‘সত্য, প্রেম ও পবিত্রতা’—এই ব্রতকে ধারণ করেই ১৮৮৯ সালে অশ্বিনী কুমার দত্ত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ। বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতীরে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠান একসময় দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষার বাতিঘর ছিল। শতাধিক বছরের গৌরব, সংগ্রাম ও ইতিহাসের সাক্ষী এই বিদ্যাপীঠ আজ নানা সংকটে। শিক্ষকস্বল্পতা, শ্রেণিকক্ষ ও আবাসনঘাটতি, পরিবহন দুরবস্থা—সব মিলিয়ে ম্লান হয়ে পড়ছে তার ঐতিহ্য।

বিএম কলেজে মোট বিভাগ ২২টি। বর্তমানে ২২টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩২ হাজার। কিন্তু অনুমোদিত ১৯৯টি শিক্ষকের পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ১৬৫ জন। সরকারি মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতিটি বিভাগে ন্যূনতম ১২ জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও বিএম কলেজের কোনো বিভাগেই তা পূরণ হয়নি। ফিন্যান্স বিভাগে শিক্ষক মাত্র দুজন, আর মার্কেটিং বিভাগে একজন। ফলে অনেক বিভাগে তিন-চারজন শিক্ষক দিয়েই পুরো কার্যক্রম চলছে।

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নাইম ইসলাম বলেন, ‘শ্রেণিকক্ষের সংকটের কারণে প্রতিটি বিভাগেই ক্লাস কমিয়ে আনতে হয়। আবার শিক্ষকসংকটের কারণে সিলেবাস শেষ করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।’

ঝুঁকিপূর্ণ আবাসন

কলেজের সবচেয়ে বড় সংকট আবাসন। ৩২ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র আড়াই হাজার ছাত্রাবাসে থাকতে পারেন। ছেলেদের জন্য তিনটি ও মেয়েদের জন্য একটি আবাসন মিলিয়ে আসনসংখ্যা মাত্র ১ হাজার ১৫০টি। সেখানে গাদাগাদি করে থাকছেন প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী। অন্যদের থাকতে হয় বাইরের মেসে, যা ব্যয়বহুল ও অনিরাপদ।

অশ্বিনী কুমার ছাত্রাবাসের ‘এ’ ব্লকের ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে, দেয়াল ও মেঝে নাজুক। শিক্ষার্থী আকবর মোবিন বলেন, ‘আমরা গাদাগাদি করে থাকি, তবু সবচেয়ে বড় ভয় ছাদের। প্রায়ই পলেস্তারা খসে পড়ে। কখন বড় দুর্ঘটনা ঘটবে বুঝি না।’ প্রশাসন এরই মধ্যে হলের দুটি কক্ষ পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে।

ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক হলের টিনশেড অংশও বসবাসের অযোগ্য। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, ফাটল ধরা দেয়াল, নোংরা মেঝে—সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকিপূর্ণ জীবন। অনেক সময় বৃষ্টি নামলে কক্ষে পানি পড়ে, এমনকি বিষাক্ত প্রাণীও ঢুকে পড়ে।

মেয়েদের বনমালী গাঙ্গুলী ছাত্রীনিবাসেও একই অবস্থা। দর্শন বিভাগের ছাত্রী সুবর্ণা খানম বলেন, ‘প্রতিটি শয্যায় দুজন করে থাকতে হয়। খুব কষ্টে দিন কাটে। ছাত্রীনিবাসের পেছনের প্রাচীর ভেঙে গেছে, নিরাপত্তাও নেই।’

মেসে থাকেন ২০ হাজার শিক্ষার্থী

কলেজের ৩২ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র আড়াই হাজার শিক্ষার্থী ছাত্রাবাসে থাকলেও ২০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে মেসে থাকতে হচ্ছে। সেই হিসাবে মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ৭ শতাংশের কিছু বেশি ছাত্রাবাসে থাকতে পারছেন। বাকি ৯৩ শতাংশকে বাইরে থাকতে হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত ব্যয়ের চাপে পিষ্ট হতে হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের।

ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মো.

বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘মেসে থাকতে আমাদের প্রতি মাসে মেস ভাড়া ন্যূনতম দেড় হাজার, খাবার বাবদ ৪ হাজার ৫০০ এবং অন্যান্য মিলিয়ে ৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু ছাত্রাবাসে আসন পেলে প্রতি মাসে আড়াই হাজার টাকায় মাস চলে যেত। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের চাপে পরিবারের হিমশিম অবস্থা।’

একই বিভাগের জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘বাড়ি থেকে মাস শেষে যখন এতগুলো টাকা মা-বাবা পাঠান, তখন তাঁদের জন্য চাপ তৈরি হয়। এতে আমরা কষ্ট পাই।’

আরও পড়ুন৪ সমস্যায় জর্জরিত খুলনার ‘বাতিঘর’ ব্রজলাল কলেজ১৭ অক্টোবর ২০২৫

পরিবহনসংকটে ভোগান্তি

৩২ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য কলেজের বাস মাত্র তিনটি। বাসগুলো চলে বাকেরগঞ্জ, ঝালকাঠি ও গৌরনদী রুটে। শিক্ষার্থীর তুলনায় বাসের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে দরজার রেলিং ধরে ঝুলে যাতায়াত করেন। মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সজীব দাস বলেন, ‘দাঁড়ানোর জায়গাও থাকে না। প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলেজে আসতে হয়।’

