ফেরদৌসী রহমান বাংলাদেশের সংস্কৃতিজগতের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি গান গেয়েছেন। চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন। আবার বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘এসো গান শিখি’ নামের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কয়েক প্রজন্মের মানুষকে সংগীতে প্রথম হাতেখড়ি দিয়েছেন। বহু শিল্পীর প্রথম গুরু তিনি।
এ বছরের ৪ জুন যখন ফেরদৌসী রহমানের ভিডিও সাক্ষাৎকার ‘ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো’র জন্য তাঁর কাছে যাই, তাঁর বিনয়সুন্দর কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছি। ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠান তিনি করতে চাননি। যখন তিনি ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠান করছেন, তখনো তিনি নিজেকে মনে করছেন ছাত্রী, এখনো তিনি নিজেকে মনে করেন ছাত্রী। ১৯৪১ সাল থেকে ২০২৫। ৮৪ পেরিয়ে গেল এই ২৮ জুনে।
এতটা বছরের সফল শিল্পীজীবন। কোচবিহারে জন্ম, ঢাকার সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্সের ছাত্রী ছিলেন। বাংলাবাজার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন।
দুই–আড়াই বছরে মায়ের কোলে বসে গান গাইতেন, সেই স্মৃতি তিনি ভোলেননি। বললেন, দুই বছর কি আড়াই বছর হবে আমার। ঘুম পেলে আমি মায়ের কাছে গিয়ে ‘আঁখি পাতা ঘুমে জড়ায়ে আসে’ গানটা গাইতাম।
তাঁর পিতা বাংলা গানের কিংবদন্তি আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তাঁর কাছে গান শেখা শুরু করেন একেবারে ছোটবেলায়। সেই সব স্মৃতি মনে করতে পারেন ফেরদৌসী রহমান, ‘তখন আব্বার কোলে বসতাম, আর “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে”, তারপর “ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ”—এসব গান তিন ভাইবোনকে নিয়ে আব্বা গাইতেন। আর পাশে মা বসে থাকতেন। তারপর এসব গান যখন শেষ হতো, তখন মাকে আব্বা বলতেন, “আলেয়া, তুমি গান করো।” তখন মা শুরু করতেন, “রাতের ময়ূর ছড়াল যে পাখনা”—এসব গান।’
ছয় বছর বয়সে প্রথম মঞ্চে গান করেন ফেরদৌসী রহমান। তাঁর মুখে সেদিনের কথা: ‘সেটা ছিল কলকাতায় মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে। সেখানে বিরাট বড় অনুষ্ঠান, আব্বাকে গান গাইতে হবে। সেই সময় যেহেতু একটু একটু করে আমি গাইতাম, তাই কোথাও গান হলে আব্বা আমাকে বগলদাবা করে নিয়ে যেতেন। কিছুটা গর্ব হতো, মজা লাগত বোধ হয়! মেয়েকে দিয়েও গাওয়াবেন আরকি। তখন আব্বা আমাকে ও রকম একটা অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলেন। আমি গিয়ে দেখি হলভর্তি লোকে লোকারণ্য। তার মধ্যে আব্বা বলছেন, “মাগো, তোমাকে একটা গান গাইতে হবে।” আমি বলি, “না”, আব্বা বলেন, “হ্যাঁ, চলো।” মজা করতে করতে নিয়ে এলেন স্টেজে। তারপর এল মাইক্রোফোন। তারপর দেখা গেল যে আব্বা পাশে টেবিলে হারমোনিয়াম নিয়ে বাজাবেন আর আমি গাইব। তো আমি গাইব কোনটা? খুব একটা রোমান্টিক গান, “শুধু কাঙালের মতো চেয়েছিল তার মালাখানি”। আমি এতটুকুন, মাইক্রোফোন অনেক ওপরে। তখন আরেকটা লোক পাশ থেকে টেবিল নিয়ে এল, এসে আমাকে টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর গাইলাম, “শুধু কাঙালের মতো চেয়েছিল।” গানের পরে তালি থামেই না.
