শরীয়তপুরে আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপিপন্থীরা জয়ী, অংশ নিতে বাধা আওয়ামীপন্থীদের
Published: 13th, February 2025 GMT
শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপি–সমর্থিত আইনজীবীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাধার মুখে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত আইনজীবীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি বলে অভিযোগ উঠেছে।
গতকাল বুধবার আইনজীবী সমিতির মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১৫টি পদে বিএনপি–সমর্থিত প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল না করায় তাঁদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এতে জেলা বিএনপির সহসভাপতি জাহাঙ্গীর আলম সভাপতি ও জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক কামরুল হাসান সাধারণ সম্পাদক হন।
আইনজীবী সমিতি সূত্রে জানা গেছে, ২২ ফেব্রুয়ারি জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সেই অনুযায়ী গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। জেলা আইনজীবী সমিতির সম্মেলনকক্ষে নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা সকাল ১০টা হতে বেলা ২টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা নেন। যাঁরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তাঁদের সেখানে গিয়ে কমিশনের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাধার মুখে অন্য কেউ মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি।
আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল সকাল থেকে আইনজীবী সমিতির ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তাঁরা সমিতিতে প্রবেশের সব রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন। অভিযোগ ওঠে, বিএনপির একটি পক্ষ সমিতির সব সিসিটিভি ক্যামেরা খুলে নিয়ে গেছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় আওয়ামী লীগ–সমর্থিত সভাপতি প্রার্থী হানিফ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী আলমগীর হোসেন হাওলাদারকে সমিতি ভবনে তাঁদের কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখে ওই পক্ষ।
আইনজীবী সমিতির বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কাছে খবর ছিল, আওয়ামী লীগ–সমর্থিত আইনজীবীদের নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না। তাঁরা বিষয়টি নির্বাচন কমিশন, জেলা প্রশাসক, জেলা ও দায়রা জজ, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার ও সেনাবাহিনীকে লিখিতভাবে দুদিন আগেই জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো পক্ষই সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। ওই সুযোগে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সমিতির ক্যাম্পাস দখল করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন।
আওয়ামীপন্থী সভাপতি প্রার্থী ও বর্তমান কমিটির সভাপতি হানিফ মিয়া বলেন, ‘আমাদের বাধা দিতে পারে, এমন তথ্য জেনে সকালেই সমিতিতে প্রবেশ করি। এরপর বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা আমাদের ভবন থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। দীর্ঘ সময় আমাদের চেম্বারে অবরুদ্ধ করে রাখেন। নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি অনৈতিক ও অবৈধ হয়েছে। ভোটাধিকার হরণ করায় সাধারণ আইনজীবীরা এ ঘটনা পছন্দ করেননি।’
সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী আলমগীর হোসেন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে চেম্বারে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়, যাতে আমি মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারি। সকালে আমাদের এক আইনজীবীকে মারধর করা হয়। এরপর আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। সমিতি প্রতিষ্ঠার পর এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি।’
এ বিষয়ে কথা বলতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম ও সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসানের চেম্বারে গিয়ে তাঁদের পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে কল করলে ‘আদালতে ব্যস্ত আছেন, এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন’ বলে জাহাঙ্গীর আলম ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। আর কামরুল হাসান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিরাজুল হক আকন প্রথম আলোকে বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হয়েছে। কোনো পক্ষ বাধা দিয়েছে, এমন অভিযোগ কেউ করেননি। আইনজীবী সমিতির ক্যাম্পাসের বাইরে কী ঘটেছে, তাঁরা বলতে পারবেন না।
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটেছে, এমন তথ্য তাঁদের কাছে নেই। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বিধি মেনে আদালত এলাকার অদূরে পুলিশ মোতায়েন করা ছিল।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এনপ র ন ত সমর থ ত আইনজ ব আম দ র আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
ভিন্ন পরিবেশে নির্বাচন, সবারই প্রথম অভিজ্ঞতা
এই ভোটারেরা আগে কখনো ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করেননি। প্রার্থীরও যেতে হয়নি ভোটারের দুয়ারে। আর যাঁরা নির্বাচনটি আয়োজন করবেন, তাঁদেরও কোনো ‘অভিজ্ঞতা’ নেই। অর্থাৎ ভোটার, প্রার্থী ও নির্বাচন কমিশনে যুক্ত সবারই এবার প্রথম অভিজ্ঞতা হবে। কেননা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হয়নি ৩৫ বছর ধরে।
আগামী ১২ অক্টোবর সপ্তমবারের মতো চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন ক্যাম্পাসে চলছে নির্বাচনী আলোচনা। ইতিমধ্যে প্রায় ১ হাজার শিক্ষার্থী নির্বাচনে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র কিনেছেন। প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে তিনটি। এখন ক্যাম্পাসের রেলস্টেশন থেকে বুদ্ধিজীবী চত্বর, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেন—সব খানেই শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি। তাঁদের প্রশ্ন, ভিপি হবেন কে?
