ছেলেকে শেষবিদায় জানাতে কবর খুঁড়ে অপেক্ষায় দিন গুনছেন মা
Published: 22nd, September 2025 GMT
ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরের বালাতা শরণার্থীশিবিরের বাসিন্দা জামিলা সানাকরা। তাঁর তিন ছেলের কেউই এখন আর বেঁচে নেই। তাঁর বড় দুই ছেলেকে ইসরায়েল হত্যা করেছে, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। কিন্তু তাঁর ছোট ছেলের সঙ্গে কী হয়েছে, তা এখনো তিনি জানেন না।
জামিলার ছোট ছেলে মাহমুদ। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২৬ বছর বয়সে পা দেওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে নিজের শোবার ঘরে ইসরায়েলি সেনারা তাঁকে গুলি করেন।
এরপর ইসরায়েলি সেনারা মাহমুদকে নিয়ে যান। তাঁকে এখনো পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি।
জামিলা এখনো জানেন না মাহমুদ বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। এ কারণে তাঁর শোক ও মানসিক যন্ত্রণার মাত্রাও বেশি।
৬৭ বছর বয়সী জামিলা আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ফিলিস্তিনি মায়েরা তাঁদের সন্তানকে দুবার বহন করেন; একবার গর্ভে, আরেকবার শোকযাত্রায়।’
প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর দ্য রিকভারি অব মার্টায়ার্স বডিস’ নামের একটি সংস্থা জানায়, পশ্চিম তীর ও গাজায় এ পর্যন্ত ২ হাজার ২২০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যার পর তাঁদের মরদেহ নিয়ে গেছে ইসরায়েল। মাহমুদ সম্ভবত তাঁদেরই একজন।
জামিলার ছোট ছেলে মাহমুদ। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২৬ বছর বয়সে পা দেওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে নিজের শোবার ঘরে ইসরায়েলি সেনারা তাঁকে গুলি করেন।এসব মরদেহ প্রায়ই রেফ্রিজারেটরে রেখে দেওয়া হয় বা সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জেরুজালেম লিগ্যাল এইড অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সেন্টার (জেএলএসি) বলেছে, এই কাজকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ইসরায়েল। এর অর্থ হলো, তারা ফিলিস্তিনিদের হারানো স্বজনের জন্য শোক পালনের সুযোগও দিতে চায় না।
অনেক ফিলিস্তিনি মায়ের মতো জামিলাও তাঁর ছোট ছেলেকে শেষবিদায় দেওয়ার সুযোগ পাননি।
পশ্চিম তীরের সবচেয়ে জনবহুল শরণার্থীশিবির বালাতা। এটি ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এক বর্গকিলোমিটারের এক–চতুর্থাংশের কম জায়গায় এটি গড়ে উঠেছে। আয়তনে এটি ৩৫টি ফুটবল মাঠের সমান। এখানে অন্তত ৩৩ হাজার মানুষের বসবাস।
শরণার্থীশিবিরের দেয়ালে দেয়ালে এবং জানালায় ৪৫ জনের বেশি ফিলিস্তিনির প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে। স্থানীয় লোকজন বলেছেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর তাঁদের ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করেছে। ওই দিনের পর থেকে গাজার পাশাপাশি পশ্চিম তীরেও হামলা ও সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়েছে ইসরায়েল। তখন থেকেই শরণার্থীশিবিরটি অবরুদ্ধ।
বালাতা শরণার্থীশিবিরের কবরস্থানে মাহমুদের বড় দুই ভাই আহমদ ও ইব্রাহিমের কবর। এর পাশেই মাহমুদের জন্য একটি কবর প্রস্তুত করেছে তাঁর পরিবার। তাঁরা এখন মাহমুদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার কিংবা তাঁর মরদেহ ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। তবে তাঁরা জানেন, এ দুটির কোনোটিই হয়তো সম্ভব নয়।
অনেক ফিলিস্তিনি মায়ের মতো জামিলাও তাঁর ছোট ছেলেকে শেষবিদায় দেওয়ার সুযোগ পাননি।জামিলার বড় ছেলে আহমদ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। ২০০৮ সালে ২০ বছর বয়সে তাঁকে হত্যা করা হয়।
