শিক্ষাঙ্গনের নিয়ন্ত্রণ অংশীজনের হাতে নেই বলে এত অস্থিরতা
Published: 12th, May 2025 GMT
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) প্রাক্তন অধ্যাপক মুহাম্মদ নাজমুল হক টিচার ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের (টিডিআই) পরিচালক। তিনি মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা ও গবেষণা পদ্ধতির ওপর যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যের এক্সেটার ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন। ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন; ২০০৪ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান এবং ২০১৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক।
সমকাল: কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা অচলাবস্থা দেখছি। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদত্যাগের আন্দোলন চলছে। কুয়েটে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত উপাচার্যকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পদত্যাগের দাবি পর্যন্ত গড়ায় কেন?
নাজমুল হক: আমার কাছে মনে হয়, সাধারণ শিক্ষার্থীরা এসব আন্দোলনের সঙ্গে খুব একটা জড়িত না। এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। হঠাৎ আন্দোলন এমন পর্যায়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। উপাচার্যের পদত্যাগ আন্দোলন, তাঁর বাসভবনে তালা দেওয়া ইত্যাদি সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। এর পেছনে রাজনৈতিক মোটিভ থাকে বলেই এমনটা সম্ভব হয়। মানুষ মনে করে, আমাদের দেশে শিক্ষাকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাজনৈতিক নেতারাও যদি সত্যিকার অর্থে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতেন; তারা যদি সত্যিই মনে করতেন– শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড; দেশের সত্যিকার উন্নয়ন শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব, তাহলে শিক্ষার হাল এমন হতো না। তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজেদের মতো চলতে দিতেন। একই সঙ্গে শিক্ষা আমলাতান্ত্রিক জটিলতারও শিকার।
সমকাল: আপনি বলতে চাইছেন, রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংকটে পড়েছে শিক্ষা?
নাজমুল হক: শিক্ষাটা প্রধানত এ দুই শ্রেণির হাতে। রাজনীতিবিদ ও আমলাদের পাশাপাশি আরেকটি শ্রেণি আছে, তারা হলেন ব্যবসায়ী। রাজনীতিকদের প্রাধান্য বিস্তারের বিষয় আছে। ব্যবসায়ীরা শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করেন, আর আমলারা নিজেদের ছকে শিক্ষাকে দেখছেন অথবা তারা বিষয়টিকে আদৌ গুরুত্ব দেন না। এসব কারণে শিক্ষা ব্যবস্থায় ধস নামছে। উন্নত বিশ্বে কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় কেউ হাত দেয় না। শিক্ষার অংশীজনই এটি নিয়ন্ত্রণ করেন। অর্থাৎ এ জগৎ হলো শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত ও শিক্ষার্থীদের। বাংলাদেশে শিক্ষা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই বলেই এ সংকট।
সমকাল: অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন, সেখানে একটা ব্যাকআপ বা পৃষ্ঠপোষকতা পায় বলেই এমন পদত্যাগ পর্যন্ত তারা অনড় থাকে?
নাজমুল হক: বাস্তবতা আসলে এমনই। তাদের সেভাবে উস্কানি দেওয়া হয়। খেয়াল করে দেখবেন, এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
সমকাল: চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বন্ধের আলোচনা হচ্ছিল। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
নাজমুল হক: শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি থাকতে হবে। ছাত্র সংসদ, ছাত্র রাজনীতি না থাকলে এরা শিখবে কোত্থেকে? কারণ এরাই তো এক সময় দেশের নেতা-নেত্রী হবে। দেশের দায়িত্বভার তারাই গ্রহণ করবে। সুতরাং ছাত্র সংসদের মাধ্যমে তাদের শেখার দরকার আছে। কিন্তু লেজড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি ক্ষতিকর। কোনো দল যখন ছাত্রদের ব্যবহার করে; তাদের অর্থ ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা দেয় তখন সেটা সমর্থনযোগ্য নয়। এর ফলে কোনো কোনো ছাত্রনেতা, যারা পড়াশোনা করে না, এটাই তাদের এক ধরনের পেশা হয়ে যায়। অথচ তাদের একেবারে একাডেমিক বিষয় নিয়ে রাজনীতি করা দরকার; শিক্ষাঙ্গনে পড়াশোনার পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের পক্ষ হয়ে দেনদরবার করা। বাস্তবে যখন ছাত্র রাজনীতি লেজুড়বৃত্তির হয়ে গেছে, তখন রাজনীতিবিদরাও বেশি করে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে চান। ফলে দেখা যায়, শিক্ষাঙ্গনে যে দলের প্রভাব বেশি, তারা নির্বাচনেও সেই প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করে।
সমকাল: কুয়েটের ঘটনা আপনি কীভাবে দেখছেন? সেখানে উপাচার্যকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে–
নাজমুল হক: এটা ভালো নজির নয়। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলে শিক্ষকদের চলে যেতে হবে কেন? শিক্ষকদের জন্য এমন বিদায় সম্মানজনক নয়। শিক্ষকদের সম্ভবত এ ব্যাপারে একমত হওয়া দরকার– আমরা শিক্ষার্থীদের অন্যায় অবদারের কাছে মাথা নত করব না। শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া থাকলে সে ব্যাপারে কথা থাকতে পারে। কিন্তু পদত্যাগের আন্দোলন এবং সে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পদত্যাগ করানো যথাযথ মনে করি না।
সমকাল: কুয়েটে শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করা হয়েছে কিংবা তাদের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। তার ব্যাখ্যা কী?
নাজমুল হক: এটিও এক ধরনের বাড়াবাড়ি। এখানে শিক্ষকদেরও রাজনীতি আছে। প্রশ্ন হলো– কেন বহিষ্কার কিংবা মামলা পর্যন্ত যেতে হবে। শিক্ষার্থীরা যে দাবিতে আন্দোলন করছিল, তার সুরাহা দ্রুত করলেই হয়তো সংকট এতদূর গড়াত না।
সমকাল: ঢাকা পলিটেকনিকসহ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন চলছে ছয় দফা ঘিরে। তাদের যৌক্তিক দাবির জন্যও দেখা গেল ঢাকা শহরের সড়ক ব্লক করে মানুষকে জিম্মি করা হয়েছে। যৌক্তিক দাবিতেও কেন এমনটা করা লাগে?
নাজমুল হক: আমরা ছাত্রজীবন থেকেই দেখেছি, রাস্তায় নেমে গাড়ি না ভাঙা পর্যন্ত দাবি আদায় হয় না। সরকারও যখন দেখে, আর উপায় নেই তখন দাবি মানতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। শিক্ষার্থীরাও বিষয়টি জেনে গেছে। সে জন্য তারা দাবি আদায়ে রাস্তা ব্লক ও মানুষকে জিম্মি করে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের এসব দাবি তো এ-ই প্রথম নয়। তারা অনেক দিন ধরেই বলে আসছে। পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে। আগেই এর সমাধান হওয়া উচিত ছিল। কেবল এই ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য বিষয়েও যখন শিক্ষার্থীরা দাবির জন্য আন্দোলনে নামে, প্রথম দিনেই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এর সমাধান খোঁজা দরকার। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসে বলা উচিত– এই দাবিটা মানা সম্ভব, আর এটা এ কারণে এখন সম্ভব নয়। এভাবে করলে আর আন্দোলন বাড়ার কথা না। অর্থাৎ মানুষকে জিম্মি করা কিংবা মানুষ মারা যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে না।
সমকাল: কলেজ পর্যায়ে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এসব আন্দোলনে একাডেমিক কিংবা রাজনৈতিক উপাদানের বাইরেও বয়সোচিত কিছু বিষয় কি আছে? যেমন ঢাকা কলেজ কিংবা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার আন্দোলন…।
নাজমুল হক: প্রতিবেশী দুটি প্রতিষ্ঠান থাকলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব হয়। এটা সিরিয়াস বিষয় নয়। তবে একে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া ভালো বিষয় নয়। এসব দ্বন্দ্বের নানা কারণ থাকে। একটি হলো অস্থিরতা। তাদের অস্থিরতা দেশ নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে। তারা কোথায় যাচ্ছে– জানে না। বয়সেরও ব্যাপার আছে নিঃসন্দেহে। একেবারে স্কুলে এমনটা হবে না। নবম শ্রেণিতে উঠলে হতে পারে। তবে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা দ্রুত সংগঠিত হয়। তাদের মধ্যে তারুণ্যের কারণে হয়। অবশ্য কেউ তাদেরকে নেতৃত্ব দিতে হয়। তবে চব্বিশের যে গণঅভ্যুত্থান, সেটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। সারাদেশেই শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এই স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা গেছে।
সমকাল: চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের কথা বলছেন। শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলনের কোনো প্রভাব কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিস্থিতির মধ্যে দেখেছেন?
নাজমুল হক: চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে যেভাবে একটি সরকারের পতন হলো, তা অবিশ্বাস্য ছিল। এতে শিক্ষার্থীদের নিশ্চয়ই এ বোধ জাগ্রত হয়েছে– আমরা একত্র হলে অনেক কিছু করতে পারব। এর ইতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি কেউ কেউ এর নেতিবাচক ব্যবহারও করেছে। যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এমনটা দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তো দেখা গেছে, উপাচার্য অনেকেই নিজ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
সমকাল: তার মানে, শুরুতে যে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির কথা বলেছেন, সেখানে শিক্ষকরাও যুক্ত ছিলেন। শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ কারও কারও ক্ষেত্রে কি যথার্থ ছিল না?
