অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ২ জুন বাজেট ঘোষণা করে অর্থবিল উপস্থাপন করবে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এর মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, স্থানীয় ও বিদেশি উভয় উৎস থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণ, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের উন্নতি, করনীতির উন্নতি ও আর্থিক এবং অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা, সুশাসন নিশ্চিত করা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এই চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে আমরা আয়কর আইনে পরিবর্তন আশা করছি।

উল্লেখযোগ্য আয়কর প্রস্তাবনা১.

ব্যক্তিগত আয়কর:

অব্যাহত মূল্যস্ফীতির চাপ এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের কম প্রকৃত আয় বিবেচনা করে ব্যক্তিগত করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা এক লাখ টাকা বাড়িয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা করা যেতে পারে। এ ছাড়া এই সীমা প্রবীণ নাগরিক ও মহিলাদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রথম স্তরে ৩ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ করারোপ করা যেতে পারে। যা বর্তমানে ১ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ। চিকিৎসা দাবির অর্থ ফেরত আয় থেকে বাদ দেওয়া উচিত। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ফান্ড এবং ডব্লিউপিপিএফ থেকে আয় সরকারি তহবিলের মতো অব্যাহতি দেওয়া উচিত।

২. করপোরেট কর হার:

বিদ্যমান কোম্পানিগুলোর জন্য আড়াই শতাংশ হ্রাসকৃত করের হার পাওয়ার শর্ত অর্থাৎ কোম্পানির আকারের নির্বিশেষে বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদ অর্থ ব্যয় করার সীমা এবং আইটিইএস কোম্পানিগুলোর জন্য শুধু ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার অর্থনীতির নগদ নির্ভরতার পরিপ্রেক্ষিতে অবাস্তব। তাই নগদ লেনদেনের অনুমোদিত সীমা ধীরে ধীরে হ্রাস করা যেতে পারে। যেমন প্রথম বছরে ২০ শতাংশ; দ্বিতীয় বছরে ১৫ শতাংশ; তৃতীয় বছরে ১০ শতাংশ এবং চতুর্থ বছরে ৫ শতাংশ। এই নগদ লেনদেনের সীমা অতিক্রম করলে উচ্চ হারে কর ধার্য করা হবে।

৩. উৎস কর কর্তন (টিডিএস):

উৎস কর (টিডিএস) টিডিএস চালু থাকলেও উপযুক্ত হার নির্ধারণের জন্য কোনো জরিপ করা হয়নি, যার ফলে প্রকৃত ব্যবসায়িক লাভের ওপর প্রদেয় করের চেয়ে বেশি হারে কাটা হচ্ছে। এটি কার্যকর করের হারের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসা করার খরচও বাড়ায়। যা শুধু বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকেই বাধাগ্রস্ত করে না, বরং স্থানীয় ভোক্তাদের জন্য খরচও বৃদ্ধি করে। তাই এই হারগুলোর জরিপ ও যথাযথভাবে সমন্বয়ের জন্য জরুরি সরকারি পদক্ষেপের প্রয়োজন।

৪. অগ্রিম আয়কর (এআইটি):

শিল্পকারখানা পরিচালনার খরচ কমাতে আমদানি করা কাঁচামালের ওপর উৎপাদকদের দেওয়া অগ্রিম আয়কর ধীরে ধীরে কমানো যেতে পারে।

৫. অনাবাসী আয়ের ওপর উৎস কর:

অনিবাসীদের পরিশোধিত অর্থের ওপর বর্তমান ২০ থেকে ৩০ শতাংশ উৎস করের হার খুবই অযৌক্তিক। যা কমিয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করা উচিত। কারণ, বর্তমান উচ্চ হার, আয়কর আইন, ২০২৩-এর ১১৯ ধারা অনুযায়ী, অনাবাসীরা তাদের নিজ দেশে জমা দিতে পারে না, যার ফলে দ্বৈত করের বোঝা সৃষ্টি হয়। হংকং ও নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে সাম্প্রতিক দ্বৈত কর পরিহার চুক্তিতে কারিগরি পরিষেবা ফির জন্য কম হার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা একটি নজির স্থাপন করেছে। তাই বাংলাদেশের সব দ্বৈত কর পরিহার চুক্তিতে অবিলম্বে অনুসমর্থনের মাধ্যমে কারিগরি পরিষেবা ফির জন্য এমন বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

৬. প্রচারণামূলক ব্যয়:

বাংলাদেশের বর্তমান কর বিধিমালা প্রকাশিত টার্নওভারের দশমিক ৫ শতাংশ বা আধা শতাংশ পর্যন্ত অনুমোদিত প্রচারণামূলক ব্যয়কে সীমাবদ্ধ করে। তবে ৫৫ (ঝ) ধারায় বিনা মূল্যে নমুনার জন্য বিভিন্ন শিল্পের (ফার্মাসিউটিক্যালস, খাদ্য ও প্রসাধনসামগ্রীসহ অন্য শিল্প) জন্য বিভিন্ন সীমা নির্ধারণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। রয়্যালটি, কারিগরি পরিষেবা ফি এবং কারিগরি সহায়তা ফির জন্য নিট ব্যবসায়িক লাভের ওপর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ অনুমোদিত সীমা ধার্য করা হয়। এটিকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) অনুমোদনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে হবে। অবশেষে প্রণোদনা বোনাসকে অতিরিক্ত সুবিধাভোগের সংজ্ঞা থেকে বাদ দেওয়া উচিত। এই পরিবর্তনগুলো কার্যকর করের হারকে সংবিধিবদ্ধ করের হারের কাছাকাছি নিয়ে আসবে।