অধ্যক্ষ শেখ মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিবহন পুল থাকে, সরকার বাস ও ব্যয়ের বরাদ্দ দেয়। কিন্তু আমাদের বাস কিনতে হয় নিজেদের টাকায়, সব খরচ ছাত্রদের কাছ থেকে নিতে হয়।’

‘প্রয়োজন রাষ্ট্রের আন্তরিক উদ্যোগ’

১৮৮৯ সালের ১৪ জুন সমাজহিতৈষী নেতা অশ্বিনী কুমার দত্তের উদ্যোগে কীর্তনখোলা নদীতীরে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রজমোহন কলেজ। ব্রজমোহন দত্তের স্মৃতিকে ধারণ করে নামকরণ হয় কলেজটির। অশ্বিনী কুমার দত্ত ছিলেন শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ও রাজনীতিবিদ। নারীশিক্ষা বিস্তার, স্বদেশি আন্দোলন ও কুসংস্কারবিরোধী প্রচারে তিনি ছিলেন অগ্রণী। তাঁর স্বপ্ন থেকেই জন্ম নেয় বিএম কলেজ, যা পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠে দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে এখন সেই গৌরব হারাতে বসেছে।

অধ্যক্ষ শেখ মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা বেহাল অবস্থায় আছি। এসব সংকট নিরসনে অন্তত ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রয়োজন। কিন্তু তেমন বরাদ্দ নেই।’

প্রায় ৬০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে এখনো ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যের ছাপ। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর নাগলিঙ্গমে ঘেরা এই প্রাঙ্গণ একসময় ছিল জ্ঞানচর্চা, রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। এখানকার প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ, যিনি এখানে শিক্ষকতাও করেছেন। কিন্তু আজ সেই ঐতিহ্যের প্রাঙ্গণ ‘মলিন’। ভবনের ছাদ থেকে পলেস্তারা ঝরে পড়ছে, দেয়ালে ফাটল ধরেছে, শ্রেণিকক্ষে জায়গা না থাকায় পাঠদানের পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে।

বিএম কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম নারী বিভাগীয় প্রধান এবং মহিলা পরিষদের বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, ‘বিএম কলেজ কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল চেতনার প্রতীক। শতবর্ষী ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে এখন প্রয়োজন রাষ্ট্রের আন্তরিক উদ্যোগ।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ৩২ হ জ র ম বল ন র জন য কল জ র

এছাড়াও পড়ুন:

একটা মানুষ কীভাবে এতটা সুখী হয়, জায়েদ খানকে নিয়ে জয়

আলোচিত অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয়। তার এই পরিচয় এখন খানিকটা আড়ালেই পড়ে গেছে। কারণ বিতর্কিত সঞ্চালক হিসেবে লাইমলাইটে থাকেন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভীষণ সরব জয়। এই মাধ্যমে সমকালীন নানা বিষয় নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে দেখা যায় তাকে। এবার জয় জানালেন, আলোচিত চিত্রনায়ক জায়েদ খানকে ‘হিংসা’ করেন তিনি।

জয় তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। তাতে দেখা যায়, সংগীতশিল্পী প্রতীক হাসান গান গাইছেন। আর গানের সঙ্গে চুটিয়ে নাচছেন জায়েদ খান। এ ভিডিওর ক্যাপশনে জয় তার ভালো লাগার অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন।   

আরো পড়ুন:

গিফট নিয়ে হয়ে গেলাম প্রতারক: তানজিন তিশা

ভোটের মাঠে অভিনেতা তারিক স্বপন

জয় বলেন, “উনি কোন অপরাধে অপরাধী কিংবা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য সেটা আমি জানতে চাই না। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখি, একটা মানুষ কীভাবে এতটা সুখী হয়? দলমত এবং পলিটিক্সের ঊর্ধ্বে ছোট্ট জীবনে মানুষের এই সুখকে আমি উপভোগ করি। পাশাপাশি হিংসাও করি।” 

হিংসা করার কারণ ব্যাখ্যা করে জয় বলেন, “আমার বিবেক বুদ্ধি এবং সংবেদনশীলতা আমাকে এরকম আনন্দ করতে দেয় না। আমি আমার বিবেক-বুদ্ধি এবং সংবেদনশীলতা সবকিছুকেই তুচ্ছ মনে করি, যখন তার এই আনন্দ দেখি। ভালো থাকেন ভাই।” 

জায়েদ খানের উদ্দে জয় বলেন, “আপনার দ্বারা যেন কারো ক্ষতি না হয়। বিনোদন দিয়ে যান এভাবেই। বাঙালির বিনোদনের বড় অভাব। যে কোনো একটা উপলক্ষ্যকে পেলে টেনেহিঁচড়ে বড় করে, তারা উপভোগ করার জন্য খুব চেষ্টা করে। কিন্তু আসলে কি তা উপভোগ্য হয়?”

ঢাকা/শান্ত

সম্পর্কিত নিবন্ধ