মহররমে মুসা (আ.)–এর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার
Published: 4th, July 2025 GMT
হিজরি ১৪৪৭ সনের শুরুতে মহররম মাস আমাদের সামনে এসেছে। মহররমকে আল্লাহ ‘শাহরুল্লাহ’ বা তাঁর নিজের মাস বলে সম্মানিত করেছেন। এই মাসে আশুরার রোজা আমাদের জন্য মুসা (আ.)-এর উত্তরাধিকার পুনরুদ্ধারের এক অনন্য সুযোগ করে দিয়েছে। কোরআনে সবচেয়ে বেশিবার উল্লেখিত নবী মুসা (আ.) এই উম্মাহর জন্য এক প্রেরণার পুরুষ।
কোরআনের কেন্দ্রীয় চরিত্রমুসা (আ.
ফেরাউন ছিলেন অত্যাচারী শাসক, হামান রাজনৈতিক দুর্নীতির প্রতীক আর কারুন ছিলেন অর্থের অপব্যবহার ও কপটতার প্রতিনিধি। মুসা (আ.)-এর সংগ্রাম ছিল এই তিন ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধেই। বিস্ময়ের কথা হলো, একই ধরনের দুর্নীতি আমাদের সমাজেও বিদ্যমান।
ফলে মুসা (আ.)-এর জীবন আমাদের জন্য অনন্য শিক্ষা। তিনি ফেরাউনের প্রাসাদে বড় হয়েছিলেন, তবুও নিজের জনগোষ্ঠীর জন্য লড়েছিলেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে ক্ষমতার মুখে সত্য বলতে হয় এবং ন্যায়ের জন্য দাঁড়াতে হয়।
আরও পড়ুনমুসা (আ.)-এর জীবনের ঘটনা১০ জুন ২০২৫আশুরায় মুসা (আ.)-এর স্মরণমহররমের দশম দিন আশুরা, মুসা (আ.)-এর রেখে যাওয়া আদর্শ আবার আমাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ইবন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) মদিনায় এসে দেখেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখছেন।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা কী?’ তাঁরা বললেন, ‘এটি একটি পুণ্যময় দিন, এই দিনে আল্লাহ বনি ইসরাইলকে তাদের শত্রুদের থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, তাই মুসা (আ.) এই দিনে রোজা রেখেছিলেন।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘মুসার প্রতি আমাদের অধিকার তোমাদের চেয়ে বেশি।’ তিনি সেদিন রোজা রাখলেন এবং মুসলিমদেরও তা পালনের নির্দেশ দিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২০০৪)
আরেকটি বর্ণনায় বলা হয়, ‘এটি একটি মহান দিন, যেদিন আল্লাহ মুসা ও তাঁর কওমকে রক্ষা করেছিলেন এবং ফেরাউন ও তাঁর কওমকে ডুবিয়েছিলেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৩০)
ফলে এই রোজা কেবল একটি ইবাদত নয়, বরং মুসা (আ.)-এর বিজয়ের স্মরণ এবং এই উম্মাহর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগও বটে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘আশুরার দিনের রোজা সম্পর্কে আমি আশা করি যে আল্লাহ এটিকে পূর্ববর্তী এক বছরের পাপের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২)
আমাকে মুসার ওপর প্রাধান্য দিয়ো না। কিয়ামতের দিন মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়বে, আমিও সংজ্ঞাহারা হব। প্রথম আমি জ্ঞান ফিরে পাব, আর দেখব মুসা (আ.) আরশ ধরে আছেন।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৪০৫মুসা (আ.) ও মুসলিম উম্মাহমুসা (আ.)-এর গল্প এই উম্মাহর জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। একবার একজন সাহাবি ইহুদির সঙ্গে মুসা (আ.) ও মুহাম্মদ (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিতর্ক করলেন, নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমাকে মুসার ওপর প্রাধান্য দিয়ো না। কিয়ামতের দিন মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়বে, আমিও সংজ্ঞাহারা হব। প্রথম আমি জ্ঞান ফিরে পাব, আর দেখব মুসা (আ.) আরশ ধরে আছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৪০৫)
তা ছাড়া মেরাজের সময় নবীজি (সা.)-কে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুনজিভের জড়তা কাটাতে মুসা (আ.) যে প্রার্থনা করেছিলেন০৮ এপ্রিল ২০২৫আশুরার সুন্নাত পালনতবে নবীজি (সা.) আশুরার রোজাকে এই উম্মাহর স্বতন্ত্র পরিচয়ের অংশ করেছেন। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নবীজি আশুরার দিন রোজা রাখলেন এবং মুসলিমদেরও তা রাখতে বললেন। সাহাবিরা বললেন, ‘আল্লাহর রাসুল, এটি এমন একটি দিন যাকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা সম্মান করে।’ নবীজি বললেন, ‘আগামী বছর ইনশা আল্লাহ আমরা নবম দিনেও রোজা রাখব। কিন্তু পরের বছর আসার আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৩৪)
এভাবে নবম ও দশম মহররমের রোজা আমাদের পরিচয়কে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের থেকে আলাদা করা হয়েছে। আমরা নবম ও দশম মহররমে রোজা রেখে মুসা (আ.)-এর উত্তরাধিকারকে পুনরুজ্জীবিত করি। মহররম আমাদের জন্য কেবল একটি মাস নয়, বরং আমাদের ইতিহাস ও পরিচয়ের একটি অংশ।
