পারমাণবিক শক্তির অধিকারী নয় সার্কের এমন সদস্য দেশ, যারা ভারতের চারপাশে অবস্থিত তারা হলো– বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ। এ দেশগুলো কাশ্মীরসৃষ্ট সংকটে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় আরও কোনঠাসা হয়ে পড়বে। এর ফলে সার্ক ঘিরে আঞ্চলিক সহযোগিতা আরও অচলাবস্থার মুখে পড়বে।


দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য ছোট দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ। সেখানে সম্প্রতি ভারতসমর্থিত শেখ হাসিনা সরকারকে সরিয়ে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, যারা ব্যাপক মেরূকরণ সামাল দিচ্ছে। সেখানে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট অনেক বেশি। এর পেছনে কাজ করছে ভারতের হস্তক্ষেপ ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় প্রদান। অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক ‘ম্যান্ডেট’ কম। তারা নাগরিক সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশের কাছ থেকে আরও বেশি জাতীয়তাবাদী ও ভারতবিরোধী অবস্থান গ্রহণের জন্য ব্যাপক চাপে পড়বে। একইসঙ্গে ভারত হয়তো বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি কূটনৈতিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করবে, যা ঢাকাকে অধিকতর ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। 


শ্রীলঙ্কার সরকার মনে হচ্ছে সতর্ক নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করবে, যদিও নীরবে ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা অবস্থানকে সমর্থন করবে। তবে কাশ্মীর সংঘাতের তীব্রতা বাড়লে শ্রীলঙ্কার মুসলিম কমিউনিটিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, বিশেষত যদি বিষয়টি মুসলিম জনগোষ্ঠীর দমনপীড়নের অংশ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। এসব অভ্যন্তরীণ গতিপ্রকৃতি সেই সরকারকে অস্থিতিশীল করে দিতে পারে, যারা ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে। 


নেপাল চাইবে ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে, কিন্তু নেপালের নিরপেক্ষতাকে ভারত সন্দেহের চোখে দেখবে। ভূমিসংক্রান্ত বিবাদ ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কাঠমান্ডুর অবস্থানের কারণে উবয় দেশের মধ্যে এমনিতেই উত্তেজনা চলছে। এর মধ্যে আরও কূটনৈতিক চাপ নেপালকে নাজুক করে ফেলতে পারে। ভারতে নেপালের বড় শ্রমশক্তিও তার অর্থনৈতিক নির্ভরতার প্রতীক, যা নেপালকে বিবেচনায় নিতে হবে।


ভুটান সম্ভবত নীরবে ভারতকে সমর্থন করবে, কারণ ভারতের সঙ্গে দেশটির গভীর কৌশলগত চুক্তি আছে। তবে, ভারতীয় সামরিক তৎপরতা কমলে চীন বিবদমান উত্তর সীমান্তে কার্যক্রম জোরদার করতে পারে। এদিকে কাশ্মীর সংকট উত্তেজনা বাড়ালে মালদ্বীপে ইসলামী সেন্টিমেন্ট বাড়তে পারে। কৌশলগত পর্যায়ে ভারত মহাসাগরে সামরিকায়ন বেড়ে গেলে তা মালদ্বীপের পরিসর সংকীর্ণ করে ফেলতে পারে। 
সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, কাশ্মীর সংকট আঞ্চলিক যূথবদ্ধতা কঠিন করে তুলবে। এতে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন হ্রাস পাবে এবং দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিহীন রাষ্ট্রগুলোর নিরপেক্ষতায় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবাদ বেড়ে যাবে।

তাছাড়া এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলেও প্রভাব ফেলবে। চীনের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টায় ভারতকে মূল শক্তি হিসেবে দেখে ওয়াশিংটন, বিশেষত কোয়াডের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। ভারত-পাকিস্তানের প্রলম্বিত সংকট ভারতের কৌশলগত মনোযোগকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে পশ্চিম সীমান্তে সরিয়ে দেবে। এতে অঞ্চলটিতে নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে ভারতের ভূমিকাও সীমিত করবে।


রুদাবেহ শহিদ: আটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া সেন্টারের অনাবাসিক ফেলো; আটলান্টিক কাউন্সিল থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক


 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অবস থ ন ক শলগত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