টেলিভিশনে প্রথম গাইলেন ১৯৬৪ সালে। গান শিখেছেন আবদুল আহাদসহ বড় শিল্পীদের কাছে। ১৯৬৩ সালে তিনি সংগীতে ইউনেসকো ফেলোশিপ লাভ করেন এবং লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিকে ছয় মাস ধরে স্টাফ নোটেশন শেখেন। ১৯৬৬ সালে বিয়ে হলো প্রকৌশলী রেজাউর রহমানের সঙ্গে।
এরপর আরও কত গান করেছেন। আধুনিক গান। সিনেমার গান। প্রথম সিনেমার গান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রথম ছবি আসিয়া এখানে তৈরি হয়। এর পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন নাজির আহমেদ। একটা ডুয়েট গান ছিল, “দেওয়ায় করছে মেঘ–মেঘালি...”। আমি আর আব্বাসী ভাই সেটা করলাম। ওই গানই প্রথম। তারপর “ও মোর কালারে কালা”।’ নোলক ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ রেডিওতে অবিরাম বাজত আর ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের আনাচকানাচে। স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন, একুশে পদক পেয়েছেন, পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার, পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা। তারপরও তিনি বলেন, তিনি এখনো শিখছেন। এখনো ছাত্রী।
২০২৪-এ হারিয়েছেন জীবনসঙ্গীকে। দুই ছেলে প্রবাসী।
কিন্তু এখনো ফেরদৌসী রহমান সবচেয়ে বেশি মনে করেন তাঁর বাবাকে। যে বাবাকে তিনি হারিয়েছেন ১৮ বছর বয়সে, ১৯৫৯ সালে। পরে যখনই তিনি পুরস্কার পেয়েছেন, বড় অনুষ্ঠানে গেয়েছেন, প্রথমেই তাঁর মনে পড়ত তাঁর বাবার কথা। এখনো, এই ৮৪ বছর বয়সে তিনি সবচেয়ে বেশি মনে করেন বাবার কথা। ৬৬ বছর আগে যে পিতা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁর কথা স্মরণ করে ফেরদৌসী রহমান উদাস হয়ে পড়েন।
আর তাঁর মন চলে যায় কোচবিহারে। যতবারই বলুন কোথায় যাবেন, ‘কোচবিহারে যাব। বলরামপুর যাব, আমার দাদার বাড়িতে ওই পুকুরে মাছ ধরব। সেই যে বর্ষাকালে জল কেটে দেওয়া হতো আর সব মাঠে মাছ চলে আসত। ওগুলো খুব ছোটবেলার স্মৃতি।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন প রস ক র রহম ন ত রপর প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
রাজকীয় ভোজে ট্রাম্প–মেলানিয়াকে কী কী খাওয়ালেন রাজা চার্লস
জমকালো সাজে সেজেছে যুক্তরাজ্যের উইন্ডসর ক্যাসলের সেন্ট জর্জেস হল। উপলক্ষটাও অনন্য, রাজকীয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সস্ত্রীক যুক্তরাজ্য সফর উপলক্ষে এখানে রাজকীয় নৈশ্যভোজ আয়োজন করেন রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি ক্যামিলা।
বুধবার রাতের রাজকীয় এ আয়োজনে কূটনীতি, খাবার, ঐতিহ্য, সংগীত আর আভিজাত্য একসুতোয় বাঁধা পড়েছিল। ট্রাম্প–মেলানিয়াসহ রাজার অতিথি হয়েছিলেন বিশ্বের ১৬০ জন গণমান্য ব্যক্তি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্মানে রাজা তৃতীয় চার্লসের আয়োজন করা রাজকীয় ভোজের টেবিল। যুক্তরাজ্যের উইন্ডসর ক্যাসলের সেন্ট জর্জেস হল, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