জামিলার বিশ্বাস, আহমদের কারণে তাঁর পরিবারকে শাস্তি দিচ্ছে ইসরায়েল। আর এটাই মাহমুদের মরদেহ ফিরিয়ে না দেওয়ার মূল কারণ। তিনি বলেন, ‘এটি একধরনের অপমান।’
জামিলা আরও বলেন, ‘পরিবারগুলোর ওপর, বিশেষ করে মায়েদের ওপর এটি একধরনের অত্যাচার। এতে শোক শেষ হয় না। একটি কবর নেই, যেখানে গিয়ে আমি তাঁর জন্য প্রার্থনা করতে পারি, তার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি এবং একটু শান্তিতে শোক পালন করতে পারি।’
মাহমুদের বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আল-জাজিরা। কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি।
গত ফেব্রুয়ারিতে জামিলার ঘরে হামলা চালান ইসরায়েলি সেনারা। তাঁরা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন, তার বেশির ভাগই মেরামত করার সাধ্য নেই এই পরিবারের।
জামিলা বলেন, সেদিন ভোরে দুজন সেনা দরজা ভেঙে তাঁদের ঘরে ঢুকে পুরো পরিবারকে একটি কক্ষে বন্দী করে ফেলেন। এ সময় মাহমুদ নিজের শোবার ঘরে ছিলেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে জামিলার ঘরে হামলা চালান ইসরায়েলি সেনারা। তাঁরা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন, তার বেশির ভাগই মেরামত করার সাধ্য নেই এই পরিবারের।জামিলা আরও বলেন, ‘তাঁরা আমাকে মারতে মারতে মেঝেতে ফেলে দেন। এর পর আমার বুক ও পায়ে পাড়া দেন। এক সেনা আমাকে বললেন, আমার কারণেই নাকি আমার সন্তানেরা সন্ত্রাসী হয়ে গেছে এবং আমার কারণেই তারা মারা গেছে।’
‘অন্য এক সেনা বললেন, আপনার পরিবারে কতজন শহীদ আছে। আমি বললাম, দুজন। তিনি বললেন, এখন থেকে তিনজন। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। মা হিসেবে নিজেকে অসহায় মনে হতে লাগল। আমি আমার সন্তানের জন্য কিছুই করতে পারিনি।’
জামিলার পরিবারের সদস্যদের বন্দুকের মুখে জিম্মি করে ফেলেন ইসরায়েলি সেনারা। তাঁরা দাবি করেন, পরিবারটি ঘরের ভেতরে অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে। সেগুলোর সন্ধান দিতে চাপ দিতে থাকেন তাঁরা। ঠিক এ সময় ওপরের তলা থেকে একটা গুলির শব্দ ভেসে আসে। সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদের নাম ধরে চিৎকার দিয়ে ওঠেন পরিবারের সদস্যরা।
গুলির শব্দের পরপরই মাহমুদের তীব্র আর্তনাদ শুনতে পান জামিলা। তাঁর বিশ্বাস, ওই আর্তনাদই ছিল তাঁর ছেলের মুখ থেকে বের হওয়া শেষ শব্দ। তিনি বলেন, ওই শব্দ আজও তাঁদের ঘরে বাজে এবং পুরো পরিবারকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
পরিবারটিকে বন্দিদশা থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর ইসরায়েলি সেনারা চলে যান। সঙ্গে নিয়ে যান মাহমুদকে।
জামিলা মাহমুদের রক্তে ভেজা জামা–কাপড় দেখালেন, গুলিতে ছিদ্র হয়ে যাওয়া টি-শার্ট ও প্যান্ট। এগুলো প্রমাণ করে, তাঁর পুরো শরীর গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। সেনারা তাঁকে নগ্ন করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
মাহমুদের বিছানা, কাপড় ও কার্পেটে এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে। হামলার পর থেকে সেগুলো স্পর্শও করা হয়নি। দেয়াল ও জানালার ফ্রেমে গুলির ছিদ্রও রয়ে গেছে।
নাবলুস শহরের মনোবিজ্ঞানী নেসরিন বাশরাত বলেছেন, তিনি বালাতার মায়েদের জন্য একটি সহায়তা গ্রুপ চালান এবং গাজার শিশুদের অনলাইনে থেরাপি দেন। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘অন্য সব মায়ের মতো ফিলিস্তিনি মায়েদেরও মাতৃত্ববোধ আছে। তাঁরা চান না তাঁদের সন্তান মারা যাক।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শরণ র থ শ ব র র পর ব র র সন ত ন পর ব র র ইসর য় ল র জন য মরদ হ
এছাড়াও পড়ুন:
মহাপিণ্ডদান উদ্যাপিত
২ / ৯পূজার সামগ্রী নিয়ে শিশুদের অংশগ্রহণ