Samakal:
2025-07-04@05:21:20 GMT

মহররম, আশুরা ও আমল

Published: 3rd, July 2025 GMT

মহররম, আশুরা ও আমল

মহররম হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। ইসলামে এ মাসের সঙ্গে অনেক ঘটনার স্মৃতি জড়িত। এসব স্মৃতির সম্মানার্থে এ মাসকে মহররম বা সম্মানিত বলে নামকরণ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সুরা তাওবার ৩৬ আয়াতে এরশাদ হয়েছে: ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২। এর মধ্যে চারটি মাস (মহররম, রজব, জিলকদ, জিলহজ) সম্মানিত’। 
আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজিদের সুরা বাকারার ১৮৯ আয়াতে হিজরি সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন: লোকেরা আপনার কাছে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি তাদের বলে দিন, এটা মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের হিসাব এবং হজের সময় নির্ধারণ করার জন্য। 

মুসলমানদের বহু দ্বীনি বিষয়, বিশেষ করে হজের মতো মহিমান্বিত আমল নির্ভরশীল চাঁদের হিসাবের ওপর। আরবি মাস-বছর ঘিরে ইসলামের বহু বিধান আবর্তিত হয়। এই আরবি হিজরি চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাসটিই হচ্ছে মহররম। মহররম ঘিরেও রয়েছে শরিয়তের বিধান ও আমল। ফলে ইমানি দায়িত্ববোধ থেকেই হিজরি মাস-বর্ষের গণনার হিসাবের প্রতি যত্নবান হওয়া মুমিনের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশারা’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ১০। মহররম মাসের ১০ম দিনকে আশুরা বলে। সৃষ্টির শুরু থেকে ১০ মহররম তথা আশুরার দিনে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সর্বশেষ ৬২ হিজরি সনে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে আমাদের প্রিয় নবী (সা.

)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেইন (রা.)-এর শাহাদত এই দিনকে বিশ্ববাসীর কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রেখেছে। 
আশুরার দিনে আল্লাহতায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন এবং জান্নাতে স্থান দিয়েছেন। এই দিনে নূহ (আ.)-এর কিস্তি প্লাবন থেকে রক্ষা পেয়েছিল। হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। 

এদিন হজরত ইব্রাহিম (আ.) জালিম বাদশাহ নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে ৪০ দিন পর নিরাপদে মুক্তি পান। এদিন হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। আশুরার দিনে হজরত আইয়ুব (আ.) রোগমুক্তি লাভ করেন। এই দিনে হজরত সুলায়মান (আ.) তাঁর হারানো রাজত্ব ফিরে পান। হজরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর হারানো পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)-কে ৪০ বছর পর ফিরে পান।
এই দিনে হজরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং এদিনেই তাঁকে দুনিয়া থেকে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়। আশুরার দিনে আরও বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।
পূর্বে মুসলমানদের জন্য আশুরার রোজা ফরজ ছিল। দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে রমজানের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা সুন্নত হয়ে যায় (আবু দাউদ)। 
হাদিস শরিফে বর্ণিত, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করে ইয়াহুদিদের মহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখতে দেখে বললেন, এটা কীসের রোজা?
তারা জানাল, এটি একটি উত্তম দিন; এই দিনে আল্লাহতায়ালা ফেরাউনের হাত থেকে হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের মুক্ত করেছিলেন।

এ কথা শুনে তিনি বললেন, ‘হজরত মুসা (আ.)-এর ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমিই বেশি হকদার। অতঃপর তিনি নিজে রোজা রাখলেন এবং সাহাবাদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (বুখারি)
আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট আমি আশাবাদী, তিনি পূর্বের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন’ (মুসনাদে আহমাদ)। 
অপর হাদিসে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবারের ব্যয় বৃদ্ধি করবে, ভালো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করবে; আল্লাহতায়ালা সারাবছর তার প্রাচুর্য বাড়িয়ে দেবেন’ (আবু দাউদ)। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে মহররম মাসের মর্যাদা রক্ষার তাওফিক দান করুন। 

ড. মো. শাহজাহান কবীর: চেয়ারম্যান, ইসলামিক 
স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসল ম এই দ ন

এছাড়াও পড়ুন:

মহররমে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি

মহররম কেবল একটি মাস নয়, বরং ইসলামের ইতিহাসের একটি জীবন্ত অধ্যায়, যেখানে বিষাদ, সংগ্রাম ও আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণ রয়েছে। কেবল ১০ মহররম নয়, এই মাসজুড়ে ঘটেছে ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ও ব্যথাতুর নানা ঘটনা। আমরা কয়েকটি উল্লেখ করছি।

মহররমের উল্লেখযোগ্য তারিখ ও ঘটনা

২ মহররম: কারবালায় হোসাইন (রা.)-এর প্রবেশ

৬৮০ সালে, হিজরি ৬১ সনে হোসাইন ইবন আলী (রা.) কারবালায় প্রবেশ করেন এবং তাঁর শিবির স্থাপন করেন। ইয়াজিদের সেনাবাহিনী তাঁদের ঘিরে ফেলে।