নাজমুল হক: আমরা দেখেছি, অনেক শিক্ষকের ওপর বাস্তব কারণেই শিক্ষার্থীরা সংক্ষুব্ধ ছিল। অনেক শিক্ষক দুর্নীতিসহ অনৈতিকতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এগুলোর বিচার হওয়া দরকার। সরকার যদি এমন কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পায়, আমি বলব, সঙ্গে সঙ্গে তার তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখনই উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে; শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করবে, তখনই প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। একে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে দেওয়া অনুচিত, যেখানে শিক্ষার্থীদের কাছে উপাচার্যের পদত্যাগ চাওয়া ব্যতীত আর পথ থাকে না।
সমকাল: শিক্ষার্থীদেরও তো বোঝানো দরকার– পড়াশোনাই মূল দায়িত্ব।
নাজমুল হক: শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা যেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধানের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় তাদের বোঝাতে হবে– শিক্ষার্থীদের প্রধান কাজ পড়াশোনা; সেখানেই তাদের মনোযোগ দিতে হবে। তাদের দাবিদাওয়া থাকলে সেগুলো নিশ্চয় তুলবে। কিন্তু দিন শেষে পড়াশোনাই যেন মূল কাজ হয়। তাদের বোঝাতে হবে, যখনই শিক্ষাঙ্গনে সমস্যা সৃষ্টি হয়, তাতে শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে তারাই সেশনজটে পড়বে।
সমকাল: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমস্যা হলে স্থানীয় কমিউনিটি তাতে কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে?
নাজমুল হক: বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন একটি সংকট হয়, তা দেখা যায় সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ পর্যন্ত চলে যায়। এখানে সমাজের ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়ে। প্রারম্ভিক ও স্বল্পমাত্রায় সমস্যায় হয়তো সমাজের গণ্যমান্য লোকজন ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু তাদের হাতে সব ক্ষমতা নেই। অনেক জায়গায় সমাজই দুর্নীতিগ্রস্ত। সেখানে শিক্ষা প্রশাসনই ভরসা। পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসনেও সংকট আছে।
সমকাল: যেমন–
নাজমুল হক: যেমন কোনো প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিয়ে অভিযোগ বা কোনো শিক্ষককে কেন্দ্র করে আন্দোলন হলে সরকার যদি তাঁকে রক্ষা করতে চায়, লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করে তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে। এভাবে তাদের সুরক্ষাও দেয়। আগে যেমন দেখতাম, উপাচার্যরা আক্রান্ত হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এই প্রটেকশনটা নিশ্চয়ই তাঁর জীবনের জন্য দরকার। কিন্তু উপাচার্য সেই পর্যায়ে কেন পৌঁছবেন? সেই ধারা যদি এখনও চলতে থাকে, তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।
সমকাল: আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের রাজত্ব ছিল; হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর আমরা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোতে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ এসেছে। তারপরও শিক্ষাঙ্গনে শান্তি সেভাবে আসছে না কেন?
নাজমুল হক: শিক্ষাঙ্গন শান্ত থাকুক– এটি সবাইকে চাইতে হবে। লেজুড়বৃত্তি সেখানে বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এটা সবাই কি আন্তরিকতার সঙ্গে চাইছে? আমার মনে হয় না। রাজনীতিবিদদের যেমন চাইতে হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদেরও চাইতে হবে। শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমে মনোযোগ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খেলাধুলা, বিতর্কসহ অনেক সহশিক্ষামূলক কাজ আছে। যারা সেগুলোতে সময় দেয়, তারা পড়াশোনার মধ্যেই থাকে। এ নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। সংবাদমাধ্যমকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকেও চাইতে হবে– শিক্ষাঙ্গন শান্ত থাকুক। অর্থাৎ তারা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করবে না। বর্তমান সরকারের সেই রাজনৈতিক ইচ্ছা নেই বলেই মনে হয়। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার এলে সংকট আরও বাড়বে বলে মনে হয়।
সমকাল: সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে যদি আরেকটু বলেন–
নাজমুল হক: যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ বজায় রাখতে হলে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যিনি একাডেমিক ও গবেষণায় মনোযোগ দেবেন, তাঁকে নিয়োগ দিতে হবে। সাধারণত যেটা দেখা যায়, এমন লোকদের সরকার নিয়োগ দিতে চায়, যারা তাদের কথা শুনবেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা যায়, যিনি মালিকের কথা শুনবেন, তাঁকেই নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ধরনের প্রবণতা শিক্ষার জন্য ভালো লক্ষণ নয়।
সমকাল: শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতে সামগ্রিকভাবে আপনার পরামর্শ কী?