সূত্র: ইসলাম টুয়েন্টিওয়ান-সি ডটকম
আরও পড়ুনমুসা (আ.)-কে দেশ ছাড়ার পরামর্শ২১ মার্চ ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র ফ র উন র জন য আল ল হ বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
দারফুরে ধর্ষণ-মুক্তিপণ-হত্যা: আরএসএফের ভয়াবহ নিপীড়নের বর্ণনা দিলেন পালিয়ে আসা মানুষেরা
সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর শহরে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)–এর কাছ থেকে পালিয়ে আসা ক্ষুধার্ত এবং নির্যাতিত মানুষেরা বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করছেন। তবে তাঁরা পালাতে পারলেও হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশের শহর ছিল রাজ্যটিতে সুদানি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি। গত রোববার আরএসএফ বাহিনী এটির দখল নেয়। এরপর থেকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা স্থানীয় মানুষের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এরই মধ্যে দারফুরে ধর্ষণ, মুক্তিপণ ও গণহত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা সামনে আসছে।
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইসমাইল বলেন, ‘খার্তুমের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন এমন একজন তরুণ সেখানে ছিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “ওকে হত্যা করো না”। এরপর তাঁরা আমার সঙ্গে থাকা সব তরুণ ও আমার বন্ধুদের হত্যা করেন।’
তাবিলা এলাকায় পালিয়ে আসা অন্য নাগরিকেরাও তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তেমনই একজন তাহানি হাসান। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই তাঁরা সেখানে হাজির হলেন। কোথা থেকে এলেন জানি না। ভিন্ন ভিন্ন বয়সী তিন তরুণকে দেখা গেল। তাঁরা আকাশে গুলি ছুড়লেন এবং বললেন, ‘থামো, থামো’। তাঁরা আরএসএফের পোশাকে ছিলেন।’
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। আলখেইর বলেছেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।তাহানি হাসান বলেন, ‘এই তরুণেরা আমাদের বেধড়ক মারধর করেছেন। আমাদের পোশাক মাটিতে ছুড়ে ফেলেছেন। এমনকি আমি একজন নারী হওয়ার পরও আমাকে তল্লাশি করা হয়েছে। হামলাকারীরা সম্ভবত বয়সে আমার মেয়ের চেয়েও ছোট হবে।’
ফাতিমা আবদুলরহিম তাঁর নাতি–নাতনিদের সঙ্গে তাবিলাতে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, পাঁচ দিন ধরে অনেক কষ্ট করে হেঁটে তাবিলাতে পৌঁছাতে পেরেছেন।
ফাতিমা বলেন, ‘তাঁরা (আরএসএফের সদস্যরা) ছেলেশিশুগুলোকে মারলেন এবং আমাদের সব সম্পদ কেড়ে নিলেন। আমাদের কিছুই রাখা হলো না। আমরা এখানে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম, আমাদের পর যেসব মেয়ে এসেছে, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তবে আমাদের মেয়েরা বেঁচে গেছে।’
পালিয়ে আসা তরুণী রাওয়া আবদাল্লা বলেছেন, তাঁর বাবা নিখোঁজ।
গত বুধবার রাতে দেওয়া এক বক্তৃতায় আরএসএফের প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাঁর যোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। হামদান ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানি সেনাদের সঙ্গে আরএসএফ সদস্যদের লড়াই চলছে। গত বৃহস্পতিবার আরএসএফ দাবি করে, নির্যাতনের অভিযোগে বেশ কয়েকজন যোদ্ধাকে আটক করেছে তারা।
তবে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার সাধারণ নাগরিকদের ওপর আরএসএফ সদস্যদের নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তে বাহিনীটির দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফের একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডার এই ঘটনাগুলো ‘গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর দাবি, এল–ফাশেরে নিজেদের পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করতে সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্ররা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এ সংঘাত চলাকালে আরএসএফ ও সেনাবাহিনী—দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বিরাজ করছে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের অবস্থা। পাশাপাশি কলেরা ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।
দারফুর থেকে পালিয়ে আসা লোকজন তাবিলা এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। ২৯ অক্টোবর, ২০২৫