কুফার দিকে যাওয়ার পথে উমাইয়া সৈন্যরা তাঁদের থামান এবং কারবালার মরুভূমিতে শিবির স্থাপন করতে বাধ্য করেন, যেখানে পানি বা কোনো সুরক্ষা দেয়াল ছিল না। এই ঘটনা কারবালার ট্র্যাজেডির সূচনা করে (আল-তাবারি, তারিখ আল-তাবারি, ৫/৩৯১, দারুল কুতুব, ১৯৬৭)।

৭ মহররম: পানি নিষিদ্ধকরণ

৬৮০ সালে, হিজরি ৬১ সনে ইয়াজিদের নির্দেশে হোসাইন (রা.)-এর শিবিরের জন্য পানির সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে হোসাইন (রা.) ও তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে তীব্র তৃষ্ণা ও ক্ষুধার সৃষ্টি হয়। (আল-তাবারি, তারিখ আল-তাবারি, ৫/৪০১, দারুল কুতুব, ১৯৬৭)

আরও পড়ুনহিজরি কালপঞ্জি: ইসলামি পরিচয়ের ধারণা২৩ মে ২০২৫৮ মহররম: জয়নুল আবেদীন (রা.)–এর মৃত্যু

৯৫ হিজরির এই দিনে ইমাম জয়নুল আবেদীন (রা.) মৃত্যু। কোনো কোনো বর্ণনা মতে উমাইয়া খলিফ ওয়ালিদের নির্দেশে তাকে বিষপানে শহিদ করা হয়। তিনি ছিলেন হোসাইন ইবন আলী (রা.)-এর পুত্র এবং কারবালার ট্র্যাজেডির সাক্ষ্য হয়ে বেঁচে থাকা একমাত্র পুরুষ সদস্য।

৯ মহররম: আলোচনার ব্যর্থতা

৬৮০ সালের এই দিনে হোসাইন (রা.) ও উমাইয়া বাহিনীর মধ্যে আলোচনা ভেঙে পড়ে। উমাইয়া নেতা উমার ইবন সাদ বিকেলে নামাজের পর আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু তাঁকে পরের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি করানো হয়। হোসাইন (রা.) ও তাঁর অনুসারীরা সেই রাত ইবাদতে কাটান। (আল-তাবারি, তারিখ আল-তাবারি, ৫/৪১১, দারুল কুতুব, ১৯৬৭)

১০ মহররম: আশুরা ও কারবালার যুদ্ধ

এ দিন আশুরার দিন। নবীজি (সা.) বলেন, ‘আশুরার দিনের রোজা পূর্ববর্তী এক বছরের পাপের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২)

৬৮০ সালে এদিনেই কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হোসাইন ইবন আলী (রা.), তাঁর ভাই আব্বাস (রা.) এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ পুরুষ সদস্য উমাইয়া সৈন্যদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। যুদ্ধের শেষে উমাইয়া সৈন্যরা হোসাইন (রা.)-এর শিবিরের নারী ও শিশুদের বন্দী করে দামেস্কে নিয়ে যায়। (আল-তাবারি, তারিখ আল-তাবারি, ৫/৪২৩, দারুল কুতুব, ১৯৬৭)

আরও পড়ুনআশুরা ও কারবালা করুণ ইতিহাসের স্মারক১৭ জুলাই ২০২৪১৬ মহররম: প্রথম কিবলা নির্ধারণ

১৬ মহররমে নবীজি (সা.) বাইতুল মুকাদ্দাসকে প্রথম কিবলা হিসেবে নির্ধারণ করেন। পরবর্তীকালে কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে কিবলা কাবার দিকে পরিবর্তিত হয়, ‘আমরা তোমার মুখকে আকাশের দিকে বারবার ফিরতে দেখি, তাই আমরা তোমাকে এমন কিবলার দিকে ফিরিয়ে দেব, যা তুমি পছন্দ কর।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৪৪)

১৭ মহররম: হস্তির ঘটনা

৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মক্কায় ‘হাতিওয়ালাদের’ আগমন ঘটে, যা কোরআনের সুরা ফিলে উল্লেখিত হয়েছে, ‘তুমি কি দেখনি, তোমার রব হাতিওয়ালাদের সঙ্গে কী করেছেন?’

২০ মহররম: বেলাল (রা.)-এর ইন্তেকাল

১৭ বা ১৮ হিজরির এই দিন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বেলাল (রা.) ইন্তেকাল করেন। তাঁর আজানের আহ্বান ইসলামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। (ইবন সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৩/২৩২, দার সাদির, ১৯৬০)

 সূত্র: দ্য ইসলামিক ইনফর্মেশন ডটকম

আরও পড়ুনপবিত্র আশুরা ৬ জুলাই২৬ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মহররমে ইবাদতের নামে ছড়ানো ৫টি কুসংস্কার
  • মহররম মাসের ৫ ইবাদত
  • পবিত্র আশুরা ঘিরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে: ডিএমপি
  • মহররমে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি