মূল্যস্ফীতির চাপ বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৪ লাখ টাকা করা উচিত
Published: 10th, May 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ২ জুন বাজেট ঘোষণা করে অর্থবিল উপস্থাপন করবে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এর মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, স্থানীয় ও বিদেশি উভয় উৎস থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণ, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের উন্নতি, করনীতির উন্নতি ও আর্থিক এবং অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা, সুশাসন নিশ্চিত করা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এই চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে আমরা আয়কর আইনে পরিবর্তন আশা করছি।
উল্লেখযোগ্য আয়কর প্রস্তাবনা১.ব্যক্তিগত আয়কর:
অব্যাহত মূল্যস্ফীতির চাপ এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের কম প্রকৃত আয় বিবেচনা করে ব্যক্তিগত করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা এক লাখ টাকা বাড়িয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা করা যেতে পারে। এ ছাড়া এই সীমা প্রবীণ নাগরিক ও মহিলাদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রথম স্তরে ৩ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ করারোপ করা যেতে পারে। যা বর্তমানে ১ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ। চিকিৎসা দাবির অর্থ ফেরত আয় থেকে বাদ দেওয়া উচিত। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ফান্ড এবং ডব্লিউপিপিএফ থেকে আয় সরকারি তহবিলের মতো অব্যাহতি দেওয়া উচিত।
২. করপোরেট কর হার:বিদ্যমান কোম্পানিগুলোর জন্য আড়াই শতাংশ হ্রাসকৃত করের হার পাওয়ার শর্ত অর্থাৎ কোম্পানির আকারের নির্বিশেষে বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদ অর্থ ব্যয় করার সীমা এবং আইটিইএস কোম্পানিগুলোর জন্য শুধু ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার অর্থনীতির নগদ নির্ভরতার পরিপ্রেক্ষিতে অবাস্তব। তাই নগদ লেনদেনের অনুমোদিত সীমা ধীরে ধীরে হ্রাস করা যেতে পারে। যেমন প্রথম বছরে ২০ শতাংশ; দ্বিতীয় বছরে ১৫ শতাংশ; তৃতীয় বছরে ১০ শতাংশ এবং চতুর্থ বছরে ৫ শতাংশ। এই নগদ লেনদেনের সীমা অতিক্রম করলে উচ্চ হারে কর ধার্য করা হবে।
৩. উৎস কর কর্তন (টিডিএস):উৎস কর (টিডিএস) টিডিএস চালু থাকলেও উপযুক্ত হার নির্ধারণের জন্য কোনো জরিপ করা হয়নি, যার ফলে প্রকৃত ব্যবসায়িক লাভের ওপর প্রদেয় করের চেয়ে বেশি হারে কাটা হচ্ছে। এটি কার্যকর করের হারের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসা করার খরচও বাড়ায়। যা শুধু বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকেই বাধাগ্রস্ত করে না, বরং স্থানীয় ভোক্তাদের জন্য খরচও বৃদ্ধি করে। তাই এই হারগুলোর জরিপ ও যথাযথভাবে সমন্বয়ের জন্য জরুরি সরকারি পদক্ষেপের প্রয়োজন।
৪. অগ্রিম আয়কর (এআইটি):শিল্পকারখানা পরিচালনার খরচ কমাতে আমদানি করা কাঁচামালের ওপর উৎপাদকদের দেওয়া অগ্রিম আয়কর ধীরে ধীরে কমানো যেতে পারে।