যুক্তরাষ্ট্র জড়ালেও যুদ্ধের ফল অনিশ্চিত

ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক অস্ত্র কর্মসূচিতে ইসরায়েলের হামলায় দীর্ঘ মেয়াদে কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ হামলায় আগামী দিনগুলোতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যদি ট্রাম্প প্রশাসনকে যুক্ত করতে পারেন, তবু এমন সম্ভাবনা ক্ষীণই থেকে যাবে।

গতকাল শনিবার দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে। কূটনীতিক, সামরিক বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল ও এর প্রধানমন্ত্রী প্রচারণায় ক্রমবর্ধমান প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে পারেন। আর এসবের মধ্যেই পুরো অঞ্চল বিপজ্জনকভাবে অস্থিতিশীল হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিভেদকারী বিশাল বোমা ব্যবহারের ফলেও পাহাড়ের গভীরে তৈরি ইরানের ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ বাড়ছে। প্রশ্ন উঠছে, ইসরায়েলের দূরপাল্লার আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা নিয়েও। 

বিশেষজ্ঞরা ইরানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের আভিযানিক সাফল্য এবং তেহরানে শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন ও তার পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসের কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে পার্থক্য করছেন।

 লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক টবি ডজ বলেন, ‘ইসরায়েলে জন্মলগ্ন থেকে একটি শক্তিশালী প্রবণতা আছে, যা তাদের রাজনীতিবিদদের কাছে এ বার্তা দিয়েছে যে, সহিংসতা (মূলত আগ্রাসন) রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দেবে। আমার মনে হয়, ইরানের শাসন ব্যবস্থা যতটা বলা হয়েছে, তার চেয়েও স্থিতিশীল। আর যেহেতু প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ ও পরমাণু বিস্তারের প্রতি ইরানের দীর্ঘ প্রতিশ্রুতির ইতিহাস আছে, তাই বোমা দিয়ে এটি দূর করা সম্ভব নয়।’

বিশ্লেষকরা ইসরায়েলের কৌশল নিয়েও বিভ্রান্ত। এ ছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন অত্যন্ত অসম্ভাব্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে যোগদানের জন্য চাপ দেওয়ার আশায় সংঘাত শুরুর কৌশলও এক ধরনের জুয়া বলে মনে করছেন তারা। ইসরায়েলের প্রত্যাশা, যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানে হামলায় জড়াতে পারলে তাদের বাঙ্কার ধ্বংসকারী বোমার অভাব পূরণ হবে।
বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন, ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনার উপরিভাগ কঠিন পাথর দ্বারা আচ্ছাদিত। এ কারণে স্থাপনা ধ্বংস করতে হয়তো বেশ কয়েকটি বোমা ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে। এটি একটি জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান হতে হবে, যার সাফল্যের নিশ্চয়তাও নেই। ফলে ইরান ওই অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটির বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা শুরু করতে পারে। সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত তীব্রতর হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।

ইসরায়েলে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল সি কার্টজার ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একজন অভিজ্ঞ সদস্য স্টিভেন এন সাইমন এ সপ্তাহে ফরেন অ্যাফেয়ার্সে লেখেন, ফর্দোতে হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের নজরে পড়বে। ইরান প্রায় নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করে প্রতিশোধ নেবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রও প্রতিশোধ নিতে বাধ্য হবে। তিনি বলেন, পরে যা অবশিষ্ট থাকবে তা হলো, ইরানের শাসন ব্যবস্থার নেতৃত্বদানকারীরা। এতে যুক্তরাষ্ট্র আবার শাসন পরিবর্তনের ব্যবসায়ে নেমে পড়বে। এটি এমন এক ব্যবসা, যেখানে খুব কম মার্কিনিই জড়িত থাকতে চান।
ইসরায়েলের কর্মকর্তারা মনে করেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যার মাধ্যমে তারা শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারবেন। এ নিয়ে ইতোমধ্যেই ওই অঞ্চলে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। ইরাকের ধর্মগুরু গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আলি আল-সিস্তানি এক বিরল বার্তায় মধ্যপ্রাচ্যের গভীর বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যুক্তরাষ্ট্র জড়ালেও যুদ্ধের ফল অনিশ্চিত