৭. উৎস কর কর্তনে ব্যর্থতার জন্য জরিমানা:

যেহেতু সরবরাহকারীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (পিএসআর) জমা না দেওয়ার জন্য ৫০ শতাংশ বেশি উৎস কর কাটার বিধান ইতিমধ্যেই রয়েছে। তাই উৎস কর কর্তনের জন্য দায়ী ব্যক্তির জন্য ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং খরচ অযোগ্য ঘোষণার বিধানটি অন্যায়। এক আইন অপরিপালনের জন্য তিনবার শাস্তি দেওয়া যায় না। অতএব এ বিধানটি বাতিল করা উচিত।

৮. ন্যূনতম বিকল্প কর (এমএটি):

দীর্ঘ মেয়াদে ন্যূনতম করের বিধান বিলুপ্ত করা যেতে পারে এবং স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে একটি ন্যূনতম বিকল্প কর (এমএটি) নীতি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে উৎসে কর হার এবং টার্নওভারের ওপর কর কমাতে হবে। অনেক দেশ এমএটি নীতি ব্যবহার করে। এমএটি ব্যবস্থায় যদি কোনো কোম্পানি এক বছরে এমএটি প্রদান করে, তবে এটি ১৫ বছর পর্যন্ত পরবর্তী বছরগুলোতে প্রদেয় করের বিপরীতে সমন্বয়ের জন্য এমএটি ক্রেডিট বহন করতে পারে। এর অর্থ হলো, যদি কোম্পানি ভবিষ্যতে এমন ছাড় দাবি করতে পারে যা তার করযোগ্য আয় কমায়, তবে পূর্ববর্তী বছরগুলোতে পরিশোধিত এমএটি ভবিষ্যতের বছরগুলোতে নিয়মিত করের দায় কমানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

৯. সম্ভাব্য করব্যবস্থা:

বর্তমানে আয়করের হার ও উৎসে করের হার ভবিষ্যৎসাপেক্ষ ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু আয়কর আইনের বেশির ভাগ পরিবর্তন ভূতাপেক্ষভাবে কার্যকর করা হয়। অর্থ আইনের মাধ্যমে আয়কর আইনে আনা যেকোনো পরিবর্তন পরবর্তী অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ভবিষ্যৎসাপেক্ষভাবে কার্যকর হওয়া উচিত।

স্নেহাশীষ বড়ুয়া: অংশীদার, স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানি।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আয়কর আইন উৎস কর ক কর র হ র ন র জন য ক র যকর অন ম দ র ওপর ব যবস কর কর

এছাড়াও পড়ুন:

সঞ্চয়পত্র কেনায় রিটার্ন জমার প্রমাণ দেখানোর বাধ্যবাধকতা থাকছে না

সঞ্চয়পত্র কেনায় আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। বর্তমানে পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে আগের বছরের আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র (পিএসআর) জমা দিতে হতো। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সীমিত ও মধ্যম আয়ের মানুষ।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র কেনায় পিএসআর দেখানোর বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হতে পারে কিংবা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সঞ্চয়পত্র কেনার সীমা পর্যন্ত এই সুবিধা দেওয়া হতে পারে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট বক্তৃতায় এই ঘোষণা দিতে পারেন। ফলে আগের মতোই শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) সনদ দেখালেই হবে।

আগামী ২ জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা দেওয়া হবে। এবার জাতীয় সংসদ না থাকায় জাতির উদ্দেশ্যে টেলিভিশন বক্তৃতার মাধ্যমে বাজেট দেওয়া হবে।
বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে থাকে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর। এগুলো হলো পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র; তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্র। তবে পরিবার সঞ্চয়পত্রের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। শুধু নারীরা এই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। দেশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের করযোগ্য আয় নেই, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে মুনাফার টাকায় উপার্জন করেন—এমন করদাতাদের বাধ্য হয়ে রিটার্ন জমা দিতে হয়।

জানা যায়, বর্তমানে দেশে ৪৫টি সরকারি-বেসরকারি সেবা পেতে গেলে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র বা পিএসআর দেখাতে হয়। রিটার্ন দাখিলকারীর সংখ্যা বাড়াতে এই উদ্যোগ নেয় এনবিআর। অনেক করদাতা শুধু পিএসআর দেখানোর বাধ্যবাধকতার কারণে শূন্য রিটার্ন জমা দেন।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ১৬ লাখ করদাতা অনলাইনের রিটার্ন জমা দেন। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ শূন্য রিটার্ন দিয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • খালেদা জিয়ার ভাগনে শাহরিনের জামিন মঞ্জুর, মুক্তিতে বাধা নেই
  • সঞ্চয়পত্র কেনায় রিটার্ন জমার প্রমাণ দেখানোর বাধ্যবাধকতা থাকছে না
  • অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা ১৬ লাখ ছাড়াল