৫. অনাবাসী আয়ের ওপর উৎস কর:অনিবাসীদের পরিশোধিত অর্থের ওপর বর্তমান ২০ থেকে ৩০ শতাংশ উৎস করের হার খুবই অযৌক্তিক। যা কমিয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করা উচিত। কারণ, বর্তমান উচ্চ হার, আয়কর আইন, ২০২৩-এর ১১৯ ধারা অনুযায়ী, অনাবাসীরা তাদের নিজ দেশে জমা দিতে পারে না, যার ফলে দ্বৈত করের বোঝা সৃষ্টি হয়। হংকং ও নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে সাম্প্রতিক দ্বৈত কর পরিহার চুক্তিতে কারিগরি পরিষেবা ফির জন্য কম হার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা একটি নজির স্থাপন করেছে। তাই বাংলাদেশের সব দ্বৈত কর পরিহার চুক্তিতে অবিলম্বে অনুসমর্থনের মাধ্যমে কারিগরি পরিষেবা ফির জন্য এমন বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৬. প্রচারণামূলক ব্যয়:বাংলাদেশের বর্তমান কর বিধিমালা প্রকাশিত টার্নওভারের দশমিক ৫ শতাংশ বা আধা শতাংশ পর্যন্ত অনুমোদিত প্রচারণামূলক ব্যয়কে সীমাবদ্ধ করে। তবে ৫৫ (ঝ) ধারায় বিনা মূল্যে নমুনার জন্য বিভিন্ন শিল্পের (ফার্মাসিউটিক্যালস, খাদ্য ও প্রসাধনসামগ্রীসহ অন্য শিল্প) জন্য বিভিন্ন সীমা নির্ধারণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। রয়্যালটি, কারিগরি পরিষেবা ফি এবং কারিগরি সহায়তা ফির জন্য নিট ব্যবসায়িক লাভের ওপর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ অনুমোদিত সীমা ধার্য করা হয়। এটিকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) অনুমোদনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে হবে। অবশেষে প্রণোদনা বোনাসকে অতিরিক্ত সুবিধাভোগের সংজ্ঞা থেকে বাদ দেওয়া উচিত। এই পরিবর্তনগুলো কার্যকর করের হারকে সংবিধিবদ্ধ করের হারের কাছাকাছি নিয়ে আসবে।
৭. উৎস কর কর্তনে ব্যর্থতার জন্য জরিমানা:যেহেতু সরবরাহকারীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (পিএসআর) জমা না দেওয়ার জন্য ৫০ শতাংশ বেশি উৎস কর কাটার বিধান ইতিমধ্যেই রয়েছে। তাই উৎস কর কর্তনের জন্য দায়ী ব্যক্তির জন্য ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং খরচ অযোগ্য ঘোষণার বিধানটি অন্যায়। এক আইন অপরিপালনের জন্য তিনবার শাস্তি দেওয়া যায় না। অতএব এ বিধানটি বাতিল করা উচিত।
৮. ন্যূনতম বিকল্প কর (এমএটি):দীর্ঘ মেয়াদে ন্যূনতম করের বিধান বিলুপ্ত করা যেতে পারে এবং স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে একটি ন্যূনতম বিকল্প কর (এমএটি) নীতি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে উৎসে কর হার এবং টার্নওভারের ওপর কর কমাতে হবে। অনেক দেশ এমএটি নীতি ব্যবহার করে। এমএটি ব্যবস্থায় যদি কোনো কোম্পানি এক বছরে এমএটি প্রদান করে, তবে এটি ১৫ বছর পর্যন্ত পরবর্তী বছরগুলোতে প্রদেয় করের বিপরীতে সমন্বয়ের জন্য এমএটি ক্রেডিট বহন করতে পারে। এর অর্থ হলো, যদি কোম্পানি ভবিষ্যতে এমন ছাড় দাবি করতে পারে যা তার করযোগ্য আয় কমায়, তবে পূর্ববর্তী বছরগুলোতে পরিশোধিত এমএটি ভবিষ্যতের বছরগুলোতে নিয়মিত করের দায় কমানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
৯. সম্ভাব্য করব্যবস্থা:বর্তমানে আয়করের হার ও উৎসে করের হার ভবিষ্যৎসাপেক্ষ ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু আয়কর আইনের বেশির ভাগ পরিবর্তন ভূতাপেক্ষভাবে কার্যকর করা হয়। অর্থ আইনের মাধ্যমে আয়কর আইনে আনা যেকোনো পরিবর্তন পরবর্তী অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ভবিষ্যৎসাপেক্ষভাবে কার্যকর হওয়া উচিত।
স্নেহাশীষ বড়ুয়া: অংশীদার, স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানি।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আয়কর আইন উৎস কর ক কর র হ র ন র জন য ক র যকর অন ম দ র ওপর ব যবস কর কর
এছাড়াও পড়ুন:
এনবিআরের পাঁচ কর্মকর্তাকে ‘তাৎক্ষণিক’ বদলি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের-এনবিআর পাঁচ উপ-কর কমিশনারকে ‘তাৎক্ষণিক’ বদলি করা হয়েছে। এদের সবাইকে আগামীকাল মঙ্গলবারের মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে বলা হয়েছে। গতকাল রোববার এনবিআর থেকে এ সংক্রান্ত এক অফিস আদেশ জারি করা হয়।
বদলি করা পাঁচ কর্মকর্তার মধ্যে দুজন আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের, একজন এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ের এবং বাকি দুজন ঢাকা ও কুমিল্লার কর অঞ্চলের। এনবিআর সংস্কার নিয়ে চলমান আন্দোলনের মধ্যেই এসব কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে।
আদেশে বলা হয়েছে, উপ-কর কমিশনার শাহ্ মোহাম্মদ ফজলে এলাহীকে এনবিআরের আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট থেকে ময়মনসিংহ কর অঞ্চলে বদলি করা হয়েছে। একই সঙ্গে তার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলে (সিআইসি) উপপরিচালক পদের সংযুক্তি বাতিল করা হয়েছে।
উপকর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলামকে ঢাকার কর অঞ্চল-১৬ থেকে খুলনা কর অঞ্চলে এবং মো. আব্দুল্লাহ ইউসুফকে এনবিআরের প্রধান কার্যালয় থেকে বগুড়া কর অঞ্চলে বদলি করা হয়েছে।
এছাড়া আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট থেকে উপ কর কমিশনার ইমাম তৌহিদ হাসান শাকিলকে কুমিল্লা কর অঞ্চলে এবং কুমিল্লা কর অঞ্চলের উপ কর কমিশনার নুশরাত জাহান শমীকে রংপুর কর অঞ্চলে বদলি করা হয়।
আদেশে বলা হয়েছে, বদলি করা এসব কর্মকর্তাদের আজ সোমবারের মধ্যে তাদের বর্তমান কর্মস্থলের দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হবে এবং আগামীকাল মঙ্গলবারের মধ্যে বদলি করা অফিসে যোগদান করতে হবে। অন্যথায়, সোমবার অপরাহ্ন (দুপুর) থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের দায়িত্ব হস্তান্তরিত হয়েছে মর্মে গণ্য হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আন্দোলনরত এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এই বদলি স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়া নয়, এটি সুপরিকল্পিত কুটপরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ, যা চলমান রাজস্ব সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের পক্ষের শক্তি-কে দুর্বল করার কুপ্রচেষ্টা।
এদিকে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণসহ দুই দাবিতে আজ সোমবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার কলম বিরতি ও অবস্থান কর্মসূচির ডাক দিয়েছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। আজ ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে এনবিআরের সব দপ্তরে এ কর্মসূচি পালন করা হবে।
গত ১২ মে এনবিআর দুই ভাগ করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও নীতি নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর পর থেকে এই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে কলম বিরতিসহ নানা কর্মসূচিতে ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন করে আসছেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের আন্দোলনের মুখে অধ্যাদেশ বাস্তবায়নে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে আশ্বাস দেয় অর্থমন্ত্রণালয়। এরপর কাজে যোগ দিলেও আন্দোলনকারীরা এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি অব্যাহত রাখেন এবং এনবিআরে তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেন। তবে এনবিআর চেয়ারম্যান স্বাভাবিক কাজে ফিরলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে এখনও তার দূরত্ব রয়েছে।