নাজমুল হক: শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ আনতে হলে পরিকল্পিতভাবে কাজ করা দরকার। এ জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করতে হবে। এখানে রাজনীতিবিদদের অঙ্গীকার জরুরি। সরকারি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও এর সহায়ক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাকে অগ্রাধিকার বাস্তব অর্থেই রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকার অর্থে জ্ঞানচর্চার জায়গা করে তুলতে হবে। যোগ্য ব্যক্তিদের উপাচার্য ও অন্যান্য পদে নিয়োগ দেওয়ার কথাও বলেছি। শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করতে হবে। এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল পরিবেশ ফিরে আসতে পারে।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
নাজমুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ছ ত র র জন ত র জন ত ব দ শ ক ষকদ র উপ চ র য র জন ত ক ব যবস থ পদত য গ র জন য ন র পর পর ব শ পর য য় অর থ ৎ দরক র ধরন র সমক ল সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে দূরদর্শী সিদ্ধান্তে
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংবিধান সংস্কার। নির্বাহী বিভাগের এককেন্দ্রিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেশে কার্যত একনায়কতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তি তৈরি করেছে। গত রোববার নাগরিক কোয়ালিশন নামে একটি নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবিধান সংস্কারের জন্য যে সাতটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, তা সময়োপযোগী ও বিবেচনার দাবি রাখে।
নাগরিক কোয়ালিশনের প্রস্তাবগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিতকরণ ও ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন।
এই দাবি বেশ জনপ্রিয় হলেও বক্তাদের কেউ কেউ যুক্তি তুলে ধরেছেন যে শুধু মেয়াদ নির্ধারণ করলেই একনায়কতান্ত্রিক শাসন ঠেকানো যাবে না। তাঁরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত না করলে মেয়াদসীমা নির্ধারণ কোনো বাস্তব পরিবর্তন আনবে না। কারণ, পরিবারভিত্তিক ক্ষমতা হস্তান্তর এই বিধানকে অকার্যকর করে তুলতে পারে। একই পরিবারের সদস্যরা যদি পালাক্রমে ক্ষমতায় বসেন, তাহলে মেয়াদ নির্ধারণের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে এবং পুনরায় স্বৈরাচার বা একনায়কতান্ত্রিক শাসনের উত্থান হতে পারে।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করেন। এ ধরনের কেন্দ্রীকরণ রাজনৈতিক জবাবদিহি হ্রাস করে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিগুলোকে দুর্বল করে তোলে। এই বাস্তবতায় সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা হ্রাস করে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। ভারত বা যুক্তরাজ্যের মতো সংসদীয় গণতন্ত্রে যেভাবে রাষ্ট্রপতির ভূমিকায় ন্যূনতম স্বশাসন ও প্রতীকী ভারসাম্য রাখা হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও একটি গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন।
আলোচনায় অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ হাসিনার ‘স্বৈরতান্ত্রিক রূপান্তর’ কোনো সামরিক অভ্যুত্থান বা সংবিধানবহির্ভূত প্রক্রিয়ায় ঘটেনি; বরং বর্তমান সংবিধানই এমন এক কাঠামো তৈরি করেছে, যেখানে নির্বাহী প্রধানের ওপর অন্য কোনো বিভাগের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই কাঠামোই তাকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করেছে। সেই কাঠামো ভেঙে ফেলাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।
প্রস্তাবিত সাত দফায় আরও বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, উচ্চকক্ষসহ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, নারী প্রতিনিধিত্বে সরাসরি ভোট, তত্ত্বাবধায়কধর্মী সর্বদলীয় কমিটি এবং সংবিধানের প্রস্তাবে ‘জুলাই সনদ’-এর অন্তর্ভুক্তি।
নাগরিক কোয়ালিশনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো সাংবিধানিক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার বিষয়টি। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মতো তাদের পক্ষ থেকেও জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হবে। এসব পদক্ষেপ যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোয় জবাবদিহি ফিরে আসবে এবং জনগণের আস্থা পুনর্গঠিত হবে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল শর্ত হচ্ছে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা। বাংলাদেশের সংবিধান বর্তমানে একজন প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে অগাধ ক্ষমতা তুলে দিয়েছে, তা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখনই সময় সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে প্রকৃত অর্থে জনগণের মালিকানাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।
আমরা মনে করি, নাগরিক কোয়ালিশনের এই প্রস্তাবগুলো শুধু রাজনৈতিক বিতর্কের খোরাক হবে না, বরং একটি ভবিষ্যৎমুখী, গ্রহণযোগ্য এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের বাস্তব রূপরেখা তৈরি করতে সহায়ক হবে। এটি কেবল সংবিধান সংস্কারের প্রশ্ন নয়, এটি জনগণের মালিকানায় রাষ্ট্র পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আলোকপাত করেছে। প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও অঙ্গীকার অপরিহার্য। ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের পরও রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছিল। এবার যেন ইতিহাসের সেই পুনরাবৃত্তি আর না হয়।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই সময়ের সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ওপর। সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ একটি গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সেতুবন্ধ হবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।