ভিপি কে হবেন, তা জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে চাকসুর কাছে প্রত্যাশা কী, এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল ২০ শিক্ষার্থীকে। তাঁরা বলছেন, চাকসু হবে ছাত্ররাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। আগের মতো হানাহানি, সংঘর্ষ তাঁরা চান না। কোনো নির্দিষ্ট সংগঠনের একক আধিপত্যও তাঁরা মেনে নেবেন না। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে যাঁরা কাজ করতে চাইবেন, তাঁরা নির্বাচিত হবেন চাকসুতে। চাকসুর মাধ্যমে শিল্প, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিতর্কসহ নানা ধরনের কার্যক্রম চলবে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, আবাসন ও পরিবহন-সংকট, হলে হলে নিম্নমানের খাবার সরবরাহসহ এমন গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যু উঠে নির্বাচনী আলোচনায় আসবে। যেসব প্রার্থী ও প্যানেল শিক্ষার্থীবান্ধব ইস্যু ইশতেহারে আনবে, তাঁরাই ভোটের মাঠে এগিয়ে যাবে।যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী এখলাস বিন সুলতান কিছুটা ক্ষুব্ধ, আবার আনন্দিতও। হিসাব অনুযায়ী, তাঁর অন্তত চারবার চাকসু নির্বাচনে ভোট দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একবারও দিতে পারেননি। এখলাস বলেন, ‘প্রতিবছর চাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। স্নাতকোত্তর পর্যন্ত অন্তত চারটি নির্বাচনের সাক্ষী হতাম। তবু শেষ সময়ে এসে একটা নির্বাচন অন্তত পাচ্ছি, এতেই আনন্দিত। আশা করব, প্রতিবছর নির্বাচন হবে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালে। এরপর প্রথম চাকসু নির্বাচন হয় পাকিস্তানের সামরিক সরকারের আমলে, ১৯৭০ সালে। চাকসুতে এখন পর্যন্ত ৬টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনটি হয় ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এরপরে আর নির্বাচন আয়োজন করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মূলত ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে কোন্দল, মুখোমুখি অবস্থান ও সরকারের সদিচ্ছার অভাবে নির্বাচন আয়োজন হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবছর চাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। স্নাতকোত্তর পর্যন্ত অন্তত চারটি নির্বাচনের সাক্ষী হতাম। তবু শেষ সময়ে এসে একটা নির্বাচন অন্তত পাচ্ছি, এতেই আনন্দিত। আশা করব, প্রতিবছর নির্বাচন হবে।এখলাস বিন সুলতান, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা-কর্মীরা নির্বাচনে অংশ নিতে প্যানেল গঠন করেছেন। তাঁদের প্যানেলের নাম ‘দ্রোহ পর্ষদ’। এখান থেকে ভিপি প্রার্থী হয়েছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ। নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এত বছর নির্বাচনের আয়োজন না করে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। আশা করব, প্রশাসন প্রতিবছরই নির্বাচনের আয়োজন করবে।’
মাস তিনেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়েছেন জিহাদ আরাফাত। ভর্তি হয়েই চাকসু নির্বাচনের আমেজে উচ্ছ্বসিত তিনি। এমনকি কেন্দ্রীয় সংসদের ভিপি পদে লড়তে মনোনয়নপত্রও কিনেছেন। জিহাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভর্তি হয়েই চাকসু নির্বাচন পেলাম। আমার আগে হাজারো শিক্ষার্থী পাট চুকিয়ে বের হয়েছেন। কারও প্রার্থী বা ভোটার হওয়ারও সুযোগ হয়নি। আমি আসলে ভাগ্যবান।’
যে কারণে ভিন্ন পরিবেশ
এক দশক ধরে ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রাখা ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) নেতা-কর্মীরা এখন ক্যাম্পাসে নেই। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। তাঁদের দাপটও শেষ হয়ে যায়। ক্যাম্পাসে একের পর এক সংঘর্ষ, মারামারি, হল দখল, চাঁদাবাজি, নির্মাণকাজ আটকে দেওয়ার মতো ঘটনায় বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
ছাত্রলীগের ‘চাপে’ ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বাম সংগঠনগুলো এত দিন কোণঠাসা ছিল। হামলা ও মামলায় ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারেননি। তবে গত বছরের পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে গেছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাঁদের বিদায়ের পর ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। ব্যস্ততা বেড়েছে ছাত্রদলেরও। বাম সংগঠনগুলোও বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে ক্যাম্পাসে সরব আছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, আবাসন ও পরিবহন-সংকট, হলে হলে নিম্নমানের খাবার সরবরাহসহ এমন গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যু উঠে নির্বাচনী আলোচনায় আসবে। যেসব প্রার্থী ও প্যানেল শিক্ষার্থীবান্ধব ইস্যু ইশতেহারে আনবে, তাঁরাই ভোটের মাঠে এগিয়ে যাবে।
ভিন্ন পরিবেশে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সব ধরনের প্রস্তুতি আছে বলে জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ সময় পর গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নির্বাচনী আচরণবিধিও প্রকাশ করা হয়েছে। ভোটার তালিকাও প্রকাশিত হয়েছে। তফসিল অনুযায়ী সব প্রক্রিয়া নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজনের জন্য যা যা করণীয়, সবই পালন করা হবে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এবার মোট ভোটার ২৭ হাজার ৬৩৭ জন। গত রোববার থেকে শুরু হয়েছে মনোনয়নপত্র বিতরণ। গতকাল ছিল সংগ্রহের শেষ দিন। এদিন প্রায় ১ হাজার শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় ও হল সংসদের জন্য মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। মনোনয়নপত্র আজ বুধবার পর্যন্ত জমা দেওয়া যাবে। যাচাই-বাছাই হবে ১৮ সেপ্টেম্বর। প্রার্থীর প্রাথমিক তালিকা প্রকাশিত হবে ২১ সেপ্টেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৩ সেপ্টেম্বর। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হবে ২৫ সেপ্টেম্বর।