জাকারিয়ার বয়স মাত্র ১১ বছর এবং গাজায় থাকে সে। উপত্যকাটিতে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর এরই মধ্যে শিশুটি হাজারো মানুষের মরদেহ দেখে ফেলেছে। আর সেই কথাই স্মরণ করছিল সে।

কিন্তু জাকারিয়া এমন এক বয়সে এত মানুষের মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছে, যখন তার স্কুলে যাওয়ার কথা। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া গাজায় এখনো হাতে গোনা যে কয়টি হাসপাতাল চালু আছে, তারই একটি আল–আকসায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছে সে।

ইসরায়েলি হামলায় আহত ব্যক্তিদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সগুলো গাজার মধ্যাঞ্চলীয় দেইর আল–বালাহর ওই হাসপাতাল অভিমুখে ছুটে এলে জাকারিয়াও দৌড়ে যায়। আহত ব্যক্তিদের যাতে দ্রুত হাসপাতালে প্রবেশ করানো ও চিকিৎসা শুরু করা যায়, সে জন্য মানুষের ভিড় সরিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আসার পথ করে দেয়।

অ্যাম্বুলেন্স থেকে আহত ব্যক্তিদের নামানোর পরপরই আবারও ছোটাছুটি শুরু হয় জাকারিয়ার। রোগীবাহী স্ট্রেচার নিয়ে হাসপাতালের বারান্দা দিয়ে জরুরি বিভাগের দিকে দৌড় দেয়।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জাকারিয়ার বেশ কয়েকজন স্কুলবন্ধু নিহত হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালের আশপাশে ঘোরাঘুরি করায় মর্মান্তিক অনেক দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছে জাকারিয়া। সেই কথা বলছিল সে, একদিন ইসরায়েল হামলা চালানোর পর জাকারিয়া চোখের সামনে এক বালককে পুড়ে মরতে দেখেছে।

ফিলিস্তিনি শিশু জাকারিয়া বলেছে, ‘আমি অন্তত পাঁচ হাজার মরদেহ দেখেছি। আমি নিজের চোখে তাদের দেখেছি।’

আমি অন্তত পাঁচ হাজার মরদেহ দেখেছি। আমি নিজের চোখে তাদের দেখেছি। —জাকারিয়া, ফিলিস্তিনি শিশু

‘গাজা: হাউ টু সার্ভাইভ এ ওয়ারজোন’ (গাজা: যুদ্ধক্ষেত্রে কীভাবে বেঁচে থাকা যায়) শীর্ষক তথ্যচিত্র তৈরি করতে বিবিসি যেসব শিশু–কিশোরের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, জাকারিয়া তাদের একজন।

গাজায় ১৬ মাস আগে ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর সেখানে প্রবেশ ও স্বাধীনভাবে সংবাদ সংগ্রহ করার ওপর ইসরায়েলের বিধিনিষেধ থাকায় বিবিসির দুজন প্রতিবেদক লন্ডন থেকে তথ্যচিত্রটি পরিচালনা করেছেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি দেখা যাবে তথ্যচিত্রটি।

তথ্যচিত্রের জন্য ছবি ও সাক্ষাৎকার জোগাড় করতে গাজায় বসবাসকারী দুজন আলোকচিত্রীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বার্তা আদান–প্রদানের বিভিন্ন অ্যাপস, ইন্টারনেট ও মুঠোফোনে তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়।

ভয়ানক লড়াই–সংঘাতের মধ্যে গাজার মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম তুলে ধরা হয়েছে এ তথ্যচিত্রে। কয়েক সপ্তাহ আগে, যে দিনটিতে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়, সেদিনই এটির দৃশ্যায়নের কাজ শেষ হয়েছে।

‘গাজা: হাউ টু সার্ভাইভ এ ওয়ারজোন’ (গাজা: যুদ্ধক্ষেত্রে কীভাবে বেঁচে থাকা যায়) শীর্ষক তথ্যচিত্র তৈরি করতে বিবিসি যেসব শিশু-কিশোরের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, জাকারিয়া তাদের একজন।

তথ্যচিত্রে তিন শিশু ও এক তরুণ বয়সী মায়ের ওপর মনোযোগ দেওয়া হয়। এ মায়ের এক নবজাতক সন্তান রয়েছে। তাদের বেছে নেওয়ার কারণ হলো, গাজাযুদ্ধে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিযুক্ত নিরীহ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী তারা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতায় সই হওয়া একটি চুক্তির অধীন গত ১৯ জানুয়ারি হামাস–ইসরায়েল ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালান ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের যোদ্ধারা। ইসরায়েলের দাবি, হামলায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান তাঁরা। অন্যদিকে, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য, এ উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার ২০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন এবং আহত মানুষের সংখ্যা লক্ষাধিক।

বিবিসি ভেরিফাইয়ের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, তথ্যচিত্রটির নির্মাতারা মূলত দক্ষিণ ও মধ্য গাজার একটি এলাকা থেকে চিত্রগ্রহণ করেছেন; যা ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ‘মানবিক অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। নিরাপত্তার জন্য এ এলাকায় ফিলিস্তিনিদের যেতে বলেছিল ইসরায়েল। অথচ ২০২৪ সালের মে মাস থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এ নিরাপদ অঞ্চলেই শতবার হামলা চালিয়েছে দেশটি। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর দাবি, সেখানে সক্রিয় হামাস যোদ্ধাদের নিশানা করেছে তারা।

তথ্যচিত্রে জানার চেষ্টা করা হয়েছে, যুদ্ধের মধ্যে গাজার শিশুরা কীভাবে খাবার জোগাড় করে, কোথায় ঘুমাবে তা ঠিক করে ও বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিজেদের কীভাবে ব্যস্ত রাখে সেসব বিষয়। আল–আকসা হাসপাতালের চিকিৎসাকর্মীরাই–বা কীভাবে আহত ব্যক্তিদের বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম করেছেন, তা–ও দেখানো হয়েছে তথ্যচিত্রে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, এটিই মধ্য গাজার একমাত্র সচল হাসপাতাল।

এ হাসপাতালেই সন্ধান পাওয়া যায় শিশু জাকারিয়াকে। হাসপাতালটিতে কর্মরত সবাই তাকে চেনেন। এখনো জাকারিয়া শিশু, সে কোনো চিকিৎসাকর্মী নয়। কিন্তু হাসপাতালে সর্বক্ষণ ঘোরাঘুরি করে। অপেক্ষায় থাকে, যদি কাউকে সহায়তা করার সুযোগ পাওয়া যায়, বিনিময়ে কিছু খাবার বা অর্থকড়ি জোটে।

ইসরায়েলি হামলায় ঘরবাড়ি হারিয়ে ধ্বংসস্তূপের মাঝে শিশুসন্তানকে নিয়ে বসে আছেন এক ফিলিস্তিনি নারী। ফিলিস্তিনের গাজায়.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র মরদ হ দ খ ইসর য় ল

এছাড়াও পড়ুন:

ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ

এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।

ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।

‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।

খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।

এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী

ডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।

প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।

পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।

ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।

নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউব

ইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।

ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।

ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।

২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।

মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