবোধ ধারণ করে মনেপ্রাণে কানাডার নাগরিক হয়ে গিয়ে অবদান রাখতে। বাংলাদেশে বৈধ পন্থায় অর্থ পাঠানো বা বিনিয়োগ করার পরামর্শও দিয়েছি।
কানাডা সরকার জানে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে কী করতে হবে। তারপরও আমি কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছি, যা নীতিনির্ধারকের আলোচনার বা কর্মপরিকল্পনায় চোখে পড়ে না। সব খাতে নিজস্ব শিল্প গড়ে তুলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তেল শোধনে বা গাড়ির যন্ত্রাংশ ভাগাভাগির নীতি বাদ দিতে হবে। প্রতিটি খাতে ৫০ বছরের পুরোনো নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এই নীতি বর্তমান সময়ের সঙ্গে হালনাগাদ করতে হবে। প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ ও সরকারি তত্ত্বাবধানে ব্যক্তি খাতের উদ্যোগ নীতি গ্রহণ করতে হবে।
এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ
[email protected]
মতামত লেখকের নিজস্ব